তামাশার শহরে দুইদিন (প্রথম পর্ব)

0

 

দাপ্তরিক কাজে ব্যাংকক প্রথমবারের মতো আগমন। মাত্র তিনদিনের সভায় অংশগ্রহণ। অবস্থান হোটেল আমারি (Amaree)। অভিজাত পাঁচ তারকাবিশিষ্ট  হোটেল। আমারির বেশ কটি শাখা রয়েছে ব্যাংককে। তবে পর্যটকদের প্রিয় এলাকা সই-৫ (Soi5) এর হোটেলটি সদাই জমজমাট।

সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি সভা। এর পরে ক্লান্ত শরীরে কোথায়ই-বা যাব। তবে বলে রাখা ভাল ব্যাংকক নগরী ইয়াঙ্গুন, কাটমান্ডু বা থিম্পুর মতো নয়। ব্যাংকক নগরীর দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয় বিকেল থেকে। রাত বারটা পর্যন্ত জমজমাট। মধ্যরাতের পরে মানবস্রোতে ভাটা পড়ে। যখন পুব আকাশে ক্ষীণ আলো পৃথিবীর সকল আঁধারকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিজ উপস্থিতি জানান দেয় তখন পর্যটক এলাকাগুলোতে এ নগরীর দ্বিতীয় যাত্রা শেষ হয়।

সভা শেষে ফ্রেশ হয়ে হোটেলের লবিতে এসে বসি। সভায় অশংগ্রহণকারীবৃন্দ এসেছেন এশিয়া, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে। সভা চলাকালে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির মানুষগুলো এক উদ্দেশ্যে, এক সুরে কথা বলেন। মধ্যাহ্নভোজের  সময় হোটেলের রেস্টুরেন্টে কতই না সখ্যতা! কিন্তু সভা শেষ হলে কেউ যেন কাউকে চেনে না। যে যার উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়ে যায়।

জগতে আলো-আঁধারের কত-না রূপ-রস-গন্ধ। নিকষ আঁধারও এই জগতে আলোর ঝলকানির সাথে মিলেমিশে একাকার। কখনো-বা আঁধার আবির্ভূত হয় আলোর ঝলকানিতে। এ যেন নাটকের রঙ্গমঞ্চ। পাত্র-পাত্রী সকলেই অভিনয় করছে মাত্র। এই রঙ্গমঞ্চে নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষও রাজপোশাক পরিধান করে যা বলছে, করছে, তার বেশিরভাগই হয়ত মেকি। সাজঘর থেকে বেরিয়েই আলংকারিক পোশাক থেকে নিজেকে মুক্ত করে হয়ে যাবেন আবারও একজন সাধারণ মানুষ। রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে যা কিছু উপার্জন তা নিজের পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। যা কিছু অবশিষ্ট তা দিয়ে সাজ-সজ্জা মাত্র।

একে তো মুসলিম, তার উপরে রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ আমি। যে কারণে অন্যান্যেরা সভা শেষ হওয়ার পরে আমাকে এড়িয়েই চলে। সভায় আগত আর একজনকে পেয়ে গেলাম আমারই মতো- সালাহউদ্দিন। মনমানসিকতায় আমারই মতো।

প্রথমদিন হোটেলের চারপাশে ঘণ্টা দুয়েক হাঁটলাম আমি আর সালাহউদ্দিন। এলাকার একটা মানচিত্র মানসপটে এঁকে নিলাম। একটি সাইনবোর্ডে ইংরেজির নিচে বাংলা বর্ণ দেখে চোখ আটকে গেল। রাত তখন আটটা। খাবার সময় হয়েছে। রেস্তরাঁয় ঢুকে পড়লাম, খিদমতগারদের চেহারা দেখে মনে হলো, এরা সব বাংলাদেশি। ওরাও আমাদের স্বাস্থ্য চেহারা দেখে যা বোঝার বুঝে গেছে। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানলাম মালিক বাংলাদেশি। বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায়। হায় হায়, কুষ্টিয়া! আমার জেলার মানুষ সুদূর ব্যাংককে রেস্তরাঁর ব্যবসায় করছেন? সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই রাতের খাবার-পর্ব সারতে হবে। কিন্তু চমকিত হলাম এটি জেনে যে, ম্যানেজারসহ সকল খিদমতগারই পশ্চিমবাংলা থেকে আগত। যেহেতু মালিককে পেলাম না সেহেতু এ রহস্যের উন্মোচন হলো না। তবে পরবর্তীতে বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল-সংলগ্ন বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্তরাঁয়ও দেশি খিদমতগারের দেখা পাইনি। ঐ রেস্তরাঁর খিদমতগারেরা বিভিন্ন দেশের। সেখানে মূলত হাসপাতালে রোগীদের সাথে ভাষাগত যোগাযোগ, ইংরেজিতে যেটাকে বলে কম্যুনিকেশনের জন্য বর্মী, থাই, আরব খিদমতগার কাজ করছেন। বাংলাদেশিদের সাথে কম্যুনিকেশনের জন্য মালিক নিজেই আছেন। পরে অন্য একদিন তিনি অবশ্য অন্য কাহিনি বলেছেন। কতটুকু সত্য জানি না। তিনি বলেছেন, শুরুর দিকে দেশ থেকে লোক এনেছিলেন। তারা গোপনে আইনবহির্ভূতভাবে থাই মুসলিম রমণীকে বিয়ে করায় তাদেরকে জেলখানায় যেতে হয়েছে। এর পরে তাঁকে অনেক তখলিফ পোহাতে হয়েছে। এজন্য গোস্বা করে তিনি স্বদেশীকে নিজ রেস্তরাঁয় চাকরি দেন না।

দুপুরে আমারিতে খেয়েছি থাই ও সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের মিশেল। রাতে পাবদা মাছ, সবজি আর ঘন ডাল দিয়ে মসৃণ চালের ভাত খেলাম। হোটেলের সামনে আসতেই ভারতীয় বসের পাল্লায় পড়লাম। তার সাথে ব্রিটিশ সহকর্মীও রয়েছেন। তিনি আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দুজনই ম্যাসাজ পার্লারে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করল।

 

সান্ধ্যকালীন ভ্রমণের শুরুতেই দেখেছিলাম হোটেল আমারির চারপাশে ম্যাসাজ পার্লার। পার্লারগুলোর সামনে ষোড়শী কিংবা অষ্টদশী চঞ্চল বালিকারা কালো রঙের খাটো স্কার্ট ও গোলাপি রঙের পোলো শার্ট পরে ‘ম্যাসাজ’ লেখা ছোটো একটি বোর্ড বুকের কাছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই প্রাণচঞ্চল প্রাণোচ্ছ্বল হাসিতে মাঝে মাঝেই মিষ্টি স্বরে বলছে ম্যাসাজ, ম্যাসাজ।

সারাদিনের সভাশেষে দু’ঘণ্টা হেঁটে ক্লান্ত বটে। রাজ্যের ক্লান্তি যেন গোটা শরীরকে আবৃত করেছে চরম নিষ্ঠুরতায়। বালিকাদের ম্যাসাজে নিশ্চয়ই সে ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। হোটেলে ফিরে উষ্ণ জলে গোসল সেরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নরম-পেলব বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই দু’চোখে ভর করবে নিদ্রাদেবী।

হা-হা- কল্পনা বটে। বসকে আমার অসম্মতির কথা জানালাম। বস বলল মাত্র দশ ডলার (আট শ চল্লিশ টাকা)। ‘রেজা ভাই, আই উইল পে দিস। হোয়াই ডু ইউ ফিল শাই? অল দিজ আর ‘নো সেক্স’ ম্যাসাজ পার্লার, হারি প্লিজ। আই উইল নট শেয়ার ইট উইথ ভাবী। লেটস গো।’

আবারও আমার অস্বীকৃতি। সত্যি এ লজ্জাকর বিষয়। যদিও এগুলো সত্যিই ‘নো সেক্স’ ম্যাসাজ পার্লার, কিন্তু মনের গহনে সযতনে সুরক্ষিত মূল্যবোধ আর লজ্জা দুয়ের মিশেলে পুনঃঅস্বীকৃতি। পশ্চিমা সংস্কৃতির মানুষ ডেভিড হয়ত বুঝেই উঠতে পারছে না কেন এই অস্বীকৃতি। ও শুধু একবারই ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল ‘ইটস ড্যাম চিপ। ইন লন্ডন ম্যাসাজ ফি উল বি অ্যাট লিস্ট ফিফটি ডলার (সাড়ে চার হাজার টাকা)।’ বস আমার হাল ছেড়ে দিয়ে বিরক্তিভরা মুখাবয়বে ডেভিডকে নিয়ে চলে গেল।

পরদিন আমি আর সালাহউদ্দিন বিকেলে ট্যাক্সিতে চেপে গেলাম এমবিকে শপিং মলে। সালাহউদ্দিন ব্যাংককে এবারই প্রথম। ব্যাংকক শহরের প্রধান সকল সড়কেই রাস্তার ওপরে ফ্লাইওভার। কোনো কোনো সড়কে তারও ওপরে মেট্রোরেল নামধারী ‘আকাশ রেল’। প্রতি দু-তিন মিনিট পর-পর আসছে। মানুষ মেশিনে কয়েন ফেলে টিকেট নিচ্ছে। কয়েন না থাকলে আর এক মেশিন রয়েছে। সেখানে কাগজের নোট ফেলে দিলে কয়েন বেরিয়ে আসছে। বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ি বোধ হয় এক স্টেশনে আধা মিনিট কী তার চেয়েও কম সময় দাঁড়াচ্ছে। প্রশস্ত দরজা দিয়ে দুই সারিতে ওঠা-নামা। ওঠার সময় খেয়াল রাখতে হবে প্লাটফর্মে হলুদ দাগের এপারে আছি কিনা! অনেক বেশি প্রয়োজন? দু’মিনিট এর জন্য তর সইছে না? পা হলুদ দাগের ওপারে? ঢাকায় যা করেন এখানেও তাই করতে চান? লম্ফ দিয়ে উঠে পড়বেন? না মশাই- জীবনটাই হারাতে হবে। ও কর্ম্ম কস্মিনকালে করতে যাবেন না। সমস্যা হচ্ছে স্টেশনে ও রেলগাড়ির ভেতরে সকল ঘোষণাই থাই ভাষায়। এক ধরনের ভয়মিশ্রিত অ্যাডভেঞ্চারিজম নিয়ে আকাশ রেলে চড়ে বসলাম। থাইদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই ইংরেজি জানে। আমরা তিন স্টেশন যাওয়ার টিকেট কিনেছি। গুনেগুনে তৃতীয় স্টেশনেই নেমে পড়লাম। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে করে সই-৫ এ ফিরে এলাম। বাসে আসলে বেশ কিছু পয়সা বেঁচে যেত। কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে সে সিদ্ধান্ত প্রথমেই বাদ।

সই-৫ এলাকাতে এসে হেঁটেই হোটেলে ফিরলাম। প্রশস্ত ফুটপাত ধরে দুজনে চললাম হোটেল অভিমুখে। সই-৫ পর্যটকদের এলাকা। যে কারণে ওখানকার ফুটপাতের বেশিরভাগ অংশই ঢাকা শহরের ফুটপাতের মতো হকারদের দখলে। কিন্তু ব্যাংকক নগরীর অবশিষ্ট অংশের ফুটপাত পথচারী-বান্ধব। ভাঙাচোরা, ধুলো-ময়লাও নেই। গোটা শহরেই ওরা মাটিকে ঢেকে ফেলেছে। সড়কের দু’পাশের মৃত্তিকা স্তর সড়ক কিংবা ফুটপাত দিয়ে আবৃত। তাই বলে শহর যে সবুজহীন তা নয়। ফ্লাইওভারের স্তম্ভগুলো কার্পেট-লতায় আবৃত। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলোর সামনে সবুজ লন। আবাসিক এলাকাতে ভবনগুলোর চারপাশেও বৃক্ষের সমারোহ দেখা যায়।

পথ চলতে চলতে আমি ও সালাউদ্দিন দুজনই একে অপরের মনের সুপ্ত বাসনা আবিষ্কার করে ফেললাম। এবারে আমি যেমন ভ্রমণের জন্য দু’দিন ছুটি নিয়ে এসেছি, সালাহউদ্দিনও তেমনি। তবে সালাহউদ্দিন এককাঠি সরেস। তার ইচ্ছে পর্যটন নগরী পাতাইয়া ভ্রমণ। আমিও চিন্তা করে দেখলাম, ভবিষ্যতে আবারও হয়ত ব্যাংকক আসা হবে। কিন্তু পাতাইয়া যাওয়ার সুযোগ নাও মিলতে পারে। আঁইগুই না করে সাথে-সাথেই মত দিয়ে দিলাম- আমিও যাব।

ব্যাংকক নয় বরং পর্যটন নগরী হিসেবে গোটা বিশ্বে খুবই পরিচিত থাইল্যান্ডের পাতাইয়া ও ফুকেট। পাতাইয়া সাগরতটে পর্যটন নগরী। মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা। ফুকেট দ্বীপ। আকাশপথেই সাধারণত পর্যটকেরা সেখানে যায়। তবে পাতাইয়া থেকে সাগরপথেও যাওয়া যায়।

বলতে দ্বিধা নেই বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে পাতাইয়া ‘সেক্স সিটি’ হিসেবেই পরিচিত। তার অর্থ এই নয় যে, সেখানে পর্যটনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ও উপকরণ নেই। প্রচুর পর্যটক আসেন পাতাইয়া সাগরসৈকতের সৌন্দর্য দেখতে। অনেক নবদম্পতিকেও দেখেছি পাতাইয়া সাগরসৈকতে, ওদের দু-একজনের সাথে কথাও হয়েছে। তবে ল্যাটিন আমেরিকান, এমনকি আমেরিকান নাগরিকরাও বাংলাদেশকে চিনতে পারেনি। আমেরিকানদের ভৌগোলিক জ্ঞান আমার কাছে কম বলেই মনে হয়েছে।

সই-৫ এলাকাতে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। একটা লেনে বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে। এর মধ্যে ‘আল-সালাম’ নামে একটা রেস্টুরেন্টও দেখলাম। সম্ভবত ভারতীয় বা পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট। না, আল-সালামে নয় এক লেবাননি রেস্টুরেন্টে বসলাম, উদ্দেশ্য ভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ গ্রহণ। লেবাননি নান। সবজি ও চিকেন কাবাবের মেন্যুতে টিক দিলাম। মনে বেশ উত্তেজনা। হোটেলে গিয়েই পাতাইয়াতে হোটেল বুকিং দিতে হবে।

লেবাননি রেস্টুরেন্টে ঢুকে যে খুব ভিন্ন কোনো খাবারের স্বাদ পেলাম, তা নয়। নান একটু মিষ্টি মিষ্টি। সবজি খুবই উপাদেয়। বলাবাহুল্য খিদমতগারের পরামর্শেই সবজির এই পদ নির্বাচন করা হয়েছিল। মুরগির কাবাবও সুস্বাদু- অনেকটা সাসলিকের মতো।

 

সালাহউদ্দিনের ল্যাপটপে দুজনে মিলে পাতাইয়ার সুবিধাজনক হোটেল খুঁজতে গিয়ে যা বুঝলাম তা হচ্ছে, সেখানকার সাধারণ হোটেলের ভাড়া বেশ চড়া, ব্যাংককের তুলনায়ও বেশি। হোটেলগুলোতে দু’ধরনের কক্ষের সমাহার বেশি। টুইন বেড অথবা মাস্টার বেড। টুইন বেডের কক্ষে একজন অথবা দুজনের থাকা বাবদ ভাড়া একই। তবে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে, টুইন বেড বা মাস্টার বেডের কক্ষ একজন ভাড়া নিয়ে ভাড়া করা সঙ্গিনীকে কক্ষে কিছুক্ষণের জন্য আনলেও দুজনের ভাড়াই দিতে হবে।

সাগরসৈকতের কাছে ছোটো একটি হোটেল পছন্দ হলো তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যের জন্য। ইন্টারনেটে পাসপোর্টের স্ক্যান কপি জমা দিয়ে বুকিং দেয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় একটি টুইন বেডের কক্ষ পাওয়া গেল। আগামীকালসহ দু’রাত থাকব। প্রতিদিনের ভাড়া চার হাজার টাকা। অগ্রিম চাইল। জানালাম আমাদের ক্রেডিট কার্ড নেই। সাথে সাথেই জানানো হলো, সেক্ষেত্রে বুকিং নেয়া হলো কিন্তু নিশ্চিত না। উপরন্তু আমরা পৌঁছাব সন্ধ্যায়। সুতরাং বিশ্বাস কী? টেলিফোন করলাম। চেষ্টার কসুর করলাম না বোঝাতে যে, সুদূর বাংলা মুলুকের দুজন মানুষ পাতাইয়া ভ্রমণের ব্যাপারে পুরোপুরি সৎ ও আন্তরিক। কিন্তু তারা আগের কথার পুনরাবৃত্তিই করল।

দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব। ব্যাগ মাথায় করে হলেও হোটেল খুঁজে বের করব যদি বুকিং ওরা বাতিলই করে দেয়। হোটেল যদি না-ই পাওয়া যায়, তাহলে সাগরসৈকতের চেয়ার ভাড়া করে রাতটা কাটিয়ে দেব। পাতাইয়া সিটি কর্পোরেশন ওয়েবসাইটে পর্যটকদের জন্য বেশ কিছু বিষয়ে সাবধান বাণী-সম্বলিত নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। সেখানেই জানা গেল সাগরসৈকত গোটা রাত উন্মুক্ত এবং সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান করে। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।

 

তৃতীয় দিন দুপুর চারটায় সভা শেষ হয়ে গেল। বসকে জানালাম ব্যাংককেই বাঙালি বন্ধুর বাসায় থাকব। পাতাইয়া যাওয়ার খবর পুরো চেপে গেলাম। তিনিও তাঁর ভারতীয় বন্ধুর বাসায় দু’দিন থাকবেন বলে জানালেন। সালাহউদ্দিন ও আমি পড়িমরি করে ট্যাক্সি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড অভিমুখে ছুটলাম। ব্যাংকক পাতাইয়া সড়কে সারারাতই বাস এমনকি ট্যাক্সিও চলে। মূল্য সাশ্রয়ী বাসেই চেপে বসলাম। ছ’টা ত্রিশে পাতাইয়া পৌঁছে গেলাম। পাতাইয়া পৌঁছেই বুঝলাম ব্যাংককের সাথে একে মেলানো যাবে না। বাস থেকে পাতাইয়ার মাটিতে পা ফেলতেই হোটেল ও মক্ষিরাণিদের সেলস এজেন্ট তথা দালালরা ঘিরে ধরল।

একটা ‘টুকটুক’ (অনেকটাই আমাদের দেশের মফস্বল শহরগুলোতে চালু ইজিবাইকের মতো) ধরলাম। টুকটুক-চালক ভাড়া প্রদর্শন করলেন ক্যালকুলেটরে। উচ্চারণগত ভিন্নতার জন্য ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে ব্যাংককের সর্বত্রই এ প্রথা দেখেছি। গ্রহণযোগ্য ভাড়াই মনে হলো।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন না কি অপ্রসন্ন বুঝে উঠতে সময় লাগল। আমাদের বুকিংকৃত কক্ষ এখনো ভাড়া হয়নি। সুতরাং রাস্তায় রাস্তায় পদব্রজে ঘোরাঘুরি কিংবা সাগরসৈকতে নিশিযাপন কোনোটারই প্রয়োজন হবে না। নিবন্ধন খাতায় ঠিকুজি লিখে নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করেই হতাশ হয়ে পড়লাম। ইন্টারনেটে প্রদর্শিত ছবির সাথে কক্ষের বাস্তব অবয়বের সাদৃশ্য একেবারেই নেই। স্বল্পালোকিত কক্ষ- একটিমাত্র বাল্ব কক্ষটিতে। দেয়ালের গোলাপি রঙ সম্ভবত কয়েক বছরের পুরনো হবে। জানালার পর্দার সুরতও তথৈবচ। উদ্বেগজনক যা- তা হচ্ছে দুটি খাটের চাদরেই ছিদ্র। হাম্মামখানাও অপরিষ্কার। সম্ভবত আজকে পরিষ্কারই করা হয়নি- ধূমপায়ীদের বদঅভ্যাসের খেসারত আমাদের দিতে হবে। হাম্মামখানার মেঝেতে ও বেসিনে ধূমকাঠির অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবদ্ধ কক্ষে ধূমপানের ফলে কক্ষের পরিবেশ যেমন হওয়ার কথা তেমনই। পূর্বতন অতিথি বিদেয় হওয়ার পরে বায়ু-পরিষ্কারক সুগন্ধি স্প্রে করা হয়নি। ফলে কক্ষটির পরিবেশ গুমোট ও দুর্গন্ধযুক্ত।

খিদমতগার ইংরেজি বোঝে না। সে ওয়াকিটকিতে ফ্রন্টডেস্কে কথা বলল। তাকে নিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষে গেলাম। আমাদেরকে দেখে অর্ভ্যথনা কক্ষের ফ্রন্টডেস্কে বসা সুহাসিনীর হাসি অপসৃয়মান। কেমন যেন রুক্ষ-রুষ্ট ভাব নিয়ে তাকাল আমাদের দিকে। আমরা সমস্যাগুলো বললাম। তিনি জানালেন, চাদর পাল্টে দেয়া হবে, ঘরে এয়ারফ্রেশনার দেয়া হবে। কিন্তু হাম্মামখানা আজ পরিষ্কার করা যাবে না- কাল। আমার জিদ তাকে জানিয়ে দিলাম। হাম্মামখানা পরিষ্কার করে না দিলে আমরা বুকিং বাতিল করব। সাথে সাথে বুঝলাম এদেশ নেপাল, ভুটান, এমনকি মায়ানমারও নয়। এদেশের নাম শ্যামদেশ ওরফে থাইল্যান্ড।

তরুণী জানালেন, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে পুরো ভাড়া দিয়েই যেতে হবে। কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললাম, একটা আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরীর হোটেলে হাম্মামখানার মতো একটা স্পর্শকাতর জায়গা পরিষ্কার না করে ভাড়া দেয়াটা কতটা যৌক্তিক। তিনি নিরুত্তর। আবারও ব্যবস্থা করে দিতে বললাম। সামনের সোফাতে যে দুজন ষণ্ডামার্কা চেহারার যুবক বসেছিল তারাও উঠে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তরুণীর পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করল। আমি সোজা-সাপটা কানুনের আশ্রয় নিতে চাইলাম। মোবাইল ফোনে পাতাইয়া পুলিশের এসএমএস দেখিয়ে বললাম, ‘আমি কি এখানে কল দিব?’

ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হতে পারত ভয়ঙ্কর। কিন্তু না। ষণ্ডামার্কা দুই যুবক পিছিয়ে গিয়ে সোফাতে বসল। তরুণী বললেন, আমরা যখন রাতের খাবারের জন্য বাইরে যাব তখন হাম্মামখানা পরিষ্কার করে দেয়া হবে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু এমনতরো নোংরা বিছানায় বিশ্রাম নিতে মন কি চায়! কাপড়-চোপড় পাল্টে হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। কাছেই দেখা যায় পাতাইয়া সৈকত- তখনও জমজমাট। দূরে কেমন একটা নরম মায়াবী আলোছায়া। কে যেন ডাকে! জানি না কোন সে কুহকিনী। পাহাড় নাকি সাগর। দুটোই আমার প্রিয়। দেখা হলেই ওদের মাঝে অবগাহন করতে মন চায়। হায় কত কত দিন পর ওদের দেখি! শুষ্ক-সমতলের মানুষ বলেই কি বিপরীত প্রকৃতি-পাহাড় আর সাগরের প্রতি আমার প্রেম? যা সহজেই পাওয়া যায় তার প্রতি প্রেম হয় বুঝি-বা নরম। আর যা সহজে পাওয়া যায় না, তার প্রতি প্রেম হয় অদম্য-অতলস্পর্শী-অতিপ্রাকৃত। উপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করলাম। ওয়াকিং স্ট্রিট অভিমুখে চললাম। পাতাইয়া নগরীতে আসার আগে ইন্টারনেটে এই সড়কের কথা অনেক পড়েছি। প্রতিটি সাইটেই পর্যটকদেরকে এই সড়কে আসার ব্যাপারে খুব উৎসাহিত করা হয়েছে।

যথেষ্ট প্রশস্ত সড়ক। ফুটপাতও বেশ প্রশস্ত। সড়কের দু’পাশে স্থানীয় ঐহিত্যবাহী পণ্যের দোকান। বার, ম্যাসাজ পারলার। রেস্টুরেন্টও রয়েছে। ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা সাধারণত বিদেশে আমাদের মতো কাপড়-চোপড় কেনাকাটা করে না। তারা ছোটোখাটো স্যুভেনির কেনে। দোকানগুলোতে তাদের বিচরণ চোখে পড়ার মতো। তবে ব্যাংককে যা দেখিনি এ নগরীতে তা দেখে বেশ ভড়কে গেলাম। দলবদ্ধ ভারতীয় যুবকদলের হৈ-হুল্লোড় থেকে ব্যবধান রেখেই ধীরে সুস্থে বেশ খানিকক্ষণ হাঁটলাম। হেঁটে হেঁটে এশিয়ার অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত এই নগরী সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলাম।

প্রচুর শেতাঙ্গ পর্যটক। তাদের বেশির ভাগই থাই-যুবতীকে বগলদাবা করে ঘুরছে। বয়সে ওরা মধ্যবয়স্ক কিংবা পৌঢ়। ব্যাংককে আরবদেশীয়দের দেখা গেলেও এখানে চোখে পড়ল না। তবে ভারতীয় ও শ্রীলংকান পর্যটকদের বেশিরভাগই যুবক। তারা তিন-পাঁচ কিংবা আট-দশ জনর দলবদ্ধভাবে হৈ-হল্লা করে ওয়াকিং স্ট্রিট চষে বেড়াচ্ছে।

বাদামি চামড়ার এই-দুই আদমিকে দেখে দলগুলোর কেউ কেউ চোখ বড়ো করে আমাদের দিকে তাকাতেই ‘দেখিনি’ এমন ভাব করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। পদযুগল আগাম হুঁশিয়ারি বার্তা দিল চঞ্চল বিচলনে তার অনিচ্ছার ব্যাপারে। কাছাকাছি একটা দক্ষিণ-ভারতীয় রসুইঘর পেয়ে গেলাম। রাতের বেলা ভাত খাই। তবে সুযোগ পেলে রুটিও খাই। এখানে নান বা তন্দুরী নেই। আছে হাতে বেলা রুটি। নিরামিষাশী বলতেই ভারতীয় খিদমতগার মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। মিনিট দশেক পরে স্টেইনলেস স্টিলের থালা নিয়ে হাজির। থালার মাঝখানে কাঁচা লাল আটার রুটি, চারপাশে ছোটো ছোটো কাঁসার বাটিতে নানা পদের তরকারি ও আচার। পেট পুরেই খেলাম।

দশটা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম। কক্ষে ঢুকে কিছুটা স্বস্তিই অনুভব করলাম। হাম্মামখানা পরিষ্কার করা হয়েছে। ঘরের দুর্গন্ধ পুরোপুরি উবে যায়নি, তবে বসবাসোপযোগী। ঘরের বাইরে গেলেই আমার ঝোলাতে কাপড়-চোপড়ের নিচে পাতলা একটি চাদর থাকে। সেটির সদ্ব্যবহার করতে কসুর করলাম না। আমার এই বিকল্প ব্যবস্থা দেখে সালাহউদ্দিনকে স্বল্পমাত্রায় ঈর্ষান্বিতই মনে হলো।

ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হয়। কেননা কমপ্লিন্টারি ব্রেকফাস্ট দেয়া হয়। বরাবরই সকালের নাস্তা সেরেই ঘর থেকে বাইরে বেরোনো অভ্যেস। আমাদের দেশের বড়ো শহরগুলোতে কমপ্লিন্টারি ব্রেকফাস্টে সাধারণত অপশন থাকে দেশি ও বিদেশি, যাকে বলে কন্টিনেন্টাল নাকি ইংলিশ। এখানে কোনো অপশন নেই। শুধুমাত্র ইংলিশ- ব্রেড টোস্ট, জেলি, বাটার ও অমলেট।

ব্যাংককেও শ্বেতাঙ্গরা থাই তরুণীদের বগলদাবা করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ওখানে ভারতীয়দের দৌরাত্ম্য চোখে পড়েনি এ নগরীর মতো। এখানে ভারতীয়রা যতটা না থাই তরুণী বগলদাবা করে, তার চেয়ে বেশি শ্বেতাঙ্গদেরকে বগলদাবা করে হোটেলে আসছে। এই শ্বেতাঙ্গ রমণীরা রুশদেশীয় নামে পরিচিত হলেও মূলত পূর্ব-ইউরোপিয়ান। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পূর্ব-ইউরোপে শরীরী ব্যবসা নিষিদ্ধ ছিল। সেসময়ে তাদের ঐশ্বর্য ছিল না কিন্তু ন্যূনতম চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। তাদের তা পছন্দ হলো না। তারা গণতন্ত্রের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গণতন্ত্র পেল। এখন কিছু মানুষের সমৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। আর কিছু জমিনের অভ্যন্তরে ধাবমান। এদেরই কিছু তরুণী সমৃদ্ধির মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে পশ্চিম ইউরোপ আমেরিকা এমনকি সুদূর এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনেও উড়ে এসেছে।

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না