জুননুন মিশরী

0

(BIOGRAPHICAL ENCYCLOPAEDIA OF SUFIS (Africa & Europe) : N. Hanif, Sarup & Sons, New Delhi, 2002 থেকে এ প্রবন্ধটি সংগৃহীত এবং বাংলায় অনূদিত।)

 

 

মিশরে সুফিদের সর্বপ্রকার স্তরে ধর্মতাত্ত্বিক আধ্যাত্মিকতার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় জুননুন মিশরীকে (ইন্তেকাল, ৮৫৯ ঈসায়ী)। তিনি নবম শতকের শ্রেষ্ঠতম সুফি; সমকালীন সুফিদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত (Spiritual leader) ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ের সুফি লেখক— আবু নাসের সিরাজ এবং আবুল কাসেম কুশাইরি— তাঁর পাণ্ডিত্য ও তাসাউফে তাঁর অবদানকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেছেন। আধ্যাত্মিক সফরে তিনি যথেষ্ট বিপদসঙ্কুল পথ বেছে নিয়েছিলেন বলে, দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরী তাঁকে “রহস্যগুপ্ত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর ব্যাপারে ফরিদুদ্দিন আত্তার লিখেছেন: “আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যিনি প্রচুর লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, আধ্যাত্মিক সফরে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন, খোদায়ী জ্ঞান ও খোদাতে বিলীন হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব-গুরু, দারিদ্র্যকে যিনি আপন বাহ্যিকতা হিসেবে বরণ করেছিলেন— তিনিই মিশরের প্রধান খোদামুখী সফরকারী, জুননুন মিশরী। দুর্দশা, অনুশোচনার এক অদম্য পথিক ছিলেন; বিশুদ্ধভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পর্যবেক্ষণ এবং আত্ম-সচেতনতার (তাক‌ওয়া) নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি অদ্বৈতবাদ ও আধ্যাত্মিকতার সুক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিত্ব হিসেবে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় পৌঁছেছিলেন।”

তিনিই প্রথম সুফি যিনি তাওহীদ বা একত্ববাদের বিশ্লেষণসাপেক্ষে ‘সর্বেশ্বরবাদ’র ধারণা দেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে অনুশোচনা, আত্মত্যাগ, সংযম ও মারেফাতের সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন তিনি।
৭৯৬ ঈসায়ী / ১৮০ হিজরিতে, মিশরের ঊর্ধ্বতন শহর আকমিমে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নিউবিয়ান (Nubian— উত্তর সুদান ও দক্ষিণ মিশরে অবস্থিত শহরবাসী)। বালক অবস্থাতেই তিনি হতে চেয়েছিলেন, একজন মুক্ত মানুষ। কিছুদিন ঔষধ-পথ্য, রসায়ন এবং যাদুবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন— বলা যায়, তিনি গ্রীক সভ্যতা দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন। কায়রো শহরের সাদ‌উন নামক ব্যক্তিকে তাঁর শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তিনি মক্কা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন এবং এই ভ্রমণে, জর্ডানের লুবান নামক শহরে কিছু সন্ন্যাসী দেখে আকর্ষিত হয়েছিলেন; এই আকর্ষণ‌ই তাঁর পরবর্তী জীবনের সাধনা ও আত্মচেতনায় কার্যকর হয়েছে।
তিনি মুতাজিলাদের সাথে বিরোধিতা করেছিলেন, কারন ধর্মমতে তাঁর বিশ্বাস ছিল— কুরআন অ-সৃষ্ট। প্রকাশ্যে আধ্যাত্মিকতার তালিম দেওয়ার কারণে, মিশরীয় এবং মালিকি মাযহাবভুক্ত, আবু আবদুল্লাহ আবদ আল হাকাম দ্বারা তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো। জীবনের অন্তিমলগ্নে, তাঁকে গ্রেফতার করে বাগদাদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনি মিশরে ফিরে যান। ২৪৬ হিজরি /৮৬১ ঈসায়ীতে তিনি ‘জিজা’য় ইন্তেকাল করেন।
‘সুফিদের প্রধান’ হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন, এবং একজন স্বনামধন্য শিক্ষকও ছিলেন, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও তাঁর অনেক অনুসারী ছিল। যাদুবিদ্যা এবং রসায়ন সম্পর্কিত কিছু বই তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে; তবে তাঁর আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা সম্পর্কে, তাঁর সমসাময়িক লেখক আল মুহাসিবি ছাড়া অন্য কারো কিতাবে পাওয়া যায় না। তাঁর অনেক প্রার্থনামূলক গীতি এবং কিছু ভালো কবিতা সংরক্ষিত হয়েছে। তিনিই প্রথম সুফি যিনি আধ্যাত্মিক ধারণাসমূহের ব্যাখা করেছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদের আধ্যাত্মিক হালচাল (আহওয়াল) এবং মর্যাদা (মাকামাত) সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক দরস দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন অনুশোচনা, আত্মচেতনা, আত্মত্যাগ এবং ভিন্ন জগতের ব্যাপারে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ‘নফস’ আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের প্রধান সমস্যা হতে পারে তাই তিনি নফসের পরিশুদ্ধির জন্য সকল প্রকার নিপীড়ন, যন্ত্রণাকে স্বাগতম জানিয়েছিলেন। প্রকৃত সাধনায় আন্তরিকভাবে লিপ্ত থাকার সফরকে তিনি বলেন, “এটি পৃথিবীতে আল্লাহর তলোয়ার, যার স্পর্শে খোদা ব্যতীত সমস্ত কিছুর মোহ-মায়া কেটে ফেলা যায়”। একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা আধ্যাত্মিক জগতের একটি পরিণতিতে পৌঁছতে সাহায্য করে, কারণ “যিনি খোদা ছাড়া সমস্ত কিছু থেকে একা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি খোদা ব্যতীত কিছুই দেখতে পান না, এবং খোদার ইচ্ছা ব্যতীত অন্য কোনোকিছুই তাঁকে পরিচালিত করতে পারে না”। 

 

জুননুন মিশরী— তিনি প্রথম মারেফাতের প্রকৃত জ্ঞান-কাঠামো সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, যা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “একত্ববাদে বিশ্বাস— এটি সব সাধকদের মধ্যে একটি কমন বৈশিষ্ট্য ; যারা কলবে খোদার খেয়াল রেখে ধ্যানমগ্ন থাকেন, স্বয়ং খোদা তাঁদের কাছে এমনভাবে প্রকাশিত হন যেভাবে তিনি সৃষ্টির অন্য কিছুতেই প্রকাশিত হন না।” এবং বলা হয়, “সাধক তাঁর নিজের মধ্যে থাকেন না, কিন্তু খোদা উপস্থিত থাকেন এমন সবকিছুতেই তিনি থাকেন”।

 

খোদাসন্ধানী ব্যক্তির কোনো দেশ, রাজ্যের প্রয়োজন পড়ে না ; সে যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর প্রয়োজন কেবল খোদাকে। খোদা-মত্ত প্রতিটি মুহূর্তেই তিনি ভাবোচ্ছ্বাসে কাটান। জুননুন খোদার ভালোবাসায় ‘হুব’ (আরবি) শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন ; অর্থাৎ, তার প্রতিই ভালোবাসা যা খোদা ভালোবাসেন আর তার প্রতিই ঘৃণা যা খোদা ঘৃণা করেন। তবে, খোদাকে ভালোবাসতে গিয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা বিসর্জন দেওয়া যাবে না ; মানবজাতির প্রতি ভালোবাসাই তো ধার্মিকতার মূলভিত্তি। তিনিই প্রথম সুফি যিনি ভালোবাসার শরাবের কল্পনা করেছেন এবং তা ঢেলে দিয়েছেন, তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের পেয়ালায়। খোদায়ী তরিকায়, আধ্যাত্মিকতা অর্জনে যন্ত্রণা ও বিরহকাতরতা সহ্য করার একটি মাধ্যম হিসেবে তিনি আত্মাকে (soul) বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেন: “একজন সুফি যদি সত্যিই তাঁর জীবন যাপনের মাধ্যমে আরোগ্য (পরিশুদ্ধতা) লাভ করতে চান তাহলে তাঁর ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা অসুস্থতা এবং দুর্ভোগের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে ; দুশ্চিন্তা ও দুর্বলতার সাথেও তিনি সংযুক্ত থাকবেন।”

 

বিরহ-কাতরতার পবিত্র পুণ্য একজন সাধককে খোদার সামনে কেবল নমনীয়-ই করে না, বরং এটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার একটি আলামত‌ও। “খোদা তাঁর সাধককে তাঁর নিজের চেয়ে শক্তিশালী কোনো উৎসের হদিস দেন না, যখন ঐ সাধক নিজেকে কদর্যতম হিসেবেই বিবেচনা করেন।” (এখানে দুইটি অর্থ হতে পারে। এক. তখন সাধককে খোদা নিজের দিকে টেনে নেন ; দুই. খোদা তাঁকে আপন শক্তিতে শক্তিশালী করে তোলেন।)

 

একজন সাধারণ মানুষ এবং একজন সাধকের অনুশোচনা, অনুতাপের মধ্যে জুননুন নিজস্ব, স্বতন্ত্র একটি চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে একজন সাধারণ মানুষ তার পাপের জন্য অনুশোচনায় ভোগে, অতীতে জমানো সমস্ত অনৈতিক কাজের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পরবর্তী জীবনে শাস্তি ভোগ করে সেখানে একজন সাধক খোদার সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি, বিস্মৃতির কথা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠে। খোদার নৈকট্য থেকে সামান্য বিরত থাকার লজ্জায় মিশ্রিত থাকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির অনুশোচনা। একজন সাধারণ মানুষের অনুশোচনা কেমন হবে তা নির্ভর করে খোদার সাথে তার সম্পর্ক কেমন তার উপর, যেখানে খোদার সাথে তার ‘ঘনিষ্ঠতা’ থাকে না ; কিন্তু একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাধকের অনুশোচনা থাকে কেবল খোদার সাথে বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতার লক্ষ্যে। প্রথম অনুশোচনাকারী অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অনুশোচনা কেবল বাহ্যিক আচরণের জন্য ; দ্বিতীয় অনুশোচনাকারী অর্থাৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাধকের অনুশোচনা তাঁর আভ্যন্তরীণ আচরণ ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার জন্য। প্রকৃত অনুশোচনাকারী আসলে সাধক, কারণ তাঁর এই অনুশোচনা তাঁর আধ্যাত্মিক সফরে উচ্চাভিলাসী লক্ষ্য তথা খোদাপ্রাপ্তির মাধ্যমে সফলতা অর্জন করে।

 

খোদাকে তালাশ করা ব্যক্তি তাঁর সফরে যত বেশি একনিষ্ঠতার সাথে বিরামহীনভাবে যুক্ত থাকতে পারেন, তাঁর অন্তরচক্ষু তত দৃঢ়তার সাথে লক্ষ্য নির্ধারণ করে; ফলে দুনিয়াবি চিন্তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ রেহাই পান। তিনি চিন্তা করেন, খোদা একা, কারণ তিনি খোদার ইচ্ছাতেই স্থানান্তরিত হন— নির্জনতা ছাড়া এই রাজ্যে ভ্রমণ সম্ভব নয়। যখন খোদাকে তালাশ করা ব্যক্তি দেখেন, খোদাকে ছাড়া আর কিছুই নেই তখন তাঁর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে বিকল্প কোনো অপশন থাকে না। নির্জনতার রাজ্যে আধ্যাত্মিক ব্যক্তি দুনিয়ার সকল বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, বিশুদ্ধতার জগতে যুক্ত হন এবং কেবল খোদার সাথে সম্বন্ধতেই তিনি আনন্দিত হন। প্রকৃতপক্ষে খোদা ব্যতীত অন্য সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ব্যক্তি খোদার অনুগ্রহের স্বীকৃতি লাভ করেন— অন্য সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হবার মাধ্যমে।
“যদি তুমি দেখো তিনি তাঁর সৃষ্টিকুল থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করেছেন তখন মনে করবে, তিনি নিজেই তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন ; যখন তুমি দেখবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলকে সাথে নিয়ে তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন তখন জানবে, তিনি আসলে তাঁর ‘নিজ’ থেকেই তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।”
খোদায়ী জ্ঞানকে জুননুন তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন: ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা। ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞান তাওহিদকে নিয়ে পেরেশান ; এই জ্ঞান অর্জন করা যায় ইসলামে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে। দর্শন আলাপ করে প্রকৃত সত্য নিয়ে ; এই জ্ঞান অর্জন করা যায় মৌলিক ‘কারণ’ অনুসন্ধানের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিকতার কারবার খোদার সত্ত্বা নিয়ে ; এই জ্ঞান অর্জন করা যায় ‘মুশাহাদা’র মাধ্যমে, অথবা খোদাকে নিয়ে গভীর চিন্তায় মশগুল কলবের মাধ্যমে।

 

তাঁর বক্তব্যে: “খোদাকে নিয়ে বিশেষ জ্ঞান মূলত তিন ধরনের: প্রথমত, একত্ববাদের ধারণা যা বিশ্বাসীদের মধ্যে সিম্পলি থাকে ; দ্বিতীয়ত, এই জ্ঞান আসে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে এবং এই বিস্তৃত শাখায় অনেক শিক্ষা (টেক্সচুয়াল) এবং বাগ্মিতা প্রয়োজন ; তৃতীয়ত, এই জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হলো, ঐশ্বরিক পরিশুদ্ধতায় ডুব দেওয়া— কলবকে সবসময় খোদামুখী রাখা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের নিকট এই জ্ঞান রয়েছে ; এবং খোদা তাঁদের মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশিত হন যেভাবে তিনি সৃষ্টির অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত হন না।”

 

খোদায়ী গুণে গুণান্বিত জ্ঞান সর্বোচ্চ বিশুদ্ধ জ্ঞান, যখন ব্যক্তি কলবের মাধ্যমে খোদার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করে। জুননুন বিশ্বাস করেন: “খোদার অনুসন্ধানে থাকা ব্যক্তি (আরিফ) জানেন জ্ঞান ছাড়া, তিনি জানেন দৃষ্টি ছাড়া, তিনি জানেন তথ্য ছাড়া, তিনি জানেন চৈতন্য ছাড়া, তিনি জানেন বয়ান ছাড়া, তিনি জানেন ব্যাখ্যা ছাড়া এবং তিনি জানেন কোনোরূপ পর্দা ছাড়া। তাঁরা আসলে নিজেদের মধ্যে থাকেন না ; যদিও তাঁরা থাকেন তাহলে খোদার মাধ্যমেই থাকেন। তাঁদের কার্যক্রম সংঘটিত হয় খোদার মাধ্যমে, তাঁদের বক্তব্য হয় খোদার নির্ধারিত শব্দে, তাঁদের দৃষ্টিশক্তি চালিত হয় খোদার দৃষ্টির সহায়তায়।”
খোদা তো বলেছেন: “আমি যখন কাউকে ভালোবাসি তখন তাঁর কান হয়ে যাই যা দ্বারা সে শোনে ; তাঁর চোখ হয়ে যাই যা দ্বারা সে দেখে ; তাঁর কণ্ঠনালী হ‌ই যা দ্বারা সে বলে এবং তাঁর হাত হয়ে যাই যা দ্বারা সে করে।”
জুননুন মিশরীর সাধনা কেবল খোদার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনের এবং তা তাঁকে খোদার সম্ভাব্য পরিচয়-প্রাপ্তির মাধ্যমে সফলতা এনে দিয়েছে। নিশ্চয়তার সাথে বলা যায়, ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানী ও দার্শনিকের তুলনায় একজন সুফির মর্যাদা অনেক উঁচুতে হতে পারে। আবার খোদামুখী আধ্যাত্মিক জ্ঞান বাকি দুই সেক্টর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগত।
একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সফরে তিনটি স্তর থাকে। প্রথমত, যখন প্রকৃত অনুশোচনা সম্পাদন করতে পারেন তখন তিনি তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জ্ঞান লাভ করেন ; দ্বিতীয়ত, খোদার সাথে যখন তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে উপলব্ধি করতে পারেন তখন তিনি খোদায়ী জ্ঞান লাভ করেন ; তৃতীয়ত এবং চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে, তিনি খোদার জ্ঞানের নির্যাস-ই অর্জন করেন— এভাবেই খোদা তাঁর নিকট প্রকাশিত হয়।
শাস্ত্র-সম্মত ধর্মের অনুসারী সুফিদের মধ্যে জুননুন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের একজন, যিনি শরীয়ত সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং আধ্যাত্মিক সফরকারির জন্য শরীয়তের অনুসরণ প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। “খোদার বন্ধুর আচরণ, কার্যাবলী, জীবন যাপনের রীতিনীতি অনুসরণ করা— খোদাকে ভালোবাসার আলামত।” যিনি রাসুলের নির্দেশিত পথ, পদ্ধতি অনুসরণ করবেন তিনি প্রকৃত স্রষ্টার দর্শনের মাধ্যমে তৃপ্তি পাবেন ; আর তাঁরাই উপলব্ধি করেন, খোদা-ই সকল ক্ষমতার মালিক, সর্বজ্ঞানী এবং প্রকৃত সত্য । নিজেদের ব্যাপারে এই ‘হীন’ ধারণার মাধ্যমে মূলত, তাঁদের মাঝে খোদায়ী গুণাবলী প্রকাশিত হয়। জুননুন বলেন: “যা-ই তুমি কল্পনা করো না কেন, খোদা তার বিপরীতে”, অর্থাৎ, খোদা তার অনেক উচ্চে— যা মানবের জন্য অকল্পনীয়। 

 

আবুল হাসান সিররি সাকতি ছিলেন খুব জ্ঞানী (প্রচলিত শাস্ত্র-জ্ঞানে) সুফি এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সফরের যাত্রা হয়েছিল হযরত মারূফ কারখির মাধ্যমে। তিনি আধ্যাত্মিক সফরের সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্বতন্ত্র কাঠামোসম্পন্ন একটি স্তরের দিশা দিয়েছিলেন। তাঁর এই স্বতন্ত্র তরিকার মাধ্যমে প্রকৃত সাধক খোদার সাথে অবিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই বসবাস করতে পারেন। তাঁর জন্য সবচেয়ে কঠোর শাস্তি হচ্ছে, খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। তিনি বলেন: “ও খোদা! তোমার সবরকম শাস্তি আমাকে দাও, কিন্তু দোহাই, তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার শাস্তি ছাড়া”। 

 

জুননুন ছিলেন বাস্তবধর্মী সুফি, যিনি খোদার সাথে সঙ্গবদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপনের জন্য আধ্যাত্মিক সফরের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তীতে যা তাসাউফের মৌলিক ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না