মজলিশের গদ্য || সাকী ও কবিতা : এস. ওয়াজেদ আলি

0

 

আমাদের যুগ হচেছ নীতি-বাগীশদের যুগ। কাব্যে নীতি, সাহিত্যে নীতি, সর্বত্রই নীতির চর্চ্চা। কবিদের লেখা পড়লে মনে হয়, নীতি প্রচার করবার জন্যই তাঁরা লেখনী ধারণ করেছেন। যাঁরা নীতির বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কিছু লেখেন না, তাঁরাও সামাজিক নীতিকে, আচারগত বিধি-নিষেধকে সম্ভ্রম করে করে চলেন। ফলে সাহিত্য আজ প্রাণহীন, আর কাব্য মরণাপন্ন।

 

চিরদিন কিন্তু এমন ছিল না। কবি একদিন স্বভাবের আহ্বানকে নীতির অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর লেখনী থেকে মুক্তা ঝরেছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ মহাকবি হাফেজের বিষয় দু’চার কথা আজ বলব। হাফেজ শরাব ভালবাসতেন, সাকীকে তিনি ভালবাসতেন, তাঁর তরুণী প্রিয়াকে ভালবাসতেন ; আর এদের নিয়ে বাগানে, নদীর তীরে, উন্মুক্ত প্রান্তরে বসে আনন্দ উপভোগ করাকে তিনি জীবনের একটা দুর্ল্লভ জিনিস বলে গণ্য করতেন। আর একথা সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করতে তিনি কোন রকম দ্বিধা অনুভব করতেন না। আর যাঁরা তাঁকে উপদেশ দিতে আসতেন, তাঁর কাজের সমালোচনা করতে আসতেন, তারা তাঁর মুখ থেকে স্মরণীয় কিছু শুনে যেতেন। একটি গজলে কবি বলেছেন :

“বাগানে এখন স্বর্গের মলয় বাতাস বইছে!

এখানে আমি আছি, আমার প্রিয়া আছে, পরীর মত যার চেহারা, আর আছে আনন্দ-দায়িনী শরাব!

চারিদিকে বসন্তের আবাহন! ভবিষ্যৎ স্বর্গের আশায় এই হাতে-পাওয়া ধন ছেড়ে দেওয়া, সে কি বুদ্ধিমানের কাজ? শরাব দিয়ে আনন্দের সৌধ তুমি গড়ে তোল। এই নির্ম্মম পৃথিবী কিসের পেছনে আছে জান?

আমাদের মাটি দিয়ে সে ইট তৈয়ের করবার মতলব আঁটছে!

এ শত্রুর কাছ থেকে করুণার আশা করো না। যতই তুমি মন্দিরের আলো মসজিদে নিয়ে গিয়ে জ্বালাও না কেন!

আমি মাতাল? আমার নামে পাপের অঙ্ক উঠবে? আরে বন্ধু, তুমি কি জান কার কপালে ভাগ্য কি লিখে রেখেছে!

ফকির বটে, কিন্তু নিজেকে বাদশা বলতে আজ আমার কোন কুণ্ঠা নেই! মাথার উপর আমার মেঘের চন্দ্রাতপ! ক্ষেতের প্রান্তে আজ আমার উৎসবের মজলিস!

হাফেজ যখন মরবে, তার দেহকে কবরস্থ করতে যেতে কোন আপত্তি তুলো না বন্ধু! পাপে ডুবে আছে বটে, কিন্তু শেষে সে স্বর্গে গিয়ে পৌঁছুবে!”

 

হাফিজের গজলকে কেন্দ্র করে আঁকা একটি চিত্র; সোর্স: www.pinterest.com/azar_sami/hafez-shirazi/

শরাবের গোলাপী নেশায়, এবং প্রিয়ার আবেশ ভরা চুম্বনের মধ্যেই হাফেজ অনন্ত জীবনের সন্ধান পেয়েছিলেন, চিরন্তন সত্যের দর্শন লাভ করেছিলেন। একটি গজলে তিনি বলেছেন :

“আমার সাকী হলেন স্বয়ং খিজর, যিনি অনন্ত জীবনদায়িনী সুধা বিতরণ করেন! আমি শরাব কি করে বর্জন করতে পারি?

প্রেমিকার মধুর ওষ্ঠাধরের মিষ্টতার কাছে মিছরিও হার মানে!

প্রিয়ার দেহের মধুর সুরভি, সে যে ঈসার ফুৎকারের মতই জীবন দান করবার শক্তি রাখে!

শত বৎসরের বৃদ্ধও যে ফুৎকারে নূতন জীবন লাভ করে!

শোন বন্ধু, তত্ত্বকথা তোমাকে কিছু বলি শোন। এই যে অগ্নিগর্ভ পানি অর্থাৎ শরাব, এর একটুখানি পেটে না গেলে, বিশ্ব সমস্যার সমাধান আমার মস্তিক তো করতে পারে না!

হে হাফেজ! পৃথিবীর এই জীবনে একমাত্র মূল্যবান জিনিস যে কি, তা কি তুমি জান?

হিংসাদ্বেষহীন নির্মল অন্তর- বাকী সব আবর্জ্জনা!”

 

প্রেম, প্রেমাস্পদ, সুরা, বন্ধুবান্ধবের আনন্দ-কলরব, এসবকে হাফেজ অন্তরের সঙ্গে ভালবাসতেন, আর তিনি একান্তমনে বিশ্বাস করতেন, খোদা চান আমরা অকুণ্ঠিতচিত্তে এসব জিনিস উপভোগ করি। নীতি-বাগীশদের ভর্ৎসনা শুনে তিনি তাই হাস্য পরিহাস করতেন। একটী গজলে তিনি বলেছেন,

“হে নীতি ধ্বজাধারী ধার্মিক, আমোদপ্রিয় স্বাধীনচেতা মানুষদের নিন্দাবাদ করো না। পরের পাপের বোঝা তোমাকে ত আর বইতে হবে না!

আমি ভালই হই, আর মন্দই হই, তোমার তাতে কি আসে যায়?

তুমি নিজের কাজে যাও! প্রত্যেকে সেই ফসলই পাবে, যার বীজ সে বুনেছে!

মাতাল আর জ্ঞানী, সকলেই নিজ নিজ প্রেমাস্পদের তল্লাসেই আছে! মসজিদ আর মন্দির সবই হচ্ছে প্রেমের নিকেতন!

আমি যে শরাবখানার দোয়ারের মাটিতে আমার মাথা লুটিয়ে দিচ্ছি- সে তাঁরই প্রেমের বশে!

যে সব লোক তাদের ধর্ম্ম-কর্ম্ম নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়, তারা যদি আমায় বুঝতে না পারে, তাদের বল, তারা ইটের উপর গিয়ে মাথা ঠুকুক।

বিচারের দিনের ভয় আমায় দেখায়ো না! পর্দার অন্তরালে কে ধার্ম্মিক বলে গণ্য হবে, আর কে অধার্ম্মিক বলে গণ্য হবে তুমি তার কি জান?

কেবল আমি তো নীতির পথ ছাড়িনি! আমার পিতা আদমও স্বর্গ ছেড়েছিলেন।

নিজের ক্রিয়া-কর্ম্মের উপর বেশী ভরসা করো না, বন্ধু! মহাশিল্পীর কলম তোমার নামের পাতায় কি লিখেছে, তা কি তোমার জানা আছে?

অন্তর তোমার যদি সত্যই এত অসহিষ্ণু আর অনুদার হয়, তা হলে তার পবিত্রতা গর্ব্ব করবার জিনিসই বটে! আর তোমার মন যদি এই রকম ছিদ্রান্নেষী হয়, তা হলে সেটা আবিলতাহীন মনই বটে!

স্বর্গের বাগান সুন্দর হতে পারে, তবে এই যে গাছের ছায়া আর নদীর তীর আজি আমাদের ভাগ্যে জুটেছে, তাদের তাচ্ছিল্য করো না!

হে হাফেজ! মৃত্যুর সময় যদি এক পেয়ালা প্রেমের শরাব পান করতে পার, শরাবখানার গলি থেকে সোজা তা হলে ফেরেস্তারা তোমায় স্বর্গে নিয়ে যাবে!”

 

হাফেজ জীবনকে নিজের ইচ্ছা এবং প্রবৃত্তি মত উপভোগ করতেন, আর এরূপ করাকে তিনি ধর্ম্ম বলে গণ্য করতেন। স্বর্গের লোভ দেখিয়ে আর নরকের ভয় দেখিয়ে যারা মানুষকে নীতির পথে আনতে চেষ্টা করতেন, তারা ছিলেন তাঁর শাণিত বাক্যবাণের প্রধান লক্ষ্য-বস্তু। এ সত্ত্বেও কিন্তু হাফেজের অন্তর ছিল বিশ্ব-প্রভুর প্রেমে কানায় কানায় পূর্ণ, আর পরমার্থের চিন্তাই ছিলো তার জীবনের চরম এবং পরম লক্ষ্য। একটি গজলে তিনি বলেছেন :

তোমার আস্তানা ছাড়া

দাঁড়াবার যায়গা আমার নাই।

তোমার দরজা ছাড়া

মাথা রাখবার স্থান আমার নাই!

 

শত্রু যখন তরওয়াল খোলে, আমি তখন ঢাল দূরে ফেলে দিই ; ক্রন্দন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া অন্য অস্ত্র আমার নাই!

শরাবখানার গলি থেকে কেন আমি মুখ ফেরাতে যাব? শরাব পান আর আমোদ প্রমোদের চেয়ে ভাল রীতি যে আমি খুঁজে পাই না!

কালের নির্ম্মম হাত আমার জীবনের গোলায় যদি আগুন লাগিয়ে দেয়, আমার তাতে দুঃখ নাই! জীবনকে আমি তৃণের চেয়ে বেশী মূল্যবান বলে মনে করি না!

আমি সেই তন্বী তরুণীর অপাঙ্গ দৃষ্টির দাস, আত্মগরিমায় যে এতই মত্ত, যে কারও দিকে সে চেয়েও দেখে না!

কারও উপর অত্যাচার করো না আর যা খুশী তাই করো! আমাদের ধৰ্ম্মে অন্যায় আর অত্যাচার ছাড়া পাপ নাই!

 

পাঠকরা হয়তো ভাববেন হাফেজের মত মহাজ্ঞানী সাধক শরাব, সাকী আর মাশুককে নিয়ে কেন এত মত্ত হলেন? ওমর খৈয়ামের বিষয় এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। বিষয়টা বুঝতে হলে, তখনকার যুগের সামাজিক ইতিহাস একটু জানা দরকার। এই মহা-পুরুষদের যুগে জীবন্ত ধৰ্ম্মের স্থান গ্রহণ করেছিলো কতকগুলি আচার, অনুষ্ঠান এবং বিধি-নিষেধের সমষ্টি। আর ভণ্ড ধর্মযাজকের এই সব তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসনকে অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের উপর, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির উপর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের উপর নির্ম্মম শাসন এবং শোষণ কার্য চালিয়ে যেতো। হাসা উচিত কিনা তা নিয়ে শাস্ত্রের বিধান দরকার, খেলা উচিত কিনা তা নিয়ে শাস্ত্রের বিধান দরকার, ভালবাসা উচিত কি না তা নিয়ে শাস্ত্রের বিধান দরকার ; এক কথায় জীবনের প্রত্যেকটী খুঁটিনাটি জিনিসের জন্য শাস্ত্রের বিধান দরকার, শাস্ত্রের সমর্থন দরকার, আর তারজন্য উপযুক্ত দক্ষিণা নিয়ে যাওয়া দরকার মোল্লা-মৌলভিদের কাছে। এই কঠিন শাসনের ফলে স্বভাবধর্ম লোপ পেতে বসেছিলো, প্ৰেম-প্রীতি-ভালবাসা লোপ পেতে বসেছিল, মানুষের স্বাধীনভাবে ভাববার, স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা লোপ পেতে বসেছিল। মানুষ স্বার্থসৰ্বস্ব ভণ্ড ধর্ম গুরুদের দাসে পরিণত হয়েছিল। এই দুর্দ্দিনে মহাকবিদের আবির্ভাব। তাদের লেখায় যে বিদ্রোহের সুর বেজে উঠল সে মধুর সুর মৃতকল্প মানুষকে নূতন জীবন দান করলে। মানুষ স্বাধীন চিন্তার, স্বাভাবিক জীবনের আস্বাদ পেলে। মরনোন্মুখ সমাজে তাদের প্রতিভার প্রভাবে সভ্যতা অভিনব মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলে। আর তাদের যাদুকরী লেখনীতে যে বিশ্বপ্রেম, স্বাভাবিক জীবনের প্রতি যে ঐকান্তিক অনুরাগ, ন্যায় এবং যুক্তির যে মহিমা ফুটে উঠল, তা পারসিক সাহিত্যকে বিশ্বে এক গৌরবের আসন দান করলে। হাফেজ এবং খৈয়াম কাব্যের সাহায্যে সমাজ-জীবনে যে পরিবর্তন এনেছিলেন, বড় বড় সংস্কারকেরা বিরাট সামাজিক এবং ধর্মীয় বিপ্লবের সাহায্যেও তা ক্বচিৎ আনতে সক্ষম হয়েছেন। হাফেজ এবং খৈয়াম প্রভৃতি কবিদের কেবল কবি-হিসাবে দেখলে চলবে না ; তাঁদের যুগ-প্রবর্তক সংস্কারক হিসাবে, মানবের শ্রেষ্ঠ বন্ধু-হিসাবে, সভ্যতার পথপ্রদর্শক-হিসাবেও দেখতে হবে।

 

(এস. ওয়াজেদ আলির প্রবন্ধগ্রন্থ প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩) থেকে গদ্যটি নেওয়া হয়েছে। এস. ওয়াজেদ আলি রচনাবলী – প্রথম খণ্ড : বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫-তে সংযুক্ত।)

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না