“আঠারো শতকে মুঘল কূটনীতি এবং নবাবি রাজনীতি”

মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের “Social History of the Muslims of Bangladesh under the British Rule”র ধারাবাহিক অনুবাদ ; দ্বিতীয় পর্ব

0

প্রথম পর্বের পর…

 

ভারতে মুঘল শাসনের পূর্বে দিল্লি ও বাংলাদেশের মুসলিম শাসকদের  উপাধি ছিলো ‘সুলতান’। আরবিতে ‘সুলতান’ অর্থ ‘ক্ষমতা’ এবং পার্সীয়ান-তুর্কি মুসলিমদের ব্যবহারে ‘সুলতান’ শব্দটি বোঝায় ‘ক্ষমতার অধিকারী’ বা ‘যিনি সালতানাতের অধিকারী’। অর্থাৎ, একজন শাসক যিনি কেবলমাত্র ক্ষমতার ভিত্তিতে শাসন করেন না, বরং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত একজন  শাসক। অন্য কথায়, সুলতান খলিফার নিকট থেকে  শরিয়তের বিধি অনুসারে মুসলমানদের উপর ক্ষমতা অর্জনকারী শাসক ছিলেন। যেমনিভাবে খলিফা, (আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কর্তৃত্ব অর্জন করেছিলেন) যিনি উম্মাহ কর্তৃক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করেন। সুতরাং, ইসলামী পরিভাষায় ‘সুলতান’ হলেন মুসলমানদের ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত শাসক।

 

মুঘলরা ভারতের মুসলিম শাসনকে ইসলামী ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের তৈমুরীয় রাজা এবং সম্রাট ঘোষণা করে। তারা নিজেদেরকে পাদশাহ, বাদশাহ এবং শাহানশাহ বলে অভিহিত করেছিল, ইসলামিক দৃষ্টিকোণে যার অর্থ প্রকৃত শাসক। মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা শাহানশাহ আকবর, নিজেকে ঐশ্বরিকভাবে অনুমোদিত শাসক হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি নিজেকে ‘সুলতান আল আদিল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সম্রাট আকবরের বিখ্যাত ঐশ্বরিক আদেশে ব্যবহৃত বাক্যটি হলো: “সুলতান-আল আদিল জিল্লাল্লাহ”, অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ রাজা আল্লাহর ছায়ার অনুরূপ।

 

মুঘলরা নিঃসন্দেহে ইসলামী ন্যায়বিচার প্রদান করতো, তবে তা ‘মোগল ন্যায়বিচার’ হিসাবে প্রকাশিত হয়। অনুরূপভাবে, রাজনীতি ও প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা যে মৌলিক পরিবর্তন করেছিলো তা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। মুঘলরা যেভাবে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে মৌলিকভাবে কূটনৈতিক নীতিমালা গঠন করে নিজেদের হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে কেন্দ্রীভূত করেছিলো তা ‘মুঘলাই কূটনীতি’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত।

 

মুঘল মনসবধারী বা আমলাদের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে মুসলিম জনগণকে ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক করে ফেলে। সম্ভবত পরবর্তীতে মুঘল ন্যায়বিচারের কোল থেকে ব্রিটিশ শাসনে প্রশাসনিক উত্তরণের জন্য এরকম ‘রাজনৈতিক উত্তরণ’- বিশেষত ‘সুবাহ বাঙ্গালা’তে তার ভিত্তিতে- স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নবাবীর (স্বাধীন আমলাতন্ত্র? নাকি, প্রাদেশিক প্রশাসনের বিদ্রোহ?) ভিত্তি তৈরি করেছিল।

তৎকালীন বাংলার সার্বিক ইতিহাস এবং ইসলামী সমাজের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে ধারণা পেতে আমরা ড. আবদুল মাজেদ খানের (নিউজিল্যান্ড, মৃত্যু ১৯৭৪) সাইয়্যেদ মুহম্মদ রেজা খানের উপর বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাটি পর্যালোচনা করবো।

 

একটি বই পর্যালোচনা

সাইয়েদ মুহাম্মদ রেজা খানের উপর, আবদুল মাজেদ খানের একটি বই ১৯৬৯ সালে লন্ডনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। যার মূল নাম: “The transition in Bengal 1756-1775 : A Study of Saiyid Muhammad Reza Khan”। লেখক নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষক ছিলেন এবং তাঁর এই গবেষণাটি পিএইচডি থিসিস হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছিলেন, ১৯৬৬ সালে।

 

দক্ষিণ এশিয়ান গবেষণায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরিজ ধারাবাহিকতায় সপ্তম মুদ্রণ হিসাবে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (১৭৫৬-১৭৭৫) শাসনামলের তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। তবে এই থিসিসের কাজে বিলেত যাওয়ার আগে, লেখক, ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি-কেন্দ্রিক বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারীদের সাথে এক দশকেরও বেশি সময় নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন।

 

এমনকি, তার আগেও লেখক উচ্চতর পড়াশোনার জন্য একবার ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন এবং ঐতিহাসিক স্থায়ী বন্দোবস্তের ফাইল, নথিগুলির প্রতি আগ্রহ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন বাংলায়। প্রকৃতপক্ষে এই বিশদ পটভূমির নজির বর্তমান গবেষণাটি। সবমিলিয়ে, গত দুই দশকে প্রবীন ও নবীন ইতিহাসবিদগণ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপর যত গুরুত্বপূর্ণ ও জবরদস্ত কাজ করেছেন তাতে এই গবেষণাটি আংটির উপরিভাগের মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। বিবেচনায় রাখতে হবে যে, এই গবেষণায় কেবল মুঘল থেকে ব্রিটিশ শাসনে রূপান্তর-ই নয়, বরং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের  ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের দৃশ্যায়নও মঞ্চস্থ হয়েছে।

 

লেখক তাঁর রচনায়, বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার সম্মিলিত সুবাহ বাঙলায় মুঘল আদর্শ ও রায়তমুখী প্রশাসন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুসারী আমলাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দের সমালোচনা করেছেন তীক্ষ্নভাবে। আমলাদের এই দ্বন্দ্ব রেজা খানের ক্যারিয়ারের সাড়ে তিন দশকে তীব্রতর হয়েছিল এবং বিশেষত পলাশীর যুদ্ধের সময়, ১৭৬৫-’৯০, যখন তিনি ইংরেজ শাসকদের অধীনে কাজ করতেন। তখন রেজা খানকে নায়েবে সুবাদার, নায়েব নাজিম (Principal Minister) ইত্যাদি নামে ডাকা হত।

 

সেই সময় তিনি প্রশ্নাতীতভাবে ইংরেজদের সেবা করেন, একইসাথে প্রাচীন মুঘল শাসনব্যবস্থার সমর্থন করেন (ধর্মীয় বা ঐতিহ্যবাহী ঈর্ষার জায়গা থেকে?), ফলে ইংরেজদের সাথে তাঁর মতবিরোধ ঘটে। তবুও, সেই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাঁকে ভুল পথে হাঁটতে দেখা যায়, অর্থাৎ, ইংরেজদের পক্ষ নিতে দেখা যায়। এর অনিবার্য পরিণতি হয়েছিল, একদিকে রেজা খানের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি এবং অন্যদিকে প্রশাসনিক ক্ষমতায় ক্রমশ ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। অনিবার্যভাবে, ‘নায়েবে নাজিম’ পদ বিলুপ্তির মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসের ‘এ্যাংলো-মোঘল’ (Anglo-Mughal) পর্বের সমাপ্তি ঘটে এবং ১৭৯১ সালের ১ জানুয়ারি লর্ড কর্ণওয়ালিসের কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পুরো ক্ষমতা ইংরেজদের দখলে চলে যায়।

 

মুঘল ও ইংরেজের মধ্যকার যুদ্ধের অধীনে থাকা সত্ত্বেও, রেজা খানের সেবাগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে অমূল্য প্রমাণিত হয়েছিল। যেহেতু তিনি বাংলায় মুঘল সার্বভৌমত্বের একটি ফাঁপা দর্শন বজায় রেখে ‘রাজনীতি’ করেছিলেন, যেমনটা তাঁর পূর্বসূরীরা (মীর জাফর থেকে মুর্শিদকুলি খান) শুরু করেছিলেন; যে পরিস্থিতির বোঝাপড়া বাংলার মানুষের নাগালের বাইরে ছিলো। তিনি অন্তিমশয্যার মুঘল প্রশাসন এবং উদীয়মান ব্রিটিশ শক্তির মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র হিসেবে সাফল্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন। প্রশাসনে তাঁর ভূমিকা আফিমের মতো কাজ করেছিলো। তাঁর আফিমের নেশায় ফেলে বাংলার জনগণকে রাজনীতির প্রতি আরও উদাসীন করে তোলা হলো এবং ফলক্রমে, মুঘল থেকে ব্রিটিশদের হাতে নির্বিঘ্নে, মসৃনভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর সম্ভব হলো। যে কারণে বইটির প্রধান শিরোনাম: “The Transition in Bengal 1756-1775”

 

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না