স্মৃতিবিলাস – চতুর্দশ পর্ব

0

ত্রয়োদশ পর্বের পর…

 

অনেকদিন বাদে আজ তাঁর সাথে কথা হলো। ঠিক তাঁর সাথে নয়, একতরফা কথা- কেমন আছো বুবু? আমাকে চিনতে পেরেছো? সকালে নাস্তা করেছো? না, একটি প্রশ্নেরও উত্তর পাইনি। উত্তরগুলো তাঁর বুকের গভীরে যেন দলা পাকিয়ে অদ্ভুত এক ভাষায় শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। সে কি কান্না! সহ্য করার মতো নয়। ওদিকে ভিডিও ক্যামেরায় দেখছি, কবির (বুবুর বড় ছেলে) এক হাতে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে, অন্য হাতে নিজের চোখ মুছছে। বুবুর জন্য আমার বুকের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কেমন হাহাকার করে ওঠে! তাঁর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান প্রায় ২৫ বছরের। মায়ের সাথে বুবুর বয়সের ব্যবধান ছিল ১৬ বছরের। সেদিক থেকে বুবুকে মায়ের মতো মনে হতো ছোটবেলায়। গতবছর জুলাই মাসের কথা, করোনার দুর্যোগকালে বুবু (বড় বোন) ঢাকায় মেজ ছেলের বাসা থেকে বাগেরহাটে নিজের বাড়িতে যান। জুলাই মাসের দুই তারিখে ছিল দুলাভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী। নিজে অনেক দোয়া কালাম পড়েন। বাড়িতে ছোটখাটো একটা দোয়ার আয়োজনও করেছিলেন। এরপর কি যে হলো! তিন চারদিন পর হঠাৎ-ই ব্রেন স্ট্রোক হয়। জরুরী ভিত্তিতে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। সেই থেকেই কবিরের বাসায় আছেন। বুবুর আরও একবার মিনি স্ট্রোক হয়েছিল, মদিনা সফরের সময়। আমরা তিন বোন একসাথে গিয়েছিলাম। সেদিন বুবুর প্রেসারটা একটু বেশি ছিল। তাই বেশি না হাঁটতে হয় সেজন্য আসরের ওয়াক্তে তাঁকে মসজিদ-ই-নববীর বাইরে সিঁড়ির কাছে একটা চেয়ারে নামাজে বসিয়ে আমি আর সেজো আপা ভেতরে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি তিনি নেই। অন্য ভাষায় কেউ কেউ বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা দু’জন হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দেখি ইতোমধ্যে মেডিকেল টিম প্রাথমিক চেকআপ শেষে একটা কক্ষে বিশ্রামের জন্য রেখেছেন উনাকে। এরপর কিছু ঔষধ এবং পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। দুটো দিন ভালোই ছিলেন। কিন্তু মিনায় যাবার দিন সবাই রওনা হলাম একসাথে, একটু হেঁটে গিয়ে বাসে উঠতে হবে। হঠাৎ তিনি রাস্তায় বসে পড়লেন, কিছুতেই পা ফেলতে পারছেন না। দ্রুত হুইল চেয়ার এনে গাড়িতে তুলে ঐ অবস্থায় মিনায় পৌঁছলাম। টিমের লোকজন আমাদেরকে একটা জায়গায় রেখে উনাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, তার অবস্থা ভালো না, তাকে অবশ্যই হাসপাতালে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমাদের আনন্দময় এবাদাত আর ভ্রমণ মুহুর্তেই বিষাদে ছেঁয়ে গেল। সারাক্ষণ কাঁদি বুবুর জন্য, এত আনন্দ নিয়ে এসেছিলেন, তার হজ কি তাহলে হবে না? আমাদেরও কি হয়, কি হয়, এমন একটা অবস্থা। সারারাত কেটে গেল, বুবু এলো না। ওদিকে সবাই তৈরি, আরাফার ময়দানে রওনা হবো, বুবু এলো না। মুজদালিফায়ও তার কোন খোঁজ পেলাম না। আবার মিনায় ফিরে এলাম, আমাদের তাঁবুর মধ্যে যে আটজন মানুষ ছিলেন, তারাও আমাদের সাথে বুবুর জন্য কাঁদেন, সবাই মিলে সারাক্ষণ কাঁদি। পরদিন সকালে আমার হাজব্যন্ড তাঁবুর বাইরে থেকে আমাকে বললেন, তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য একজন মেহমান এসেছেন। সবাই অবাক বিস্ময়ে তাঁকিয়ে আছি, এই অচেনা জায়গায় এত ভিড়ের মধ্যে কে আসতে পারে! দেখি, পা পর্যন্ত সাদা ধবধব একটা পোশাক পরিহিত অবস্থায় হাতে কতগুলো গোলাপ নিয়ে বুবু দাঁড়িয়ে হাসছেন। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ভয়ে আর কিছুই জানতে চাই না তাঁর কাছে, মাঝখানের দুটো দিনে যে অনেকগুলো কাজ শেষ হয়ে গেছে, এটা জানতে পারলে তিনি হয়ত আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন। বুবু নিজেই বলতে শুরু করেন- ‘তোমরা জানো, এ দেশের বাদশাহ কত ভালো মানুষ! আমি তাঁর জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেছি।’ ‘কেন? তিনি কী করলেন?’ ‘তিনি একটা অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাদের মতো কয়েকজন অসুস্থ মানুষকে সেদিন আরাফার ময়দানে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। ওরা আমাদের বলেছিল, তোমাদের যতক্ষণ ভালো লাগে, মন ভরে আল্লাহকে ডাকো। তারপর সেখান থেকে পরবর্তী কাজগুলোও সুন্দরভাবে করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’ আমাদের কান্না আর থামে না, কখনও দুঃখে কাঁদি, কখনও আনন্দে কাঁদি! আমার জন্মের আগেই বুবুর তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। মেয়েটা আমার চেয়ে একটু বড় হলেও আমরা একই ক্লাসে পড়তাম, মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকে সুলতুমনি আমাদের বাসায়ই নিয়মিত থাকতো। কারণ ওদের বাসা থেকে স্কুল-কলেজ বেশ খানিকটা দূরে ছিল। প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার দুলাভাই আসতেন সুলতুকে বাড়ি নিয়ে যেতে। বুবু আমাকেও সাথে করে নিয়ে যেতে বলতেন। ফলে মাঝেমাঝেই বুবুর বাড়িতে যাবার সুযোগ হতো আমার। বাবা, মাকে ছাড়া কেবল এই একটি বাড়িতে যাবার অনুমতি ছিল আমাদের। আব্বা সবাইকে সাথে নিয়ে বছরে একবার দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি যেতেন। এর বাইরে আর খুব একটা বেড়ানোর স্মৃতি নেই। এমনকি ১৯৯৩-এ খুলনায় পড়াশোনা করতে গিয়ে চলাচলের সময় বড় বড় পরিবহনগুলোকে রাস্তায় দেখে আমার মনে হতো, নিত্যদিন এত বড় গাড়িতে কারা চড়ে? কোথায় যায়? অথচ আমি নিজে খুব ভ্রমণ পিয়াসী। স্বামী ভদ্রলোকের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের সৌভাগ্যও হয়েছে অনেকবার। সে কথা আজ থাক। আজ শুধু বুবুর কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

 

বুবুর বাড়িটি ছিল একটা ছোটখাটো রাজ্যের মতো। ঠিক কতটুকু জায়গার উপর, সে ধারণা আমার আজও হয়নি! সে বাড়িতে ছিল না, তেমন কিছুও দেখিনি কখনও। বেশ বড় দুটো পুকুর, তারপাশে আবার মস্ত বড় এক বিল। বিল-ঝিল পেরিয়ে হ্রদের মতো একটি জায়গায় অনেক সুন্দর সবজি বাগান হতো। অন্যদিকে সুদীর্ঘ উঠোন, আম-কাঁঠাল, সুপারি-নারকেলের বাগান পেরিয়ে এ ভিটা, সে ভিটা। এরপর মাঠের শুরু। মাঠের পাশে পানের বরজ। শুনেছি কেরোসিন আর লবণ ছাড়া কোনকিছুই কিনতে হতো না ওদের। জমিদার বাড়ির মতো বিশাল একটি ভবন, যেটা মাঝ বরাবর অর্ধেক করে ভাগ হয়েছিল দুই ভাইয়ের মধ্যে। কাকতালীয়ভাবে দুজনেরই চার ছেলে এক মেয়ে হয়েছিল। তাদের সাথে ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা করে ভীষণ আনন্দে ছুটির দিনগুলো অনেক দ্রুত কেটে যেত। খানজাহান আলীর মাজার সংলগ্ন দিঘীর দক্ষিণ পাড় ধরে মাইলখানেক হাঁটলেই বুবুর বাড়ির সীমানা শুরু হতো। মাজার পর্যন্ত রিকশায় যাওয়া যেত। এরপর মাজারের সীমানা পার হয়ে দিঘীর বামপাশ থেকে সরুমাটির বন্ধুর পথ ধরে হেঁটে যেতে হতো। বামদিকে অসংখ্য ছোট ছোট টিলার মতো উচু জায়গা, তারউপর ছোট ছোট ঘরবাড়ি। প্রচুর কাঁঠাল গাছ, বেশিরভাগ সময় ফলে ভরা থাকতো। রিকশায় চড়ার চেয়ে হেঁটে যাওয়া ঐ পথটুকুই ছিল ভীষণ আনন্দের। ডানপাশে দিঘী, স্বচ্ছ জল, অনেকখানি জায়গাজুড়ে শাপলা পদ্ম ফুটে থাকতো। খুব ইচ্ছে করতো পানিতে নেমে শাপলা তোলার কিন্তু নিষেধ ছিল বড়দের, কারণ কুমির নাকি অনেক বাচ্চাদের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে, এমন কথা প্রচলিত ছিল। তবুও কিনারের দিকে থাকা জলজ গাছগুলোকে সাহস করেই ছুঁয়ে দিতাম। বুবুদের বাড়িসহ এলাকার সকল মানুষ দিঘীর পানিকে বেশ পবিত্র পানি হিসাবে পান করতো। দিঘীর পাড়ের উঁচুনিচু টিলাগুলোই তখন আমার কাছে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। টিলার গর্তে কুমির ডিম পাড়তো। ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কুমিরের ডিম খুঁজতে যেতাম। কয়েকবার দেখাও মিলেছে। তবে সে কাজেও নিষেধাজ্ঞা ছিল, কারণ ডিম ফোটার আগে আরও কুমির নাকি আশেপাশে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কেউ তাদের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলে কিনা সেটা দেখার জন্য। অথচ জনশ্রুতিতে আছে, কখনো কখনো কোনো কোনো কুমির নিজের বাচ্চাকেও খেয়ে ফেলে। তখন আবার তাদের চোখে পানিও আসে। না, মনের কষ্টে নয় বরং তাদের শরীরের বিশেষায়িত গঠনের জন্য। তাইতো কথায় বলা হয়, কুমিরের মায়াকান্না।

 

অসম্ভব সুন্দর সুন্দর নাম না জানা বুনোফুলের ঝাঁঝালো মেঠো গন্ধ গায়ে মেখে বিশ-ত্রিশ মিনিট হেঁটে বুবুর বাড়িতে পৌঁছতাম। কখনও আবার আরও একটু বেশি উপভোগ করার জন্য ভিন্ন পাড় ধরে ঘুরেঘুরে যেতাম। প্রচলিত ছিল, দিঘীর পশ্চিম দিকের মাঝামাঝি একটা ঘাটের পানি খুব কালো ছিল। এলাকার মানুষের বিয়ে শাদী বা যে কোন উৎসবে সেখানে গিয়ে চাইলে কাঁসা ও পিতলের থালাবাসন নাকি ঘাটে এসে যেত। কাজ শেষে আবার সেগুলো ঘাটে রেখে এলে নিজেই চলে যেত পানির নিচে। আমরা সে কথা পরীক্ষা করার জন্য ওদিকে যেতাম, তবে কোনদিন দেখিনি। তখন আবার মানুষ বলতো, এলাকার লোকজনের খারাপ আচরণ, অনেক সময় থালাবাসনগুলো সঠিকভাবে ফেরত না দেওয়ায় এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। বুবুর বাড়িতে পৌঁছনোর পর পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতাম। কারণ দুলাভাইকে ভীষণ ভয় পেতাম। রাশভারী কণ্ঠ ছিল, প্রচুর প্রশ্ন করতেন যার বেশিরভাগ পড়াশোনা বিষয়ের। তিনি প্রথমে খানজাহান আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে বাঘমারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং সেখান থেকেই অবসরে যান।

 

রিকশায় মাইক বাজিয়ে আগে সিনেমার কাগজের বিজ্ঞাপন বিলি করতো রাস্তাঘাটে। তখন প্রাইমারি সেকশনে পড়ি, একদিন আমি কাগজ নেবার জন্য রিকশার পেছন পেছন ছুটছি, অন্য দিক থেকে আর একটা রিকশা দ্রুত গতিতে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মাথায় বেশ চোট লেগেছিল, খানিকটা জায়গা কেটে রক্তও ঝরেছে। এই খবর পেয়ে দুলাভাই অনেক ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এলেন। উনার আওয়াজ পেয়ে আমি দরজার পেছনে লুকিয়ে আছি। উনি সম্ভবত ইচ্ছে করেই আমাকে শোনানোর জন্য ঐ দরজার সামনে এসে চেয়ার নিয়ে বসলেন। তারপর খুব জোরেজোরে বলছিলেন, ‘কেন রাস্তায় যেতে হবে? কেন কাগজের জন্য এমন ছুটতে হবে? বাসায় থাকলে তো দুর্ঘটনা ঘটতো না, এসব যেন আর কখনও না শুনি।’ অনেক বড় হবার পর বুঝেছি, মানুষটি উপরেই অমন মেজাজি ছিলেন, ভেতরে একেবারে নরম কাঁদা। খুব ভোরে উঠে নিজের নারকেল সুপারির বাগান, পানের বরজ সবদিকে ঘুরেফিরে তদারকি করতেন। আবার সময়মত স্কুলে গিয়ে নিজের কাজটি করতেন। একটু বেশিই নিয়মতান্ত্রিক মানুষ ছিলেন তিনি। রুস্তম আলী নামে বুবুদের কর্মীদের মধ্যে একজন প্রধান সহকারি ছিল, সে জমিজমার দেখাশোনা ও কাজ করতো। সেই ছোট্ট সময়ে তাকেই আমার আলাদীনের দৈত্যের মতো মনে হতো। গায়ের রঙ বেশ কালো, আকৃতিতে যেমন লম্বা তেমন সুঠাম দেহ ছিল তার। প্রায় সাড়ে ছয় ফিট লম্বা ঐ মানুষটির সবকিছুই তখন অদ্ভুত লাগতো। বুবু বলতেন- ‘রুস্তম, ওদেরকে সাথে নিয়ে যাও, মাঠে গিয়ে দুই কাঁধি তালশাস কেটে দাও। ওখানেই খেয়ে আসবে সবাই, বাড়িতে আনলে শুধু শুধু ঘরদোর নোংরা হবে।’ রুস্তম আলী বিরাট একটা দা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে প্রায় হেঁটে খুব দ্রুত গাছে উঠে যেত। তাকে দেখে মনে হতো, তালগাছে ওঠা কত সহজ! কয়েক মিনিটের মধ্যে গাছ থেকে নেমে তালশাস কেটে আমাদের সামনে ধরতো। আমরা হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিতাম, যে যত খুশি পারে। হাত দিয়ে আঘাত করে নারকেল ভাঙতে পারতো সে। পান গুনে গুনে অদ্ভুত সুন্দরভাবে ঝাপির মধ্যে সাজাতো। রুস্তম আলী নিমিষেই সব কাজ করে ফেলতো। সে খাবার খেতোও অদ্ভুতভাবে। প্রচুর খাবার খেতে পারতো। আমরা এদিক ওদিক তাকানোর ভান করে অবিশ্বাস্যদৃষ্টিতে উনার খাওয়া দেখতাম। বিরাট একখানা গোল টিনের প্লেটে খেত, অনেকটা জামাইয়ের সামনে দেয়া সাগরানা প্লেটের মতো।

 

ছোট বয়সের অনেক বিস্ময়কর এবং আনন্দময় অভিজ্ঞতা বুবুর বাড়ি থেকে হয়েছে। সুপারি বাগানের ফাঁকে চিকন ড্রেনের মতো ছিল, যেন মিনি খাল! বড় বিলের সাথে এর সংযোগ ছিল। সেখানে বাঁশ দিয়ে বানানো মাছ ধরার জন্য ফাঁদ হিসেবে বুচনা পেতে রাখতো। ঝুম বৃষ্টির সময় ওগুলোতে প্রচুর মাছ ধরা পড়তো। রান্নাঘরের বাইরে ইট দিয়ে একটা বাথটাব বানানো ছিল, যেখানে সবসময় জিয়ল মাছ থাকতো। বৃষ্টিতে বাইরে উঠোনে খেলা যেত না, তবে বড় বারান্দায় বসে সবাই গল্প করতাম। বুবু মজার মজার খাবার পাঠাতো। পিঠাপুলির পাশাপাশি প্লেট ভরা মচমচে ভাজা পুঁটিমাছ ঐ সময়ে খেয়েছি, অবশ্যই ভাত খাওয়ার আগে। এরপর আর কখনও ওভাবে খাওয়ার সুযোগ হয়নি। বাড়ির সামনের বড় উঠোনে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, ডাঙ্গুলি, কানামাছি খেলা অসংখ্যবার খেলেছি। কি যে মজা হতো! হঠাৎ কানে এলো টুং টাং শব্দ। ব্যস! সবাই মিলে ভো দৌড়। সুপারির বিনিময়ে আইসক্রিম খাওয়া হতো। সেটাও খেলার মতো ছিল। জগের ভেতর একেকজন পাঁচটা-দশটা আইসক্রিম নিয়ে নিত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, মাঝেমাঝে গাড়ি প্রায় খালি হয়ে যেত। সারাজীবন সংসারে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা মানুষটি ২০১২ সালে আমার চরম অসুস্থতার সময়ে সব ফেলে এসে অনেকদিন আমার কাছে ছিলেন। ছোট বাচ্চার মতো কোলের মধ্যে নিয়ে আদর করে ঘুম পাড়াতেন। অনেকেই ঐ সময়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, উনি কি তোমার মা? সত্যি করে যদি বলি, আমি কখনোই বড় বোনদের স্নেহ মমতাকে মায়ের থেকে আলাদা করতে পারিনি! ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন, বুবু আমার হাতে দশ হাজার টাকা দিলেন। আমি টাকাটা তাঁকে ফেরত দিয়ে বললাম, তুমি তো চাকরি করো না, এতগুলো টাকা কোথায় পেলে? রেখে দাও, তোমার কাজে লাগবে। বুবু বললেন, টাকাটা তুমি রাখো, এটা আমার একান্ত নিজের। আমি অনেক কষ্ট করে অনেকদিন ধরে হজে যাবার জন্য এই টাকা জমিয়েছিলাম, নারকেল পাতার শলা বিক্রি করে। টাকা হাতে নিয়ে সেদিনও অনেক কেঁদেছিলাম। কিছু কান্নার প্রতিদান বোধহয় আল্লার দরবারে এভাবেই কবুল হয়। ২০১৪-তে বুবুকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলাম। তিনি প্রথমে ইচ্ছে প্রকাশ করলেও পরে না করেন। বললেন, আমি বড় ছেলের সাথে যাবো। আমি তাঁকে বোঝানোর জন্য বাড়ি পর্যন্ত ছুটে গেলাম, কাজ হলো না। ফিরে এলাম ঢাকায়। বুবু ফোন করলেন, আমার বড় ছেলে তোমাদের সাথে যেতে বলেছে। আমার জন্য কাগজপত্র ব্যবস্থা করো, আমি তোমাদের সাথেই যাবো! তিনি গেলেন এবং বাদশাহের খাস মেহমান হয়ে পবিত্র কাজ শেষ করে ফিরে এলেন। বুবুর জন্য আমার বুকের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কেমন হাহাকার করে ওঠে! বুবু এখন আমাকে চিনতে পারে না…!

 

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না