স্মৃতিবিলাস – দ্বিতীয় পর্ব

0

প্রথম পর্বের পর…

 

বিদায় নিয়ে আসার সময় মা বলেছিলেন, ‘এত দেরী করে আর কখনও এসো না, কেমন?’

উত্তরে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, মা৷’

কিন্তু সেই কথাটা আমি রাখতে পারিনি!

বিয়ের পরে বছরে দু’বার মাকে কাছে পাবার সুযোগ হতো আমার, গ্রীষ্মের ছুটিতে আর রমজানের ঈদের পরে৷ সে বছর গ্রীষ্মের ছুটির ঠিক আগে নোটিশ এলো, নতুন পরীক্ষা পদ্ধতির উপর ট্রেনিং করতে হবে এবং অবশ্যই এই ছুটিতে৷ বদলানোর চেষ্টা করলাম অনেক কিন্তু না, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের কাছে পরাজিত হলাম৷ ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চললো৷ বাড়িতে ফোন করলেই মা বলতেন, ‘তোমার মুখটা মনে করতে পারছি না, অস্পষ্ট লাগে খুব! এতদিন না এলে কি হয়?’

আমার কষ্ট মাকে বুঝতে দিই না৷ বলি, ‘এই তো, আর মাত্র কয়েকটা দিন ৷ ঈদের ছুটিতে কেউ আর আমাকে আটকে রাখতে পারবে না৷’

এখন আমার স্কুলে চাকরির সুবাদে প্রতিদিন অনেক মায়ের সাথে দেখা হয়, যারা তাদের সন্তানের জন্য নানারকম কাজে পথেপথে ব্যয় করেন প্রায় সারাটাদিন ৷ আমার মায়ের অবশ্য তেমন সুযোগ ছিল না, নয়টা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসারে সাংসারিক জটিলতায় কেটে গেছে নিত্যদিন। মায়ের অনুভূতিগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম, আমাদের পৌঁছে দিতে বা নিয়ে আসতে স্কুলে যেতো না ঠিকই কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের যে কোন পরীক্ষার জন্য মা রোজা রাখতেন!

এই তো সেদিন, ২০০৯ এ, আমার এম.এড.এর মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল, ক্লাসে গিয়ে শুনি স্যারের বিশেষ কোন সমস্যার কারণে তিনি পরীক্ষাটা সেদিন বাতিল করেছেন। অন্যান্য সহপাঠিরা খুশিতে উল্লাস করছিল, আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল সেদিন, আহ্! মায়ের রোজাটা বিফলে যাবে!

সারাবছর কতো কী যে জমিয়ে রেখে দিতেন মা আমার জন্য! সে বছরও বাড়ি গিয়ে পেলাম তালের বড়া, হাঁসের মাংস, ঝুরি পিঠা, আমের ঝুরা আচার, লেবুর আচার, তেজপাতা, বিছানা ঝাড়ু, নকশী কাঁথা…। ভীষণ সাহসী আর বিনয়ী ছিলেন মা৷ প্রচণ্ড মায়া ছিলো সবার জন্য৷ হয়তো রান্না করতে যাচ্ছেন, হাতে মাছের পাত্র৷ ভিখারী এসে বললো, ‘মাগো, অনেকদিন মাছ খাই না।’ অমনি রান্নার পাত্র থেকে মাছ তুলে দিয়ে দিতেন তাকে৷ কারো কষ্ট মায়ের সহ্য হতো না৷ নিখাদ ভালবাসা ছিলো সন্তানদের জন্য৷ কোনো একটা জিনিস তৈরী করলেই সাথে সাথে সমান ভাগ করে সবাইকে দিয়ে দিতেন, যারা দূরে থাকে, তাদের ভাগেরটা প্যাকেট করে নাম লিখে রেখে দিতেন৷ বাড়ির ছোট মেয়ে হবার কারণে আমার সবকিছু নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করতেন মা৷ শেষের সময়টাতে মনের দিক থেকে খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন৷ মা চলে যাবার ঠিক পঁয়তাল্লিশ দিন আগে আমার একমাত্র মামা মারা যান, তখনও আমি বাড়ি যেতে পারিনি৷ সে কী দুঃখ মায়ের! বড্ড অভিমান করে বলেছিলেন, ‘সবাই এসেছিল, শুধু তুমিই এলে না৷’

তখন বাড়ি যেতে পারলেও মাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম! বিধাতা এখানেও বাধ সাধলেন৷ রোজা শুরু হলো, ছুটির অপেক্ষায় দিন গুনছি৷ ঈদের কেনাকাটা চলছে৷ মাকে ফোন করলেই বারবার বলতেন, ‘আমার জন্য এ বছর শাড়ি কাপড় কিছু কিনবে না, যা আছে সেগুলোই পরে শেষ হবে না৷’ প্রায় প্রতিদিনই মা এসব কথা বলতেন৷ বিশতম রোজার দিন সকালে ফোন করে বললাম, ‘এবার কিন্তু সত্যিই শাড়ি কেনা হয়নি, মা। এতবার নিষেধ করলে কি সেটা করা যায়? তবে আপনাকে কিছু না দিতে পারলে তো আমার অনেক খারাপ লাগবে৷ অন্য কোনকিছু দরকার হলে লিস্ট করে রাখবেন, আমি এসে কিনে দেবো৷’ মায়ের সাথে এটাই আমার শেষ কথা৷ সত্যি সত্যি লিস্ট করে রেখেছিলেন আমার জন্য, ‘দুধওয়ালাকে দাম হিসেবে পাঁচশ পঁচাত্তর টাকা তুমি দিয়ে দিয়ো৷’

আমি জানি, পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে তার মা-ই শ্রেষ্ঠ মা৷ কিন্তু আমার মায়ের মতো এতো সহজ সরল মাটির মানুষ এখনকার দিনে তেমন একটা দেখা যায় না৷ বাবার কাছে বা আমাদের কাছে তেমন কোন চাহিদা ছিল না কখনও৷ নিজের দামী জিনিসটাও খুব সহজে অন্যকে দিয়ে দিতে পারতেন৷ বাবার প্রতি ছিলেন প্রচণ্ড দায়িত্বশীল৷

অদ্ভুতভাবে বিদায় নিয়েছেন মা, ঠিক যেন জেনেশুনে বুঝে চলে গেছেন৷ নিজের শাড়ি গয়না সবার জন্য ভাগ করে রেখেছেন৷ বাবা যখন বিশ রমজানে এতেকাফের উদ্দ্যেশে মসজিদে রওনা করলেন, তখন মা হাতটা ধরে বলেছিলেন, ‘আপনার সাথে বোধহয় আর দেখা নাও হতে পারে, আমাকে একবার তওবা পড়িয়ে দিয়ে যান৷’ সেদিন শেষরাতে সেহরির পর কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন, এ অবস্থায় হঠাৎ করেই চলে গেলেন মা৷ পাশে বসে থাকা আট বছরের নাতিকে শুধু বলে গেছেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি দাদু, সবাইকে গিয়ে বলো।’

 

নিজের জীবন থেকে সবকিছু গুছিয়ে বিদায় নিয়েছেন মা৷ নির্মমতা হয়েছে কেবল আমার সাথে৷ আমার কাছ থেকে তো বিদায় নেননি! সবাই বলে- মা কি কারও চিরকাল বেঁচে থাকে? এ কথা আমিও অনেককে বলেছি কিন্তু সে তো কেবল কথার কথা৷ পুরো বছরটাতে একবারও কেনো মায়ের সাথে দেখা হবার সুযোগ হলো না আমার! আজও উত্তর মেলে না কিছুতেই৷ সারাটা বছরে কতো কি যে যোগাড় করে রেখেছিলেন মা আমার জন্য৷ আমিও রেখেছিলাম অনেক কিছু৷ সব পড়ে আছে, এসবের ভার বহন করা যে কি কষ্টের!

 

শেষদিকে মা নাকি আমার লাগানো জবা গাছের পাশে বসে জোরে জোরে নাম ধরে ডাকতেন৷ এসব কথা কেউ আমাকে বলেনি আগে৷ ছোটআপু একদিন ওই অবস্থায় মা’কে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি হয়েছে? ওর কি কোনো সমস্যা?’ মা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওর জন্য বুকের ভেতরটা ভীষণ জ্বলছে, তাই জোরে জোরে ডাকছি, যদি এতে জ্বালা কিছুটা কমে!’ মা আমাকে সারাজীবনে একটিমাত্র চিঠি লিখেছিলেন, বিশ বছর আগে৷ যার সম্বোধন ছিল ‘কলিজার টুকরা’… কি করে পারলো সেই টুকরাকে ছিন্ন করে চলে যেতে!

বেঁচে থেকেও দীর্ঘদিন মাকে কাছে না পাওয়া, এমন শাস্তি যেন পৃথিবীর কোনো সন্তান কোনদিন না পায়৷

আজও অনুভব করি, মা আমার জীবনের সব আলো নিয়ে চলে গেছে দূরে, বহুদূরে, যেখানে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার সাধ্যি আমার নেই৷ তাঁর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল, চলে যাবার ৩৫৪ দিন আগে৷ এত দীর্ঘ সময় আর কোনদিন মাকে ছেড়ে থাকা হয়নি৷ চলে যাবার পর মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা ৩৫৪ দিন পর এক নির্মম সন্ধ্যায়৷ সাদা ধবধবে পোশাকে জড়িয়ে মা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন৷ যে মানুষটি বাড়িতে ঢুকলেই এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে বলতেন, ‘পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে৷’ সেদিন বলেননি কিছুই, বলবেও না আর কোনদিন৷

 

নরম শীতল মুখটা স্পর্শ করে ধীরেধীরে অনেক ডেকেছি, মনেমনে ক্ষমাও চেয়েছি বহুবার৷ এক আকাশ শূন্যতা একমুহূর্তে যেন গ্রাস করেছিল আমার সমস্ত অনুভূতিকে, কেন একটিবার জোর করে বললো না, একবার আমার কাছে আয়। অভিমানে বুকের ভেতরটা জ্বলে ছাই হয়ে গেছে, মা কিভাবে পারলো আমার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে চলে যেতে!

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না