শিখেছি বৃদ্ধের বিদ্যা। হাস্যকর, নশ্বর, একাকী,—
ব’সে-ব’সে চেয়ে দেখি দাম্ভিক যুবকদল চলে যাচ্ছে কলোচ্ছ্বাসে,
—বুদ্ধদেব বসু (দয়মন্তী, ১৯৩৯)
একটি বই প্রকাশের প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পর কোনো তরুণ— যে আদতে বইটির হাঁটুর বয়সী, কিন্তু তারপরও বয়সের দোষে আলগা সাহসে, যখন সে-টি নিয়ে দু-এক কলম লিখতে চায়, তখন একমাত্র স্বাভাবিকতা-ই সম্ভবত তার চিন্তাসূত্রের দ্বিধাবিভক্ত হওয়া, কেবল এটা ভেবেই— সে সমগ্র লেখায় বাম মার্গ অবলম্বন করবে, না কি দক্ষিণ মার্গ অবলম্বন করবে; আর বইটির লেখক যখন বুদ্ধদেব বসু’র মত একজন মহীরুহ, তখন সে সূত্র শতধা না হলে, চিন্তা-কে হয়তো শতমুখী প্রহারে ঝাঁড়াতে হতো, যদি স্বয়ং বুদ্ধদেব উক্ত বইয়ে-ই আশকারা না দিয়ে যেতেন, “নবযুবকের দল যদি আমার বিরুদ্ধতা না করত, সেটা হত প্রকৃতির বিরুদ্ধতা। পূর্ববর্তীকে এই আক্রমণ ওদের যৌবনের স্বাক্ষর, আর আমার আসন্ন প্রৌঢ়ত্বের অভিজ্ঞান।”১
— ঠিক যে কণ্ঠে তিনি তাঁর অনুজদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন, সে-ই একি কণ্ঠেই যেন তিনি প্রবন্ধ লিখে গেছেন। তবে বুদ্ধদেব-কে নিয়ে লিখতে মধ্যম মার্গ অবলম্বন-ই সম্ভবত সহজিয়া হবে, অন্তত একজন পূর্বত্রিশি তরুণের জন্য; যদিও কোন তন্ত্র সাধনা যোগে এই মার্গ অবলম্বন করা উচিত হবে— তার সূত্র সন্ধানে কিছু শব্দক্ষেপন হয়তো করতেই হবে।
মার্জনার তোয়াক্কা করা-টা ভাগ্যিস পূর্বত্রিশের বৈশিষ্ট্য নয়, না হলে একেবারে আগা থেকে গোঁড়া একটি সোম্য-শান্ত ভাব ধরে থাকতে হতো, এবং বিনয় রক্ষায় ‘আমি’ শব্দটা সমগ্র লেখায় সহসাই ব্যবহার করতে পারতাম। যাই হোক, পুরোনো কেচ্ছা: বুদ্ধদেব-কে আমি আবিষ্কার করেছিলাম তাঁর প্রবন্ধে, এখন থেকে অর্ধযুগেরও একবছর আগে— বইয়ের পাতাগুলো ছিল একেবারেই পলকা, এপাশে হাত রাখলে ওপাশ থেকে দেখা যায়, আর সেই সফেদ পাতার উপর মুদ্রিত অক্ষরগুলো কিছুটা আলগা, মুদ্রণের ব্লকগুলোর মাঝে যে সুক্ষ্ম দূরত্বটুকু থাকে, এমনকি একই শব্দের মধ্যকার অক্ষরগুলোরও মাঝে— তা স্পষ্ট বোঝা যায়, কিছু কিছু পাতা অন্যগুলোর চেয়ে ঝাপসা, কোনো পাতার ওপরের অংশের তুলনায় নিম্নাংশ ঝাপসা। প্রথম যে প্রবন্ধটি পড়া হয়েছিল, তা সম্ভবত ‘আড্ডা’— অনুমানের উপর ভর করে বলতে হচ্ছে, কারণ এটা বহুদিন আগের ঘটনা, এবং অনুমানটি নিয়ে নিশ্চয়তাবোধ করছি, কারণ আমি নিজেও তখন কিছুটা আড্ডাবাজ প্রকৃতির ছিলাম— নিজের অবসরকে তখনো আওয়ারাপনায় বিসর্জন দিতে শিখি নি— জীবনের একেবারে নগণ্য একটি অনুসঙ্গ, আড্ডা’র মত বিষয়ের-ও এমন বুদ্ধিদীপ্ত একটি ইশতেহার থাকতে পারে— কখনো ভাবি নি; বুদ্ধদেব আমাকে মুগ্ধ করে নি— বুদ্ধদেব আমাকে মাতাল করেছিল। এই প্রবন্ধগুলোর সাথে আমার অন্তরঙ্গতার শুরু সে-দিন থেকে কি না তা বলতে পারি না, তবে ওর পর বুদ্ধদেবে’র অনেক প্রবন্ধ-ই পড়েছি; বলতে গেলে, কবিতার চেয়ে বেশি সময় তাঁর প্রবন্ধ পাঠেই বিনিয়োগ করেছি। এবং এত বছর পর, ফের যখন বইটির পাতা ওল্টাচ্ছি, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্করণের, আমি কি সে-ই একি প্রবন্ধ পড়ছি? বুদ্ধদেব বসু পাঠের বৃত্ত একপাক কোনো রকমে ঘুরে যখন আবার শুরুর বিন্দুতে ফিরে আসা হল, তখন কি আমি আবার একই বুদ্ধদেব বসু পড়তে শুরু করেছি? প্রশ্নটিকে হয়তো আরেকটু মার্জিত ও নৈর্ব্যক্তিকরূপে পেশ করা যাবে, আরো বৃহৎ পরিসর ব্যয়ে।
জুলাই, ১৯৪৫। কবিতাভবন, ২০২ রাসবিহারি এভেনিউ থেকে উত্তরতিরিশ বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে, যতদিনে বুদ্ধদেব বসু লিখে ফেলেছেন ডজন দুয়েক উপন্যাস, প্রায় এক ডজন কবিতা সংকলন, আধডজন গল্পসংকলন— হয়তো এটার পূর্বাভাস দিয়েই এক দশক আগে প্রমথ চৌধুরী লিখে রাখবেন, “বুদ্ধদেবের লেখনীর সৃজনশক্তি অফুরন্ত— বারমাসই তা যুগপৎ ফলন্ত ও ফুলন্ত”২; বলা নিষ্প্রয়োজন, ইতোমধ্যে তিনি একজন পেশাদার কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত; কিন্তু তখনো তাঁর প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে মোটে একটি: হঠাৎ আলোর ঝলকানি (১৯৩৫)। অনেক বছর পর তাঁর বার্ধক্যে যখন প্রবন্ধ সংকলন (১৯৬৬) বইটি বের হবে, সেখানে প্রথম সংস্করণের সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় উত্তরতিরিশ ও হঠাৎ আলো ঝলকানি’র প্রতিনিধিত্বশীল টুকরোগুলোকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেবেন তাঁর ‘রম্যরচনা পর্যায়ে’র প্রবন্ধ হিসেবে; বলার অপেক্ষা থাকে না, উত্তরতিরিশ’র পর তাঁর লেখা এজাতীয় কোনো ‘রম্যরচনা’ মলাটবন্দি হয়ে আর কখনো বের হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭)-এর রচনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব লিখবেন, “এই অংশের রচনাগুলিতে রচনাটাই প্রধান, বিষয়টা উপলক্ষ মাত্র; যে-কোনো একটি প্রসঙ্গ অবলম্বন ক’রে লেখক বিস্তার ক’রে দিলেন তাঁর ভাবনা ও কল্পনা, তাঁর মূল্যবোধ ও পক্ষপাত। এই ধরনের রচনার জন্য আধুনিক বাংলা ভাষায় একটি নতুন নাম উদ্ভাবিত হয়েছে— ‘রম্যরচনা’, ফরাশি বেল্-লেৎর্-এর অনুকরণ এটি; কেউ-কেউ বলে থাকেন— বা আগে বলতেন— ‘ব্যক্তিগত প্রবন্ধ”…৩
অথবা অধুনা পরিভাষায়— মন্ময় প্রবন্ধ; কিন্তু এ তো একটি একজন সমালোচক ও লেখক-অনুগ সংজ্ঞা— বুদ্ধদেব এই লেখাগুলোর পাঠকদের কাছ থেকে কি আশা করেন? বা, একজন লেখক হিসেবে এই রচনাগুলোর পাঠকদের কাছে তিনি কি দাবি করেন? বা, একজন পাঠককে এহেন গদ্যকে কিভাবে নেয়া উচিত? উত্তরতিরিশ’র দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৫২)-এ নতুন যুক্ত প্রবন্ধ, “সবচেয়ে দুঃখের দু ঘণ্টা”য় পরামানিকে’র হাতের নিচে আপনার মাথা পেতে দিয়ে কাটানো দু’ঘণ্টার উপযোগিতা কিভাবে বৃদ্ধি করবেন— তা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বই এবং সংবাদপত্র পাঠের প্রস্তাব দিয়ে তিনি লিখছেন, “সবচেয়ে ভালো কোনও উজ্জ্বল সজীব সাময়িক পত্র কিংবা এমন কোনও লেখকের ছোট গল্পের বই, যিনি প্রাণ দিয়ে এবং মন দিয়ে গল্প লেখেন, বই-পড়া বুদ্ধি দিয়ে লেখেন না— কিংবা এই যে আমি যে প্রবন্ধটি লিখছি এই ধরনের প্রবন্ধের বই।”
পাঠক হিসেবে আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না, সমগ্র উত্তরতিরিশে তিনি তাঁর পাঠকদের তরফ থেকে ন্যূনতম প্রচেষ্টারও দাবি করেন নি।
কিন্তু একজন লেখক তাঁর পাঠকদের ‘পাঠকের দায়বোধ’ থেকে কলমের একটি খোঁচায় যতটা সহজে মুক্ত করে দিতে পারেন, একজন পাঠকের পক্ষে সেই দায় থেকে পালিয়ে বেড়ানো অতখানি সহজ নয়,— ক্ষেত্রবিশেষে তা অনৈতিকও ঠেকে, কখনো কখনো তা খোদ পাঠকের কাছে আত্মহত্যার সামিল-ও বোধ হয়; তাই উত্তরতিরিশ (১৯৪৫) আমাকে পড়তে হয়েছে— নির্জনে— দায়বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করে, যখন-ই শুয়ে শুয়ে পড়েছি, কিছু কিছু প্রবন্ধ আমাকে বিছানার কোমল মোলায়েম স্পর্শ থেকে টেনে তুলে আসন গেঁড়ে বসতে বাধ্য করেছে— হাতে লেড পেন্সিল নিয়ে কখনো কোনো কোনো অনুচ্ছেদের বাক্যগুলোর তলে দীর্ঘ রেখা টানার একটি তাড়না সৃষ্টি করেছে আমার মাঝে— কখনো কখনো মন্তব্যের ছলে নিজের আবেগ ঢেলে দিয়েছি বইয়ের পাতার ইষৎ হলদেটে আঁচলে, যাকে সবাই মার্জিন বলে। কিন্তু একজন পেশাদার পাঠকের হাত থেকে পাঠ্যের কোনো নিস্তার নেই; তাই, একটি বই এবং একজন পাঠকের ঐ একান্ত মুহুর্তগুলোতে যে উপলব্ধিটি সবথেকে বিব্রতকর হতে পারে, অন্তত পাঠকের জন্য, তা প্রশ্নের সুরৎ নিয়ে হাজির হলো: বুদ্ধদেব বইটি কেবল পড়ার জন্য লিখেছেন, পাঠ করার জন্য নয়; তবে এই লেখাগুলোতে একজন পাঠক কি পাঠ করবে? প্রত্যেক প্রবন্ধান্তে বাঁকা ছাঁদে মুদ্রিত যে রচনাকাল বুদ্ধদেব দিয়ে রেখেছেন৪, একজন পেশাদার পাঠকের নজর তা কখনোই এড়াবে না। আমরা কল্পনা করতে চাই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এবং এর শুরুর কিছু আগের দুঃসহ দিনগুলোতে বুদ্ধদেব বসুর মত একজন স্বঘোষিত ‘রাজনীতি বিমুখ’ কবি ও কথাসাহিত্যিককে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছিল, লেখার কলম ও কাগজের থেকে রাজনীতিকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে। হয়তো এই সচেতন দমনের প্রতিক্রিয়ায় সমকালীন রাজনীতি একেবারে বিস্ফোরক হয়ে ফের তাঁর কবিতা, গল্প-উপন্যাসের উপরিতলে ভেসে ওঠে নি, কিন্তু স্ফুলিঙ্গের বেশে তা ঠিক-ই তাঁর ঐ সময়কার লেখা প্রবন্ধগুলোতে হাজির হয়েছিল— আমরা তাঁকে আবিষ্কার করি, জীবনের দৈনন্দিন বিষয়-আশয়ের মধ্যেও সমকালীন রাজনীতির সুক্ষ্ম প্রভাব নিয়ে শ্লেষমাখা মন্তব্য করতে। এভাবে বিবেচনা করলে উত্তরতিরিশ’র প্রবন্ধগুলোকে মোটাদাগে দু’ভাগে ফেলে দেয়া যায়—
এক. যে প্রবন্ধগুলোতে সমকালীন রাজনীতির প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ফুটে আছে,⸻ সমকালীন রাজনীতি কেবল মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো সংকীর্ণ অর্থে নয়, এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত সেসময়কার শিল্প-সাহিত্য-ফ্যাশন যেভাবে আধুনিকতা দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছিল, যান্ত্রিক যুগ যেভাবে তখন কলকাতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল— আর বুদ্ধদেবে’র প্রকৃতিলালিত প্রাণের তাতে সাময়িক হাঁসফাঁস, কিংবা একটি প্রজন্মের সাথে আরেকটি প্রজন্মের মিথস্ক্রিয়া যেভাবে বিবর্তিত হচ্ছিল— এমন সব-ই; সংজ্ঞার এত বৃহৎ পরিসরে বইটি’র সিংহভাগ প্রবন্ধ-ই ধ’রে যায়— সে-সবের ক্লান্তিকর দীর্ঘ একটি তালিকা: ‘এ যুগের কবিতা’ ও ‘ব্লাক-আউট’-এ আমরা কাব্য ও কলকাতাজীবনে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রভাব নিয়ে কখনো তত্ত্বনির্মাণ, কখনো সমালোচনায় নামতে দেখি— ‘নব বসন্ত’, ‘ছোট রাস্তায় বড় ফ্লাট’ ও ‘জিনিস’-এ তৎকালীন মহাযুদ্ধ-উদ্ভুত মন্বন্তরে’র রূঢ় রূপ দেখি— কি মধ্যবিত্ত জীবনে, কি নিম্নবিত্ত জীবনে— ‘সবচেয়ে দুঃখের দু ঘণ্টা’, ‘মাত্রাজ্ঞান ও অতিরঞ্জন’, ‘স্পোর্টস-এর বিরুদ্ধে’ ও ‘মেক-আপ-এর বিপক্ষে’-এ আমরা বাঙালি মূল্যবোধ ও কেতাকে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় আক্রান্ত হতে দেখে সখেদ এক বুদ্ধদেবকে দেখি— ‘খাকি’-তে দেখি রঙের রাজনীতি— ‘ডাকঘর’-এ শহর আর গ্রামীণ দালান-কাঠামোর মনস্তাত্ত্বিক আবেদন— ‘নোয়াখালি’-তে তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিত— ‘উত্তরতিরিশ’-এ যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের মধ্যকার রাজনীতি; যদিও আপাতদৃষ্টিতে জীবৎকালে প্রকাশিত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু’র আগা-গোঁড়া ঘেটে আমাদের মারাত্মক কসরৎ করা লাগে তৎকালীন প্রচলিত অর্থে একজন রাজনীতি-সচেতন লেখকের প্রতিচ্ছবি তৈরিতে, কি গল্প-উপন্যাস, কি কবিতা, কি সমালোচনা সেখানে তাঁর সময়ের রাজনীতির ছায়া খুবই ম্লান, অথচ ‘আমার যৌবনে’ আমরা তাঁকে আবিষ্কার করি ’৪২-এর মার্চে “ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে” যোগ দিতে ঢাকার কম্যুনিস্ট কর্মী তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ হত্যার প্রতিবাদে; সমান্তরালে তিনি কবিতা’য় সম্পাদকীয় লিখছেন এ নিয়ে, ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ নামক প্রবন্ধ লিখছেন, যা তাঁর জীবৎকালে কখনো কোনো গ্রন্থভুক্ত করবেন না, যে প্রবন্ধের পয়লা বাক্যেই তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন, “রাজনীতি আমার জীবনে কখনো আলোচ্য বিষয় ছিল না। … রাজনীতির কোলাহল কখনো ভাল ক’রে আমার কানে পৌঁছয় নি।”৫
এবং তারপর তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ সমালোচনা করে যাবেন, পরবর্তীতে পরিচয় পত্রিকায় যেটাকে বাক্য ধরে ধরে আক্রমণ করে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখবেন “বড় একখানা খোলা চিঠি”৬— যা-কে পরবর্তীতে উত্তরতিরিশ (১৯৪২) প্রবন্ধে আপনার প্রৌঢ়ত্বের অভিজ্ঞানরূপে বরণ করে নেবেন;
দুই. যে প্রবন্ধগুলোতে সমকালীন রাজনীতির প্রভাবটা একেবারে বিমূর্ত রূপ নিয়েছে— প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রবন্ধের নাম নেয়া এখনো বাকি আছে— কিন্তু তাদের নাম নিয়ে বাক্যটি অহেতুক আরো দীর্ঘায়িত করা-টা সম্ভবত ক্ষুদ্রবাক্যপ্রেমীদের সাথে বেআইনী রকমের মস্করা হবে। সমকালীন রাজনীতির ছায়ার বাইরেও প্রবন্ধগুলোর মাঝে একটি সত্ত্বা সবসময়-ই স্পষ্টরূপে মূর্ত। আত্মজীবনী আর ভ্রমণবিবরণীর বাইরে, এই প্রবন্ধগুলোতেও স্বয়ং ব্যক্তি বুদ্ধদেবে’র উপস্থিতি যেভাবে বিরাজমান, সেভাবে তাঁকে আমরা ‘কবি রবীন্দ্রনাথে’র কথাসাহিত্য পর্যায়ের শুরুর দিকের সমালোচনাগুলোতে হয়তো আবছারূপে দেখি (কারণ তারা বুদ্ধদেবে’র একই সময়ের রচনা), কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো প্রবন্ধসংকলনে পাই না। এমন নয় যে, এ জাতীয় রচনা বুদ্ধদেব পরবর্তীতে আর কখনো লিখবেন না; তারপরও, ও লেখাগুলো মলাটবন্দি হয়ে কেন বের হয় নি— এর সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে বিস্তর একটা গল্প হয়তো লিখে ফেলা যাবে; কিন্তু বর্তমান লেখাটির পরবর্তী অংশের গতান্তর সেদিকে না করে, যে প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, তা হল: উত্তরতিরিশর প্রবন্ধগুলো এক মলাটের মাঝে গ্রথিত কেন হতে পেরেছিল?
উত্তরতিরিশ নিয়ে কিছু লিখতে গেলে অবধারিতভাবেই এর পূর্বে প্রকাশিত বুদ্ধদেবে’র একমাত্র প্রবন্ধ সংকলন হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র প্রসঙ্গ চলে আসে, যার গদ্যপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, “এর স্বচ্ছন্দ গতি মুক্তছন্দ গদ্যের প্রকৃষ্ট নমুনা। এর ভিতর বন্যা নেই, স্রোত আছে, কিন্তু সে স্রোত মনকে টেনে নিয়ে যায়। বুদ্ধদেবের ভাষার স্পষ্ট গুণ তাঁর গতি ও প্রাণ।”৭
কিন্তু হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র টুকরো গুলো বুদ্ধদেব যখন লিখছেন, তখন তিনি সবেমাত্র কলকাতায় পা রেখেছেন, পেশা বলতে গৃহশিক্ষকতা আর পত্রিকায় ছুটো-ছাটা লেখা, এবং পাশাপাশি একটি স্থায়ী কোনো চাকরী খুঁজছেন, ইন্টারভ্যু দিচ্ছেন; জীবনে কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা এবং স্থিতি নেই— এই ঝঞ্চার আভাস আমরা প্রায়ই পাই হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র প্রবন্ধগুলোর গদ্যে। অথচ যখন উত্তরতিরিশ’র প্রবন্ধগুলোর মাঝে প্রথম ‘কথা ও কথক’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭-এ, তখন বুদ্ধদেব বসু’র রিপন কলেজে’র অধ্যাপনা জীবনের বয়স সবে তিন বছর হয়েছে, যে জীবন নিয়ে তিনি বার্ধক্যে মন্তব্য করবেন, “আমার আয়ুর অনুপাতে আমি অল্পকালই চাকরী করেছি, সবচেয়ে লম্বা মেয়াদে রিপন কলেজে;”৮ এবং এ-বছরই উঠবেন সেই বিখ্যাত ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিন্যু’র বাড়িটিতে৯— বলার অপেক্ষা থাকে না, তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘতম স্থিতিশীল সময়ে প্রবেশ করে ফেলেছেন। হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র গদ্যের পাশে উত্তরতিরিশ’র গদ্যকে রাখলে পাঠক হিসেবে আমরা তা-র মাঝে তাঁর জীবনের তৎকালীন স্থিতি এবং নিশ্চয়তার ছায়াটুকু লক্ষ্য না ক’রে পারি না— লেখাগুলোর অন্তর্নিহিত দর্শনে, এমন কি শব্দচয়নেও— একটা শান্ত-সংহত গতি, আরো অভিজ্ঞ স্থিতধী একটি প্রাণ। হয়তো এর আরো একটি হেতু আছে: বুদ্ধদেব তখন উত্তরতিরিশে প্রবেশ করেছেন— উদযাপন করছেন নিজের প্রৌঢ়ত্বকে, শিখছেন বৃদ্ধের বিদ্যা, দেখছেন একদল পূর্বত্রিশি যুবককে একি পথে হাঁটতে— যার প্রতিফলন উত্তরতিরিশের প্রবন্ধগুলোর রচনাকালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত দয়মন্তী কবিতায় আমরা পাই। হয়তো এই কারণে প্রবন্ধগুলো একই মলাট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। এটুকু নিশ্চিত, সমগ্র উত্তরতিরিশ জুড়ে আমরা কেবল দয়মন্তী কবিতার ঐ শ্লোকে’র বুদ্ধদেবকে-ই পাঠ করতে চাই; কিন্তু সে-ই পাঠের তরিকা কি হবে?
তথ্যসূত্র:
১. বসু, বুদ্ধদেব; উত্তরতিরিশ(১৯৪২), উত্তরতিরিশ, ১৯৪৫।
২. চৌধুরী, প্রমথ; দুখানি বই: হঠাৎ আলোর ঝলকানি, বিচিত্রা ৯:১:৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪২, পৃ ৬৪৩-৪৪।
৩. বসু, বুদ্ধদেব; রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যসাহিত্য(১৯৬১), সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা, রবীন্দ্রনাথ, ১৯৬৩ ।
৪. একমাত্র ‘ডাকঘর’ প্রবন্ধটির রচনাকাল দেয়া নেই।
৫. বসু, বুদ্ধদেব; সভ্যতা ও ফ্যাসিজম (১৯৪২), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০০৯, সম্পা: বিশ্বজিৎ ঘোষ), বর্ণায়ন।
৬. শঙ্খ ঘোষ, লেখা যখন হয় না (২০১৯), পত্রভারতী।
৭. চৌধুরী, প্রমথ; দুখানি বই: হঠাৎ আলোর ঝলকানি, বিচিত্রা ৯:১:৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪২, পৃ ৬৪৩-৪৪।
৮. বসু, বুদ্ধদেব; ৭, আমাদের কবিতাভবন, ১৯৭৩।
৯. বসু, বুদ্ধদেব; ৩৭, আমার যৌবন, ১৯৭৩।