মজলিশের গদ্য || হৃদয়ের কথামালা : ফাহাদ বিন আজাদ সিদ্দিকী

0
হৃদয় বা অন্তর; আরবীতে ‘কলব’ আর ইংরেজিতে বলা হয় ‘হার্ট’। আমি আমার লেখায় এ ‘কলব’কে কখনো ‘অন্তর’ বলবো বা কখনো বলবো ‘হৃদয়’ অথবা ‘কলব’কে ‘কলব’-ই বলে উল্লেখ করবো। যাই হোক, —এটি মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। শুধু অংশ বললে যথার্থ হবে না; বলতে হবে হৃদয়-ই মূলত পুরো দেহের অস্তিত্বের ভরসা।

 

অন্তর বা হৃদয় হলো বাদশাহ। অন্তর বিশুদ্ধ আছে তো ব্যক্তির সমস্ত কর্ম বিশুদ্ধ। রাহমাতুল্লিল আলামীন সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস থেকে এই কলবের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তিনি ইরশাদ করেছেন: “মনোযোগ দিয়ে শোনো, নিশ্চয় শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে। যখন এটি ঠিক থাকে তখন পুরো শরীর ঠিক থাকে। আর যখন এটি বিশৃঙ্খল হয়ে যায় তখন পুরো শরীর বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। শুনে রাখো, সেটি হলো কলব।” (বুখারী : ১/১৩, মুসলিম : ২/৮২)
“কলব এর অবস্থান বুকের বাম পাশে। এটা মানুষের নেককর্মকে আলোকিত করে। কলব সেই নূরানী ঐশী লতিফাকেও বলা হয় যেটি খোদায়ী নূরের অবতরণস্থল। এই নূরানী বস্তু দ্বারাই মানুষ মানুষরূপে গড়ে উঠে। এটির মাধ্যমেই মানুষ রাব্বুল আলামীনের আদেশ যথাযথ পালন করে এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞা হতে বিরত থাকতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।” (রুহুল মায়ানী : ১/১৩৬)
আমাদের শরীরে যখন কোনো রোগ-ব্যধি দেখা দেয় তখন আমরা একদম দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে যাই। পেরেশান হয়ে যাই৷ অন্তরেরও কিছু রোগ-ব্যধি আছে। অন্তরের এ রোগগুলোর প্রতি আমাদের কোনো মনোযোগ নেই বললেই চলে। লৌকিকতা হলো অন্তরের রোগ। অহংকারও অন্তরের রোগ। অন্তরের আরো রোগ আছে, যেমন— লোভ, হিংসা, কৃপণতা, কপটতা, বিদ্বেষ— এভাবে অসংখ্য। অন্তর যখন পরিবর্তন হয়ে যায় তখন তার মানুষটিও পরিবর্তন হয়ে যায়৷ তার জীবন পাল্টে যায়৷ জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে যায়৷ পরিবর্তন হয়ে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গি। ভালোবাসা ও শত্রুতার ধরণ পাল্টে যায়। পরিশ্রম ও সাধনায় পরিবর্তন ঘটে। আবাস বদলে যায়৷ জীবনযাপন বদলে যায়৷ সময়কাল পাল্টে যায়৷ বদলে যায় ইতিহাস। রাত-দিন বদলে যায়। বদলে যায় সবকিছুই।
আমরা আমাদের ঘরকে খুব পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করি। ঘরে কোথাও বিন্দু পরিমাণ অপরিচ্ছন্নতা দৃষ্টিগোচর হলে গৃহকর্তার ডাক পড়ে। নিজের ঘরের প্রতি এত মনোযোগীদের একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি— বান্দার অন্তরটাও আল্লাহ তায়ালা’র ঘর৷ এ ঘরটাতেও পরিচ্ছন্নতা আসা প্রয়োজন। এ ঘরে গুনাহের যে ময়লা পড়ে আছে তা পরিষ্কার করা আবশ্যক-অত্যাবশ্যক।

 

শত আফসোস… আমরা এই খোদায়ী ঘরটাকে চরম অবহেলা-অমনোযোগিতায় ফেলে রেখেছি। এটা রাব্বুল ইজ্জতের ঘর৷ তিনিও তো চান এ ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় পরিপাটি থাকুক। যখন কলব পরিষ্কার হয়ে যাবে তখন আল্লাহ’র রহমত স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অবতীর্ণ হতে থাকবে। অন্যথায় আবর্জনায় পড়ে থাকুক হৃদয়। আবর্জনাময় হয়ে যাক গোটা জীবন। মানুষের যতগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে সব এ অন্তরেরই অনুসারী। হৃদয় সংশোধনে মানুষ সংশোধিত হয়৷ আর হৃদয় ভাঙনে মানুষও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এ হৃদয়টাকে মূল্যবান বানাতে হয়। সাধনার প্রয়োজন হৃদয়কে মূল্যবান বানাতে। এটাকে সংশোধন করতে হয়৷ গড়ে তুলতে হয়। সমস্ত কুপ্রবৃত্তিকে বের করে দিতে হয় হৃদয় থেকে। এ অন্তর-ঘরটা ভাঙা খুবই সহজ। ঘরের ভিতর ভেন্টিলেটর থাকে ; যখন এটা খোলা থাকে তখন সব কামরা ধুলো-ময়লায় মলিন হয়ে যায়৷ ঠিক তেমনি চোখ, কান ইত্যাদি ভেন্টিলেটরগুলো যখন খোলা থাকে তখন হৃদয়-ঘরের কামরাসমূহে ধুলো-ময়লা জমে অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর আমরা তো হৃদয়ের এ ভেন্টিলেটরগুলো বন্ধ-ই করি না। চোখ-কান বন্ধ রাখা মানে চোখকে অন্ধ বানিয়ে ফেলা কিংবা কানকে বধির বানিয়ে ফেলা নয়। প্রকৃত অর্থ হলো—চোখ-কানসহ প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হারাম থেকে দূরে রাখা।
আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না