সায়েন্স ফিকশনের গোড়াতে মুসলিমদের কৃতিত্ব

0

 

বিশাল এক ডাইনির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পের মতোই ভয়ঙ্কর। চেহারা দেখে ভয়ে শরীর কাঁপছে ,সেই সঙ্গে মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন জড়ো হচ্ছে। এই শহরের নিয়ম হলো নারীদের কোনো ভুল নজরে এলেই তাদের ডাইনি বলে আখ্যা দেওয়া আর শাস্তিস্বরূপ শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। নিজের চোখের সামনে এই অন্যায় দেখে বহুবার প্রতিবাদ করতে চেয়েও নিরুপায় হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু আজ স্বচক্ষে যা দেখছি তাতে প্রথমবার মায়ের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলো। সত্যি কি তাহলে প্রেতাত্মা বা ডাইনি আছে আর মায়ের সাথে কি এদের  কোনো সম্পর্ক আছে? কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঔষধের থলে নিয়ে মা হাজির হলেন, আমায় দেখে দ্রুত বাইরে নিয়ে এলেন…

যারা কমবেশি কল্পবিজ্ঞান বা সায়েস্ন ফিকশন পড়েন তারা গল্পটির সঙ্গে কেপলারের ‘সম্নিয়াম’  লেখার কিছুটা মিল খুজে পাবেন। সম্নিয়াম, যার অর্থ কল্পনা। কেপলার এতে চন্দ্র অভিজানের কল্পনা করেন। এখানে নায়কের বাবা-মায়ের সঙ্গে আত্মা-প্রেত্মাদের যোগাযোগ ছিলো এবং পরবর্তীতে নায়ক তাদের কাছ থেকে মহাকাশ ভ্রমণের কৌশল আয়ত্ত করে নেয়। কিন্তু এই লেখাই তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেপলারের মা ঔষধ ও বিভিন্ন পথ্য বিক্রি করতেন। এই সুযোগে কেপলারের বিরোধিরা বইটিকে তারই মায়ের ডাইনি হওয়ার প্রমাণ হিসেবে দায়ের করে এবং শাস্তিস্বরূপ তার মাকে অন্ধ কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। সেই সময় ধর্মযুদ্ধের কারণে কেপলারে সায়েন্স ফিকশন তার জন্যেই বিপদ ডেকে আনে। বিজ্ঞানী হিসেবে কেপলার তার কাজের মাধ্যমে নিজের মাকে বাঁচানোর সাথে সাথে সমাজকে কুসংস্কার হতে বের করে আনেন। সাধারণত একেই কল্পবিজ্ঞানের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু কেপলারের বহু বছর আগে থেকেই মুসলিম বিশ্বে সায়েন্স ফিকশনের চর্চা হয়ে আসছে।

শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে, ইসলামি ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের স্বর্ণযুগটিকে ইসলামি সায়েন্স ফিকশনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। পশ্চিমাদের একচেটিয়া অধিকার, একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি আর ইসলাম সম্পর্কিত সঙ্কীর্ণ  মনোভাবের দরুন আজও এসব লেখার বেশিরভাগ পশ্চিমা সাহিত্যে অপরচিত।

সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান বলতেই আমরা সাধারণত ভিনগ্রহের প্রাণী, ভবিষ্যতে যাওয়া বা রোবট ইত্যাদি বুঝি। যেখানে বিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজ, সময় সব মিশে আমাদের সাধ্যের অধিক কল্পনা করতে শেখায়, আর সেই কল্পনায় ইসলামের বিভিন্ন মুজেজা মুসলিম সাহিত্যিকদের রসদ যুগিয়ে এসেছে। ফলে সায়েন্স ফিকশন শুধু ভীনগ্রহী প্রাণী বা সময় ভ্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে স্বতন্ত্ররূপ ধারণ করেছে। এছাড়া কোরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন মোজেজা মুসলিম লেখকদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যদিও অনেকে সায়েন্স ফিকশনকে পাশ্চাত্য সাহিত্য বা আজগুবি কল্পনা বলে অভিহিত করেন। অবশ্য তা আরবি গল্পের বেশি অনুবাদ না হওয়ার কারণে এই ধারণার জন্ম হয়েছে বলে মনে করেন সায়েন্স ফিকশন সংশ্লিষ্টরা।

মেরি শেলীর ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’ বইটিকে প্রথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন বলা হলেও ‘এ ট্রু হিস্টোরি’ যা একজন সিরিয়ান লেখক দ্বিতীয় শতকে চাঁদে ভ্রমণ নিয়ে কল্পকাহিনী লেখেন এবং এটি মেরি শেলীর বহু শতাব্দী পূর্বেই রচিত হয়েছে। নবম শতকে আল ফারাবির লিখিত ‘মাবাদিয়ুল আহল আল মাদিনাতুল ফাদ্বিলাহ’ বইটি অন্যতম। এছাড়াও ‘আল রিসালাহ আল কামিল ফি সিরাতিল নবি গ্রন্থটি প্রাথমিক কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম একটি উদাহরণ। বারশ শতকে রচিত  ইবনে নাফিসের এই উপন্যাসটিতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সত্যকে কল্পনা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়া এটি প্রাথমিক দর্শন সাহিত্যেরও অন্যতম নজির। একই উপন্যাসের মধ্যে তিনি বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক মতবাদ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন যা সেই যুগের অনন্য সৃষ্টি। মুসলিম সমাজের মধ্যে সুন্নিয়তের ধারা ও নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই ছিলো তার প্রধান উদ্দেশ্য। উপন্যাসটিতে কামিল নামক এতিম কিশোরের মরুদ্বীপ হতে সভ্য দুনিয়ায় আসা এবং সেখানে এসে স্বশিক্ষিত হয়ে নিজের যুক্তিবোধ দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয় উন্মোচন নিয়ে বর্ণনা করা হয়। কিয়ামতের বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কল্পনার আশ্রয় নিয়ে তিনি রচনাটিকে যে পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন তা কল্পবিজ্ঞানের প্রাথমিক উদাহরণে পরিণত হয়েছে।

তবে, এসব নিয়ে পর্যালোচনার অভাব ও ভাবধারার অপরিবর্তনের ফলে ইসলামি সায়েন্স ফিকশন এখনো স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই রচনাবলির উপর ভিত্তি করেই পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিখ্যাত চরিত্র ও রচনার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বহু বছর ধরে এই বৈশিষ্টগুলোই সকল ধারার লেখকদের রসদ যুগিয়েছে। বলা যেতে পারে ইসলামিক আদর্শের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও ধর্মকে রক্ষার এক অন্যতম মাধ্যমই হলো সায়েন্স ফিকশন। তবুও বর্তমানে মুসলিম সমাজের দুর্দশা সত্ত্বেও এই মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে বহু লেখক লিখে চলেছেন তার স্বপ্নের গল্প।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না