মহান স্রষ্টার আঠার হাজার মাখলুকাতের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির নাম মানুষ। নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নিজের মান অক্ষুণ্ণ রাখতে শ্রেষ্ঠ গুণাবলী মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ জীবের তথা আমাদের মাঝে থাকা অবশ্যক। কেননা রাহমানুর রাহিম প্রভু মানুষের কল্যাণের জন্যই বাকি সব সৃষ্টিকে তৈরি করেছেন। আর মনুষ্য জাতীকে সৃষ্টি করেছেন কেবল আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এঁর ইবাদতের জন্য।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সমানুপাতিক হারেই বেড়েই চলেছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়। মেকি আচরণতো আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা ‘লোকদেখানো’ রীতি দিয়ে জীবনকে ভরপুর করে তুলেছি। লোকদেখানো সালাত, লোকদেখানো হজ্ব, লোকদেখানো সদকাহ, লোকদেখানো সততা, লোকদেখানো সৎকর্ম, লোকদেখানো সত্যের বাণী, লোকদেখানো ভালো মানুষী- সকাল-দুপুর, সন্ধ্যা-সাঁঝে আমাদের শিরা-উপশিরায় মিশে গেছে এই ‘লোকদেখানো’।
যে কোন মূল্যেই সমাজে ভালো সেজে থাকতেই হবে, যে কোন মূল্যেই ফেরেস্তার ভান করতেই হবে! এতো এতো পাপ করার পরেও নিজেকে পূর্ণ ঈমানদারের সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে পারার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে অদ্ভূত স্বর্গীয় প্রশান্তি। এরা যেন ভুলেই যায় যে, একদিন কেয়ামত হবে, একদিন তাদেরকে এইসব কিছুর জন্য জবাব দিতেই হবে। এটা মূলত কেয়ামতকে অস্বীকার করার নামান্তর। নৈতিকতাহীনতার পেছনে যেসব কারণগুলো জোড়ালো ভূমিকা রাখে, তার মধ্য হতে কতিপয় বিষয় আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়াতায়ালা কুরআনুল কারিমের সুরা আল-মাউনে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
পরকালে অস্বীকারকারী
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে অস্বীকার করে?” যে কাজে জবাবদিহিতা যত বেশি, সেই কাজে ভুল করার পরিমাণ ততই কম। কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, এই জীবনে ৫০-৬০ বছর শেষ করার পর এমন এক জীবনের দিকে ফিরে যেতে হবে, যা অনন্ত। সেখানে ভালো কিছু পেতে হলে এখানেই ভালো কিছু করতে হবে, তখন সে ওই পরকালের ভয়ে অথবা উত্তম কিছু পাওয়ার লোভে হলেও সমাজে মন্দ কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।
দুর্বলের প্রতি নিষ্ঠুর
তারা একইভাবে মিসকিনদের প্রতিও সদয় হয় না, এক বেলা খাবার অসহায় নিঃস্বদের দিতে গেলে যার সমস্ত ব্যাংক ব্যালেন্স শূণ্যের কোটায় নেমে যায় আবার আড্ডার মঞ্চে তাদের দানশীলতার ঝংকার হৃদয়ে কম্পন ধরিয়ে দেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন, “সে তো সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়।”
বড় নামাজী
যে মানুষটা সুদকে একমাত্র লাভজনক ব্যবসা হিসেবে নিয়ে নিঃস্বকে আরো সম্বলহীন ফকির বানায়, হালাল রুজির নিয়ামতকে ভুলে হারামের মাঝে আরাম খুঁজে পায়, যারা সরকারী চাকরি নামক সোনার হরিণটাকে ধরতে পারলেই সেখানে দূর্নীতির বাজার জমায়, এরকম অনেক ব্যক্তিই নিজেদের নামাজী, মুত্তাকী সাজাতে মসজিদের প্রথম কাতারে সালাত আদায় করে থাকে। এমনকি তারা মসজিদও নিয়ন্ত্রণে রাখার পায়তারা করে, তাদের ব্যাপার স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিনের ফতোয়া হচ্ছে, “অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজীর”; “যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে অমনোযোগী”; “যারা তা (নামাজ) লোক-দেখানোর জন্য (আদায়) করে”। (সূরা মাঊন দ্রষ্টব্য)
কৃপণ ব্যক্তি
সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটা অত্যন্ত জরুরী যে, স্বচ্ছল পরিবারের পক্ষ থেকে অস্বচ্ছলদের সাহায্য করতে হবে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় এদের দেখভালের দায়িত্বটা আপনা-আপনি চলে যায়, সমাজের বিত্তবানদের ওপর। এখন অবস্থা তো এমন যে, নিজ থেকে গরিবদের খবর নিয়ে তাদের সাহায্য করার দায়িত্বটুকু তো পালন করে না, আবার যখন কেউ ঘরের দুয়ারে চলে আসে তখনো নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে কোনো ভাবনাই রাখে না। আবার অনেকে দিলেও কত ধরনের উচ্চবাচ্য যে করে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এদের ব্যাপারেই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন, “এবং প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (সুরা আল-মাউন, ১-৭ )
বর্ণিত পবিত্র সূরাটি আমাদের সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে। আমরা আজ সৌজন্যচর্চিত মানুষের রূপান্তর হয়েছি। সৌজন্যমূলক আচরণকে নৈমিত্তিক করে এর প্রবাহ বাড়াচ্ছি। সমাজকে চালিত করতে গিয়ে সমাজব্যবস্থার নৈতিকতা লোপ করছি। বস্তুত হৃদয় দিয়ে সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ঠিক করে সার্বিক নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা রং হারাচ্ছি। আমরা মানুষ হয়ে মনুষ্যজাতির জন্য কিছু করতে রাজি নয়। আমরা সমাজের প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসেছি। আমরা ‘লোকদেখানো’ ভালো মানুষ সাজতে কত রকমের যে বাহানা করি তা ড্রামা সিরিয়াল আকারে প্রকাশযোগ্য। কিন্তু বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত রাসূল (দ.) কত অপরূপ মানবিক মানুষ হতে শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের। একদা হযরত আবু জরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে আবু জর! তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করিও।” (মুসলিম, হাদিস : ২৬২৫)
সমাজব্যবস্থাকে সুন্দর ও মজবুত ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক নবী মোস্তাফা (দ.) ঘোষনা করেন, “এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের হক্ব ৬টি; যখন সে সালাম দেয় তার উত্তর দিবে। যখন সে অসুস্থ থাকে তাকে দেখতে যাবে। যখন সে হাঁচি দেয় তখন ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবে। যখন সে দাওয়াত করে তা গ্রহণ করবে। যা নিজের জন্য পছন্দ করে তা তার দ্বীনি ভাইয়ের জন্য পছন্দ করবে, আর যা সে নিজে অপছন্দ করে তা তার দ্বীনি ভাইয়ের জন্যও অপছন্দ করবে। সে মারা গেলে জানাজায় অংশগ্রহণ করবে।” (মুসলিম শরীফ : ২১৬২) সাহাবীগণকে উদ্দেশ্যে করে হুজুর পূরনুর (দ.) ইরশাদ করছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীকে সম্মান করে।” (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮) অন্যত্র বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে।” (মুসলিম, হাদিস: ১৮৫)
এমনকি নারীরাও যে সমাজে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থা ও নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে সেই দিকটা খুবই সুক্ষ্মভাবে উঠে এসে একটি হাদিসে, “হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে সংকোচবোধ না করে। যদিও তা বকরির খুরের মতো নগণ্য বস্তুও হয়।” (বুখারি, হাদিস : ৬০১৭)
সমাজের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা যদি ইসলামের সুমহান জীবনাচরণকে পরিপূর্ণ গ্রহণ করে সুন্দর জীবন অতিবাহিত করেন এবং সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যাহিক কুরআন-সুন্নাহ’র আমলগুলো চর্চা করেন, তবে এই সমাজের রূপ বদলে যাবে। শিশুরা পাবে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার উপাদেয়, কিশোররা পাবে সত্যের দিশা, যুবকরা পাবে ন্যায়ের মশাল আর প্রবীণরা পাবেন সুখের অবকাশ!
আল্লাহ পাক রাব্বু্ল আ’লামিন যেন তাঁন প্রিয় হাবীব (দ.) এঁর সদকায় আমাদের সমাজ সংস্কৃতিকে নৈতিক অধঃপতন হতে রক্ষা করেন এবং আমাদের যেন আখলাকে হাসানাহ দান করেন, আমিন।