এজরা পাউন্ডের কবিতা

0

 

এজরা পাউন্ড কবি, সমালোচক, সম্পাদক, অনুবাদক হিসেবে বিশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিক কবিতার সূচনা যে কয়জন কবির হাতে তাদের মধ্যে এজরা পাউন্ড অন্যতম। ‘চিত্রকল্পবাদ’ বা ‘Imagism’- ধারণার প্রবক্তা হিশেবে সুপরিচিত এজরা পাউন্ড ছিলেন সে সময়কার অনেক কবি লেখকদেরই গুরুস্থানীয়।

ইংরেজ বংশোদ্ভূত আমেরিকান এই কবি, জন্মেছেন ১৮৮৫ সালের ৩০ অক্টোবর। শৈশব থেকেই কবিতার প্রতি তার আগ্রহ। আমৃত্যু কবিতার প্রতি তার আকর্ষণ রয়ে গেছে।

তাঁর সময়ে ইংরাজি ও আমেরিকান সাহিত্যের আধুনিকতা, সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অ-পশ্চিমী এবং প্রাচীন সংস্কৃতির নানাদিককে কবিতায় নিয়ে আসা এবং প্রথা-জাড্যকে নির্মমভাবে অস্বীকার করার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তিনিই। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন সমালোচনা ও কবিতা বিষয়ক গদ্যও। করেছেন বিস্তর অনুবাদও। প্রাচীন চৈনিক কবিতাকে তিনি পশ্চিমা সাহিত্যজগতের সামনে নতুনভাবে তুলে ধরেন। একজন সমালোচক ও সম্পাদক হিসেবে পাউন্ড এমন অনেককে আবিষ্কার করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন, যাদের অনেককেই বিশ্বসাহিত্যের একেকজন দিকপাল হিসেবে আজ আমরা জানি। এদের মাঝে জেমস জয়েস, টি.এস.এলিয়ট, রবার্ট ফ্রস্ট ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ে উল্লেখযোগ্য। একজন প্রাবন্ধিক হিসেবে আমরা তাঁর কাছ থেকে কবিতার আঙ্গিক, শৈলী ও বিষয় নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান মন্তব্য পেয়েছি। পাউন্ডের সাহিত্যকর্মের কথা বলতে গেলে আলাদাভাবে কোনও কবিতাগ্রন্থের কথা উল্লেখ করা মুশকিল, বরং তাঁর সমগ্র কাব্যকীর্তিকেই অখণ্ড এক অভিযান হিশেবে বিবেচনা করা যায়। এমনকি তাঁর অনুবাদ কবিতাগুলিকেও মৌলিক সাহিত্যের মর্যাদা দিতে কারও কুণ্ঠাবোধ হবার কথা নয়। গদ্যগ্রন্থ ABC of reading  কবি ও কবিতাপ্রেমী পাঠকদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য একটা বই।

 

পাউন্ড ছিলেন নিরীক্ষাধর্মী কবি, সাহিত্যজীবনের পুরো সময়টাই কবিতার বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। তাঁর ছোট ছোট কবিতাগুলো থেকে মাস্টারপিস বলে খ্যাত ‘ক্যান্টোস’ পর্যন্ত তাঁর নিরীক্ষা কখনও থেমে থাকেনি এবং এক্ষেত্রে তার সাফল্য ও সার্থকতা বিশ্ববিদিত। আর এর ফলস্বরূপ তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থই আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়।

পাউন্ডের কবিতা পরবর্তী অনেক কবিকেই প্রভাবিত করেছে। এ প্রসঙ্গে টি এস এলিয়টের মন্তব্য— “পাউন্ডের কবিতা কেবল যেমন ভাবা হয়—তার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণই নয়, বরং তা ধারাবাহিক উন্নতিরও চিহ্ন রেখেছে।”

জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ভ্রমণ করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং ফ্যাসিবাদের সমর্থক হয়ে উঠেন। ফ্যাসিবাদের সমর্থন ও ফ্যাসিবাদী প্রচারণার জন্যে ১৯৪৫ সালে ইতালিতে তিনি আমেরিকান সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। সামরিক কারাগারে বন্দি অবস্থায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় ওয়াশিংটনের সেন্ট এলিজাবেথ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে, সেখানে তার প্রায় বার বছর কেটে যায়। বিভিন্ন কবি-লেখকদের প্রতিবাদের মুখে আমেরিকান সরকার তাকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জীবনের শেষ বছরগুলো তিনি ইতালিতেই কাটিয়ে দেন। ১৯৭২ সালের পহেলা নভেম্বর পাউন্ড মৃত্যুবরণ করেন।

 

অনুবাদ প্রসঙ্গে পাউন্ড বলেছিলেন: “No translation has to reproduce all aspects of the original. It can choose to concentrate on only some aspects. It can leave part of the original out. It may even add to it or rearrange it in order to accomplish the translator’s purpose.”

অনুবাদ করার সময়ে আমি ওনার এই কথাগুলো মাথায় রেখেছি, জানি না আমার অনুবাদে এর কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছি। তবে আশা করি ওনার একটা আদেশ আমি যযথাযথভাবে পালন করতে পেরেছি, আর তা হল: “translations should be new poems…” আদৌ পেরেছি কিনা তা বিচার করবেন আপনারা।

 

ক. মেট্রো ষ্টেশন

ভিড়ের মাঝে ভেসে ওঠা মুখ,

যেন ঘন ভেজা ডালে মেলানো পাপড়ি।

 

খ. এবং এই দিনগুলো যথেষ্ট নয়

এবং এই দিনগুলো যথেষ্ট নয়,

এবং এই রাতগুলো যথেষ্ট নয়,

এবং ঘাস না নড়িয়ে ছুটে চলে ইঁদুরের মতো

পিছলে চলে জীবন।

 

গ. অভিবাদন

এই যে শোন,

আত্মতুষ্ট আর অসুখী প্রজন্ম,

আমি দেখেছি জেলেদের সূর্যালোকের চড়ুইভাতি,

দেখেছি তাদের দলানো সংসার

আর উচ্ছ্বাসে দাঁত বের করা মুখ,

শুনেছি তাদের অভব্য হাসি;

আমি তোমাদের চেয়ে  সুখি

এবং তারা আমার চেয়েও,

এবং আরও সুখি

হ্রদে সাঁতার কাটা মাছেরা

যাদের নিজস্ব কোনো বস্ত্র নেই।

 

ঘ. বালিকা

গাছ ঢুকে গেলো হাতে,

কাধে সপসপে ভেষজ রস,

স্তনের নিচে বেড়ে উঠছে বৃক্ষ,

বাহুর মতো ফুঁড়ে বেরুচ্ছে শাখা।

তুমি এক বৃক্ষ,

তুমি এক শ্যাওলা ঢাকা উদ্ভিত,

ঝড়ের ঝাপটা খাওয়া তুমি এক ভায়োলেট গাছ,

তুমি যেন একটি শিশু – এত উঁচু;

বাকি সবকিছু পৃথিবীর মূর্খতা।

 

ঙ. নর্তকী

কৃষ্ণচক্ষু রমণী,
ওগো – মোর স্বপ্নচারিণী,
হস্তিদন্তশোভাময় চর্চিত চন্দন,
অদ্বিতীয়া তুমি, তোমার মতো নেই কেউ,

নেই কেউ এত দ্রুতপদ।

তোমাকে পাইনি খুঁজে তাঁবুতে,
ছেঁড়া আধারের মাঝে,
তোমাকে পাইনি খুঁজে কুয়োতলায়
কলসি কাঁখে ঝুঁকে থাকা রমণীদের ভিড়ে।

পা ,  বাকলের নিচেকার ছোট চারাগাছ,
মুখ, এক আলোকিত নদী,

কাঁধ অপরূপ সফেদ কাজুবাদাম,
যেন নতুন খোসা ছাড়ানো বাদামের শাঁস।

তোমার প্রহরায় তামার ভোজালি হাতে খোঁজা নেই,
তোমার বিশ্রামাসনে সোনা মোড়ানো নীলকান্তমণি
আর  রূপোর মোড়ক,

স্বর্ণতন্তুর  নকশি-তোলা একটি বাদামি আভরণ

ছলকিয়ে তোলে তোমার শোভা;
হে নাতহাত ইকানাই, তুমি যেন নদী-তীরের মাছ।

তৃণ ভুমে বয়ে যাওয়া শাখা নদীর মতো
আমার শরীরে তোমার হাত,
প্রতিটি আঙ্গুল যেন হিমেল জমাট স্রোত!

আর যারা নিবেদন করে গান,

সেই কুমারী সখিগণ যেন ধবল পাথর;

অদ্বিতীয়া তুমি, তোমার মতো নেই কেউ,

নয় কেউ এত দ্রুতপদ।

 

চ. অমরত্ব

যদিও গেয়েছি গান আলস্য ও প্রেমে,

রিক্ততা ছিল সবচেয়ে ভালো,

যদিও ঘুরেছি অনেক প্রান্তরে

জীবনজুড়ে আছে শূন্যতার আলো।

দূরদেশে কত রাজ কাজ

চলে ফেরে মানুষের বিশ্বাসে চরে,

বরং আমি হবো আমার মিষ্টখনি

যদিও গোলাপের পাতা দুঃখেই মরে।

 

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না