ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি লিখেছেন মাহমুদ নূরুল হুদা

0

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পিছনে যুবলীগ নামক সংগঠনটির ভূমিকা সম্পর্কে পাঠকসমাজ অবহিত। বস্তুত যুবলীগের নেতা-কর্মীরাই এ আন্দোলনকে সফল করে তুলেছিলেন। ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার সময়ে আমাদের মেনিফেস্টোর অন্যতম পয়েন্ট ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্রভষারূপে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি। ভাষা আন্দোলন উক্ত দাবিরই এক বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। ৫২-র ফেব্রুয়ারি মাসের ঐ সময়গুলোতে যারা জীবনপণ করে মাতৃভাষার মর্যাদা আদায়ের জন্য লড়াই করেছিলেন, তাদের পরিচয় বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের মাপকাঠিতে চিহ্নিত করা যায় না। বস্তুত, যুবলীগ গঠনের সময়ে একত্রিত সর্বদলীয় জনতার যে সম্মেলন ঘটেছিলো, ভাষা আন্দোলনের সময়কার রাজনীতিক পরিবেশও ছিলো অনুরূপ। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট বা আওয়ামী লিগারগণ যেভাবে প্রাপ্যের অধিক কৃতিত্ব প্রচারে ব্যস্ত থেকেছেন, তা ভাষা আন্দোলনের মূল ইতিহাসকে অনেকাংশে বিকৃত করে।

ভাষা আন্দোলন কোনো দলীয় সংগঠনের কর্মসূচি ছিলো না, বরং বলা যায় তা ছিলো সর্বদলীয়। এমনকি, মুসলিম লীগেরও বহু তরুণ কর্মীকে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পুরোপুরি ইসলামপন্থি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস এবং তাদের পত্রিকা সৈনিক-ও ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো। পত্রিকার সঙ্গে জড়িত প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের ভূমিকাও ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এমনকি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক গোলাম আজমও ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেমন ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে প্রদত্ত সম্বর্ধনা সভায় গোলাম আজম পঠিত মানপত্রের এক জায়গায় “সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত” এমন কথা ছিলো। একথা শোনামাত্রই লিয়াকত আলী খান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং “Your address is full of provincialism.” বলে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেন।

 

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ঐ দিনগুলোতে রাজনীতিকভাবে আমি কিছুটা কোণঠাসা অবস্থায় থাকার জন্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আমার নাম কোথাও চোখে পড়ে না। তবে তৎকালীন সরকার আমাকে গুরুত্বহীন মনে করেননি। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে তখন ওয়ারেন্ট জারি ছিলো। তখন পিছনে থেকেই আমাকে আন্দোলনের কাজ করে যেতে হচ্ছিলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে পারি, ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলি চালনার ঘটনার পর সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে প্রথম যে সভা হয়, সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমি আন্দোলনের স্বার্থে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম এবং আমিই প্রথম সভার উদ্যোক্তাদের হাতে একশো টাকার একটি নোট চাঁদারূপে দান করেছিলাম। এই সভার সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান, যার হাতে আমি এ টাকা তুলে দিয়েছিলাম ।

একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর ছাত্রনেতা ও যুবলীগ নেতৃবৃন্দের ওপর কঠোর পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। আমার বাড়ির ওপর সার্বক্ষণিকভাবে গোয়েন্দারা নজর রাখতেন। বুঝতে পারলাম, যে কোনো সময়ে আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তখন এক সন্ধ্যাবেলা কোনো এক অজুহাতে আমার ১নং মৌলবীবাজারের বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ রিক্ত হাতে বের হয়ে পড়ি। প্রথমে গিয়ে উঠি নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে আমার পূর্বপরিচিত নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়িতে। খানসাহেব ছিলেন সে সময়ের রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক ও সত্যে আপোসহীন এক নিভীক ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৮ সালে শান্তি মিশনের কাজে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন পূর্ববঙ্গ সফরে এসেছিলেন, খান সাহেব তখন সোহরাওয়ার্দীর শান্তি মিশনের কাজে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন।

বাড়িটার নাম ছিলো বায়তুল আমান। তিনি বিখ্যাত পাট কোম্পানি Rally Brother’s-এর চিফ-ব্রোকার (মুখ্য-দালাল) ছিলেন যার মারফত পাট বেচাকেনা হতো। ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহখানেকের মতো, আমি এই বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলাম। দোতলাতে খানসাহেব থাকতেন, তাঁর পাশের কামরাতেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। খান সাহেবের চার স্ত্রী এবং অনেক ছেলেমেয়ে ছিলো। কিন্তু খানসাহেবের কঠোর ব্যবস্থায় তাঁর স্ত্রীগণ এবং ছেলেমেয়েরাও আমার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না। শুধু রাত্রিবেলা আমি এবং খান সাহেব একত্রে খেতাম।

খানসাহেব স্বাভাবিকভাবেই কঠোর সরকারবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যগণসহ নারায়ণগঞ্জে এঁরা ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর ছেলে শামসুজ্জোহা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন এবং অন্য এক ছেলে মোস্তাফা সারোয়ারও তখন যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং এঁরা দু ভাইই ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাজনীতির সঙ্গে এ পরিবারের এ জাতীয় ঘনিষ্ঠতার কারণে এঁদের ওপরেও কড়া পুলিশি নজর ছিলো। আমি পুলিশের নজর এড়িয়েই এ বাড়িতে ঢুকেছিলাম। কিন্তু একদিন রাতে খানসাহেব, আমাকে বলেন, মনে হয় সরকার আমাকে আটক করবে- তাই আপনারও আর এ বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। অতঃপর আমি খানসাহেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। আমি বের হয়ে আসার পরের দিনই খানসাহেবের বাড়ি পুলিশ ঘেরাও ও অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধান চালানোর সময়ে খানসাহেবের ৭৮ বছর বয়স্কা মা বেগম আলতাফুন্নেসা বাধা দিতে গেলে পুলিশ তার ওপর লাঠিচার্জ করে, এতে তাঁর হাতের হাড় ভেঙে গিয়েছিলো। পুলিশ ঐ সময়ে খানসাহেব ওসমান আলীকে গ্রেফতার করে। তাঁর ছেলে আজগর আলী, শামসুজ্জোহা, মোস্তফা সরোয়ার এবং তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র জালাল আহমদকেও গ্রেফতার করে। এরা সকলেই বৎসরাধিকাল জেল খেটেছেন। এর মধ্যে মোস্তফা সারোয়ার জেলে বসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। খানসাহেবের বৃদ্ধা মায়ের উপর পুলিশের এ নির্যাতনের প্রতিবাদে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এম এল এ এবং বেগম আনোয়ারা খাতুন এম এল এ তখনকার কাগজে বিবৃতি দিয়েছিলেন। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অ্যাসেম্বিলিতে এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “খানসাহেব ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকে অপরাধ করতে পারেন, কিন্তু তার বৃদ্ধা মাতা এমন কী অপরাধ করেছেন—যার উপর পুলিশি নির্যাতন করা হলো?”

 

(আমার জীবনস্মৃতি : মাহমুদ নূরুল হুদা, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯, ২৪৬-৪৮ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত; কর্তৃপক্ষের নিকট আমরা ঋণী।)

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না