আমাদের জীবন খুব স্বাভাবিক ছন্দে চলে যায়। যেমনটা একটা এক্সপ্রেস ট্রেন এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে পৌঁছায়। কোথাও অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো নেই। আবার কোথাও থেমে থাকার রেওয়াজ নেই। এই ছন্দময় জীবনে যে অস্বাভাবিক আকর্ষণীয় কিছু আছে বিষয়টা অধিকাংশ সময়ে আমাদের চোখেই আসে না। কিন্তু, মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে মনে হয়, এই জিনিসটাকে যদি আমরা অন্যচোখে দেখে নিতাম তবেই মনে হয় ভালো হোত৷ হয়তো আমাদের বেঁচে থাকা আর টেনেটুনে একটা জীবন পার করে দেওয়ার বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যেতে পারতো। তখন মনে হয়, এই নির্লিপ্ততায় জড়িয়ে থাকে জীবনের ছোটখাটো জিনিসগুলোয় এক বিরাট আকর্ষণ। সে আকর্ষণ যে যতটা আবিষ্কার করে সে ততটা আলোমাখা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
বুদ্ধদেব বসু হঠাৎ-আলোর ঝলকানি প্রবন্ধ বইয়ে আমাদের জীবনের এই ছোটোখাটো বিষয়গুলোকে বেশ নিপুণতার সাথে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বইটা সাজানো হয়েছে একগুচ্ছ মননশীল প্রবন্ধের সমারোহে। খুব বেশি চকচকে হলেও আমাদের মেকি জীবন আমাদের বেশিদিন পছন্দের হয় না। দিনের শেষ ডালভাত প্রিয় হয়ে উঠে। পুরানা পল্টন, ক্লাইভ স্ট্রিটে চাঁদ, সরস্বতী, ভূতের ভয়, কলকাতা, ছাদ, বাথরুম, রূপ ও স্বরূপ, মৃত্যু-জল্পনা, পৌষ তাদের ডাক দিয়েছে নামক দশটি প্রবন্ধের মাধ্যমে সাবলীলভাবে আমাদের চোখের সামনে হাজির করেছেন জীবনের সাথে জড়িয়ে বিষয়গুলো। আমরা যখন আমাদের স্কুলজীবন কাটাই তখন স্কুলটাকে একটা বন্দীশালা মনে হয়। কিন্তু সেই জীবনটা পিছনে ফেলে আসার পরে মনে হয় যে ওটা আমাদের অন্তরের জায়গা ছিলো। তেমনি আমাদের বসবাসের ক্ষেত্রেও একইরকম বিষয় ঘটে। আপনি যে জায়গাটাতে বর্তমানে বসবাস করছেন, সেই জায়গার সুযোগ সুবিধা আপনার কাছে কম মনে হবে। এক ধরণের অসুবিধা মনে হবে বিষয়গুলোকে। কিন্তু যখন সেই জায়গাটা ছেড়ে নতুন সুবিধাজনক জায়গায় চলে যাবেন, তারপর হুট করে মনে হতে শুরু করবে ওটা আপনার একদম আপন জায়গা ছিলো। ফলে নতুন জায়গায় আপনি স্বস্তি পাবেন না। আর একটা বিষয়, আমাদের আধা-শহর যে শান্তশিষ্ট পরিবেশে ছিলো তা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আধুনিকতার নামের এই সভ্য সমাজব্যবস্থা। আমরা সহজে আমাদের সঠিক অভাববোধকে চিহ্নিত করতে পারি না। সারাক্ষণ মনে ঘুষঘুষুনি করতে থাকে নানা প্রয়োজন আর অভাববোধ। কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করার অভাববোধ আমরা কখনো বোধ করি না। ফলে, এমন এমন সময় এত তুচ্ছ জিনিসকে এত সুন্দর বলে মনে হয় যে সেটা সভ্য সমাজের কাছে হাস্যকর মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিচ্ছু নয়। যেমন, ছাদ প্রবন্ধে, মানুষের অন্তত একটা বাঙালির জীবনে ছাদ যে অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে তা অবলীলায় দেখিয়েছেন লেখক। যখন আপনার জীবনে জাগতিক কোন আকাঙ্ক্ষা, পয়সার অভাব, সুস্থ থাকার অভাব মনে হবে না, তখনো কোন কোন দিন রাতে খাওয়ার পরে শান্তি খোজার শখ জাগতেই পারে। হঠাৎ করে কোন এক জোছনা রাতে আপনার মনে হতেই পারে, আমার যদি একটা ছাদ থাকতো! এই ছাদের অভাববোধ তখন আপনাকে দুঃখী করে তুলতে পারে। যে ছাদের কোন ব্যবহারযোগ্যতা নেই, সেই অব্যবহৃত জিনিসটা অনেক ক্ষেত্রে সুখ এনে দিতে পারে।
কলকাতা প্রবন্ধে সাহিত্যে নবাগতদের জন্য তিনি বিরাট দিকনির্দেশনা রেখেছেন। তৎকালীন সময় পর্যন্ত গ্রামীণ সাহিত্য ছাড়া অন্য কোন সাহিত্য-চর্চার চলন তখনো ছিলো না। নিজের শহরকে যে প্রেমিকার মতন ভালোবেসে তাকে নিয়ে সাহিত্যে নামা চলে তা জানতে হয়। এই শহরকে চিনে নেওয়ার মধ্যে যে বিরাট মহিমা রয়েছে তা বুঝতে বলেছেন। শুধু পল্লীর সাহিত্য যে সাহিত্য নয় তা তিনি ভালো করেই ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। কলকাতা নিয়ে এমন কিছু লিখতে চেয়েছেন যাতে কয়েকশো বছর পরেও আমি আপনি পড়ে আফসোস করতে পারি, ইস পুরনো কলকাতা কতটা সুন্দরই না ছিল!
আমরা বেচে থাকি আমাদের সর্বত্র। প্রত্যেকটা অণুতে। প্রতিটা জিনিসে। আশেপাশের জিনিসগুলোকে আমরা যতটা সুন্দরভাবে দেখতে পাই, আমাদের জীবনাটাও ঠিক ততটাই সুন্দর হয়ে ধরা দেয়। আপনার জীবনে হয়তো নিত্য ব্যবহার করা জিনিসটা আপনার কাছে প্রতিনিয়ত খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু একটা সময় ওই স্বাভাবিক তুচ্ছ জিনিসটা হয়ে উঠতে পারে আপনার মনের সৌন্দর্য পাল্টে দেওয়ার উপকরণ। বেশ কয়েকযুগ পরেও যে সুন্দর জিনিসগুলো আজকের মতনই সুন্দর মনে হবে। সে হোক ক্লাইভ স্ট্রিটের চাঁদে, ছাদের আফসোসে কিংবা পুরনো বাসা বাড়ির শোকে নয়তো শহরকে চিনে নেওয়ার আক্ষেপে। সবুজ হয়ে উঠুক সমস্ত পথ। আলোকিত হোক একচ্ছত্র চাঁদের মায়াবী আলোয়।
আসলে প্রবন্ধ-পাঠ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। বুদ্ধদেব বসুর এই বইটিও তেমনটির ব্যতিক্রম ছিলো না। স্বল্প পরিসরে দশটি প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে গিয়েছেন। উপলব্ধি করিয়েছেন জীবনবোধের বিষয়টা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আসল সৌন্দর্যের বিষয়বস্তু। সুখপাঠ্য ছিলো বইটি পাঠ করা।
খুব বেশি স্পর্শ করেছে যে উক্তিগুলো:
ছাদ একটা মুক্তি ; সীমাহীনতার, সৃষ্টির রহস্যময়তার সঙ্গে একটা স্পর্শ।
প্রকৃতির এই আটপৌরে, অসাবধান রূপই আমাকে মুগ্ধ করে।
স্মৃতির রঙিন কাঁচের ভিতর দিয়ে সব জিনিসই সুন্দর দেখায়,মনোরম দেখায়।
নিয়ম করা উচ্ছৃঙ্খলতা বেশিদিন ভালো লাগে না; সে ঢেউ কেটে যায়।