সূর্য-দীঘল বাড়ী : চরিত্রনির্মাণে আবু ইসহাকের আসল মুনশিয়ানা
প্রকাশনী: নবযুগ ; প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৫ ; বর্তমান প্রকাশনী: নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
যেভাবে নজরুলের ব্যাপারে বলা হয় ‘কেবল অগ্নিবীণা লিখলেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হতেন’; যেভাবে বিভূতিভূষণের ব্যাপারে বলা হয় ‘কেবল পথের পাঁচালী লিখলেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হতেন’; যেভাবে আল-মাহমুদের ব্যাপারে বলা হয় ‘কেবল সোনালী কাবিন লিখলেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হতেন’ ঠিক সেভাবে কথাশিল্পী আবু ইসহাকের ব্যাপারে নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘কেবল সূর্য-দীঘল বাড়ী লিখলেই তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হতেন’।
চরিত্রনির্মাণে আবু ইসহাক যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তা অন্তত বাংলাদেশী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বিরল প্রকৃতির। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়গুন- জয়গুনকে এমন সংগ্রামী প্লটে তিনি ফেলেছেন, এমন মরণদশার মানচিত্রে তিনি জয়গুনের চিত্র স্থাপন করেছেন যে, তাকে দিয়ে যা যা করাতে, বলাতে চেয়েছেন ঠিক তা তা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে পেরেছেন। এক পর্যায়ে আবু ইসহাক জয়গুনের ব্যাপারে বলেছেন: “ধর্মের অনুশাসন সে ভুলে যায় এক মুহূর্তে। জীবন-ধারণের কাছে ধর্মের বারণ তুচ্ছ হয়ে যায়, মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে।” আরেক জায়গায়: “ক্ষুধার অন্ন যার নেই, তার আবার কিসের পর্দা, কিসের কি? সে বুঝেছে, জীবন রক্ষা করাই ধর্মের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মূলমন্ত্র। জীবন রক্ষা করতে ধর্মের যে কোন অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সে প্রস্তুত। উদরের আগুন নিবাতে দোজখের আগুনে ঝাঁপ দিতেও তার ভয় নেই।” ধর্মের প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে এই যে আক্রমণাত্মক উচ্চারণ, ধর্মের ‘অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে’ জয়গুনকে প্রস্তুত করে দেওয়া এসব নিয়ে আবু ইসহাক কোনোরকম দ্বিধায় পড়েন না, কলম একটুও কাঁপে না! কিন্তু কেন? কারণ, জয়গুনের চরিত্রকে তিনি এতোটা বাস্তবানুগ, সংগ্রামমুখর এবং বেহাল দশার ক্যানভাসে এঁকেছেন যে, যত ধর্মান্ধ পাঠকই হোক না কেন, জয়গুনের এসব উচ্চারণে পাঠক এতটুকুও বিচলিত হবে না, বরং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে জয়গুনের প্রতি তার সহানুভূতি ঢের উপচে পড়বে। এখানেই চরিত্রনির্মাণে আবু ইসহাকের আসল মুনশিয়ানা ফুটে উঠেছে।
আবু ইসহাক তার মনের অব্যক্ত কথা বিনাবাধায় বলতে জয়গুনের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং সার্থকতার সাথে বলাতে পেরেছেনও। এই পারার জন্য তার ‘জয়গুন’ চরিত্র এবং পরিবেশকে এমনভাবে সৃষ্টি করতে হয়েছে যে, যেখানে পাঠক নির্মাতার নিকট কোনো কৈফিয়ত চাইবে না, বরং পাঠকের মনোভাব থাকবে ‘এটাই তো বলার ছিল, এমনটাই তো হওয়ার ছিল’। অর্থাৎ, বিকল্প কোনো রাস্তা আবু ইসহাক রাখেননি। এই পয়েন্টে একজন চিত্রনির্মাতা হিশেবে আবু ইসহাকের অসাধারণত্বের জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে তিনি বর্তমান ঔপন্যাসিকদের নিকট যথা-অর্থে অনুসরণীয়।
ধর্মান্ধতা, প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য কেমন চরিত্র ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয় তা শেখার জন্য বাঙালী ঔপন্যাসিকের নিকট আবু ইসহাক একজন চিরায়ত ওস্তাদ।
আমরা আবু ইসহাকের অন্য উপন্যাস জাল এর ভূমিকা থেকে জানতে পারি, সূর্য-দীঘল বাড়ী লেখা শেষ হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ১৯৫৫ সালে- কেন? কারণ, মাঝখানে ৭ বছর তিনি এই উপন্যাসের কোনো প্রকাশক খুঁজে পাননি। অন্তত বাংলাদেশের জন্য কি এটা বিরল কোনো ঘটনা? মনে হয় না।