সূচনা: বাংলা ভাষায় সিরাতসাহিত্য চর্চা ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে তা বলা কঠিন। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় হযরত উমর রা. এর যুগেই আরব মুসলিম বণিকগণ এ দেশে আসেন। ১২০০ খৃস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি কর্তৃক রাজা লক্ষন সেনকে পরাজিত করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকারের পর মুসলমানদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলা ভাষা বিস্তৃতি লাভ করে।
বাংলা ভাষাকে তিন যুগে ভাগ করা হয়। প্রাচীন যুগ: ১০-১৩ শতাব্দী, মধ্যযুগ: ১৩-১৮ শতাব্দী, আধুনিক যুগ: ১৮- বর্তমান কাল। বিশিষ্ট সিরাত গবেষক নাসির হেলাল তার বাংলা ভাষায় সীরাত বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি বইটিতে মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ১০২৮টি সীরাত গ্রন্থের সন্ধান দিয়েছেন।১ গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বক্ষ্মমান প্রবন্ধে গ্রন্থালোচনা; অধ্যাপক আবদুল খালেক (রহ.) প্রণীত বাংলা ভাষায় লিখিত তিন খণ্ডে সমাপ্ত অনবদ্য ও কালজয়ী নবীজীবনচরিত সাইয়েদুল মুরসালীন।
লেখক পরিচিতি
আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন অধ্যাপক আবদুল খালেক সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার দুই ধারাতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তিনি আরবী ও ফার্সী ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডবল এম.এ সম্পন্ন করে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচ ভরি ওজনের স্বর্ণপদকও লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি ফেনী সরকারী কলেজ ও অখণ্ড ভারতের কলকাতার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপনা করেন এবং লেডী ব্রেবোর্ন কলেজে ও ঢাকায় সরকারী ইডেন কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য সরকারীভাবে গঠিত ‘তা’লীমাতে ইসলামিয়া বোর্ডে’ সম্মানিত সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাজার শরীফ ছতুরা শরীফ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় অবস্থিত।
অধ্যাপক আবদুল খালেক বিশিষ্ট সুফি ফুরফুরা শরীফের খলিফা ছদর উদ্দিন আহমদ (রহ.) ও ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদে জামান পীর আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) উভয় থেকে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দেদিয়া, মুহাম্মাদীয়া তরীকার তালিম, তায়াজ্জুহ ও খেলাফতপ্রাপ্ত। তাঁর পীরভাইদের মধ্যে মাওলানা রুহুল আমীন বশীরহাটি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ছারসিনার নেসার উদ্দিন আহমদ প্রমুখ ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত খলিফাদের মধ্যে ফরাযীকান্দী উয়েসীয়া শরীফের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সুফি শায়খ বোরহানুদ্দীন উয়েসী ও বিশিষ্ট মুরিদ মুসলিম রেনেসাঁর কবি, ফররুখ আহমদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক আবদুল খালেক (রহ.) এর চিন্তা ও লেখনীতে মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রহ.), শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেস দেলহভী (রহ.) ও সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) এর প্রভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত।
অধ্যাপক আবদুল খালেক স্বরচিত গ্রন্থগুলো হলো: সাইয়েদুল মুরসালীন (তিন খণ্ড), সেরাজুস সালেকীন ও বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারী রচয়িতা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানীর (রহ.) এর লিখিত গ্রন্থ মুনাব্বেহাতের বাংলা অনুবাদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তাঁর রচিত গুনচা-ই-ফারসী প্রথম খণ্ড, দুররাতুল আদাব ২য় খণ্ড, সহজ আরবী ব্যাকরণ মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর অর্ন্তভূক্ত ছিলো।২
সাইয়েদুল মুরসালীন : সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
এই অদ্বিতীয় গ্রন্থটির (দুই খণ্ড) প্রথম প্রকাশকাল ১৯৫১; দ্বিতীয় ও পরিবর্ধিত সংস্করণ বের হয় ১৯৫৯ সালে। তৃতীয় খণ্ডটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। তিনখণ্ড মিলিয়ে মোট পৃষ্টা সংখ্যা ১১৭০। ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট দশবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে মোট চারবার প্রকাশ হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে গ্রন্থটি সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক তথ্যবহুল এবং বাংলা ভাষায় কোন আলেম কর্তৃক রচিত প্রথম নবী-জীবনচরিত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে বিভিন্ন ধর্মানুসারীদের নিজ নিজ ধর্মের বিকৃতি সাধনের স্বরূপ, তৎকালীন হিন্দুস্তান, চীন ও আরবের ভৌগোলিক অবস্থা, প্রাচীন আরব ও ইসলামপূর্ব আরব জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণপূর্বক লেখক সুচারুভাবে শেষনবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের গভীর, ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলমে আরওয়াহ’র জিন্দেগী থেকে শুরু করে তাঁর মাক্কী জীবন, নবুওয়াতের প্রকাশ, শবে মিরাজ, হিজরত, মদীনার জীবন এবং প্রায় প্রত্যেকটি যুদ্ধের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণসহ হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। জানা যায়, গ্রন্থটির প্রুফ রিডার হিসেবে অধ্যাপক সাহেবের মুরিদ, কবি ফররুখ আহমদ ভাষাশৈলী ও সৌন্দর্যবর্ধনে ভূমিকা রেখেছেন।৩
এই গ্রন্থের প্রধান অবলম্বন ছিল ইমাম আলী বিন বুরহানুদ্দিন হালাবী’র সীরাত-ই-হালাবী নামক গ্রন্থ। সীরাতে হালাবী ব্যতীত নিম্নলিখিত গ্রন্থসমূহ থেকে আলোচিত হয়েছে:
১. সীরাতে ইবনে হিশাম : আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম।
২. মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া : ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন আবু বকর বিন খতিব কাসতালানী।
৩. যাদুল-মা’আদ : ইমাম আবু আব্দুল্লাহ বিন কাযয়্যেম জাওমী।
৪. রাওজুল উনফ : ইমাম সোহাইলী।
৫. খাসাযয়েসে কুবরা : ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ূতী।
৬. সীরাতুন্নবী : শিবলী নোমানী ও সুলায়মান নদবী।
৭. আসাহচ্ছিয়ার : মাওলানা আব্দুর রউফ দানাপুরী।
৮. হাযরাতে মোহাম্মদ (সঃ) : মোহাম্মদ হোসাইন হাইকেল (মিশর)।
৯. মিশকাতুল মাসাবীহ ও অপরাপর হাদিস গ্রন্থ।
১০. বয়ানুল কুরআন, তাফসীরে আযিযী ও অন্যান্য তাফসীর।
১১. শাযারাতুল কওম : শেখ আকবর ইমাম মহীউদ্দিন ইবনুল আরাবী।
১২. মাকতুবাত : হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী।
গ্রন্থের শুরুতেই লেখক নিজেই গ্রন্থ লেখার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। অধ্যাপক আবদুল খালেক বলেন: “সাইয়েদুল মুরসালীন, সারওয়ারে কায়িনাত হযরত আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরত লেখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার মূল হইতেছে বুযুর্গানে দ্বীন ও আয়েম্মা-ই-শারয়ে মতীনের ন্যায় নিজেকে সারওয়ারে কায়িনাত (সঃ)-এর খিদমতে নিয়োজিত রাখা, ঈমান সতেজ ও সরস করা, তাঁহার ফয়েজ ও দোয়া লাভ করা এবং সায়াদাত-ই-দারাইন হাসিল করা। এই জন্য এই কিতাবে তাঁহাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রয়াস পাইয়াছি যাতে আল্লাহ পাক পরোয়ারদিগারের দরবারে কবুলিয়তের দরজা লাভ করে ও রহমত এর কারণ হয়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা ও জড়বাদের ভাবধারায় প্রভাবান্বিত প্রচারণার ফলে তাওহীদ, ইসলাম, কুরআন, হাদীস ও সারওয়ার কায়িনাত (সঃ) সম্বন্ধে সমাজে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে, এই কিতাবে তাহা অপনোদন করাও অন্যতম উদ্দেশ্য।”
গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য থেকে কিছু অংশ নিম্নরূপ: “মূলত এই গ্রন্থে আমরা সাধারণভাবে মশহুর ঘটনাবলীর কিছু বা কোন দিকই বাকি রাখি নাই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীকে সাজাইতে হইবে রিসালাতের পটভূমিতে। যে সমস্ত ঘটনা ও কার্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে ঐ সমস্তকে বিচার বা গোপন করিবার অধিকার মানুষের নাই। তাঁহাদের সর্ব কাজ ও আদেশ আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশে হইয়া থাকে। ঐ সমস্তই ঈমান ও ইসলামের ভিত্তি; কাজেই সমালোচনার অতীত। তাই কুরআনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ করতে বলা হইয়াছে, সমালোচনা ও বিচার করিয়া সত্যের অপলাপ করিতে নহে। আধুনিক লেখকদের অধিকাংশই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী রিসালাতের পটভূমি হইতে বহু দূরে সরাইয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহারা তাঁহাকে রসূল হিসাবে দেখান নাই দেখাইয়াছেন রিফর্মার সংস্কারক, ভাববাদী অতিমানব হিসাবে। এখানেই সত্যের অপলাপ করা হইয়াছে। রিসালাত প্রমাণ করিবার একমাত্র উপায় হইতেছে মুযিজা। ইহা রিসালাতের মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ব্যতীত দেহ যেরূপ দাঁড়াইতে পারে না, মুযিজা ছাড়াও পার্থিবলোকে রিসালাতের সত্যতা প্রমাণিত হইতে পারে না। নবীগণ আল্লাহ প্রেরিত পুরুষ, তাদের এই দাবির সত্যতা প্রমাণ কল্পে কাফিররা জ্বলন্ত নিদর্শন প্রদর্শনের দাবী করিত। তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁহাদিগকে অলৌকিক ঘটনাবলী দ্বারা সাহায্য করিতেন। ঐ সমস্ত ঘটনা দ্বারা একদিকে যেমন অকাট্যভাবে তাঁহাদের দাবির সত্যতা প্রমাণিত হইত, অপরদিকে তেমনি তাওহীদের নিদর্শনও প্রকাশ হইয়া পড়িত। রিসালাতের দাবীর সহিত নবীগণের নিকট হইতে তাওহীদের নিদর্শন রূপে যে সমস্ত অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হয় তাহাই মুযিজা অপরগুলো নহে। যাঁহারা রিসালাত সম্বন্ধে আলোচনা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মুযিজা অস্বীকার করেন, তাহারা যে ওই বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞানও রাখেন না ইহা তাহারই পরিচায়ক। যাহারা মুযিজা স্বীকার করেন না, তাহারা রিসালাত স্বীকার করেন না, এবং যারা রিসালাত স্বীকার করেন না, তাহারা সন্দেহাতীতভাবে কাফির। কুরআন, মি’রাজ, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া প্রভৃতি মুযিজা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাস্তিও মুযিজা। যে ব্যক্তি কুরআনের এক অংশ মানে, অপর অংশ মানে না সেও কাফির। আমরা এই গ্রন্থে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মশহুর মুযিজাগুলি সমস্তই লিপিবদ্ধ করিয়াছি। হাদিস ও কোরআনের বর্ণিত অসংখ্য মুযিজার কয়টি তাহারা অস্বীকার করিবেন? …এই গ্রন্থে বহু ঘটনা ও মুযিজা লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং তাহা হাদিস ও সীরাত গ্রন্থ হইতেই করা হইয়াছে। তের শত বৎসর পর অভিনব কিছু ইহাতে স্থান পায় নাই। আমরা এই গ্রন্থে কোন একজন নির্দিষ্ট লেখকের কোন একটি খামখেয়ালি অভিমত লইয়া অযথা কাগজ অথবা সময় নষ্ট করি নাই; আমরা ঘটনাবলী পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছি। সত্যমিথ্যা আপনাতেই প্রকাশ হইয়া পড়িবে এবং তাহারাও সহজে বিচার করিতে সমর্থ হইবেন। আমরা শরহে-সদর, শককে সদর, মি’রাজ, মুযিজা প্রভৃতি বিষয়ে অপরাপর কৌশলী লেখকদের বিক্ষিপ্ত মূল্যহীন মন্তব্য করিয়া অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকদিগকে ইসলাম ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিতে প্রয়াস পাই নাই; সেইগুলি কুরআন ও হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মুহাদ্দিস ও ইমামগণের পদাঙ্কানুসরণে সকলের সম্মুখে হাজির করিয়াছি।৪
বিশিষ্টজনের মূল্যায়ন
অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও মোহাম্মাদ আব্দুল হাই: “মাওলানা আবদুল খালেক এম, এ রচিত ছাইয়েদুল মুরসালিন অধুনা প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ বিরাট গ্রন্থটি রচনায় লেখকের শ্রমশীলতা ও হযরতের প্রতি অকৃত্রিম হৃদয়ানুরাগ লক্ষ করার মতো।” ৫
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান:
“এই প্রসংগে সর্বশেষ যে গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করব তার নাম হচ্ছে ছাইয়েদুল মুরলীন। গ্রন্থটির লেখক মাওলানা আবদুল খালেক। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। দুই খণ্ড মিলে গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮০৮। বাংলাভাষায় এটিই রাসূলের সর্ববৃহৎ জীবনী। এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় প্রকাশিত রাসূলের জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে মওলানা আবদুল খালেকের গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল এবং যতটা সম্ভব তিনি রাসূলের জীবনের প্রধান প্রধান সবকটি ঘটনাকেই উল্লেখ করবার চেষ্টা করেছেন। মুদ্রণ বিভ্রাটের জন্য এবং ভাষার জটিলতার জন্য গ্রন্থটি পাঠে কিছুটা অসুবিধা হলেও তথ্যাদির দিক থেকে এই গ্রন্থটি সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য।”
সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ: “বাংলা ভাষায় রচিত একটি শ্রেষ্ঠ রসূল-চরিত মওলানা আবদুল খালেকের সাইয়েদুল মুরসালীন…।”৬
নাসির আল হেলাল সূত্রে মাহদী হাসান: “বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মরহুম মাওলানা আবদুল খালেক রচিত সাইয়েদুল মুরসালীন (দু’খণ্ড) বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সংযোজন। মোস্তফা চরিত, বিশ্বনবী পর্যায়ের গ্রন্থ এটি না হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেকটা কাছাকাছি। এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গ্রন্থটির ৪টি সংস্করণ প্রকাশ করেছে। দু’খণ্ডে প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি লেখকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। …। উল্লেখ্য যে, এটিই ছিল প্রথম কোন আলেম রচিত সিরাতগ্রন্থ।”৭
মুহাইমিনুল ইসলাম মঈন: “মাওলানা আব্দুল খালেক রচনা করেন বাংলাভাষায় সর্ববৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা তথ্যবহুল ৮০৮ পৃষ্ঠার দুই খণ্ডের গ্রন্থ ছাইয়েদুল মুরছালীন, যা ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়।”৮
বিশিষ্ট্য লেখক ও সিরাত গবেষক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান: “আমার জানামতে বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ মরহুম অধ্যাপক আবদুল খালেক কৃত সাইয়্যেদুল মুরসালীন নামক বইটি। এটা দু’খণ্ডে সমাপ্ত। …শিবলী নো’মানীর সীরাতুন নবী, সৈয়দ সুলায়মান নদভীর খুতবাতে মাদরাজ, সুলায়মান সালমান মনসুরপুরীর রাহমাতুল্লিল আলামীন, মুহাদ্দেস ইদরীস কান্দলভীর সীরাতে মোস্তফা, মানাজের আহসান গিলানীর রহমাতুল্লিল আলামীন, আব্দুর রউফ দানাপূরীর আসাহহুস সিয়ার প্রভৃতি আমাদের বিবেচনায় সর্বোৎকৃষ্ট। এগুলোর মধ্যে সীরাতুন নবী গ্রন্থের মোট ছয় খণ্ডের মধ্যে তিন খণ্ডের বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় মৌলিক রচনার মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল খালেকের সাইয়্যেদুল মুরসালীন, অধ্যাপক শিশির দাসের প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী সর্বোৎকৃষ্ট বলে আমার ধারণা।”৯
তথ্যসূত্র:
১. ক. বাংলা ভাষায় রচিত সিরাতগ্রন্থের তালিকা নিয়ে বই – মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
খ. সীরাত চর্চার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, হাফেজ ফজলুল হক শাহ , দৈনিক ইনকিলাব,
১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
২. ক. হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) এর বিস্তারিত জীবনী – রুহুল আমিন বশীরহাটি
খ. হযরত শাহ সূফী অধ্যাপক আবদুল খালেক (র.) – সিদ্দিক আহমদ খান
গ. ইসলাম প্রসঙ্গ – ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ
ঘ. ফুরফুরা শরীফের ইতিবৃত্ত – মুবারক আলী রহমানী
ঙ. হাদীয়াতুছ সালেকীন – বোরহানুদ্দীন (বি. এ)
চ. পীর প্রফেসর আব্দুল খালেক ছতুরাভী (র.) জীবন ও কর্ম – মাসুক আহমেদ
ছ. ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার ইতিবৃত্ত – শোয়েব চৌধুরী সম্পাদিত
৩. কবি ফররুখ আহমদ ব্যক্তি ও কবি – শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত
৪. সাইয়েদুল মুরসালীন – আব্দুল খালেক (এম. এ), অবতরণিকা, পৃ: ১৮-২২
৫. ক. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১৯৫৬), অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও মোহাম্মাদ আব্দুল হাই, ৭ম সংস্করণ পৃ. ১২১
খ. ফুরফুরার ইতিহাস : আবদুল্লাহ আল আরিফ সম্পাদিত(২০০৫) পৃ. ২০৯-২১১
৬. বাংলা সাহিত্যে মুসলমান : আবদুল মান্নান সৈয়দ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১৮ (চতুর্থ মুদ্রণ), ১৯১ পৃষ্ঠা
৭. ক. বাংলা ভাষায় সীরাত বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি – নাসির হেলাল, ইসলামিক ফাউন্ডেশন (১৯৯৩)
খ. বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত পূর্ণাঙ্গ সিরাত সমূহ পরিচিতি ও পর্যালোচনা- মাহদী হাসান
৮. বাংলা ভাষায় হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনী : মুহাইমিনুল ইসলাম মঈন
৯. প্রিয় নবীজীর (সা:) প্রিয় প্রসঙ্গ, সম্পাদনায় : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মদীনা পাবলিকেশন, পৃ. ২০৭-৮