পৃথিবীতে নাকি একজন মানুষের অনুরূপ ৭জন মানুষ থাকে। এই কথার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ গবেষকের নিজের কাছেও নেই। তবে, দেখতে হুবহু না হোক, প্রায় একই যে থাকে এটা চরম ও পরমতম সত্য কথা। ঠিক এমন ছিল আমাদের প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষেত্রেও। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার গঠনের সাথে বেশ কজনের গঠন মিলে যায়। দূর থেকে দেখলে সাহাবায়ে কেরামগণ মাঝে মাঝেই রাসুল ভেবে ভুল করতেন। এমন লোক ছিলেন ৫ জন।
১। নবীজির চাচাতো এবং দুধ ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব
২। নবীজির চাচাতো ভাই কুছাম ইবনে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব
৩। সাইব ইবনে উবাইদ (রা.); তাঁরই বংশধর হলেন ইমাম শাফেয়ী (রহ.)
৪। নবীজির প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হাসান ইবনে আলী (রা.)
পঞ্চম জনের কথাটা বাড়িয়ে বলব। বলব কারন উনাকে নিয়ে ততটা লেখালিখি হয় না।
যারা হিজরত তথা ইসলাম ধর্মের কারণে নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে তাদের বলা হয় মুহাজির। যদি প্রশ্ন করি ইসলামের সর্বপ্রথম মুহাজির কে? হকচকানো প্রশ্ন৷ অনেকেরই জানা থাকবে না। না থাকাটাও স্বাভাবিক। আবার ধরুন, যদি প্রশ্ন করি, বেহেশতের পাখি কে? হতভম্ব হয়ে যাবে সবাই। কারণ যদিও প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন পাখ-পাখালীদের কলরবে মুখরিত হই কিন্তু বেহেশতের পাখির কুঞ্জনের সাথে ঠিক পরিচিত নই আমরা।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার গঠনের সাথে মিল থাকা ৫ম ব্যক্তি, সর্বপ্রথম মুহাজির এবং বেহেশতের পাখি তথা তাইয়্যার সবগুলো উপনাম একজনেরই। তিনি হলেন হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.)। যিনি সম্পর্কে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপন চাচাতো ভাই এবং শেরে খোদা আলী (রা.) এর আপন বড় ভাই। হযরত জাফর তাইয়্যার (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রভাত কালের মুসলমান। তিনি ২৬ কিংবা ৩২তম মুসলমান ছিলেন।
পুরোনাম আবু আবদুল্লাহ জাফর। উপাধী আবুল মাসাকিন (মিসকিনদের পিতা), জুল-যানাহাইন (দুই ডানাওয়ালা), আত তাইয়্যার (পাখি)। তিনি এমন সাহাবী ছিলেন যার শৈশব কেটেছিলো নবীচাচা হযরত আব্বাস (রা.) এর গৃহে। যিনি নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বেই ছোটভাই আলী (রা.) এর সাথে এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে নামাজ আদায় করেন।
প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা কুরাইশদের নানাবিধ অত্যাচারে জর্জরিত হতো। তাই কামলিওয়ালা নবী জাফর (রা.) কে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দেন৷ প্রথমবারের মতো মুসলমানরা হিজরত করেন, আর প্রথম হিজরতকারী ব্যক্তিটিই হলেন জাফর (রা.)। হিজরত করা মোটেও সহজসাধ্য ছিলো না। ঘর-বাড়ি বিসর্জন দেয়ার এ সংগ্রামী কাফেলায় ছিলো ৮৬জন পুরুষ এবং ১৭জন নারী। সেখানে জাফর (রা.) এর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস (রা.)ও ছিলেন। এ মহান কাফেলার আমীর হলে হযরত জাফর তাইয়্যার (রা.)।
আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশি খুবই দয়ালু ছিলেন। তাই মুসলমানরা সেখানে নিরাপদে বসবাস করতে লাগলো। আর তাতেই কুরাইশদের অত্যাচারী অন্তর পাপের নেশায় সুড়সুড়িয়ে উঠে। কুরাইশরা বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে নাজ্জাশীর দরবারের ধর্মযাজকদের হাত করে নেয়। ধর্মযাজকদের পীড়াপীড়িতে নাজ্জাশী মুসলমানদের তার দরবারে ডাকেন। কিন্তু অকুতোভয় জাফর রা. সগৌরবে ইসলাম ধর্মের আদর্শ এবং সৌন্দর্য তুলে ধরেন। তিনি সুমধুর সুরে সূরা মারিয়াম তেলাওয়াত করতে লাগলেন। ঈসা আ. এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাজ্জাশী পাক কালামের প্রেমময় অমীয় বানী শুনে অশ্রুসিক্ত ও হৃদয় বিগলিত চিত্তে বলেন, “এ তো সে বাণী যা নিয়ে আগমন করেছিলেন নবী ঈসা ইবনে মারিয়াম আ.।” কিন্তু তাতেও না দমে পরেরদিন কুরাইশরা ভিন্ন চাল প্রয়োগের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সব অভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিয়ে স্বয়ং বাদশাহ নাজ্জাশীই জাফর রা. এর হাতে শাহাদা পাঠ করে নিজ অন্তরে ইসলামের বীজ বুনন করেন। দৃঢ়কন্ঠে তিনি বলেন, “খোদার কসম! আমি যদি রাজ্যের অধিপতি না হতাম তাহলে আমি তাঁর (রাসূল) কাছে ছুটে যেতাম। আমি তাঁর পাদুকা বহন করতাম এবং তাঁকে অযু করিয়ে দিতাম।”
আবিসিনিয়ায় মুসলিমদের প্রশান্তির বসবাস এখান থেকেই শুরু। এদিকে শান্তিতে দিন যাপন করলেও জাফর রা. এর মনটা দয়াল নবীর কাছেই আটকা পরে আছে। অপরদিকে ইতিমধ্যেই নানান ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবাগণ মদিনা পানে হিজরত করেন। বদর-উহুদ-খন্দক সহ বেশ কিছু বড় বড় যুদ্ধ হয় কাফেরদের সাথে। আবিসিনিয়ায় বসে সেসব যুদ্ধবিজয়ের সংবাদ শুনে বেশ আনন্দিত হয় জাফর রা. এবং মনে এক সুপ্ত বাসনা জাগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ করার। তাই নিরাপদ ভেবেই মদিনা অভিমুখে যাত্রা করে ইসলামের প্রথম মুহাজির কাফেলা৷
যখন জাফর রা. এবং তাঁর কাফেলা মদিনা মুনিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছায়, তখন মুসলমানরা তাঁরই ভাই শেরে খোদা আলী রা. এর বীরবলে অর্জিত খায়বার দূর্গের জয়োৎসব করছিল। এমতাবস্থায় জাফর রা. কে পেয়ে রহমাতুল্লিল আলামীন নবী মহাখুশি হন। জাফর রা. কে বুকে জড়িয়ে এবং কপালে চুমু খেয়ে আবেগ উদ্দীপ্ত কন্ঠে বলেন, “আজ আমি জাফরের আগমনে অধিক খুশি না খায়বারের বিজয়ে তা ঠিক বলতে পারছি না।”
সময় গড়িয়ে যায়। অবশেষে ডাক এলো রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের। অন্যায়ভাবে রোমানরা রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূত হযরত হারিস রা. কে হত্যা করে। তারই প্রতিবাদে নবীজি মূতা প্রান্তরে এক সংগ্রামের ডাক দেন। একে একে তিনজন সাহাবীকে রণপতি হিসেবে ঘোষণা দিলেন তিনি। সে দায়িত্ব আসে জাফর রা. এর উপর। বাকি দুজন হলেন নবীজির পালক পুত্র যায়েদ রা. এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা.। তিনজন সেনাপ্রধান নির্বাচন করার পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এঁরা শহীদ হয়ে গেলে তোমাদের মধ্য থেকে মুসলিম সেনাপতি নির্বাচন করে নিও।” এতেই বুঝা যায় তিনজন সেনাপতি সকলই আল্লাহর পানে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। এ ইঙ্গিত অনেক সাহাবীই আঁচ করেছিলেন। খোদ যায়েদ, জাফর, আবদুল্লাহ (রা.)ও বুঝেছিলেন। কিন্তু পিছু হটেননি, ভীত হননি এক মুহুর্তের জন্যেও।
মুতার যুদ্ধের মুসলিমদের তিন হাজার মুজাহিদদের বিপরীতে দুই লক্ষাধিক রোমানীয় সেনা। প্রথমে ইতস্তত করলেও সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. এর ঈমানদীপ্ত ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে মুসলিম বাহিনী। প্রথম সেনাপ্রধান হযরত যায়েদ রা. বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যায়। এরপর পতাকা হাতে নেয় হযরত জাফর রা.। শারীরিক অবয়বের কারণে দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ করছেন। উপমাহীন বীরত্বে রণাঙ্গন কাঁপিয়ে তুলেন জাফর রা.। অপার্থিব এক পবিত্র নেশায় তিনি তখন ব্যাকুল। হটাৎ করে শত্রুর আঘাতে দক্ষিণ হস্ত কেটে যায় জাফর রা. এর। দ্রুত পতাকা তুলে নেন ডান হাতে। এ পতাকা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা, একে তো ভূলন্ঠিত হতে দেয়া যাবে না। কাফিররা এবার আঘাত হানে ডান বাহুতে। তরবারির নিষ্ঠুর আঘাতে কেটে যায় হাত। তবুও তিনি পতাকা ছাড়েননি। কর্তিত দুবাহু দিয়ে চেপে রাখেন রাসূলের দেয়া শুভ্র পতাকা। জীবনের শেষশক্তি দিয়েও অবনত করেননি পতাকা। অমনি এক জালিম রোমানীয় সৈন্যের আঘাতে শাহাদাতের অমৃত পান করে ঘুমিয়ে পরেন হযরত জাফর রা.। তা দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে পতাকা তুলে নিয়ে লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পরে ৩য় সেনাপতি আবদুল্লাহ রা.। একসময় তিনিও শাহাদাত বরণ করেন৷ এরপর চতুর্থ সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন হযরত খালিদ বিন ওলিদ রা.। তাঁর অসামান্য রণনিপুণতা ও দক্ষতায় মুসলিম দল বিজয় লাভ করে। তাই তো তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
মদিনা মুনিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় তাঁর প্রিয় সাহাবিদের লড়াই মসজিদে নববির মিম্বারে বসে মদিনাবাসীর নিকট বর্ণনা করছিলেন। প্রতিটি সাহাবির শাহাদাতের সংবাদ দিচ্ছিনে তিনি। কিন্তু যখন জাফর রা. এর শাহাদাতের খবর বলতে শুরু করলেন, তখন নবীজির নেত্রযুগলে মুক্তোর মতো অশ্রু চিকচিক করে উঠছিলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করেছিলো খুবই মর্মাহত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং জাফর রা. এর বাড়ি গেলেন। নবিজীকে পেয়ে জাফরপরিবার খুশিতে আটখানা। কিন্তু নবীজির তপ্ত অশ্রু দেখে জাফর রা. এর স্ত্রী হযরত আসমা ব্যাপারটা আঁচ করতে পারেন। এ এক বেদনাকাতর মুহূর্ত। নবীজির পবিত্র মুখ মোবারক দিয়ে বের হলো জাফর রা. এর শাহাদাতের সংবাদ। কেঁদে উঠলেন আসমা রা., পাশে নবীতনয়া ফাতেমা রা. ও চাচার শোকে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবারকে জাফর রা. এর পরিবারের কাছে পাঠালেন। আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন জাফর রা. ও উনার পরিবারের জন্য।
হযরত জাফর তাইয়্যার রা. মুক্ত বিহঙ্গের মতোন বেহেশতের বাগানে উড়ছেন তাঁর দুই ইয়াকুতের ডানা দিয়ে৷ জান্নাতের পাখি জাফর রা.। আল্লাহর রাহে যিনি তাঁর দুহাত বিলিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দুটো ডানা দিয়ে দেন। এটিই হলো প্রেমের লেনদেন। এ প্রেমের সওদাতে সর্বদা প্রেমিকেরই জয়োৎসব হয়৷