স্মৃতিবিলাস – অষ্টম পর্ব

0

সপ্তম পর্বের পর… 

স্কুল পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত আমার সার্কেলটা বরাবরই বেশ ভালো ছিল। যদিও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার, তবুও মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বন্ধুবান্ধব-ই ছিল বেশি। সবাই ভালোভাবেই মিশত। যাদের সাথে মেলামেশা করতাম, তারা লেখাপড়ায়ও মনোযোগী ছিল। কোন কিছু শেখার ক্ষেত্রে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল ঠিকই কিন্তু তারপরও সবাই সবার প্রতি সহানুভূতিশীল ও বন্ধুসুলভ ছিল।

 

স্কুল জীবনে যেহেতু আমি পড়াশুনায় প্রথম দিকেই ছিলাম, স্যার আপারা খুব ভালোবাসতেন। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, আদর্শ শিশু বিদ্যালয় থেকে ফাল্গুনী এসে ভর্তি হলো আমাদের স্কুলে। ওর হাতের লেখা ছিল চমৎকার। অল্পদিনেই সবার নজরে চলে এলো সে, তার হাতের লেখার সে কি প্রশংসা! আমার লেখা তখন খুব বেশি ভালো ছিল না। ওর সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম, ফণি স্যারের কাছে নাকি অনুশীলন করে এমন হয়েছে। মনেমনে জিদ করলাম, আমার হাতের লেখাও অমন সুন্দর করতে হবে। অল্পদিনের প্রচেষ্টায় আমার লেখাও ভালো হয়ে গেল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত “হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতায়” জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়ে খুলনাতে গিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম।

 

ছোটবেলা থেকেই চুলচেরা হিসাবের মধ্যে বড় হয়েছি। দামী জামাকাপড় পরার কোন সুযোগ ছিল না, দুই ঈদে কেবল দুটো নতুন জামা বানিয়ে দিতেন আব্বা। তবে আমাকে সাথে নিয়ে বাজারে গিয়ে পছন্দ করতে দিতেন। আমার ইমিডিয়েট বড় দুই বোনের যাবার কোন অনুমতি ছিল না। ওরা আমাকে নানারকম ডিজাইন দেখিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠাত, কারণ তিনজনের জন্য একই কাপড় এবং ডিজাইন বরাদ্দ হতো, স্যান্ডেলও।
একবার কোন এক সমস্যার কারণে আব্বা বললেন, “এবার ঈদে যে কোন একটা জিনিস নিতে হবে, জামা অথবা স্যান্ডেল”।
আমার তখন স্যান্ডেলের প্রয়োজনটাই বেশি ছিল। আমি বললাম স্যান্ডেলই নেবো। আব্বা তবুও বললেন, “এখনও সময় আছে, চিন্তা করে দেখো। ওটা তো পায়ের নিচে থাকবে, কেউ খেয়াল করবে না কিন্তু পুরনো জামা পরে কি ঈদের দিন থাকতে পারবে?” আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। মনে আছে, সে বছর ঈদের দিন আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে নীরবে কেঁদেছিলাম! যা হোক, অনার্স লাইফে আমি বি.এল. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মন্নুজান হলে থাকতাম। সেখানে নানান পরিবেশের এবং পরিবারের অনেক মেয়ে থাকত। তাদের দেখে অনেক কিছু শিখেছি। মায়া নামে একজন সিনিয়র দিদি ছিলেন, বেচারার ঠিক তিন সেট জামা ছিল, দুই সেট ঘরে পরতো আর এক সেট পরে প্রতিদিন ক্লাসে যেত। দিদির রুমমেটরা তাকে কাপড় কিনে দিতে চাইলেও উনি নিতেন না। এটা জানার পর আর কখনও আমার অভাববোধ হয়নি।

 

১৯৯৩ সালের কথা, আমার মিলচার্জ ছিল তখন প্রতিদিন ১৭ টাকা, সকালের নাস্তা ৪ টাকা, দুপুর ও রাতের খাবার ৬.৫০ টাকা করে। সে হিসাবে মাসে খাবার খরচ ছিল ৫১০ টাকা, সিট ভাড়া ৫০ টাকা, ৪০ টাকা হাতখরচসহ আব্বা আমাকে মাসে ৬০০ টাকা দিতেন। সেটা দিয়েই সব প্রয়োজন মিটিয়েছি।
কখনও যদি বন্ধুদের কোন গিফট দেবার প্রয়োজন হতো, তখন সকালের মিল অফ করে দিতাম। পাঁচ-ছয় দিনের নাস্তার টাকা জমিয়ে তখন ২০-২৫ টাকায় অডিও ক্যাসেট কেনা যেত। এটাই ছিল জনপ্রিয় উপহার।
মাঝেমাঝে প্রিয় গানগুলো বাছাই করে সেগুলো মিলিয়ে অডিও ক্যাসেট তৈরী করা হত। খুব কাছের বন্ধুদের জন্য আরও একটু কষ্ট করে বই কেনা হতো। বাড়িতে চিঠি পাঠাতাম ৫০ পয়সার পোস্ট কার্ডে অথবা ১ টাকার খামে।

 

আব্বা প্রতি সপ্তাহে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, বাড়ি থেকে মা হাতের কাছে যা পেতেন, পাঠিয়ে দিতেন। যাবার সময় আব্বা জিজ্ঞেস করতেন, “টাকা লাগবে তোমার?” “না”, সহজ উত্তর দিয়ে আব্বাকে বিদায় দিতাম। গেস্টরুমে অন্য কোন রুমমেট বা আপুরা থাকলে, বলতো- ‘টাকা তো দরকার তোমার, বললেই পারতে’। হেসে বলতাম, খুব একটা সমস্যা তো হচ্ছে না। ততদিনে সংসার খরচ কিছুটা কমলেও আব্বা চাকরি থেকে অবসরে চলে যান। আমার আর ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ তখনও চলছিল। বড় ভাইয়ের সংসারটাকেও চালিয়ে নিতে হতো আব্বাকেই।

 

আমার রুমমেট ছিল বুলবুল। ওর মা ওকে হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে পড়ার খরচ দিত। বিষয়টি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম। একবার গিয়েছিলাম ওর মাকে দেখতে, মাটির ছোট একটা জীর্ণ কুটির, তারই বারান্দায় বসে খুব কাঁশছিলেন, অ্যাজমা ছিল উনার। বাড়ি গিয়েই সমস্ত কাজ শুরু করতে হতো বুলবুলকে, তার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গেছে, স্বপ্ন ছিল- ভালো চাকরি পাবে, মা সুস্থ হবে। শুনেছি বুলবুল একটা ভালো চাকরি পেয়েছে, তবে ওর চাকরি পাবার আগেই মা পৌঁছে গেছেন শেষ ঠিকানায়!

 

বড় আপুদের মধ্যে পান্না, মুক্তি, ডল, মনি… ওরা আমাকে খুব আদর করতো। একবার আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল, জ্বর কমানোর জন্য আমাকে আনারস খাইয়েছিল। কেউ একজন দুধ খেতে দিয়েছিল। সম্ভবত মারাত্মক অ্যাসিডিটি হয়েছিল, ওরা ভেবেছিল আমি বোধহয় সে রাতেই মারা যাবো। হল সুপারের অনুমতি নিয়ে সেই রাতে ওরাই আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করেছিল।

 

যখন সময় ছিল, বাইরে ঘোরার বয়স ছিল, তখনও খুব বেশি বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়নি, কারণ হলে ছোট-বড় যাদের সাথে মিশেছি সবাই খুব ভালো ছিল। বি.এড. করার সময় রুপা, অনু, শিমুল, মুনা আর আমি একসাথে থাকতাম সবসময়, সবাই “ফাইভ স্টার” বলে ডাকতো। ওরা সবাই বয়সে আমার চেয়ে একটু হলেও ছোট ছিল কিন্তু মনমানসিকতায় একইরকম। খুব সংক্ষিপ্ত সময় আমরা একসাথে ছিলাম কিন্তু ওদের সহযোগিতার কথা কখনও ভোলার নয়। এখন সহকর্মীদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখছি, শেখার সত্যিই কোন শেষ নেই, বয়সও নেই।

 

ছেলেবেলা থেকে বন্ধু নির্বাচনে খুব খুঁতখুঁতে মনোভাব ছিল আমার, এখনও আছে। যাকে ভালো লাগে না তার সাথে মিশতে পারি না, চেষ্টাও করি না, তাকে আমার প্রয়োজন হলেও নয়। এটা ভালো না-কি মন্দ অভ্যাস জানি না, তবে সমবয়সী দল নির্বাচনে পছন্দ-অপছন্দ থাকার কারণে ফেলে আসা জীবনের দীর্ঘ সময়ে কারও কাছ থেকে খুব বেশি ক্ষতির কিছু ঘটেনি কখনও।
বেড়ে ওঠার সেই ক্ষণে গণমাধ্যম বলতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুর সাথে আমার সংযোগ ছিল না, কাঠের তৈরী বড় একটা রেডিও ছিল আব্বার, খবর শুনতেন। আমরা সুযোগ পেলে গান শুনতাম। পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে কোন কিছু পেলেই পড়তে ভালো লাগত। বাদামের ঠোঙা, রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজ যাই পেতাম গায়ের লেখাগুলো পড়ে ফেলতাম। খবরের কাগজে (ইত্তেফাক/ইনকিলাব) সপ্তাহে একদিন শিশুদের জন্য একটা পাতা বের হতো, সেটা নিয়ে সবাই টানাটানি করতাম, ছড়া, কার্টুন পড়া হতো। আরও একটু বড় হবার পর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখাগুলো নিয়ম করে পড়তাম, শব্দের খোলগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম। বাড়িতে টিভি না থাকায় পেপার পড়ার অভ্যাসটা ভালোভাবে গড়ে উঠেছিল। সমাজের বিভিন্ন অসংগতিপূর্ণ খবরগুলো খুব ব্যথিত করতো! মাঝেমাঝে লেখালেখি করতাম চিঠিপত্র কলামে…।
১৯/০৩/২০২১
চলবে…
আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না