স্মৃতিগত তাৎপর্যে ডক্টর এনামুল হক লিখেছেন সৈয়দ আলী আহসান

0

কবে প্রথম সাক্ষাৎ হয় মনে নেই, সম্ভবতঃ দেশ বিভাগের পরে ১৯৪৮ কি ১৯৪৯ সালে ঢাকায়। এর পূর্বেও সাক্ষাৎ হয়ে থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু সে ঘটনাকে স্মৃতির আয়ত্তে আনতে পারছিনা। এক সময় তাঁর লেখা পড়ে মুসলমান হিসাবে নিজেকে সমৃদ্ধমান ভেবেছিলাম। তাঁর তিনটি লেখার কথা আমার বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। একটি প্রবন্ধ ছিল মিশরীয় ভাস্কর ‘মুখতার’ সম্পর্কে একটি শিল্পকলা বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রবন্ধটিতে শিল্পের কলা-নৈপুণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। প্ৰবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, ‘প্রবাসীত’ । অন্য একটি প্রবন্ধ দারাহ্ শিকোর ‘মুজমুঅল বাহরায়ন’ অবলম্বনে। ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির একই স্রোতো-ধারা বিষয়ে একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবেচনা। এ লেখাটি বোধ হয় ‘বুলবুল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তৃতীয় লেখাটি ছিলো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের দান সম্পর্কে। লেখাটির নাম ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’। এটি ছাপা হয়েছিলো ‘ছায়া-বীথি’ পত্রিকায়। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক কিন্তু তৃতীয় লেখাটির দ্বারাই এবং সমধর্মী অন্যান্য লেখার দ্বারাই সকলের কাছে পরিচিত। এনামুল হকের গবেষণা কর্মে প্রথম দুটি রচনার ধারাক্রম রক্ষিত হয়নি। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “যেখানে আমার নিজস্ব বক্তব্য নেই, অন্যের বক্তব্যের সারাৎসার মাত্র উদ্ধার করতে হচ্ছে, সে-সব ধরনের রচনায় প্রথম জীবনে উৎসাহ ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই।” তিনি অত্যন্ত বিবেচনা করেই মধ্যযুগের সাহিত্য এবং তার ইতিহাস, বাংলা ভাষা এবং তার ব্যাকরণ তাঁর গবেষণা এবং বিবেচনার বিষয় করেছিলেন। এ-পথ যাত্রায় তাঁর দক্ষতা ছিলো, সঙ্গী সাথীদের প্রতি কঠোরতা ছিলো—কখনও কখনও অবিবেচনাও ছিলো কিন্তু নিজস্ব পদচারণায় কোনও বিচ্যুতি ছিলোনা।

 

এনামুল হক যে-কাজেই হাত দিতেন কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গেই তা সম্পন্ন করতে চাইতেন। পাকিস্তান হবার পর স্কুলের পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুতির দায়িত্ব এসে পড়ে ঢাকা বোর্ডের হাতে। ম্যাট্রিকের বাংলা সিলেক্শন কমিটিতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ডক্টর এনামুল হক, অধ্যাপক আবদুল হাই ও আমি ছিলাম। পর পর কয়েকটি বৈঠকেও আমরা একটি সম্মিলিত পাঠ্যসূচী নির্মাণ করতে পারছিলাম না। একটি বৈঠকে শহীদুল্লাহ্ সাহেব উপস্থিত ক্ষেত্রেই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রবন্ধ, কবিতা ও গপের একটি তালিকা প্রস্তুত করে বলেন, “এগুলোই সিলেকশনে থাকতে পারে। হক সাহেব দেখে বলুন কোনও সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিনা।” হক সাহেব বললেন, “আমি লাইব্রেরীতে বসে মূল লেখা পাঠ করে তবেই বলতে পারবো সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিনা।” শহীদুল্লাহ্ সাহেব বললেন, “তাতে-তো অনেক সময় যাবে। কোন্ লেখা কি কিরকম তাতো আমরা লেখার শিরোনাম এবং লেখকের নাম দেখেই বলতে পারবো। সবই তো পড়া।” এনামুল হক কিন্তু এতে রাজী হননি। প্রায় দিন পনেরো প্রত্যহ পারিশ্রম করে মূল গ্রন্থ অনুসন্ধান করে লেখাগুলোর উপযুক্ততা পরীক্ষা করেছিলেন। অবশ্য পরীক্ষা শেষে শহীদুল্লাহ্ সাহেবের সিদ্ধান্তকেই মান্য করেছিলেন। এ আচরণ ছিলো তাঁর রক্তমজ্জায় এবং তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে। সহজ সম্পাদ্য বলে কোনও কিছু তাঁর কাছে ছিলো না, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করেই তিনি সিদ্ধান্তে আসতেন এবং সে-সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন।

 

তাঁর রচনায় সাহিত্য সৃষ্টির আনন্দবোধ ছিলোনা কিন্তু পরিশ্রম এবং ব্যাকরণের নিষ্ঠা ছিলো। বিদ্যাসাগরের আমলে সংস্কৃত পণ্ডিতগণ বিশেষের দ্যোতনা আনতে চাইতেন ভাষায় কিন্তু সুন্দরের দ্যোতনা নয়। তাঁরা ভাবতেন সুন্দরের সহায়তায় আবেশ জাগে এবং বস্তু-পরিচয় স্পষ্ট হয়। তাঁরা লিখতেন ‘বিস্পষ্ট’ অর্থাৎ বিশেষ রূপে স্পষ্ট কিন্তু বিদ্যাসাগর একে পরিত্যাগ করে ‘সুস্পষ্ট’কে গ্রহণ করলেন যার অর্থ হল সুন্দররূপে স্পষ্ট। এনামুল হক সাহেব সুন্দর-অসুন্দরের বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে ‘বিশেষের’ প্রস্তাবনাকেই ধার্য করেছেন চিরকাল। আমাদের মধ্যে মতের মিল হয়নি কিন্তু বিতর্কের প্রয়োজনও হয়নি। এনামুল হক সাহেব বলতেন, “সিদ্ধান্তটি বিপুল কালের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কালক্রমে যে কোনও একটি গৃহীত রূপে সচল থাকবে।”

 

তিনি একবার ভাইস চ্যান্সেলারের বাংলা প্রতিশব্দ করেছিলেন ‘উপ-মহাধ্যক্ষ’। আমি এটিকে মেনে নিতে পারিনি। আমি বলেছিলাম, “অক্ষকে অধিকার করেন যিনি তিনিই অধ্যক্ষ অর্থাৎ মহাদেব কিন্তু বেদ শিক্ষা যিনি দেন তিনি আচার্য। তাহলে শিক্ষার সঙ্গে আচার্য শব্দের সংহতি এবং হিন্দুধর্মের সঙ্গে অধ্যক্ষ শব্দের সহধর্মিতা।” এনামুল হক এর প্রতিবাদ করেননি কিন্তু উপাচার্য থাকাকালীন নিজেকে উপমহাধ্যক্ষ রূপেই পরিচিত রেখেছিলেন। একদিন শুধু বলেছিলেন, “অধ্যক্ষ শব্দটি আপনি মানলেন না কেননা আপনার মনে কলেজ অধ্যক্ষ শব্দটি একটি জাত্যাভিমান এনে দিয়েছে। আপনি মনে করছেন উপমহাধ্যক্ষ হয়েও লোকেরা হয়তো আপনাকে কলেজের প্রিন্সিপাল ভাবাবে। সুতরাং ভিন্ন জাতি হিসেবে আপনি উপাচার্য থাকতে চান।” এ-ব্যাপারে আমরা একে অন্যের বিরোধটি সম্মানের সঙ্গেই মেনে নিয়েছিলাম।

 

‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের’ সদস্য হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দিয়েছিলেন। নতুন নাম হয়েছিলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান অধ্যায়োগ’। আমি এটাও মেনে নিতে পারিনি। বলেছিলাম, “মঞ্জুরী ও দান এক কথা নয়-মঞ্জুরী হচ্ছে sanction, দান হছে gift। আমরা সরকারের কাছ থেকে দয়ার ভিক্ষা নিচ্ছিনা, অধিকারের মঞ্জুরী নিচ্ছি। তাছাড়া উপসর্গ ‘অনু’র সংযোগে শব্দটির অর্থ সঙ্কোচ ঘটেছে। অর্থ হয়েছে ক্ষুদ্র দান। তা ছাড়া Commission অর্থে অধ্যায়োগ বাংলা ভাষায় একটি অপপ্রয়োগ। হিন্দীতে Commission অর্থে ‘অয়োগ’ ব্যবহৃত হয়, যে-অর্থে ভারতীয় হাই কমিশন ‘ভারতীয় উচ্চায়োগ’। সুতরাং আপনার ‘অনুদান অধ্যায়োগ’ চলবে না।” তিনি আমার কথা শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন। মোট কথা, তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা যেন তার নিজস্ব উপকরণে সমৃদ্ধ হয়ে জাগ্রত থাকে। ভাষার নিজস্ব প্রবাহে বিজাতীয় শব্দ তাঁর কাছে বন্ধুর প্রস্তরের মতো মনে হত যেন আঘাত খেলে ভাষা বিপর্যস্ত হবে। তবে এক্ষেত্রে সংস্কৃতকে তিনি বিজাতীয় ভাবতেন না। তিনি বললেন, “দণ্ডীর কাব্যদশে গৌড়ের ভাষাকে বলা হয়েছে ‘গৌড়দ্যা সংস্কৃতস্থা’ তাতে মনে হয় প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের উপর নির্ভরশীল ছিলো। সুতরাং সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার নৈকট্য যতটা অন্য ভাষার ততটা নয়। তাই আমি বিদেশী শব্দ প্রত্যাহার করে সংস্কৃত শব্দ গ্রহণের পক্ষপাতি।”

 

ডক্টর এনামুল হক অত্যন্ত দায়িত্ববান ব্যক্তি ছিলেন। অর্পিত দায়িত্বকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। মনে আছে, ১৯৬১ সালে দিল্লীতে আমরা অনেকে গিয়েছিলাম পাকিস্তান-ভারত সংস্কৃতি সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শাখায় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করবার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। পশ্চিম বঙ্গের পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্লেনারী সেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পেশকৃত বক্তব্যকে ইংরেজীতে উপস্থাপনার দায়িত্ব পড়লো ডক্টর এনামুল হকের উপর। তিনি আমার সঙ্গে বসে আমার বক্তব্যকে ইংরেজীতে প্রস্তুত করতে থাকেন। এতে আবদুল কাদির আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তুমি অন্যের বক্তব্য পেশ করবে কেন?” এনামুল হক উত্তরে বলেছিলেন, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি এবং এ দায়িত্ব পালনে তিলমাত্র বিচ্যুতি না ঘটে সেদিকে আমি লক্ষ্য রাখছি।” দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, সততা এবং অকুতোভয় ডক্টর এনামুল হককে একটি অনন্য বিশিষ্টতায় মণ্ডিত করেছিলো।

 

যৌবনে ডক্টর এনামুল হক প্রথানির্ভর ছন্দে কিছু কবিতা লিখেছিলেন। এটি আমি জানতাম না। তিনিও গোপন রেখেছিলেন। একটি প্রস্থের উৎসর্গ-পত্রে আবদুল কাদিরকে লক্ষ্য করে লেখা একটি চৌপাই আমাদের অনেকের কৌতুকের কারণ হয়েছিলো। এনামুল হক বলেছিলেন, “আমি আপনাদের মতো ‘অলাতচক্র’ ‘বিবমিষা’ এ-সমস্ত শব্দ যোগাড় করে ছন্দহীন তাণ্ডব নির্মাণ কারিনা, আমি গুরুজনদের পন্থা অনুসরণ করি।”

ডক্টর এনামুল হক ছিলেন বলেই আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদের ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ একটি সুশৃঙ্খলা বিন্যাসে প্রকাশ পেয়েছিলো। পরবর্তী কালে নতুন নতুন গবেষণায় অনেক নতুন তথ্য উদ্ঘাটিত হলেও সূত্রপাতের এ-গ্রন্থটি কালজয়ী হয়ে রয়েছে! আমার মনে হয় এ-গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের নিকট তথ্যগত কারণে চিরকাল বিচার্য থাকবে এবং সম্মানের সঙ্গে বিবেচিত হবে।

এনামুল হক সাহেবের দুর্বলতা ছিলো আলাওলের জন্মস্থান নিয়ে। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, আলাওল চট্টগ্রামের অধিবাসী ; কিন্তু আভ্যন্তরীণ এবং ঐতিহাসিক নিরীক্ষায় স্পষ্ট হয় যে আলাওলের পিতৃভূমি এবং জন্মস্থান ফরিদপুরের ফতেহাবাদ পরগনা। আবদুল করীম সাহিত্য বিশারদও এ-মতকে গ্রাহ্য করেন। কিন্তু এনামুল হক সাহেব এ-মত খণ্ডন করবার চেষ্টা না করলেও এ-ব্যাপারে তার একটি নিঃশব্দ প্রতিবাদ ছিলো। বলতেন, “যতদিন না নতুন তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে, ততদিন আপনাদের অবিষ্কারের বিরুদ্ধে কিছু বলবোনা। আমারও শুভদিন আসতে পারে, অপেক্ষা করুন।”

ব্যাকরণের শৈথিল্য তিনি সহ্য করতে পারতেন না। শব্দ ব্যবহার এবং বাক্যের অন্বয়-বন্ধনের ক্ষেত্রে তিনি সীমাহীন শাসক ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রচণ্ড অহঙ্কার ছিলো। একটি শুচিতা এবং নির্ণেয় বিবেচনাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাংলা ভাষার রাজ্যে পরিভ্রমণ করেছেন। আজ যখন শিথিলতার সঙ্গে আমাদের সহবাস তখন এনামুল হক সাহেবের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের অগ্রগামী একজন বিস্ময়কর প্রতাপী পুরুষ।

 

ভাষা-সাহিত্য পত্র : নবম বর্ষ ১৩৮৮, ২০০-২০৪ পৃষ্ঠা (বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে গৃহীত; কর্তৃপক্ষের নিকট আমরা ঋণী।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না