স্মৃতিবিলাস – দ্বাদশ পর্ব

0

একাদশ পর্বের পর…

 

আড়াই যুগের কাছাকাছি সময় পার হয়ে গেছে, প্রায় ২৯ বছর পর আজ প্রিয় প্রাঙ্গনটিকে নিয়ে লিখতে বসে কতো কথাই যে মনে পড়ছে! চোখের সামনে এখনও নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে সেইসব দিনগুলো।

মনে করার চেষ্টা করলাম, তার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে? না, কলেজ জীবনের শুরুতে নয়। পি. সি. কলেজের সাথে একটা পরোক্ষ সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল স্কুল জীবনের শুরুতেই, বলতে গেলে প্রথম শ্রেণি থেকেই।

 

আমার স্কুল ‘বাগেরহাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’র তখন নিজস্ব কোনো শহীদ মিনার ছিলো না কিন্তু আমার প্রিয় স্কুল শিক্ষকেরা সেই শিশু বয়সেই হৃদয়ের গহীনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কাক-ডাকা ভোরে জড়ো হতাম স্কুলের মাঠে। ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটে ওঠার আগেই শুরু হতো ‘প্রভাত ফেরি’। অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক খালি পায়ে রাস্তার দুই ধারে লাইন করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতো, মাঝখানে মাইকে বাজতো সেই হৃদয় ছোঁয়া গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…!”

 

আমলাপাড়া-সরুই-হরিণখানা… ব্রীজটা পার হলেই চোখে পড়তো পি. সি. কলেজের শহীদ মিনারটিকে। শহীদ মিনারের দেয়ালটা একটু অন্যরকম ছিল, অনেকটা সাগরের ঢেউয়ের মতো। হাতে ফুল নিয়ে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যেতাম, প্রচণ্ড ভীড় হতো সেদিন কারণ আশেপাশের সব প্রতিষ্ঠানগুলোও শ্রদ্ধা জানাতে এখানেই আসতো। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে ফুল দিয়ে আসতাম, অদেখা মানুষগুলোর জন্য সেই ছেলেবেলাতেই কী ভীষণ মায়া তৈরী হয়েছিল হৃদয়ের গভীরে, সেই সাথে শহীদ মিনারটির জন্যও। মিনারের ঠিক পেছনেই ছিলো একটি বহুবর্ষী কৃষ্ণচূড়া গাছ, বহুদূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল তার শাখা-প্রশাখা। হলুদ মেশানো টকটকে লাল রঙের ফুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো শহীদ মিনারের আল্পনা আঁকা বেদীতে, কি যে অপরূপ শোভা ছিল তার!

 

শহীদ মিনারটির ডান দিকে ছিল পি. সি. কলেজের প্রধান ফটক। ফটকটি পার হতেই ডান দিকে রাস্তার শুরু আর রাস্তার বাম দিক থেকে মাঠের শুরু। চারিদিকে প্রাচীর ঘেরা বিশাল আকৃতির মাঠ, প্রাচীরগুলো মাঝারি উচ্চতার কিন্তু চওড়া স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। মাঠের ভেতরে তরতাজা সবুজ ঘাস, পরিধি জুড়ে নারকেল পাতার এলোমেলো হাওয়া, অনায়াসে দৃষ্টি কেড়ে নেয়!

 

রাস্তা ধরে একটু সামনে এগোলেই ডান পাশে পরপর দুটো ভবন, আইসিটি ও বানিজ্য ভবন। একটা ভবনের সামনের দিকে ব্যাংক ও অন্য ভবনটির কিছু অংশ জুড়ে পোস্ট অফিস ছিল। আরও কিছুদুর সামনে এগোলেই ডান পাশে কলা ভবনের গেট, গেটের দুইপাশে দুটো বড় বড় ঝাউ গাছ ছিল। গেটের ঠিক বামপাশে সুউচ্চ মর্যাদায় দাঁড়িয়ে পরম শ্রদ্ধেয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রতিকৃতি, যিনি শতবর্ষ আগে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন।

 

১৯১৬ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে তৎকালীন খলিফাতাবাদ ও হাবেলী বরগুনার জমিদার, কিছু সাধারণ মানুষ ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণ মিলে কলেজটির ভিত্তিফলক স্থাপন করেন।

১৯১৮ সালের ৯ আগস্ট কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বাগেরহাট কলেজ’ নামে স্বীকৃতি দান করেন। পরে ১৯৩৩ সালে বিখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম অনুসারে ‘পি. সি. কলেজ’ নামকরণ করা হয়।

কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন কামাক্ষাচরণ নাগ, তিনি টানা ২২ বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের কাজ শেষে তিনি এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণকে সাথে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে শিক্ষার্থী ও অর্থ যোগাড় করতেন। সেই মানুষগুলোর নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ক্যাম্পাসের ২০ একর জমি এবং প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত ব্যাপক সমৃদ্ধি। সেই থেকেই দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের মৌলিক চাহিদা শিক্ষার মান শতভাগ পূরণে অসামান্য অবদান রেখে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

গেট পার হয়ে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপর আড়াআড়িভাবে কলাভবন, বাম পাশে অধ্যক্ষের কার্যালয়, তার পাশে উপাধ্যক্ষের কার্যালয়সহ প্রশাসনিক ভবন। এদিক থেকে বের হবার ছোট আর একটা গেট ছিল। বিপরীত পাশে মাঠের সীমানাও এখানেই শেষ। এখান থেকে রাস্তাটা বামে খানিকটা বাঁক নিয়ে আবার সামনের দিকে এগিয়েছে। ডানে অধ্যক্ষের বাসভবন, তার পাশে অন্যান্য শিক্ষকদেরও গাছপালা ঘেরা অনেক পুরনো কিছু বাসভবন ছিল। ব্যাচেলর শিক্ষকদের জন্য লম্বালম্বিভাবে কিছু কোয়ার্টারও ছিল।

 

রাস্তা বরাবর আরও দশগজ সামনে এগিয়ে গেলেই বিজ্ঞান ভবন, এর সাথেও সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল স্কুল জীবনে। প্রতিবছর কলেজের বিজ্ঞান মেলায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হতো, পারিবারিকভাবে এবং স্কুলের পক্ষ থেকেও যাবার অনুমতি ছিল। আমার কাছে মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বড় বড় কাঁচের বোতলে রাখা বিভিন্ন আকৃতির শিশুগুলো। কোনো কোনোটির অবয়ব ঠিকমতো বোঝা যেতো না, কোনোটি দেখে মনে হতো একেবারে জীবন্ত, কোনো শিশুর আবার মাথাভর্তি চুল, দেখে মনে হতো যেনো ঘুমিয়ে আছে, একটু শব্দ হলেই জেগে যাবে। ওদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অনেক কথা ভাবতাম, আহা! এরা বড় হলে কেমন হতো এদের জীবন!

 

পি. সি. কলেজে পড়ার স্বপ্নটা তাই স্কুল জীবন থেকেই মনের মাঝে লালন করেছি। তবে স্বপ্নপূরণ করা অতো সহজে সম্ভব হয়নি। ১৯৯০ সালে যশোর বোর্ডে এস. এস. সি পরীক্ষার ফল বিপর্যয় ঘটে। আমার স্কুল থেকে মাত্র চারজন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। আমি যদিও তাদের মধ্যে ছিলাম তবুও কলেজে ভর্তি হবার ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে নানান প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছিল। আব্বার একটাই কথা ছিল- “তোমার বড় বোনেরা সবাই মহিলা কলেজে পড়েছে, তুমিও সেখানেই পড়বে। এটা নিয়ে এতো ভাববার তো কোনো অবকাশ নেই। নিজের চেষ্টা থাকলে সবখানেই ভালো করতে পারবে।”

 

দু’টি কলেজই আমাদের বাসা থেকে প্রায় একই দূরত্বে অবস্থিত। কাজেই দেখানোর মতো তখন কোনো অজুহাতও ছিল না। মফস্বল শহরে সবগুলো ভালো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের মধ্যে মোটামুটি চেনা-জানা ছিল। ওদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে বড় বোনের সহায়তায় পি. সি. কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, টিকেও গেলাম কিন্তু আব্বা তখনও তার সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে আমার এক ভগ্নিপতি (মর্তুজা হোসাইন) এবং স্কুলের কিছু প্রিয় শিক্ষকের অনুরোধে আব্বা নিজের মত বদলেছিলেন, আমিও হাতে পেয়েছিলাম চিরচেনা আকাশটাকে!

 

আমাদের সময়ে কলেজে স্কুলের মতোই টানা ক্লাস করতে হতো। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কারণে আড্ডাবাজির তেমন কোনো ফুরসত ছিলো না। ক্লাসের পরপরই আবার ব্যবহারিক ক্লাস থাকতো, শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। বিজ্ঞান ভবনের তিনতলায় উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান ক্লাস হতো। লাল স্যার অনেক যত্ন করে হাতে ধরে ধরে কাজ শেখাতেন।

 

বিজ্ঞান ভবনের সামনে একটা ছোট পুকুর ছিল, দুপুরবেলা গাছের পাতার ফাঁক গলে কিছুটা রোদ গিয়ে বসতো সেই পুকুরের জলে, দূর থেকে জলের উপর আলো-ছাঁয়ার অপূর্ব খেলা, ক্লাসের মাঝেও মন কেড়ে নিতো। ডানদিকে একটা নতুন ল্যাবরেটরি ভবন তৈরী হয়েছিল, সেখানে পদার্থ ও রসায়নের ব্যবহারিক ক্লাস হতো। করিম স্যার লবন তৈরী করা শেখাতেন, কাগজের টুকরায় লিখে ভাঁজ করে হাতে দিতেন, অনেকটা লটারীর মতো। সেটা কোন লবন, তা প্রমাণ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো। কলেজের পিয়ন কালিপদ, মাঝে মাঝে নোটিশ নিয়ে আসতো। খুব দ্রুত চলাফেরা করতো মানুষটা, স্যার বলতেন- কালিপদ হাঁটে না, ছোটে।

 

বিজ্ঞান ভবনের খানিকটা পেছনেই কলেজের সীমানার শেষ। শেষ সীমানার কিছুটা আগে রাস্তার ডানপাশে একটা বয়সী রাঁধাচূড়ার গাছ ছিল। গাছের গোড়ায় সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো থাকতো, তার উপর ঝরে পড়া গাদা গাদা হলুদ রঙের ফুলগুলোকে মনে হতো, হাঁসের বাচ্চার তুলতুলে নরম শরীর। কলেজের সীমানার শুরুতে কৃষ্ণচূড়া আর শেষে রাঁধাচূড়া, জানি না কোন উদ্দেশ্যে, কে এভাবে গাছ দুটো লাগিয়েছিল, তবে বিষয়টা ক্যাম্পাস জুড়ে দারুণ আবহ সৃষ্টি করেছিল, সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিল শতগুণ।

 

মূল ক্লাস আর ব্যবহারিক ক্লাসের মাঝে অবসর পেলে মাঝে মাঝে দল বেঁধে পুকুর পাড়ে যেতাম। বড় মাঠটির পাশেই ছিল পুকুরটা। লোকে বলতো- মিষ্টি পানির পুকুর। এলাকার অনেক মানুষ নাকি এই পুকুরের পানি পান করতো। মাঝে মাঝে সাদা শাপলা ফুটতো। শান বাঁধানো ঘাট, কতো আগে তৈরী কে জানে! ঘাটের দু’একটা সিঁড়ি ভাঙা ছিল, কিছুটা শ্যাওলা ধরা, যেটা নিজেই তার আভিজাত্য বহন করতো। সিঁড়ির ঠিক উল্টো দিকে পুকুরের পাড় ঘেঁষে বসলে হাত দিয়ে পানি ছোঁয়া যেতো। আরও একটু ভালো করে গভীরে তাকালেই জলের সংসার! ঝাঁঝি, পাতাঝাঁঝি… জলজ উদ্ভিদগুলো ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে থাকতো। তাদের গলাগলির ফাঁক দিয়ে সাঁতরে যেতো ছোট ছোট ডানকিনে মাছ। পুকুরের কিনার ঘেষে লম্বা লম্বা ঘাস জাতীয় কিছু উদ্ভিদ ছিল, তাদের গায়ে লেগে থাকতো রঙ বেরঙের ছোট ছোট শামুক। চোখ বন্ধ করলে এখনও সেইসব স্মৃতি হৃদয়ে একই অনুভূতি জাগায়!

 

আমাদের সময়ে দক্ষিণ বঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ হিসেবেই পরিচিত ছিল কলেজটি। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, বিভিন্ন ক্লাবের কার্যক্রম, বিশেষ দিনগুলো উদযাপনসহ সামাজিক আন্দোলনের বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হতো কলেজের পক্ষ থেকে। নিয়ম কানুনও ছিল যথেষ্ট কড়া। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতো এখান থেকে জ্ঞান লাভের আশায়। আমাদের ব্যাচেও ছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অনেক ছেলে-মেয়ে। তখন কলেজে এইচ.এস.সি’র পড়াশোনাটাই মূল বিষয় ছিল, সাথে কেবল বাংলা বিভাগে অনার্স কোর্স চালু ছিল, মাস্টারস এর কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

 

ঐ সময়ে অধ্যক্ষ ছিলেন মুজিবর রহমান স্যার। জ্ঞানে গুণে অতুলনীয় একজন মানুষ। তখনকার একটা ঘটনা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়:- ছয় জনের একটা গ্রুপ ছিল আমাদের, আমি, রিমি, আন্না, নূপুর, আঁখি ও দিপা। রিমি ছিল অপরূপ সুন্দরী! তখনকার জেলা সিভিল সার্জনের ছেলে ‘মিথুন’ও আমাদের সাথে মানবিক বিভাগে পড়তো। ছেলেটা রিমিকে অসম্ভব পছন্দ করতো। কলেজ ছুটির পর আমরা দল বেঁধে বাসায় ফিরতাম। মিথুনও দল বেঁধে পেছন পেছন আসতো এবং নানারকম মন্তব্য করতে করতে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো। ওর একটা মোটর সাইকেল ছিল, সেটা নিয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরপাক দিতো। একবার আমরা বিরক্ত হয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে ওর নামে বিচার দিয়েছিলাম। এর সপ্তাখানেক পর আমাদেরকে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল। গিয়ে দেখি প্রিন্সিপাল স্যারসহ আরও বেশ কয়েকজন স্যার বসে আছেন। তাদের সামনে মাথা নিচু করে মিথুন দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্সিপাল স্যার আমাদেরকে দু’একটি করে প্রশ্ন করছিলেন। অরুণ স্যার কিছুটা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন- “স্যার, ওরা আর কি বলবে, দেখেন ছেলের অবস্থা! পড়াশোনার নাম নেই, কানে দুল পরেছে, গলায় আবার সোনার মালা পরেছে!” আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটু হেসেছিলাম। সেদিন প্রিন্সিপাল স্যার মিথুনের জন্য শাস্তি বরাদ্দ করেছিল, পাঁচ ঘণ্টা টয়লেটে আটকে রাখা।

 

এই ঘটনার পর আর কোনোদিন বিরক্ত করা তো দূরের কথা, মিথুনকে আমাদের চারপাশেই দেখা যায়নি। এতোটা সাহস নিয়ে কে আর এখন দায়িত্ব পালন করবে। সেই সুযোগও হয়তো নেই অথবা সেই ধরণের ছাত্র, যে তার শিক্ষাগুরুর কথা অকাতরে মেনে নেবে। এখনকার দিনে অমন ঘটনা ঘটলে হয়তো ঐ শিক্ষকের জীবননাশের মতো জঘন্য পরিণতিও হতে পারতো।

 

কলেজের অনেক শিক্ষকের পড়ানোর ধরণটা এখনও মনে আছে। রসায়ন পড়াতেন মোজাফফর স্যার, তিনি বিজ্ঞানীদের সাহেব বলে সম্বোধন করতেন, নিউটন সাহেব, ডালটন সাহেব… আমার কাছে তখন মনে হতো, স্যারের দক্ষতা ও আভিজাত্য ঐ বিজ্ঞানীদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। জলি স্যার প্রাণিবিজ্ঞানের চিত্রগুলো রঙিন চক দিয়ে খুব সুন্দর করে বোর্ডে এঁকে লম্বা পয়েন্টার দিয়ে বোঝাতেন। স্যারের অপূর্ব উপস্থাপনের কথা মনে রেখেই প্রাণিবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছি এবং শিক্ষকতা-জীবনের শুরুতে এক বক্স রঙিন চক কিনেছিলাম। অরুণ স্যার ক্লাসে গাছ লতাপাতা নিয়ে এসে উদ্ভিদ চেনাতেন, নুরুল ইসলাম স্যার রসহীন পদার্থবিজ্ঞানকে নিজের পাণ্ডিত্য দিয়ে অনেক সহজ করে দিতেন। গোলাম রসুল স্যার এবং রবিন স্যারের ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোর ধরণটা অসাধারণ ছিল, ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পড়ানোর পর অনেক ছেলেই দেয়ালে লিখে রাখতো- অ্যালিস, তোমাকে ভালোবাসি, জিম আর ডেলার মতো ভালোবাসাও তৈরী হয়েছিল অনেকের হৃদয়ে। কমল স্যারের ‘হৈমন্তী’ গল্পটা পড়ানোর শেষে কি যে প্রতিবাদী হয়েছিল মন! মনে হতো, বড় হয়ে ভেঙে ফেলবো সব অকারণ বিধি নিষেধের দেয়াল! কাসেম স্যার ‘লালসালু’ উপন্যাসটি এমন করে পড়াতেন, যেনো সমাজের সহজ সরল মানুষগুলোর অন্ধ বিশ্বাস ও কু-সংস্কারকে পুঁজি করে যারা সমাজটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, তিনি নিজেই তাদের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠস্বর!

 

কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি ২৯ বছর আগে, তখনকার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই দেশে-বিদেশে নিজের কর্মস্থলে প্রশংসিত। আমাদের আগের বা পরের ব্যাচের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীও হয়তো দেশে বিদেশে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

 

আজকাল মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে, কলেজের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। খুব ব্যথিত হই এসব কথা জেনে, কিছুতেই মেনে নিতে পারি না! আমার খারাপ লাগে এই ভেবে যে,

একটি ইট কাঠের তৈরী স্থাপনা কখনও নিজে নিজে খারাপ বা ভালো হতে পারে না। আমরাই তাকে খারাপ বা ভালো করে থাকি, আমাদের কর্মের দ্বারা।

কাজেই যারা বর্তমানে কলেজের সাথে সম্পৃক্ত আছে এবং যারা ভবিষ্যতে থাকবে, তাদের সকলের প্রতি অনুরোধ, পি. সি. কলেজের শত বছরের ঐতিহ্যকে আমরা যেনো কোনোভাবেই আমাদের কর্মের দ্বারা কলুষিত না করি।

 

আর যারা একদিন তার ছোঁয়াতেই বড় হবার স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম, আমরা যেনো নিজের তাগিদ থেকেই ভালো কাজ করি, দেশকে ভালোবেসে কাজ করি, তাহলেই দেশটা পৃথিবীর মানচিত্রে পরিচিত হবে নিজের যোগ্যতায়, একদিন সেভাবেই শিকড়ের সন্ধান হবে। আর এভাবেই গৌরবান্বিত হবে আমাদের দক্ষিণ বঙ্গের জ্ঞান অর্জনের তীর্থস্থান ‘সরকারী পি. সি. কলেজ, বাগেরহাট।’

 

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না