ইয়াঙ্গনে প্রথম যাই ২০০৯ সালে। বাল্যকালে স্কুলের পাঠ্য-বইয়ে শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের অংশবিশেষ ‘সমুদ্র যাত্রা’ পড়েছিলাম। সে গল্পে বার্মার রাজধানী জেনেছিলাম ‘রেঙ্গুন’। হালে ভারত আর বার্মা মুলুকে ছোটো-বড়ো নানা শহরের নাম পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। ভারতে বোম্বে হয়েছে মুম্বাই, মাদ্রাজ হয়েছে চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর হয়েছে ব্যাঙ্গালুরু। মিয়ানমারের সামরিক সরকার জানা-অজানা উদ্দেশ্যে সেদেশের ২৬টি প্রদেশ ও শহরের নাম পরিবর্তন করেছেন। সেই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমাদের চেনা-জানা রেঙ্গুন হয়েছে ইয়াঙ্গন, আরাকান হয়েছে রাখাইন স্টেট। আর আরাকানের রাজধানী আকিয়াব হয়েছে সিত্তে।
দাপ্তরিক কাজ। ইয়াঙ্গনে থাকতে হবে পাঁচ দিন। কোনো দেশে প্রথমবারের মতো যাওয়ার আগে সেখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে পড়াশোনা করে যাওয়া আমার অভ্যেস। বার্মা মুলুকে নানা জাতি-গোষ্ঠী বসবাস করে। দেশটিতে বার্মিজ বা বর্মীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এবং দেশের নাম এমনকি জাতীয়তাও তাদের নামেই হওয়ায় সেদেশের সামরিক সরকার অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর জন্য সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে ১৯৮৯ দেশের নাম পাল্টে ফেলে। দেশের নামকরণ করা হয় ‘ইউনিয়ন অব বার্মা’র পরিবর্তে ‘রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব মায়ানমার’। মায়ানমার শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘দ্রুত গতিসম্পন্ন ও শক্তিশালী জনগণ’। সেই সাথে রাজধানীর নামও রেঙ্গুনের পরিবর্তে ইয়াঙ্গন করে। সামরিক সরকার ২০০৬ সালে দেশের রাজধানী নবনির্মিত শহর নেপিটোতে নিয়ে যায়। রাজধানীতে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়। আমার ধারণা, গণআন্দোলন থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতেই সামারিক সরকার এই পদক্ষেপ নেয়।
এতে করে অবশ্যি শান, কারেন, কাচিন ও রাখাইন প্রদেশে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র বিদ্রোহী তৎপরতা বন্ধ হয়েছে তা কিন্তু মোটেও নয়। রাখাইনে অবশ্যি এই তৎপরতা খুবই সীমিত পরিসরে; শুধুমাত্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে। জাদুর বাক্স গুগলে গেলাম ইয়াঙ্গনে ‘বেস্ট টেন টুরিস্ট সাইট’ খোঁজার উদ্দেশ্যে। হতাশ হলাম-দশটা সাইটের মধ্যে পাঁচটা পেলাম: প্যাগোডা, একটি মিউজিয়াম, একটি চিড়িয়াখানা, একটি লেক, তিনটি বাজার (চায়না টাউনসহ)। কিন্তু শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সম্পর্কে সেখানে কিছু পেলাম না। কিশোর বয়স থেকেই রাজনৈতিক ইতিহাস পড়াশোনায় আগ্রহ আমার। সেই সূত্রেই জানা, ১৮৫৭ সালে ব্যর্থ সিপাহী বিপ্লবের পরে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে তদানিন্তন রেঙ্গুনে বাধ্যতামূলক নির্বাসন দেয়া হয়। বাহাদুর শাহ জাফর সেখানে বন্দি অবস্থায়ই মারা যান। তাঁর সমাধি দেখার ইচ্ছায় মায়ানমার সম্পর্কিত গুগল লাইব্রেরিতে তন্ন তন্ন করে তালাশ করেও হদিস পেলাম না। অবশেষে গুগল লাইব্রেরিতে বাহাদুর শাহ জাফর নামে কড়া নাড়তেই পেয়ে গেলাম। হাঁ, তাঁর সমাধি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। পড়লাম। কিন্তু আশ্চের্যের বিষয়, তাঁর সমাধির বিবিধ বিবরণ থাকলেও শহরের কোন সড়কে এর অবস্থান তা জানানো হয়নি।
বার্মা তথা মায়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হলেও দেশটির সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীর নয়। সে দেশের সামরিক সরকার মূলত চায়নার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথেও আদান-প্রদান রয়েছে। অভিন্ন সীমান্তে নিজ নিজ স্বার্থে ভারতের সাথেও সম্পর্ক জোড়দার। ইউরোপ-আমেরিকার অবরোধের কারণে তাদের সাথে সম্পর্ক বেশ নাজুক। বাংলাদেশের তরফ থেকে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগে ঘাটতি নেই। কিন্তু অজানা কারণে এ ব্যাপারে তারা মোটেও আন্তরিক নয়। চট্টগ্রাম থেকে আকাশপথে ইয়াঙ্গন মাত্র এক ঘণ্টার উড়াল পথ, ঢাকা থেকে বোয়িং বিমানে দেড় ঘণ্টার বেশি হবে না। চট্টগ্রাম তো দূরের কথা, ঢাকার সাথেও আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগ তখন নেই। সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ বেশ ক’বার প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি অর্থায়নও করতে চেয়েছে। তাদের অনাগ্রহের কারণে পরিকল্পনা থেকে ‘পরি’ উড়ে চলে গেছে; রয়ে গেছে ‘কল্পনা’। অথচ টেকনাফের ওপারে রাখাইনের সাথে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাসে চেপে আমরা চীন দেশেও যেতে পারতাম।
আকাশপথে ভ্রমনে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। সড়কপথে যদি চীনদেশে যাওয়া যেত, আহা! কতবারই না যেতাম। মায়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাবে সে গুড়ে বালি! মায়ানমার এদেশের ইতিহাসে আরও এক কারণে কুখ্যাতির দুর্নাম কুড়িয়েছে। সাবেক আরাকান, বর্তমান রাখাইন প্রদেশের মগ সম্প্রদায়ের কিছু দুষ্ট মানব নৌপথে চট্টগ্রাম অথবা নোয়াখালী, চাঁদপুর হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আসত লুণ্ঠনের জন্য। দু’তিন বছর পরে তারা একবার করে হানা দিত। থাকত এক থেকে তিন মাস। যাওয়ার সময় পাল তোলা শত শত জাহাজ ভর্তি করে ধান, চাল, অলংকার এমনকি গরু ছাগলও নিয়ে যেত। স্বল্পকালীন অবস্থানের সময় তারা যা খুশি তাই করত। সে সময়ে তারা যে জেলায় অবস্থান করত সে অঞ্চলকে ‘মগের মুল্লুক’ বলা হতো। মোগল সুবাহদার শায়েস্তা খানই তাদের উৎপাত থেকে এদেশবাসীকে রক্ষা করেছিলেন। তবে মগের মুল্লুক কথাটি মানুষের চলতি ভাষায় এমনকি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
কী আর করা? যেহেতু ঢাকা-ইয়াঙ্গন ফ্লাইট নেই সেহেতু ব্যাংকক হয়ে যেতে হবে। কপাল সুপ্রসন্ন নয়। তিন দিনের ব্যবধানে ঢাকা-ব্যাংকক ফ্লাইটে টিকেট পাওয়া গেল না। সে সময়ে ব্যাংককে দিনে মাত্র দুটো ফ্লাইট ছিল। একটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, অপরটি থাই এয়ারের। অগত্যা বিপুল ব্যয়ে সিঙ্গাপুর হয়ে যাত্রা ঠিক হলো। প্রশাসন শাখার বাহাউদ্দিন তপাদার ভাই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস এর টিকেট ধরিয়ে দিয়ে কৌতুকপূর্ণ চাহনীতে বললেন, ‘যান, রাতের যাত্রা খারাপ হবে না। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস-এর কেবিন ক্রুদের মিষ্টি হাসিতে ঘুম এসে যাবে নিমিষেই।’
রাত বারোটায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-এ চড়ে বসলাম। চার ঘণ্টা পরে যখন দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে নামছি তখন সেখানে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। ভ্রমনপথে এ আমার জন্য বিব্রতকর এক বিড়ম্বনা-ঘুম আসে না। পুরোটা রাত কেটেছে নিদ্রাহীন। দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ছোটো-বড়ো ৬৩টি দ্বীপ নিয়ে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্র। ১৯৬০ সালে এর আয়তন ছিল ৫৮২ বর্গকিলোমিটার। পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে মাটি কিনে এনে বেশ কিছু কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে বর্তমানে এর আয়তন বেড়ে হয়েছে ৭২০ বর্গকিলোমিটার। সে দেশের সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ আরও কিছু কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে আরও ১০০ বর্গকিলোমিটার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রাজধানী সিঙ্গাপুর সিটিই বৃহত্তম দ্বীপ।
তখন সুবহে সাদেক’র সময়। বড়ো দ্বীপটির চারপাশে সাগরে শত শত জাহাজ আলো জ্বালিয়ে চলাফেরা করছে। বিমানখানা আরও যখন নিচে নেমে এলো মনে হলো এ কোনো নগর নয়- বরং কম্পিউটারে তৈরি কাল্পনিক এক নগরের এক গ্রাফিক নকশা। বিস্তৃত সবুজের মাঝে সড়কগুলো যেন পেন্সিল দিয়ে টানা সরল রেখা। তারই মাঝে মাঝে অকাশচুম্বি অট্টালিকা।
বোয়িং ৭৭৭ নিরাপদে আমাদেরকে মাটিতে নামিয়ে দিল। এখানে আড়াই ঘণ্টা যাত্রা বিরতি। একটা সোফায় ল্যাপটপের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে পুরো দুই ডলার (সাকুল্যে ১৭০ টাকায়) দিয়ে এক কাপ চা আর এক টুকরো শুকনো কেক খেয়ে পেটের মধ্যে সৃষ্ট আচানক হৈচৈ থামালাম। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস এর সিস্টার কনসার্ন সিল্ক এয়ারে করে যেতে হবে ইয়াঙ্গন। পুনরায় চেক-ইন। প্যান্টের বেল্ট, পায়ের জুতো খুলে দীর্ঘ মানবসারিতে দাঁড়ালাম। ধীর পদক্ষেপে মানবসারি এগিয়ে যাচ্ছে। সাথে আমিও। এক সময় হ্যান্ডব্যাগ স্ক্যানিং পয়েন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোমরের বেল্ট ও জুতো বেশ নির্বিঘ্নেই স্ক্যানিং মেশিন পার হয়ে চলে গেছে। আমি ঘরের মধ্যেও চপ্পল পায়ে হাঁটা মানুষ। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোট-প্যান্ট পরে নগ্ন-পদে (মোজা অবশ্যি আছে) যারপরনাই লজ্জা অনুভব করছিলাম। নিজেকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে, সকলেই নগ্ন পদে হাঁটছে। এক গাঁয়ের সকলেরই যদি কান কাটা হয়, তাহলে একজনের জন্য আর সেটা লজ্জাজনক কিছু না- এই বলে মনকে প্রবোধ দিলাম।
কম্পিউটারের মনিটরে যে আপা-মনি ল্যাপটপের ব্যাগ স্ক্যানিং ইমেজের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি মোটেও সিঙ্গাপুর এয়ার-এর কেবিন ক্রুদের মতো মিষ্টি হাসিমুখো নন। বরং শিকারী বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে। মনে হলো স্ক্যানিং চিত্রে কিছু আছে, এমনটি তিনি সন্দেহ করছেন। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করলাম। বিপদে পড়লে কে-ই বা না পড়ে! মনে পড়ল ফরিদের কথা।
তখন ক্লাস সিক্স কী সেভেন-এ পড়ি। আরবি পাঠ্যে জের-জবর না থাকায় আমরা বুঝে পড়তাম না। মুখস্তই ছিল ভরসা। ফরিদ পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী ছিল লাগামহীন। আরবি হুজুর সেদিন কেন যেন ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। ঠিকঠাক মতো উচ্চারণ করতে না পারলেই হাতে পড়ছে ডাস্টারের নিষ্ঠুর আঘাত। কাউকে দু’টো, কাউকে-বা দু’য়ের অধিক ডাস্টারাঘাতে জর্জরিত করছেন তিনি। ফরিদ আগের ক্লাসেও ডাস্টার এর ছোঁয়া পেয়েছে। হাতের তালু নিশ্চয়ই ব্যাথা। হুজুর ফরিদের কাছে যেতেই ফরিদ আবারও ডাস্টারের ছোঁয়ার ভয়ে থরথর কম্পমান। হুজুর বুঝে ফেললেন। হুজুর বললেন, ‘এই তোর ঠোঁট নড়ছে কেন? ও বুঝেছি বাসায় পড়িসনি। এখন ভয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার দোয়া পড়ছিস। ঠিক না? মিথ্যে বলবি না। মিথ্যে বললে আজ তোর রেহাই নেই। খবরদার।’
ফরিদ নিতান্তই বোকা। মিথ্যে বললে হুজুর নিশ্চয়ই মনের খবর ধরত পারতেন না। সে স্বীকার করে ফেলল। হাউমাঁউ করে কেঁদে দিল ফরিদ। হুজুর অনুমানের ওপরে ভিত্তি করে নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে ফরিদ বিপদ থেকে পরিত্রাণের দোয়া পড়ছিল। তাঁর অধিকতর জেরার মুখে ফরিদ স্বীকারোক্তি দিয়ে দিল, “ডাস্টারাঘাতের ভয়ে সে দোয়া ইউনুস পাঠ করছিল।” সে যাত্রায় ফরিদ ডাস্টারাঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তবে চড়াঘাত থেকে রেহাই পায়নি।
কম্পিউটারের মনিটরের সামনে বসা আপা-মনির কপালের ভাঁজ অপসৃত হতে দেখলাম। কিন্তু একি! তিনি আমার ল্যাপটপের ব্যাগের সাইড-পকেট খুলে ভেতরে হাত চালান করে দিলেন কেন? ব্যাগের পকেটের মধ্যে হাতটি বেশ খানিকটা রগড়িয়ে বের করে আনলেন ভয়ঙ্কর এক মারনাস্ত্র-নেইলকাটার। দুনিয়াবাসীর উদ্দেশ্যে কসম করে বলছি- কবে, কখন ওটা ল্যাপটপ ব্যাগের মধ্যে রেখেছিলাম আমার মনে নেই। আপা-মনি নেইলকাটারটি চরম বিরক্তিভরা চেহারা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ব্যাগটি আমাকে ফেরত দিলেন। পেছন থেকে কে এক শ্বেতসাহেব ‘ওউ’ বলে উঠলেন। আমাকে যে পাকড়াও করা হলো না এজন্য ওপরওয়ালার দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া জানিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
পূর্বদিন রাত্রি কেটেছে নির্ঘুম। সাতসকালে অবশ্যি সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। সিল্ক এয়ারের বিমান বত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উঠে থিতু হতেই নিদ্রাদেবীর আলতো পরশে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল। কিন্তু হা হতোশ্মী। বেরসিক কেবিন ক্রুর সুললিত কণ্ঠে ঘুম ভেঙে গেল। বিমান আকাশে উঠতে না উঠতেই প্রাতঃরাশ নিয়ে হাজির। হাতে ট্রে- তার মাঝে নানা পদের খাবারের আঞ্জাম। ঘুম আর হলো না। পুরো তিন ঘণ্টা পরে সিল্ক এয়ারের এয়ার বাস ইয়াঙ্গন বিমানবন্দরে নামিয়ে দিল। বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে বেরুতেই দেখি লুঙ্গি ও সার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি আমার অফিসের নামযুক্ত প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে নিতে এসেছেন। পরে জেনেছি, লুঙ্গি ও ওপরে সার্ট ইন্ করে পরাটা তাদের জাতীয় পোশাক।
বিমানবন্দর থেকে শহর খুব বেশি দূরে না- পাঁচ-ছয় কিলোমিটার। বিমানবন্দর ও শহরের সংযোগ সড়কের দু’পাশ খুবই মনোরম। ভবনগুলো বেশ দূরে দূরে। আকাশচুম্বী ভবন নয়- দোতলা কী তিনতলা। দু’পাশে সবুজের সমারোহ চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে আসে প্রশান্তি। রাস্তার মাঝে হলুদ রেখা দিয়ে সড়ক-বিভাজকের চিহ্ন রয়েছে। পরে দেখেছি গোটা শহরেই এমন। সড়কদ্বীপ দিয়ে ডিভাইডার করা হয়েছে, এমন সড়ক খুব কম। তবে এটি ভাবা ঠিক হবে না যে, ভিড় দেখলেই গাড়ি হলুদ রেখা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার ছুতো খোঁজে। না- তা করে না। শহরের কোথাও-ই ট্রাফিক পুলিশের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সামরিক সরকার দেশের উন্নতি কতটুকু করতে পেরেছে জানি না। তবে শহরবাসীকে নাগরিক আইন মেনে চলতে অভ্যস্ত করতে পেরেছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শহরে রিকশা নেই, মটরবাইকও চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ঢাকায় সড়কদ্বীপে বিদেশী গাছ রোপন করে সবুজের ছোঁয়া আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা খুবই নাজুক। শীতকালে গাছগুলোর দৈন্যদশা বস্তিবাসীর হতদরিদ্র সন্তানটির মতোই হয়ে যায়। ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কের দু’পাশে অপরিকল্পিতভাবে কোথাও বৃক্ষ, কোথাও ভাস্কর্য, কোথাও যুদ্ধজাহাজ কিংবা বিমানের রেপ্লিকা বসিয়ে নান্দনিকতার নামে যে কৃত্রিমতা সৃষ্টি করা হয়েছে- তা না নান্দনিক, না শিল্পিত ল্যান্ডস্কেপ।
আধঘণ্টার ব্যবধানেই নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আবারও ঘুম। দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন-ভোজ সেরে নিলাম। হোটেল থেকে অফিস কাছেই-পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। আর এ শহরে আমার প্রিয় বাহন রিকশা যেহেতু নেই, সেহেতু হেঁটেই যেতে হবে। পথে দেখলাম সারিবদ্ধভাবে হেঁটে যাওয়া গেরুয়া পোশাক পরিহিত বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল। তারা কথা বলছে না, কিন্তু তাদের মধ্যে একজনের হাতের পিতলের ঘন্টি বাজছে। রাস্তার ধারে বিভিন্ন বাড়ি থেকে কেউ একজন থালা বা বাটি হাতে বের হয়ে ভিক্ষুদের পাত্রে খাবার ঢেলে দিয়ে গৃহভ্যন্তরে চলে যাচ্ছে। পরে অফিসে স্থানীয়দের কাছে প্রশ্ন করে জানলাম বৌদ্ধ ধর্মশালায় অধ্যয়নরত তরুন ভিক্ষুরা মাসে দু’বার (সম্ভবত আমবস্যা, পূর্ণিমার দিন) সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনাশেষে খাবার সংগ্রহ করতে বের হয়। সংগৃহীত খাবার ধর্মশালার সকলে ভাগ করে খায়। জিগ্যেস করলাম, ‘খাবারগুলো তো পাত্রে পৃথক ভাবে রাখা হচ্ছে না। বিভিন্ন বাড়ি থেকে বিভিন্ন খাবার দেয়া হচ্ছে। একই পাত্রে ওগুলো তো ‘সুপার খিচুড়ি’ হয়ে যাচ্ছে?’
‘সুপার খিচুড়ি কী?’
আগে তাকে বোঝালাম খিচুড়ি কী জিনিস? এবারে ভদ্রলোক সুপার খিচুড়ির পাঠোদ্ধার করতে পেরে বেশ হাসলেন। এবং যা বললেন, তার অর্থ হচ্ছে, ওই খাবার ‘পবিত্র সংগ্রহ’। ওটা সুপার খিচুড়ি হোক আর যাই হোক, তাতে কোনো অতৃপ্তি আসে না।
মনে মনে বললাম, তা বটে!
অফিসে ঢোকার মুখেই অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময়। অফিসের গেট পেরিয়ে মূল দরজার মুখে শ’খানেক জুতো-স্যান্ডেল। আমাকে নতুন দেখে প্রহরী জুতা খুলে অফিসে প্রবেশ করতে বললেন। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে একবার জুতো খুলেছিলাম। বার্মা মুলুকেও যে নগ্নপদে অফিসে ঢুকতে হবে, তা জানা ছিল না। জুতা আবিস্কার কবিতা কবিগুরু লিখে গেছেন। কিন্তু মোজা আবিষ্কারের গল্প লিখেননি। মোজা আবিষ্কার যেই করুন না কেন, তাঁর প্রতি সহস্র শুকরিয়া জ্ঞাপন করে মোজা পায়ে অফিসে প্রবেশ করলাম। মেনে নিলাম বহুল প্রচলিত প্রবাদ-বাক্য, ‘যস্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার’। পরে জেনেছি, এটা এদেশের প্রথা। হালে কোনো কোনো অফিসে জুতো পরে হাঁটাহাটি অনুমোদিত হলেও বাসা-বাড়িতে একেবারেই না।তবে পুরনো, এমনকি অনেক নতুন ভবনের মেঝেতেও সেগুন কাঠের টাইলস আমাকে বেশ বিস্ময়াভিভূত করেছে। এগুলো ওরা পানি দিয়ে মোছে না। কেননা পানি লাগলেই মূল্যবান সেগুনকাঠ নষ্ট হয়ে যাবে।
পাঁচদিন কাটতে চলল নিদারুন ব্যস্ততায়। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই সন্ধ্যে। এরপরে বিভিন্ন বাঙালীবাড়িতে নেমন্তেন্নে হাজিরা দেয়া। রাতে কোথায়ই-বা যাওয়া যায়। খুব ইচ্ছে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো স্বর্ণাচ্ছাদিত প্যাগোডা আর বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি দেখা- তা আর হলো না। রাতে বাঙালী-বাসাতে খাওয়া অবশ্যি আমার জন্য ছিল দিনের একমাত্র পরিপূর্ণ ভোজন। সারাজীবন সকালে রুটি-পরোটা খাওয়া মানুষ। হোটেলের রেস্টুরেন্টে ইংলিশ ডিশের ব্রেড, জ্যাম, জেলি, মাখন, জ্যুস-এ উদরপূর্তি হলেও মনের কোথায় যেন হাহাকার কাজ করে। আর দুপুরের বার্মিজ ডিশ, সে আরও বেদনাদায়ক। এক হাফ প্লেটে থাকে পাতা-পুতি, শাক-সবজি। এর মধ্যে থাকে কাঁচা পুদিনা, থানকুনি, ধনে পাতা, শসা ও গাজর। ছোটো এক বাটি স্যুপ। হায়রে বার্মিজ স্যুপ। গোলমরিচের মিশেল দেয়া পানি- বাটির নিচে এক টেবিল চামচ সেদ্ধ সবজি- পেঁপে, লাউ বা পটল। সবশেষে প্রিয় ভাত এক বাটি পাওয়া যায় বটে, সাথে পাঁচমিশালী আধাসেদ্ধ সবজি। ফলে রাতে বাঙালি বাড়িতে নেমতন্নে হাজিরা দেয়ার অর্থই ছিল যারপরনাই জান্নাতি খাবার। একটি কথা না বললেই নয়। ইয়াঙ্গন নদীর ইলিশ মাছ খেলাম। আমি চাঁদপুরের ইলিশের সাথে পাথর্ক্য খুঁজে পেলাম না। বার্মিজরা মাছ খায়। ইলিশও খায়। কিন্তু বাঙালি যেমন ইলিশের নাম শুনলেই হাউ-মাউ করে ওঠে, ওরা তেমন না। আর দশটা মাছ যেমন খায়, ইলিশও তেমনই খায়। এটা নিয়ে অতি উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত কিংবা উল্লসিত হতে দেখিনি ওদেরকে। অবশেষে দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পাঁচ দিন পরে আবারও মাথার পেছন দিয়ে নাক দেখানোর কায়দায় সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকায় ফিরে আসলাম। ঢাকায়ও অফিসের জরুরি কাজ রেখে গিয়েছি। যে কারণে পাঁচ দিনের আফিস অ্যাসাইনমেন্ট শেষে ছুটি নিয়ে দুটো দিন ইয়াঙ্গনে ঘোরার ইচ্ছে থাকলেও তা আর হলো না।
দ্বিতীয় দফা ইয়াঙ্গন গেলাম ২০১১ সালে। এবারে সাত দিনের অ্যাসাইনমেন্ট। এবারেও ঢাকায় অফিসের জরুরি কাজ রেখেই ইয়াঙ্গন ভ্রমন। তবে এবারে ব্যাংকক হয়ে। সে সময়েও ঢাকা-ইয়াঙ্গন সরাসারি ফ্লাইট চালু হয়নি। রাত বারটায় বাসা থেকে বের হলাম। ব্যাংকক এয়ারওয়েজের বিমানছাড়ল রাত তিনটায়। বিনিদ্র রজনী পার করে ব্যাংক পৌঁছলাম সেই ভোরে-ই। রাতের অর্ধেকটা কেটে গেল ৩২ হাজার ফুট উঁচুতে এয়ারবাস নামের বায়ুযানে। নিশিকালে আকাশযাত্রার কারণ নাকি যাত্রীদের হোটেল ভাড়া বাঁচিয়ে দেয়া- তা বটে বেশ। ব্যাংকক থেকে আরও দেড় ঘণ্টা আকাশভ্রমন শেষে ইয়াঙ্গন পৌঁছে দুপুরের খাবার খেলাম। এবারে অফিসের কাছেই বেশ বড়ো আঙিনার ওপরে দোতলা এক কোরিয়ান হোটেলে থাকলাম।
হোটেল থেকে বের হতে মন চায় না। ভবনের পুরো অঙ্গনে সবুজের সমারোহ মনে যে প্রশান্তি এনে দেয় তা ছেড়ে বাইরে যেতে কারোর-ই হয়ত মন চাইবে না। হোটেলের রেন্টুরেন্ট, করিডর, ভবনের ছাদ সর্বত্রই ঘন সবুজ গাছ মন ছাড়িয়ে শরীরকেও আবেশিত করে তোলে। অফিসে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে স্থানীয় দুই তরুণ-তরুণীকে নিয়ে বিকেল নাগাদ শহর দেখতে বেরোলাম। গতবারেই ওদের সাথে পরিচয়। আগেই সমঝোতা করে নিলাম ট্যাক্সিতে নয়, যতটুকু পারি হেঁটেই শহরটা দেখার চেষ্টা করব। তখনও বিকেল। সন্ধ্যা হতে ঘণ্টা দেড়েক বাকি।
ঘণ্টা দেড়েকের পদভ্রমণে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা দোতলা ভবনগুলোকে অক্ষত রেখেই শহরের বৃদ্ধি ঘটেছে। কলকাতার বেশ কয়েকটি রাস্তা রয়েছে যেসব রাস্তায় হাঁটলে মনে হয় বুঝি-বা আঠার কিংবা উনিশ শতকের শহরে হাঁটছি। ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ব্যতিক্রম ঢাকা। পুরনো ঐতিহ্যবাহী ভবন পুরনো ঢাকাতেও তেমন আর চোখে পড়ে না। ঐতিহ্যের শেকড় উপড়ে ফেলতে আমরা যেন বদ্ধপরিকর।
একদিন ইয়াঙ্গন জেনারেল হাসপাতালের পরিচালকের সাথে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, একশ বছর আগে নির্মিত হাসপাতালের পুরাতন ভবনটি রেট্রোফিটিং করে স্থায়ীত্বশীলতা বাড়ানো হচ্ছে। আর বর্ধিত চাহিদার পেক্ষিতে পুরাতন ভবনের পেছনেই নতুন ষোলো তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। মনের দুঃখ মনেই চেপে রাখলাম। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আদি ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন বহুতল ভবন নির্মানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও এ ব্যাপারে যুক্তি পেশ করা হয়েছে।
পথেই পড়ল চায়না টাউন। নামে চায়না টাউন হলেও ছোটো একটি রাস্তায় বেশ কয়েকটি ভবন মাত্র। ভবনগুলো চায়নিজ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। চীনা অধিবাসীদের কম্যুনিটি সেন্টারে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। কাছে যেতেই বোঝা গেল তাদের নিজস্ব কোনো পার্বনের উদ্যাপন চলছে। উচ্চশব্দের বাজনার সাথে মান্দারিন ভাষায় একটার পর একটা গীত পরিবেশিত হচ্ছে। সাথে তরুণ-তরুণীদের উদ্বাহু নৃত্য। উচ্চশব্দে আমি স্বস্তি অনুভব করি না। দ্রুত সেখান থেকে নিস্ক্রান্ত হলাম। ফেরার পথে ওদের দু’জনকে কিছু খাওয়ার কথা বললাম। ওদের পছন্দেই ছোটো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ততক্ষণে ওদের রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। ওদেশে দুপুর ও রাতের খাবারের সময় আমাদের সাথে মেলে না। দুপুরের খাবার বারটায়, আর রাতের খাবার সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটা।
তিনজনের জন্য ফুলপ্লেট ফ্রাইড রাইস আর মিক্সড ভেজিটেবল অর্ডার দেয়া হলো, সাথে ফিস ফ্রাই। চটপটে সুদর্শন খিদমতগার পনের মিনিটের ব্যবধানেই কাঙ্খিত খাবার দিয়ে গেলেন। এ ক’দিনে বাঙালি বাসায় সুস্বাদু মাছ খেয়েছি। কিন্তু তবিয়ত খারাপ হলে যা হয় আর কী। এখানে ফিস ফ্রাই কেন যেন তিতকুটে লাগল। মিক্সড ভেজিটেবল মানে নানা পদের আধা সেদ্ধ সবজি, সবজির ওপরে মুক্তহস্তে সস্ দেয়া। শুধু ফ্রাইড রাইস খেয়ে উদরপূর্তি করতে চেয়েছিলাম। ওদের চাপাচাপিতে সস্ মাখানো আধা সেদ্ধ সবজিও প্লেটে তুলে নিলাম। কচকচ করে চিবিয়ে খেলামও।
এবারে বার্মা মুলুকে থাকতে হবে সাত দিন। মাঝে এক রবিবার ছুটি আছে। কিন্তু যথারীতি দুপুরে আহাদ ভায়ের বাসায় নেমন্তন্ন। সুখকর যন্ত্রণা। কী-ই বা করা! যেতে হবেই। উনিই আমার স্থানীয় অভিভাবক। ওনাকে মনের গহীনে লালিত বহুদিনের আকাঙ্খার কথা জানালেম- এ যাত্রায় মিস করতে চাই না। আমি আগামীকাল বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি দেখতে যাবই। সমাধিসৌধের অবস্থানটা জানা দরকার। এখানে ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া বেশ কম। আমার বাংলাদেশী সঙ্গী যাবেন না। উনি প্রাচীন দ্রব্যাদির সংগ্রাহক। দেশ-বিদেশে থেকে এগুলো সংগ্রহ ও ক্রয় বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। অথচ এমন একটি সুযোগ হেলায় হারাচ্ছেন- বেশ অবাক হলাম।
বিস্মিত হলাম গোটা অফিসের জনা দশেক স্থানীয় কর্মকর্তা বেশ তকলিফ করেও কেউ-ই কাক্সিক্ষত সমাধির হদিস দিতে পারলেন না। দু’একজন অফিসের দেয়ালে ঝুলানো ইয়াঙ্গন শহরের মানচিত্রের কাছে ছুটে গেলেন, তালাশ করলেন, গভীর মনযোগ সহকারে তালাশ করলেন। কিন্তু ফলাফর তথৈবচ। অবশেষে যিনি সমাধি-সৌধের হদিস দিতে পারলেন তিনি ভারতীয় বংশদ্ভূত একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। সমাধিসৌধটি বৃহত্তম স্বর্ণমণ্ডিত শোয়েডাগন প্যাগোডার কাছেই- পূর্বপাশে উইসারা রোডের জিওকা স্ট্রিটে।
ভারত সরকারের অর্থায়নে বাহাদুর শাহ’র মাজারটি বেশ চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। মাজার কমপ্লেক্স-এ তার নামে একটি সভাকক্ষও রয়েছে। মাজারে প্রবেশ করতেই হাতের ডান পাশে বাহাদুর শাহ’র নামাঙ্কিত সভাকক্ষটির সামনেই রয়েছে বাহাদুর শাহ জাফরের বেশ বড়ো আকারের পোট্রেট। মাজারের ভেতরের দেয়োলগুলোতেও রয়েছে বাঁধাই করা নানা ছবি। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তোলা একটি ছবিও রয়েছে। বাহাদুর শাহ তখন পক্ষঘাত-রোগে আক্রান্ত। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে খুবই ক্লান্ত ও বির্মষ। এই কমপ্লেক্সে বাহাদুর শাহের দুই ছেলের ছবিও রয়েছে। রয়েছে তৃতীয় স্ত্রী বেগম জিনাত মহলের ছবি। মাজার প্রাঙ্গণে গেলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। কী এক অজানা রহস্যে হৃদয় উদ্বেলিত হয়। টেনে নিয়ে যায় কল্পনার মোগল-জগতে।
প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের ইচ্ছানুসারে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে কাবুলে। দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে দাফন করা হয়েছে দিল্লীর সন্নিকটে সিকান্দ্রায়। তৃতীয় মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে সমাহিত করা হয়েছে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে লাহোরে। চতুর্থ মোগল সম্রাট আকবরকে সমাহিত করা হয়েছে আগ্রার সন্নিকটে মোগলদের স্বল্পকালীন রাজধানী ফতেহপুর সিক্রীতে। পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানকে সমাহিত করা হয়েছে তাজমহলে তাঁর স্ত্রীর পাশে। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ ও ষষ্ঠ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে সমাহিত করা হয়েছে তাঁর ইচ্ছা অনুসারে মহারাষ্ট্রে তাঁর শিক্ষাগুরু শেখ জৈনউদ্দিনের সমাধির পাশে। সম্রাট আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন ১৭০৭ সালে। এর পরে বাহাদুর শাহ জাফরের মধ্যবর্তী সময়ে দিল্লীতে আরও দশ জন মোগল সম্রাটের অস্তিত্ব ছিল। তাদের সমাধি কোথায় সে খবর নেইনি।
কিন্তু দিন যতই এগিয়েছে মোগল সাম্রাজ্য ততই ছোটো হয়েছে। ১৭৩৯ সাল পারস্য অধিপতি নাদির শাহ দিল্লী দখল করে দুই মাস অবস্থান করেন। তিনি দিল্লী দখল করলেও মোগল সম্রাটকে হত্যা করলেন না। হত্যা করলেন দিল্লীর ৩০,০০০ বেসামরিক মানুষকে। ফিরে গেলেন ১০ হাজার ঘোড়া, ৩০০ হাতি, মণকে মণ সোনা রূপা আর বিখ্যাত ময়ুর সিংহাসন নিয়ে। মোগল পিদিমে রেড়ির তেল আর রইল না কিছুই। ক্রমেই প্রদেশগুলো স্বাধীনভাবে চলতে শুরু করল। বাবর, জাহাঙ্গির ও আওরঙ্গজেব বাদে ৩ দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী মোগল সম্রাট হুমায়ুন, আকবর ও শাহাজাহানের সমাধি দেখেছি। আওরঙ্গজেব ও বাহাদুর শাহের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁদের সকলের সমাধিসৌধ অনন্য স্থাপত্য-সৌকর্যের দুর্লভ নিদর্শন। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে নির্বাসিত শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের সমাধি-সৌধ নিতান্তই সাদামাটা কোনো পীর-মুর্শিদের মাজারের মতোই।
কিন্তু সিমাধিসৌধের ভূর্গভস্থ তলায় চমৎকার এক ঝাড়বাতির নিচে বাহাদুর শাহের সমাধি। উপরের তলায় তার স্ত্রী ও দুই ছেলের সমাধি। সমাধিসৌধে ঢোকার আগে ভাবছিলাম সেলামি দিতে হবে কি না? আমার কাছে স্থানীয় মুদ্রা নাই। না। এখানকার মাজারে সেলামি-নজরানা নেয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। ইয়াঙ্গনের কিছু মুসলিম নারী-পুরুষ সমাধিসৌধের ভেতরে বাহাদুর শাহের স্ত্রী ও ছেলেদের কবরের পাশে বসে পবিত্র কোরআন থেকে তেলওয়াত করছেন। তেলওয়াত-শেষে মোনাজাত করে যে যার মতো চলে যাচ্ছেন। তবে কবরের পাশে দেয়ালে কিছু ছবি বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। বড়ো ছবিটি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের-রাজকীয় বেশে বসে আছেন তিনি। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক আমাদের দেশের মাজারে অবশ্য ছবির প্রদর্শন দেখা যায় না। ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, সমবেত জনতার মাঝে মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে দিল্লীর রাস্তায় হাতকড়া পরিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। খুব কষ্ট হলো। অপমানিত বোধ করলাম। ভগ্ন হৃদয়ে বের হয়ে আসলাম।
আবারও সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে সম্রাটের কবরের পাশে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবছিলাম ভারত-বর্ষের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে এই মহামহিম চুড়াশি বছর বয়সে কত না অপমান ও কষ্ট সহ্য করেছেন। বাহাদুর শাহের একটি লেখা তাঁর এপিটাফে খোদাই করে রাখা হয়েছে,
“কিতনা বাদ নাসিব জাফার দাফান কে লিয়ে
দো’গাজ জামিন ভি না মিলি কু-এ ইয়ার মেঁ”
অর্থ: হে জাফর (কবি নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন), তুমি কতই না দূর্ভাগা,
দাফনের জন্য প্রেমাস্পদের গলির দুই গজ জমিনও নসিব হলো না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ উচ্চপদস্থ কেউ মায়ানমারে এলে তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য পেশ করেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আশির দশকে মিয়ানমার সফরে গিয়ে তাঁর সমাধি ফলকে লিখে এসেছেন, “দো’গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে, পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউড় শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে।”
যার বাংলা অর্থ:
‘হিন্দুস্তানে তুমি দু’গজ মাটি পাওনি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।’
বাহাদুর শাহের পূর্ণ নাম আবুল মুজাফ্ফার সিরাজুদ্দীন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ গাজী। তিনি ২৪ অক্টোবর ১৭৭৫ সালে দিল্লীর লালকেল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ (১৮০৬-৩৭) ও সম্রাজ্ঞী লাল বাঈর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। বাহাদুর শাহ সিংহাসনে আরোহণের ২০ বছর পর ঐতিহাসিক সিপাহি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। পলাশী যুদ্ধের পর একশ বছর কেটে গেছে তত দিনে। ছলে বলে কৌশলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারত উপমহাদেশ দখল করে নিয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যের নবাব ও রাজা অবশ্য সার্বভৌম ক্ষমতা ছাড়াই বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে রাজ্যে কোনো রকমে নিজ অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন। দেশবাসীর সাথে সৈন্য বিভাগের লোকদের ওপরও চলছে জুলুম, বঞ্চনা ও নির্যাতন। একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ অধিকারে নিয়ে যাওয়া, লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কারাগারে হিন্দু-মুসলমান সিপাহিদের জন্য একই খাবারের ব্যবস্থা, গরু ও শূকরের চর্বি-মিশ্রিত কার্তুজ বিতরণ ইত্যাদি ভারতের জনমনে ও সৈনিকদের মনেও ব্যাপক নেতিবাচক ব্যাঞ্জনা তৈরি করে।
বৃটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহের মধ্যে মনোভাব তৈরি হয়। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর সেনাছাউনিতে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি। বৃটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সিপাহিরা কার্তুজ নিতে অস্বীকার করে। রাতে অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে পুরনো মাসকেট বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করে। সে সময়ে তারা ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় ছিল। ধূর্ত ইংরাজ সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সিপাহিদের নিরস্ত্র করে ফেলে।
এই সংবাদও দ্রুত পৌঁছে যায় বিভিন্ন সেনানিবাসে। ২৯ মার্চ রোববার বারাকপুরের দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। মঙ্গল পান্ডে নামের এক সিপাহি গুলি চালিয়ে ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করে। বিচারে মঙ্গল পান্ডে ও তাকে সহায়তার অভিযোগে জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ৮ এপ্রিল সকাল ১০টায় তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। এর পরিণতিতে সিপাহীদের মধ্যে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের উত্তর থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং জলপাইগুড়ি থেকে পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লির পথে অগ্রসর হন। ১১ মে সিপাহিরা দিল্লী অধিকার করে বহু বৃটিশ নাগরিককে হত্যা করে, কিছু পালিয়ে যায়। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা এদিন গভীর রাতে লালকেল্লায় প্রবেশ করে একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ বৃটিশ পেনশনভোগী শুধুমাত্র উপাধি-সর্বস্ব মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করে। সে রাতেই সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ভারতকে ইংরেজমুক্ত করে স্বাধীনতার শপথ নেন।
নামে সম্রাট হলেও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কোনো সাম্রাজ্য ছিল না। পিতার মতোই বাহাদুর শাহ জাফর ব্রিটিশ পেনশন নিয়ে লালকেল্লার ভেতরে অলস জীবন-যাপন করছিলেন তখন। পিতার মতো তিনিও নিজের ও মোগল খান্দানের ভরণপোষণের ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ‘বাদশাহ’ উপাধি ত্যাগ এবং লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপনের শর্তে রাজি হননি। এ ছাড়া সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়েও ইংরেজদের সাথে সম্রাটের মনোমালিন্য চলছিল। সম্রাটের ক্ষমতা ও মর্যাদা খর্ব করতে নানা উদ্যোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এ সময়ে অমর্যাদার মনোবদেনা ভুলে থাকার জন্য তিনি গজল ও কবিতা রচনায় নিমগ্ন হন। লালকেল্লায় সহিত্যের আসর বসিয়েও সময় কাটাতেন। জীবনের কষ্ট ও বিষাদই ছিল তাঁর কবিতার মূল বিষয়। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে দুঃখ ও বিষাদের সাথে দেশ ও জাতির পরাধীনতার কথাও বিধৃত। একটি কবিতায় লিখেছেন:
“উমর এ দারাজ মাঙ্গকে লায়ে থে চার দিন,
দো আরজু মে কাট গায়ে,দো ইন্তেজার মে।”
“চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম।
দু’দিন কাটল প্রত্যাশায় আর দু’দিন অপেক্ষায়।”
তাঁর আর একটি কবিতাও বিষাদময়। তিনি লিখেছেন:
‘ইয়া মুঝে আফসার-ই-শাহানা বানায় হোতা,
ইয়া মেরা তাজ গাদায়ানা বানায়া হোতা’
You should Have made me the chief of the kings or
Instead you should have given me a crown that a begger may wear
আমায় তুমি বানাতে ওগো রাজাদের রাজা
নয়তো তুমি দিতে আমায় ভিখিরীর মুকুট
শাহজাদারা তখন কেউ বসে খায়। কেউ-বা ব্যবসায়-বাণিজ্য করে। মোগল শাহজাদাদের বুদ্ধিমত্তা, সাহস, শৌর্য সবই তারা হারিয়েছে। বাহাদুর শাহ জাফরের নিষেধ সত্ত্বেও মোগল শাহজাদাদের নেতৃত্বে দিল্লীতে বেসামরিক ইংজেদেকেও হত্যা করা হলো। সম্রাটের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিশ্বসঘাতকতা করে লালকেল্লার সকল পরিকল্পনা ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দিতে থাকল।
বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ সংবাদে কানপুর, লক্ষৌ, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠে। ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল না। কিন্তু তারা জানত না যে, ভারতীয় রাজন্যবর্গ ব্যবসায় ও সাম্প্রদায়িতকার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন না।
বিপ্লবী সৈন্যরা এক মাস যেতে না যেতেই সম্রাটের কাছে বেতন দাবী করে বসল। এত সৈন্যের বেতন সম্রাট দিবেন কোথা থেকে? পেনশনের টাকায় তো তাঁর নিজের সংসারই চলে না। বাহাদুর শাহ নিকটস্থ ভারতীয় রাজন্যবর্গ ও জমিদারদের কাছে অর্থ-সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখলেন। রাজন্যবর্গ ও জমিদারদের কেউ-ই সম্রাটের ডাকে সাড়া দিলেন না। দিবেন-ই বা কেন? মোগল যুগে তাঁরা শুধু জমিদারী থেকেই অর্থ উপার্জন করতেন। এখন তাঁরা ইংরেজদের সাথে বাণিজ্য করে বিপুল টাকা উপার্জন করছেন। মোগলরা ভারতের বাইরে মধ্য এশিয়া থেকে আসলেও তারা কখনো ভারতের সম্পদ তাদের পূর্বপুরুষের বাসভূমিতে নিয়ে যায়নি। ইংরেজরা স্থানীয় রাজন্যবর্গ ও জমিদারদের সাথে বাণিজ্য করে সস্তায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় রাজন্যবর্গ ও জমিদারদের কাছে মোগল শাসন অপেক্ষা ইংরেজ শাসন ছিল লাভের। জয়পুর, যোধপুর, উদয়পুরের রাজারা অর্থ ও সৈন্য-সামন্ত দিয়ে ইংরেজদেরকেই সহযোগিতা করল। আর রাজপুত, মারাঠারা তো কোনোদিনই মোগলদেরকে মেনে নেয়নি। তারাও ইংরেজদের পক্ষেই লড়াই করল। বাহাদুর শাহ জাফর স্ত্রীর অলংকার, সঞ্চিত সামান্য মূল্যবান রত্নরাজি, এমনকি আসবাবপত্রও বিক্রি করে সৈন্যদের চাহিদা মেটাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সবই বিফলে গেল।
১১ মে তারিখে বিপ্লবের যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল দুই মাস দশ দিন পরে ব্রিটিশ বাহিনীর দিল্লী পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে সিপাহী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। অবশেষে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইংরেজরা দিল্লী দখল করে নেয় এবং ২১ সেপ্টেম্বর সম্রাট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দিল্লী থেকে পালিয়ে পাঞ্জাব হয়ে দুর্গম খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে কাবুল অবধি গেছেন। সেখান থেকে সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করে ফিরে এসে আবারও দিল্লী দখল করেছেন। আর বাহাদুর শাহ জাফরের শাহাজাদাগণ দিল্লীতে পরাজিত হয়ে দিল্লীর কাছেই সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধে আশ্রয় নিলেন।
ইংরেজ সৈন্যরা অল্প সময়েই সেখানে হাজির হয়। তারা মোগল শাহজাদাদেরকে বিনা প্রতিরোধে প্রেপ্তার করে। বন্দি অবস্থায় ২৯ জন মোগল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি ও সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। বাহাদুর শাহ জাফরের ৩ পুত্রকে জনসমুখ্যে দিল্লী গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করে। (অপর ২ কিশোর পুত্রকে হত্যালীলা থেকে অব্যাহতি দেয়)। নিহত শাহজাদাদের ছিন্নমস্তক-দেহ হুমায়ুনের সমাধিসৌধ থেকে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসে। দিল্লীতে শাহজাদাদের ছিন্নমস্তক-দেহ দিল্লীতে এনে সম্রাটকে দেখতে বাধ্য করা হলো। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লিীর সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে প্রধান অপরাধী। তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ রহিত করে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল, দুই কিশোর শাহজাদা, ও ভৃত্যদের নিয়ে ইংরেজ গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনী দিল্লী ত্যাগ করে। ৯ ডিসেম্বর জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট্ট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবার-পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটের শয়নের ব্যবস্থা করা হলো পাটের দড়ির তৈরি একটি খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দুঃখ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন।
এক বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টায়। তবে সম্রাটকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে দাফন করা হয়। কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য একসময় সম্রাটের কবরের স্মৃতি মুছে যাবে। রেঙ্গুনের বৃষ্টিবিধৌত সবুজ ঘাস কবরের চিহ্ন আচ্ছাদিত করে ফেলবে। কোথায় সর্বশেষ মুঘল সম্রাট শায়িত আছেন, তার চিহ্নও যেন কেউ খুঁজে পাবে না।
এখন যেখানে বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিসৌধ ঐ এলাকাতে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা মেরামতের সময় ১৯৯১ সালে তার আসল কবর আবিষ্কৃত হয়। ভারত সরকারের উদ্যোগ ও অর্থায়নে পরবর্তীতে সেখানে সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল, যিনি ‘লাস্ট মুঘল’ বইয়ে লিখেছেন “জাফর একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামী শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি এবং সুফি পীর জাফর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে গভীর গুরুত্ব দিতেন। জাফর কখনও নিজেকে বীর বা বিপ্লবী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, তাঁর ব্যক্তিত্বও সে ধরনের ছিল না, কিন্তু তাঁর পূর্বপরুষ সম্রাট আকবরের মতো তিনিও ইসলামী সভ্যতার একজন আদর্শ প্রতীক ছিলেন, যে সময় ইসলামী সভ্যতা তার উৎকর্ষে পৌঁছেছিল এবং সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।”
বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধির সামনে বেশ কিছুক্ষন একাকী নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। হৃদয়ে তখন উথাল-পাথাল। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমিও পরাজিত সৈনিক। পরাজয়ের গ্লানিতে আমি ম্রিয়মান। মানসপটে বিচিত্র এক অনুভূতি কাজ করছে আমার মধ্যে। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব বুঝি-বা দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছেন। হুমায়ুনের সমাধিসৌধে মোগল শাহজাদাদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ইংরাজ সাহেবরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। গুলি করছে একর পর এক। স্বাধীনতাযোদ্ধাদের লাশের রক্তে সমাধিসৌধের প্রাঙ্গন ভেসে যাচ্ছে। হুমায়ুন দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে অবিরাম।
পরাজয়ের গ্লানি আর স্বাধীনতার ঔদ্ধত্ব আমার হৃদয়ে জন্ম দেয়- ক্রোধ। বৃটিশরা ভারত ত্যাগ করেছে। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নয়- সসম্মানে। সেখানেই আমার ক্ষোভ। আমেরিকা যেমন ভিয়েতনাম থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পালিয়েছে, পকিস্তান পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে বন্দি অবস্থায় ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু গ্লানি থেকে ধূর্ত বৃটিশ জাতি রেহাই পেয়েছে।
আমি ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে আমি সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স থেকে। গেটের বাইরে আমার গাড়ি অপেক্ষমান। আজ রাতে আহাদ ভাইয়ের বাসাতেই খাওয়ার কথা। যেতে মন চায় না। ড্রাইভারকে বললাম, হোটেল ক্লোভার ইন। হোটেলে রিসেপশন থেকে ফোন করে আহাদ ভাইকে জানিয়ে দিলাম, আজ লেখালেখির কাজ আছে। তাই যাব না। আহাদ ভাই হাঁ হাঁ করে উঠল। ভাবী নাকি আমার জন্য দই বসিয়েছে। সেদিনকার মতো মাফ চেয়ে নিলাম। ভালো লাগছিল না।