তামাশার শহরে দুইদিন (দ্বিতীয় পর্ব)

0

প্রথম পর্বের পর…

 

সালাহউদ্দিন বয়সে আমার পনের বছরের ছোটো। কিন্তু বিদেশ-বিভূঁইয়ে বয়সের ব্যবধান যেন চুকে গেছে। তাই-ই হয়। কর্মস্থলের রাশভারী বসও ঢাকা থেকে বেরিয়ে যখন অন্য জেলামুখী হন তখন সহকর্মীদের সাথে চটুল আড্ডায় মেতে ওঠেন। হোটেলের বোর্ডাররা যে যার মতো একজনকে বগলদাবা করে ঘরে ঢুকছে। আমরা দুই বাংলাদেশি ব্যতিক্রম। রিসেপশনিস্ট নিশ্চয় তার সহকর্মীদের সাথে এ নিয়ে তামাশা করছে বা করবে। যে বিষয় নিয়ে সালাহউদ্দিনের সাথে ঘটা করে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করলাম তা হচ্ছে ‘জাতিগত সম্পর্ক’।

জাতিভেদের কারণেই পৃথিবীতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। জাতিগত দাঙ্গা হাঙ্গামাতে পৃথিবীতে কত কোটি মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছে। অথচ যৌনতার ক্ষেত্রে মানুষ কেন ভিন্ন জাতের প্রতি আগ্রহী। ইউরোপিয়ানদেরকে এখানে রুশ রমণীদেরকে নিয়ে ঘুরতে দেখিনি। তাদের আকর্ষণ বাদামি চামড়ার থাই রমণী। পক্ষান্তরে ভারতীয়দের আকর্ষণ শ্বেত চামড়ার রুশ রমণীদের প্রতি।

সালাহউদ্দিনের মৃদু হাসি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না।

গাঁটের পয়সা উসুল করতে হবে। কাল একদিনের মধ্যে যতটা পারা যায় পাতাইয়া দেখে নিতে হবে। পরশুদিন বিকেল পর্যন্ত থাকব এ নগরীতে। রিসেপশন থেকে পাতাইয়া নগরীতে ভ্রমণের ব্রোসিয়র নিয়ে এসেছি। ব্রোসিয়র দেখেই পরিকল্পনা সাজালাম পরদিন। খুব সকালে সাগরের সৌন্দর্য অবলোকনে আমার দিল্ পরিষ্কার হয়ে যায়। সুতরাং ভোরে উঠে সাগর পাড়ে যাব। আটটার দিকে হোটেলে এসে গোসল, নাস্তা সেরে কোরাল রিফ বা প্রবাল দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ। স্পিডবোটে যেতে হবে। দুপুর নাগাদ ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। বিকেলে আবার সাগর পাড়ে। সন্ধ্যায় ওয়াকিং স্ট্রিটে পদভ্রমণ। সংকোচ নিয়ে সালাহউদ্দিনের আবদার, ‘ভাই আমাদের তো কোনো বদ উদ্দেশ্য  নেই। রাতে রেডলাইট এলাকাতে একটু পদভ্রমণ করে দেখার খুব ইচ্ছে।’ বেচারা তো পয়সা খরচ করে এসেছে। যা বলেছে তাতো মিথ্যে না। সম্মতি দিয়ে ঘুমোনোর আয়োজন করলাম। যত সমস্যাই থাকুক ঘরে মশককুলের সাড়াশব্দ পাইনি।

 

সে-রাতে নিদ্রাদেবী দ্রুতই ভর করল দুজনের ওপরে। সালাহউদ্দিনের বিছানা থেকে অবশ্য কিঞ্চিৎ নাসিকা গর্জনের শব্দ ভেসে আসছিল। মৃদু শব্দ বলাই ভালো, গর্জন বলা যাবে না। ক্লান্তিজনিত ঘুমের পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম-পর্ব সেরে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বিস্কুট খেয়ে পড়িমরি করে সাগরসৈকতে ছুটলাম দুজনে। কিছুক্ষণ হেঁটে, নাকি ছুটেই পৌঁছলাম সৈকতে। তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। রাতের বেলা সৈকত-সংলগ্ন পাহাড়ের গায়ে আলো ঝলমলে অসংখ্য বহুতল হোটেল ভবন দেখেছিলাম। কক্সবাজার সৈকতের পাশে যে ধরনের পাহাড় দেখা যায়, এ সৈকতের পাশে তার চেয়েও উঁচু সবুজ পাহাড়ের সারি। সাগরসৈকত এ জায়গাটাতে অর্ধচন্দ্রাকৃতির। সাগরের পানি এখানে পুরোই নীলাম্বরী। সদ্য উদিত সূর্যালোকের ছটায় সৈকতের বালুকারাশি চিকচিক করছে। ভোরে সূর্য যেন দ্রুতই পশ্চিমাকাশ পানে ধাবিত হয়। উদীয়মান সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত আলোকছটার নাচন সাগরসৈকতে এক অপূর্ব আলোছায়ার কায়া তৈরি করেছে।

 

যা ভেবেছিলাম তা না! ভেবেছিলাম সৈকত বুঝি-বা মানবশূন্য থাকবে কক্সবাজারে ভোরে যেমনটি দেখি। কিন্তু এখানে তা না। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এ শহরে আসে। অনেক পর্যটক এখানে আসে রাত জেগে আনন্দ-অভিসার করার জন্য। কিছু পর্যটক কিংবা কিছু দম্পতি মধুচন্দ্রিমাতেও এখানে আসে। সুতরাং কাকডাকা ভোরেও সৈকতে বেশ কিছু পর্যটকের আনাগোনা। আরাম চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। চেয়ারের ওপরের ছাতা গুটিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ারের মালিক কিংবা ইজারাদারের দেখা পেলাম না। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে দুজন বসে পড়লাম।

যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। সাগর আর পাহাড় সর্বদাই আমাকে ডাকে। সে ডাক আর কেউ না শুনতে পেলেও আমি পাই। পাহাড়ের ডাকে সাড়া দেই। তার বুকে অবগাহন করি। কিন্তু সাগর আমাকে যেভাবে ডাকে তাতে আমি সাড়া দেই না। কেননা সে আমাকে যেভাবে ডাকে তা তার বুকে বিলীন হয়ে যাওয়ার আহ্বান। তা সম্ভব না। অপলক নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্য, রূপ-মাধুর্য উপভোগ করি। সম্বিত ফিরে পাই সালাহউদ্দিনের ডাকে। ‘ভাই প্রায় আটটা- চলেন হোটেলে। বিকেলে আবার আসব।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই- এক যুবক পাশে এসে দাঁড়ালো। হাঁ চেয়ার ইজারাদারের টোল আদায়কারী! ক্যালকুলেটরের নব টিপে দেখিয়ে দিল দুজনকে দিতে হবে পঞ্চাশ বাথ (দু শ টাকা)।

 

হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন সোয়া আটটা। গোসল ও নাস্তা সেরে নিলাম দ্রুত। আবার বেরিয়ে পড়লাম ন’টায়। গন্তব্য প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার, টেকনাফে ভ্রমণে গিয়ে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্ন্টিনে না গেলে ভ্রমণ অসমাপ্ত থেকে যায়। তেমনি পাতাইয়া এসে কোহ লারন-এ না গেলেও ভ্রমণটা অসমাপ্তই থেকে যাবে। টুকটুকে করে দশ মিনিটেই ঘাটে পৌঁছে গেলাম। ঘাটে এসে দেখলাম স্পিডবোট ছাড়াও প্রবাল দ্বীপে  ছোটো জাহাজ যাতায়াত করে। প্রথম জাহাজ ছাড়ে ন’টায়, ওদিক থেকে শেষ জাহাজ ছাড়ে বিকেল ৫টায়। ঘাটে পৌঁছে চক্ষু যেন চড়কগাছ। শত শত স্পিডবোট এবং ডজনের ওপরে ছোটো যাত্রীবাহী ফেরিজাহাজ। স্পিডবোটে সময় লাগে ৩০ মিনিট। ফেরি জাহাজে এক ঘণ্টা। ঘাট অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হাঁক-ডাক নেই। ত্রিশ বাথ (এক শ বিশ টাকা) দিয়ে টিকেট করে একটা ফেরিজাহাজে উঠে বসলাম। খুব শক্তপোক্ত জাহাজ বলেই মনে হলো। সকলেরই বসার ব্যবস্থা আছে। রসুইঘরও আছে। জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই।

জাহাজ ছেড়ে দিল। দ্রুতগামী জাহাজ সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলল প্রবাল দ্বীপ ‘কোহ লারন’ অভিমুখে। পাশ দিয়ে প্রবাল ঢেউ তুলে আরও দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য স্পিডবোট। আধা ঘণ্টা পার হয়েছে। তখন পাতাইয়া নগরী দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়েছে। কোহ লারনও দেখা যাচ্ছে না। বিশাল নীল জলরাশির মধ্যে ছোটো এক জাহাজে আমরা আকাশের গাঙচিলগুলো যেন তখন আমাদের একমাত্র সঙ্গী। আরও কিছুক্ষণ পরে দূরে সবুজের আভা দেখতে পেলাম- কোহ লারন প্রবাল দ্বীপ। কোহ লারন জাহাজ ঘাট খুব পরিচ্ছন্ন। স্পিডবোট ভিড়ার ঘাট পৃথক। জাহাজ থেকে নেমে মিনিট দশেক প্রধান সড়ক ধরে ইতস্তত হাঁটলাম। কাল রাতেই হোটেল থেকে পাওয়া ব্রোসিয়রে এ দ্বীপের বিনোদনের উপায়-উপকরণ জেনেছি। জাহাজেও ব্রোসিয়র পেয়েছি। কিছুটা হেঁটেই বিস্মিত-বিহ্বল-বিমূঢ় হয়ে পড়লাম।

মন ছুঁয়ে গেল দেশের কথা- কক্সবাজারে একটা শিশুপার্ক নেই। প্রধান সড়কের দুপাশে পাকা ফুটপাত পর্যন্ত নেই। খোলা পানির সাগরপাড়ে বড়রা আনন্দ পেলেও শিশুদের আনন্দের জন্য কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। একটা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত নেই।

 

এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। পৃথিবীতে এমন কোনো অ্যাডভেঞ্চার উপকরণ বোধ হয় নেই যা এ দ্বীপে দুষ্প্রাপ্য। সার্ফিং স্নোরকেলিং, ওয়াটার স্কিয়িং, প্যারা গ্লাইডিং- কী নেই এখানে! সব উপকরণ মজুত করা হয়েছে এ দ্বীপে। তাই তো সারা বিশ্ব থেকে এত এত মানুষের আগমন এখানে। নানা দেশি রেস্তরাঁর সমাহার রাস্তার দুধারে। দ্বীপের সাগর পাড় ঘেঁষে সৈকতে খোলা আকাশের নিচে রেস্তরাঁগুলো বেশ জমজমাট মনে হলো। টেবিলের ওপরে অবশ্য বিশালাকৃতির রঙিন ছাতা। এখানে অ্যাডভেঞ্চারিজমের যেসব উপকরণ তা দেখা ছাড়া কোনোটিতেই আমার আগ্রহ নেই। তবে সালাহউদ্দিন প্যারা গ্লাইডিং করতে চায়। বয়সে তরুণ- আমার মতো ভীতুও নয় সে। গ্যাস সিলিন্ডারযুক্ত বিশাল বেলুনে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে শূন্যে উঠে গেল। ওগুলো পঞ্চাশ, খুব বেশি হলে ষাট ফুট (ছ’তলা ভবনের সমান) উচ্চতায় উঠতে পারে। নির্ধারিত সময়ের আগেই ও নেমে এল। দুই পায়ে গ্যাসসিলিন্ডার বেঁধে বেলুন ছাড়াই ওড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। কিছু দুঃসাহসী শ্বেতাঙ্গ ওগুলোর গ্রাহক হয়ে স্থলভাগ পেরিয়ে রীতিমতো সাগরের ওপরেও আকাশ ভ্রমণ করছে।

ঘণ্টা খানেক হেঁটে কোলাহল ছেড়ে সাগর পাড়ে পাথরের দেখা পেলাম। এখানে পানির গভীরতা খুব কম। পানির নিচে জলজ উদ্ভিদের কারণেই সম্ভবত পানির রঙ এখানে সবুজ। মাত্র তিন-চার ফুট গভীরতায় জলজ উদ্ভিদের গা ঘেঁষে নানা বর্ণের মাছ ছোটাছুটি করছে। খোলা আকাশ (ওপেন স্কাই) রেস্তরাঁতেই আগাম মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। ক’দিন দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেয়ে ক্লান্ত। স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে খেলাম- স্প্যানিশ স্টাইল স্প্যাগেটি আর ফ্রাইড লবস্টার। উইদাউট মিট বলায় খিদমতগার ম্যানেজারকে ডেকে আনল। স্প্যানিশ মহিলা আমাদের নানাভাবে বোঝালো কিছু মাংসের টুকরা না দিলে সুস্বাদু হবে না। বেশ কোশেশ করেই তাকে রাজি করালাম এটা বলে যে আমরা নিরামিষাশী। নিরামিষ স্প্যাগেটি বোধ হয় এখানকার শেফ কোনোদিন তৈরি করেনি। যে কারণে এবারে ম্যানেজারের সাথে তিনিও আমাদের দরবারে তশরিফ আনলেন। তিনি জিগ্যেস করলেন পনির, ডিম বেশি করে দেয়া যাবে কিনা। হাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। বলতে দ্বিধা নেই, নিরামিশ স্প্যাগেটি ছিল সুস্বাদু। পুরোটা খেয়েছিলাম- একেবারে যাকে বলে চেটেপুটে খাওয়া।

পাতাইয়া হোটেলে যখন এসে পৌঁছলাম তখন বিকেল চারটা। বিশ্রামের সময় নেই। খুব ভোরে উঠেছি। একটা ভাত ঘুম দেয়ার ইচ্ছে ছিল। সময় হবে না।  আবারও গোসল করে ঝাড়া পনের মিনিট ‘শবাসন’ যোগব্যায়ামটি করলাম। শরীর মন সম্পূর্ণ সতেজ হয়ে উঠল। ক্লান্ত শরীরে এই আসনে যোগব্যায়ামের সমস্যা হচ্ছে ঘুম এসে যেতে পারে। সালাহউদ্দিন ঘুমিয়েই পড়েছে। বেচারাকে ডেকে তুলে নতুন কাপড় চোপড় পাল্টে নিলাম। হোটেলে রেস্তরাঁ নেই। তবে রিসেপশনে কফি মেশিন আছে। ব্যাগ থেকে দেশি বিস্কুট বের করে খেয়ে কফি মেশিন থেকে দুজন দু’মগ কফি কিনে খেলাম। সকালের রিসেপশনিস্ট তখনও আছে। হালকা হাসি দিয়ে জিগ্যেস করল কোথায় কোথায় বেড়ালাম, এখন কোথায় যাব। বললাম, ভোরে সাগরসৈকত দেখে কোহ লারন দ্বীপে গিয়েছিলাম। কাল ওয়াকিং স্ট্রিট ঘুরে দেখেছি, আজ আবার যাব।

‘কোহ লারন থেকে এত তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারলে?’

‘হাঁ, আমাদের সময় কম তো। অফিসের কাজে ব্যাংকক এসেছিলাম। দু’দিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে পাতাইয়া এসেছি।’

‘এখন কোথায় যাবে?’ ‘এখন আর একবার সৈকতে যাব। বিকেলের ভিড়ে সৈকত থেকে সূর্যাস্তটা দেখব।’

‘সৈকতে এক্সক্লুসিভ জোন আছে, তা জানো।’ ‘মানে?’ ‘ওটা বিদেশিদের জন্য। ওখানে মূলত প্রকৃতিবাদীরা যায়।’

‘তার মানে ওটা নিশ্চয় নুড বিচ?’

‘হাঁ।’

হায়! মানবসভ্যতার ইতিহাসে পড়েছি আদিমযুগে গুহা মানবরাও গাছের ছাল-পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করত। জ্ঞানের বিকাশলাভের প্রথম পর্যায়েই মানুষ শিকারলব্ধ মাছ-মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন আনে, তারা রান্না করতে শেখে। এরপরেই তারা পাথরে পাথর ঘষে ধারাল অস্ত্র তৈরি করে। ওগুলো দিয়ে পশু শিকার, জমিকর্ষণ ইত্যাদি কাজ করতে থাকে। এরপরেই তারা কাপড় চোপড় পরার তাগিদ অনুভব করে। তারা তৈরি করে বয়নযন্ত্র, তৈরি করে কাপড়। এই ইলেকট্রনিক যন্ত্র-সভ্যতার যুগে কিনা প্রকৃতিবাদ! ঐ লোকগুলোকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলেই আমার মনে হয়। গোটা দিন সপরিবারে কাপড়বিহীন অবস্থায় সাগরসৈকতে শুয়ে বসে থাকবে। সেখান থেকে ফিরে উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর সিএফসি গ্যাস নির্গমনকারী যন্ত্র ফ্রিজ থেকে সর্বাগ্রে হুইস্কি বের করে খাবে। এরপরে আরও এক উচ্চমাত্রার সিএফসি গ্যাস নির্গমনকারী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে শয়ন করবে। তখন প্রকৃতির কথা ভুলে যাবে।

‘না আমরা ওখানে যাব না।’

‘তোমরা মুসলিম?’

‘হাঁ, কেন?’

‘মুসলিমদের বেশিরভাগই রক্ষণশীল। আমি আগে ব্যাংকক থাকতাম। ওখানে মুসলিম মেয়েদের দোকানদারি করতে দেখেছি। সবসময় হিজাব পরে থাকে। নিবন্ধন খাতায় দেখলাম তোমাদের ঘরে কাল কোনো নারী-অতিথি আসেনি, আজ আসবে?’

‘না, আজ না, কালও না।’

‘ও তোমরাও তো খুব রক্ষণশীল। তাহলে পাতাইয়া এসেছো কেন?’

‘দেখতে। এই যেমন আজ কোহ লারন দ্বীপের সৌন্দর্য দেখলাম।’

‘রেড লাইট এলাকায় যাবে না? ঘুরে দেখতে পার।’

‘হাঁ দেখতে যাব। আচ্ছা বলতো ওখানে গেলে কেউ আমাদের ধরে টানাটানি করবে না-তো?’

‘অসম্ভব! তোমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। ডাকও দিতে পারে। কিন্তু টানাটানি করবে না। নিশ্চিন্তে যেতে পার।’

মগে কফি শেষ, সময়ও স্বল্প, একেবারে চলতি ভাষায় যাকে বলে টাইট। ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে দশ মিনিট হেঁটে সাগরসৈকতে চলে এলাম। এলাহী কাণ্ড! দৃষ্টি প্রসারিত করলেই মনে হয় ইউরোপের কোনো সাগরসৈকত। নারী-পুরুষে ঠাসা। আমাদের কলাতলী সৈকতের মতো। জনবহুলতা ছাড়া আর কোনো সাদৃশ্য খুঁজতে যাওয়া নিরেট বোকামি। নারী-পুরুষ সকলেই স্বল্পবসনা। তবে নারীদের পোশাকের দৈর্ঘ্যজনিত স্বল্পতা অবর্ণনীয়। আমার মতো অনেকেরই এ সৈকতে সন্তানাদি নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

সৈকতে চাদর বিছিয়ে শোয়া মেয়েগুলো জেগে না ঘুমে বোঝা যায় না। গোটা শরীর উদোম করে রাখলেও চোখে কালো কাপড় বেঁধে রেখেছে আলো যেন ওদেরকে বিরক্ত না করে। ওরা চামড়া ট্যান করছে। বাংলাতে বললে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, সাদা চামড়া রোদে পুড়িয়ে বাদামি করার চেষ্টা করে। হায়! বাদামি চামড়ার ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর জন্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপন আমাদের দেশে কতই না রমরমা। কেউ-ই কী তাহলে নিজ অবস্থানে সুখী বোধ করে না?

অসংখ্য মানুষ কিলবিল করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একেবারে ঢাকায় মিরপুর ৬ নম্বর বাজারে শুক্রবার সকালে যেমনটি হয় আর কী! এরই মধ্যে নারী কিংবা পুরুষ চাদর বিছিয়ে ম্যাসাজ নিচ্ছে। ম্যাসাজের ধরন দেখে মনে হয় একেবারে শরীর দলাই-মলাই যাকে বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ম্যাসাজ গ্রহীতা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বেছে নিয়েছেন। সৈকতের ভিড় ঠেলে সাগরের নীল জলের কিনারায় দাঁড়ালাম। পশ্চিমাকাশে সূর্য তখন আজকের মতো বিদায় নেবার পালায় নিমগ্ন। প্রবল তেজে গোটা দিন এই ধরাধাম আলোকিত করার পরে প্রস্থান-পর্বে লজ্জাবশত রক্তিম আভা ধারণ করে সকলকে বিদায় জানাচ্ছে যেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঘন কালো মেঘের আভায় তার রক্তিমাভাও লুপ্তপ্রায়। তখনও সাগরে কিছু মানুষ ব্যস্ত গোসল, সার্ফিং কিংবা জেট বাইক নিয়ে।

এদেশ তো নেপাল, ভুটান কিংবা মিয়ানমার নয় যে রেস্তরাঁ রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যাবে? সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো আজ দেরীতেই রাতের খাবার খাব। যাকে বলে লেড ডিনার। ভেতো বাঙালি বলে বদনাম আমাদের। কেন, কে, বা কারা এহেন বদনাম রটিয়েছে জানি না। তবে আমার জন্য এটাই সত্য যে, দুপুরে ভাত না খেলে মনে হয় পেটপুরে খাবার খাওয়া হয়নি, পুষ্টিও বোধ হয় শরীরে কম গিয়েছে- যা আদৌ সঠিক নয়। বরং ভাতেই পুষ্টিগুণ কম। তা সে যাই হোক আজ দুপুরে ভাত না খাওয়ায় নিজেকে কেন যেন হালকা হালকা লাগছিল। সালাহউদ্দিন তরুণ। তার নাকি পেটে চনমন অবস্থা।

সাগরসৈকত থেকে এসে ঢুকেছি ওয়াকিং স্ট্রিটে। সৈকত সড়কের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে ওয়াকিং স্ট্রিট। কত আর হাঁটা যায়। সুবিধাজনক একটা রেস্তরাঁ খুঁজছিলাম। বসাও হবে, বৈকালিক নাস্তাও হবে। ফাস্টফুডের দোকানেই পা দিলাম। নামে ফাস্টফুডের দোকান বটে। এখানে এমন কোনো ধরনের ফাস্টফুড শপ বা রেস্টুরেন্ট নেই যেখানে দ্রাক্ষারসযুক্ত পানীয় পাওয়া যায় না। একটি টেবিলও খালি নেই। খালি টেবিল না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ম্যানেজার দেখছে, খিদমতগারেরাও দেখছে, টেবিলের অতিথিরাও দেখছে। কারুরই কোনো বিকার নেই। তিন সারিতে অন্তত তিন পাঁচে পনেরটা টেবিল। টেবিলের সন্ধানে দুই সারির মাঝ বরাবর হাঁটছি। একটি টেবিল থেকে ‘হাই’ শব্দ শুনে দাঁড়ালাম। স্থূলদেহী এক শ্বেতকায় ভদ্রলোক। তার পাশে হাফ প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত থাই তরুণী। ভদ্রলোকের সাথে রাতে হোটেলে চোখাচোখি হয়েছে। সকালে নাস্তার সময়ও হাই-বিনিময় হয়েছে। আমাদের দুরবস্থা দেখেই সম্ভবত বসতে বললেন। বসতে দেরী করলাম না। পরিচয়-পর্ব সারতেই থাই তরুণী উঠে গেল। যাওয়ার সময় অবশ্যি হাত নেড়ে বিদায় জানাতে ভুল করেনি।

উনি ডেভিড, বয়স পঞ্চাশ, জাতে অস্ট্রেলিয়ান। অবলীলায় বলে গেলেন নিজের কথা। পেটে সুরা বোধ হয় পরিমাণের চেয়ে বেশি গেছে। পেটে সুরা বেশি গেলে মানুষ নাকি দিলখোলা হয়ে যায়। ডেভিড অবলীলায় বলে চলল নিজের কথা। ‘কুড়ি বছর আগে এদেশে এসেছিলাম। এশিয়ার অনেক দেশেই গিয়েছি। কিন্তু এদেশটাই ভালো লেগেছে। কেননা এরা রক্ষণশীল না। ধর্মীয় গোঁড়ামি এদের নেই।’ হুইস্কির গ্লাসটা পূর্ণ করে নিল ডেভিড। ফ্রায়েড চিকেন দিয়ে স্কস হুইস্কি খাচ্ছে। বোধ হয় নেশায় ধরেছে। ডেভিড বলে চলল, ‘অস্ট্রেলিয়ায় আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ে আছে। আমি থাকি সিডনিতে আমার ব্যবসায় নিয়ে। স্ত্রী মেয়েদের নিয়ে থাকে ক্যানবেরাতে, ও চাকরি করে। সে খুবই নাক-উঁচু স্বভাবের। বদরাগীও। আমি আর্থারাইটিসের রোগী। ছুটি নিয়ে কদাচিৎ-কদাচিৎ সিডনি এলেও আমার প্রতি যত্ন নেয়া তো দূরের কথা বাসায়ও থাকে কম, ভাই-বোনের বাসায় সময় কাটিয়ে রাতে ফেরে। আর থাই-নারীরা ভালো। খুব পতিব্রতা। আমি স্ত্রী লরাকে তালাক দিব। মাস তিনেক আগে এখানে এসে ডুয়ানফেন এর সাথে এক মাস কাটিয়ে গিয়েছি। ও ম্যাসাজ পারলারে কাজ করে। এ দফায়ও আমি ওর সাথে এক মাস থাকব।’

‘তাহলে এই লিভ টুগেদার কি তোমাদের বিবাহপূর্ব পরীক্ষাকাল?’

‘ইয়েস। ডুয়ান খুব ভালো মেয়ে ও বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তানের মা হবে। ও সকাল-বিকেল আমাকে রান্না করে খাওয়ায়। প্রতিদিন আমাকে ম্যাসাজ করে দেয়, যা আমার শরীরের ব্যথা-বেদনা দূর করার জন্য খুবই প্রয়োজন। এদেশের মেয়েদেরকে তুমি স্বামীর সাব-সারভেন্ট বলতে পার।’

‘তোমার ব্যবসা?’

‘হাঁ, আমি এবারই কাগজপত্র প্রস্তুত করে যাচ্ছি। আমি আমার ব্যবসা এদেশে নিয়ে আসব।’

‘তোমার মেয়েরা তোমাকে মিস করবে না?’

‘মিস করলে আমাকে দেখতে আসবে। এখনও তো ওরা বছরে দু’তিন বারের বেশি আসে না। মা-ই ওদের জীবন। ওরা আমাকে চেনে না।’

পারিবারিক সংকট ও তা থেকে বেরিয়ে মানুষটা শেষ বয়সে সুখের সন্ধান করছে। মদে চুর হয়ে অভিমানী ডেভিড প্রায় অপরিচিত মানুষের কাছে নিজের জীবনের কথা হরহর করে বলে গেল।

‘তোমরা আজ কী করলে আর কাল কী করবে?’

বললাম আমাদের আজকের ভ্রমণের কথা ও কালকের পরিকল্পনার কথা।

‘আই গেস বোথ অফ ইউ আর মুসলিম। অ্যাম আই কারেক্ট?

‘হাঁ, ঠিকই ধরেছ।’

‘ইয়েস। তোমরা খুব রক্ষণশীল। তোমরা জীবনটাকে উপভোগ করতে জান না।’

ডেভিডের চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে উঠেছে। তরুণী ডুয়ানফেন পঞ্চাশোর্ধ বিশালাকৃতির বপুসমৃদ্ধ আর্থারাইটিসের রোগী এই ডেভিডকে বিয়ে করে কী পাবে? শংকরবর্ণের সন্তান পাবে। ডেভিডের ব্যবসায়ের উত্তরাধিকারী হবে। ডেভিড যদি কোনো কারণে ওকে ছেড়ে দিয়েও যায় তবুও এদেশের আইন অনুযায়ী ডেভিডের বিপুল বিত্তের অংশবিশেষ পাবে। তারপরে হয়ত সে আবারও পারলারের চাকুরিতে ফিরে যাবে। আবার তা নাও হতে পারে। ডেভিড দীর্ঘজীবী হতে পারে। ডুয়ানফেন এক বৃদ্ধের স্ত্রী হিসেবে সচ্ছল জীবন যাপনের সুযোগ পাবে।

 

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না