আম্মা- আমাদের মুশকিল আসান

0

 

বেশ কিছুদিন ধরে একটা যন্ত্রণায় ভুগছি। কলম দিয়ে কালি বের না হলে, ভিতরটা কেমন যেনো হাহাকার করে। এ তীক্ষ্ম যন্ত্রণা- অনুভূতিও বলা যায়, অনুভূতিই এমন সময় যন্ত্রণার আকার ধারণ করে- কাউকে বুঝানোর মতো নয়। আজ অবধি কোনো প্রিয় মানুষকে নিয়ে দু’চার লাইনের বেশি লিখতে পারিনি। কোনো এক অদ্ভূত কারণে কলম থেমে যায়। উপমারা সব লুকিয়ে পড়ে। শব্দভাণ্ডারে কপাট লেগে যায়। তাই কোনো শব্দ নয়, কিছু পরমাত্মিক আবেগ নিয়েই আজ রচনা করতে বসলাম আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশকে।

তিনি আমার আম্মাজান। যিনি আমাদের সাক্ষাত আদর্শ। এই জগৎ সংসারে আমাদের সকল সময়ের একমাত্র নীরব সাক্ষী। তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য কোনো ভুবনে। তাঁর আজ ৩৬৫ দিন। এই ইট বালুর শহরে শেষ বিকেল অদ্ভূত সুন্দর আর উপভোগের। ঠিক তেমনি এক পড়ন্ত বিকেল, বৃহস্পতিবার। দুপুরের আকাশে ছিলো একঝাঁক মেঘ। আলো-আধারের ছন্দপতনে বিকেল ঘনালো। আসরের ওয়াক্ত। তাঁরপর হঠাৎ পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ। আমি কান পেতে শুনছি সেই পাখার উত্তাল আওয়াজ। বাতাসে কি যেনো সংবাদে ভেসে আসছে আমাদের দুয়ারে। খানিকবাদে আম্মা চোখ বুঝলেন। একটা নির্জন, নিঃসঙ্গ বিকেল আমাদের আলিঙ্গন করলো। আমি আম্মার মুখের দিকে তাকালাম, মনে হলো কোনো আকাশ দেখছি- শরতের নীলাভ আকাশ। কি পবিত্র আর নির্মল মুখখানা। শেষবারের সাক্ষাতে আম্মার এই পবিত্র মুখখানাই রাখলাম আমার হৃদপকেটে। খুব যত্নে, তবে নীরবে।

 

আব্বা যেনো গলাকাটা কবুতরের মতো ছটফট করছেন। আর আমি মুহূর্তের মধ্যে আচমকা বড়ো হয়ে গেলাম, অনেক বড়ো। আমার মাথা ঘরের ছাঁদ ফুঁড়ে আকাশ ছোঁয়ার মতো বড়ো।

এই ছবিটা আমার সবচে’ প্রিয়। তার বিশেষ কারণ- আম্মা। আমি বরাবর কোনো ছবি তুলে আগে আম্মাকে দেখাতাম- কেমন হয়েছে জানতে। এটা যখন দেখাই তখন আম্মা বলেছিলো, আমার এ যাবৎ তোলা সব ছবি থেকে এটা সবচে সুন্দর আর মিনিংফুল। তাই এটা আমার প্রাণের ছবি। ছবিতে আমার তিন ভাই। (বড় ভাইয়া, আতিক, আর অপু)

 

তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ- বিদায়। মাত্র তিন অক্ষর। তাঁর সাথে আমাদের নতুন করে পরিচয় হলো। আমরা নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু শব্দটি আপাদমস্তক বিষাদে ভরা। বিদায়ের শেষবেলা মনটা কেন যেন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। কারণ এই যে, বিদায় হচ্ছে বিচ্ছেদ। আর প্রত্যেক বিচ্ছেদের মাঝেই নিহিত থাকে নীল, গাঢ় নীল কষ্ট। প্রিয় মানুষের বিয়োগ, আমাদের জীবনে এই প্রথম অভিজ্ঞতা। তাঁরপর থেকে আজ… গোটা একটা বছর।

 

এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, আম্মা নেই। তাই আমি খিলখিল করে চলতে পারি। আম্মার গড়া জীবনের জন্য আমরা বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াই। জীবনের পরতে পরতে আম্মাকে কাছে পাই। বলতে গেলে আম্মা ছিলেন আমাদের মুশকিলে আসান। কত কিছু চোখের সামনে রেখেও খুঁজে পেতাম না, আম্মা খুঁজতে গেলেই ম্যাজিক ঘটতো। জানিনা কি অদ্ভুত নিয়মে আজো এটা ঘটে! কিছু খুঁজতে খুঁজতে যখন পাগলপারা ঠিক সেই মুহূর্তে চোখের সামনেই পেয়ে যাই। তাই মনে হয়, আম্মা অলওয়েজ আমাদের খুবই নিকটে থাকে। আমাদের গোটা বসবাস জুড়েই আম্মার অবস্থান। মনে হয়, আম্মার অশরীরি আত্মা আমাদেরকে দেখছেন, নীরবে নিভৃতে পাহাড়া দিচ্ছেন তাঁর বুকজোড়া মাণিকদের। শারীরিক আমরা মাঝেমধ্যে শারীরিক দুর্বলতাঁর ঊর্ধ্বে উঠি অনুভূতির জোরে, তখন আমরা অনুভব করি এমন।

 

আমাদের জীবনে অনেক কিছুই ঘটেছে। যা যা জীবনে চাইনি তা তা পেয়েছি। আবার যা আঁকড়ে ধরে সারাটা জীবন বাঁচতে চেয়েছিলাম তা তা হারিয়েছি। বলতে গেলে আম্মা অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। তাঁর মধ্যে গোটা শ’খানেক বই, একজোড়া কলম, আম্মার কষ্টার্জিত মানুষের মহব্বত, আমাদেরকে সুশিক্ষা, আর একটা সুন্দর মন। যা দিয়ে গোটা জীবনটা রাজার হালে কাটিয়ে দিতে পারবো।

 

আমাদের আম্মা ছিলেন যুগের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। অসম্ভব আধুনিকমনা একজন মানুষ। অসম্ভব তেজীয়ান আর সাহসী। আচারে ছিলো বিনয়, শব্দে ছিলো নম্রতা। আম্মা কোনোদিন কারোর মনে কষ্ট দিতেন না। এটা আমি ছোটো থেকে দেখেছি তবে উপলব্ধি করতে পেরেছি আম্মা চলে যাওয়ার পর। অনেক মানুষ আমার সাথে দেখা করে এসব বলতেন। আম্মা কিভাবে তাদের হেল্প করেছিলেন বা আম্মার কিঞ্চিৎ সুপারিশে অনেক কাজ কতো সহজ হতো। প্রতিনিয়ত এসব শুনতাম আর মুগ্ধ হতাম। এমন মায়ের সন্তান হিসেবে রোজ আমরা গর্ববোধ করি।

 

ছবিটা গতবছরের, মুন্সিবাড়িতে। ভোরের আলোর পবিত্রতা আর মাধুর্যতা ভোগ করছিলেন আম্মা আর আরিফা। তৎক্ষণাত মোবাইল দিয়ে তোলা।

আমার মনে আছে ইন্টার পরীক্ষার পরপর আম্মা আমাকে তাগাদা দিতে শুরু করলেন ‘কিছু একটা কর, কিছু একটা কর’। জীবনে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার গুরুত্ব প্রথম জানতে পেরেছি আম্মার কাছেই। যদিও আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক তিনিই। দীর্ঘ সময় তাঁর শাসনেই তটস্থ ছিলাম আমরা। আমাদের ব্যাপারে যতটা উদার ছিলেন ঠিক ততটাই কঠোর ছিলেন। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচে বেশি কনফিডেন্ট ছিলেন আম্মাই। তিনি জানতেন আমরা স্বপ্নতক পৌঁছবো। আম্মার আধবয়স কেটেছে কেবল আমাদের পড়াশোনার পিছনে। একাডেমিক পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি খুব সেন্সিটিভ ছিলেন। একহাতে সব সামলাতেন।

 

এইতো সেদিন সায়মার সাথে কোচিং-এ গিয়ে দুই ঘণ্টা বসেছিলাম। সাথে মোবাইল ছিলো। গেম খেলছিলাম, বাট কি ঝিমানোই না আসছিলো! মনে মনে চরম বিরক্ত হচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ আম্মার কথা মনে পড়লো। কত বিকেল, কত সন্ধ্যা আম্মার এমন কোচিং এর বাইরে কেটে যেত আমার জন্য, আমাদের জন্য। তাঁর তো সময় কাটানোর জন্য মোবাইল বা গেম ছিলো না। তখন ভাবলাম, না জানি আম্মারা কত ধৈর্যশীল হোন! আম্মারা কেবল আম্মা হন না, সাথে সাথে আরও অনেক কিছু হন।

 

এসএসসির আগ মুহূর্তটা কড়া শাষনে আমরা বড় হই। দিনরাত পড়াশোনা। কঠোর সাধনা। অধিকাংশ চাপই আম্মার মাথায়। আমি রাত জেগে পড়তাম আম্মা পাশে বসে থাকতেন, আর টেবিলে ঝিমাতেন। তবুও আমাকে একা ফেলে যেতেন না। আমি ঘুমালে তবেই আম্মা কিছুসময় চোখ বুঝতেন। আমি অনেকের মা’কে এখন দেখি। কাউকে আম্মার মতো দেখি না।

আমাদের পড়াশোনার প্রতি তিনি পাগলের মতো যত্নবান ছিলেন। তিনি কোনোদিন প্রতিযোগিতায় নামাতেন না, জিততে হবেই এসব শেখাতেন না। তবে তিনি বলতেন তুমি তোমার সেরাটা দাও, প্রচুর পরিশ্রম করো বাকিটুকু আল্লার হাতে। আজতক এভাবেই চলছে আমাদের জীবনযাপন।

 

ছোটোবেলার একটা ব্যাপার খুব মনে পড়ে, আম্মার মুখ থেকেই প্রথম সুরা, দুরুদ শেখা। রাতে পড়া শেষ করে আমাদের নিয়ে শুয়ে পড়তেন তাঁরপর দুরূদপাঠের, সুরাপাঠের অনুশীলন চলতো। এভাবেই আমাদের মুখ থেকে দরূদ ঝড়তো। বুকে তাঁর কদর তৈরি হলো আম্মার জন্যই।

 

আম্মাকে আমি আমার এলার্ম ঘড়ি বলতাম সবসময়। এই রহস্য আমি আজো খুঁজে পাই না। শেষ রাতে শুয়েও কি করে তিনি ফজরের নাগাল পেতেন। আমি ফজরের পর পড়তে বসতাম। এখন ভাবি আম্মা মনে হয় ঘুমাতেনই না, কেবল চোখজোড়াকে একটু বিশ্রাম দিতেন।

 

আমার বুকে রক্তক্ষরণ হয়, আম্মা। জীবনের প্রতিটি রাত কি অসহনীয় লড়াইটা করলেন আমাদের জন্য। ভোর থেকে আবার সেই একঘেয়ে ব্যস্ত জীবন। আপনার শান্ত শীতল বুকটাই ছিলো আমাদের শেষ আশ্রয়। আম্মার নেউটা ছিলাম আমরা। আমাদের আম্মা মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। কোনোদিন আমাদের শেকলে বাঁধতেন না, প্রাণে বাঁধতেন। হ্যাপী পেরেন্টিং বোধহয় এটাই। আমাদের সব আবদারের ঘাঁটি ছিলো আম্মার আঁচল। চুপিসারে আধোভাঙ্গা শব্দগুলো দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতাম, আম্মা ঠিক বুঝতেন।

 

আম্মার রুচিবোধ আমাদের চেয়ে ঢের ভালো। সৌন্দর্য বলতে আম্মা বুঝতেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি। কাজের ক্ষেত্রেও তাই। আম্মা আমাদেরকে সবসময় বলতেন “জীবনে অনেক কাজ করতে হবে তা নয়, যেটুকু করবে মন দিয়ে করবে। পারফেকশন ইজ মোষ্ট ইম্পরট্যান্ট।” এসব আমাদের জীবনের সূত্র। এসব ধরেই পথ আগাচ্ছি।

 

আম্মাকে কোনোদিন দেখিনি আয়নার সামনে কিছু মুহূর্ত কাটাতে। কিন্তু তিনি অসম্ভব সুন্দর ছিলেন। আমার আম্মাই মনে হয় এমন নারী যারে কোনোদিন আমি কাজল পড়তে দেখিনি। তাঁর ধবধবে চোখগুলো সবসময় আমাদের কাছে প্রিয় ছিলো।

 

আম্মা প্রচণ্ড সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। তবে খুব উল্লাসপ্রিয় ছিলেন। আম্মা অবাধ মেলামেশা অপছন্দ করতেন। কিন্তু উদযাপনে পিছপা হতেন না। আম্মা মুহূর্তকে নিয়ে মাততেন সবসময়। ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও উদযাপন প্রিয় মানুষ। উদযাপন বাড়তি কিছু সময় বেঁচে থাকার রসদ যোগান দেয়, এটা আম্মার কাছ থেকেই শেখা। বৃষ্টির সময় আমরা আম্মার দিকে তাকালেই তিনি বুঝতে পারতেন আমরা খিচুড়ি খেতে চাই। আমাদের চোখের ভাষা, আমাদের খাবারের স্বাদ সবটুকুই আম্মার তদারকিতে হতো।

 

আমাদের শেষ সফরের সময় তোলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিলো। আম্মা আমার মাথায় ছাতা ধরে রাখছে, আর আমি ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখছিলাম। আম্মাই বললেন এটা তুলে রাখ, আমিও তুলে রাখলাম। মুহূর্তে বন্দী।

 

ছোটো থেকে আমি খুব একটা মানুষের সাথে মিশতাম না; অপরিচিত কারোর সাথে নিজেকে কমফোর্ট ফিল হতো না। সেই সুবাধে আমার প্রথম বন্ধু আম্মাই। আমি ছিটেফোঁটা যতটুকু ক্রিয়েটিভ, তাঁর সবটুকু অবদান আম্মার। তাকে ছাড়া আমার সাহিত্যচর্চা প্রায় অসম্ভব ছিলো। তিনি দুর্দান্তরকমের একজন শৈল্পিক মানুষ ছিলেন। কি দারুণ ছিলো তাঁর কারুকাজ। আমার লেখালেখির হাতেখড়ি আম্মার বদৌলতে। ছোট্টবয়সে দৈনিক দিনলিপি লিখাতেন। ক্লাস থ্রী/ফোরে পড়ি তখন। লাল মলাটে বাধা পুরাতন কিছু খাতা। স্কুল থেকে ফিরলেই আম্মাকে বিরক্ত করবো বলে তিনি সেই খাতা আর পেন্সিল দিয়ে বলতেন সকাল থেকে স্কুলে কি কি করছো লিখো। আমিও বানিয়ে বানিয়ে লিখতাম। সেখান থেকেই গল্প লেখা শুরু, কাগজ কলমের সাথে প্রেম… আমার জীবনে তাঁর অবদান প্রতিটা সেক্টরেই। আম্মা চমৎকার আঁকতেন। তাঁর হাতেই আঁকা শিখে বহুবার প্রাইজ পেয়েছি। আমাদের সর্বোচ্চ সফলতাই ছিলো আম্মার সম্মানি।

 

ইন্টারের দিকে আমি এক কোচিং-এ পড়ি। আম্মা আমার সাথে নিয়মিত যান। হঠাৎ একদিন, কোত্থেকে এক ছেলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। পড়ে দেখলাম ফটোগ্রাফি কোর্সের। তাও ফ্রী। আম্মা জোর করে বললেন করতে। তিনমাস, সপ্তাহে একদিন। করলাম। বাট চালিয়ে গেলাম না। ব্যাপারটা, কাকপক্ষীও জানতে পারেনি। আম্মার এমন অনেক শৌখিনতা আমাকে দিয়ে পূরণ করেছিলো। এটাই ছিলো তাঁর আনন্দ।

 

আমি উদ্ভট পাগলাটে ছিলাম। রাগও ছিলো প্রচণ্ড। আম্মা যদিও আমার সরলতাকেই বেশি পছন্দ করতেন। আমার স্বাভাবিক চলাফেরা। আর পাঁচজন থেকে একটু ভিন্ন ভাবনা। ইন্টারের পর আমি একটু একটু বড়ো হলাম। তখন প্রচুর স্বপ্ন দেখতাম। আর সেই স্বপ্নগুলো কেবল আম্মাকেই বলতাম। তিনি কেমন জানি ভরসা দিতেন। তাঁর বুকভরা আশা ছিলো আমরা তিনবোন একদিন বড়ো হবো। অনেক বড়ো। আমাদের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিলো। তিনি বারোমাস চাইতেন আমরা যেনো সুস্থ মানুষ হই। আমরা যেনো সবার হকটা বুঝি।

তাঁর বোনা স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে তিনি আমানত রাখতেন।

 

তবে ভালো মানুষ হওয়ার লোভ জন্ম থেকেই আমাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন- “রুজিরোজগার যাই হোক না কেনো, ভালো মানুষের মতো সুখি না-কি এ পৃথিবীতে আর কেউ নাই”। তিনি বলতেন- “তোমরা উদার হও। জীবনে যত বড়োই হও না কেনো, বিনয় থেকো।”

আমার বই পড়া, বইয়ের সাথে সখ্যতা সবকিছু আম্মার জন্য। তিনি ছোটোবেলায় খেলা বলতে বুঝিয়েছেন বইকে। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে মানুষ-গোনা খেলতাম। অনেকবার আম্মার সাথে খেলেছি এই খেলা।

 

আম্মার চাবির তোড়ার শব্দ খুব মিস করি। বাড়িতে তিনি যখন হাঁটতেন, বুঝতে পারতাম আম্মা হাঁটছেন। গত ৩৬৫ দিন অনেকের চাবির তোড়ার শব্দ শুনি কিন্তু আম্মার চাবির তোড়ার মতো শব্দ কানে ভাসে না।

 

আজকে আম্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদেরকে উনি একটা সুস্থ পরিবেশে লালন পালন করেছেন। সুস্থ ও দৃঢ় মনমানসিকতা তৈরিতে জোর দিতেন। আর অসম্ভব সুন্দর ছোটবেলা আর কৈশোর উপহার দিয়েছেন। আজকে আমরা যতটা ভালো দিনাতিপাত করছি তার একমাত্র কারণ আম্মার খাস কর্মের জন্য। কোনো একজনকে বলতে শুনেছি, মা-বাবার ভালো কৃতকর্মের ফল সন্তানরা ভোগ করে। আমাদের জন্য এর সর্বোচ্চ উদাহরণ আমরাই।

 

১৫ জুলাই, ২০২০-এ তোলা। আম্মার দেখা শেষ চাঁদ।

 

আম্মা, আপনার পরকালযাত্রা দেখে আমি তৃপ্ত হয়েছিলাম। এমন হালতেই আপনি যেতে চেয়েছিলেন। আল্লা- আমার আম্মাকে জান্নাতের উঁচু মকাম দান করুন, আমিন।

 

আম্মা, আমি আবাবিল পাখির অপেক্ষায় আছি। যদি তারে দিয়ে আপনার কাছে আমাদের সুখে থাকার বার্তাটা পৌঁছানো যায় তাই। আম্মা, আপনার দেখানো পথটা অনেক কষ্টের। তাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনি বলতেন ‘বাপ, তুমি পারবে’- আপনার একটা কথাই আমার জীবনের সেরা মোটিভেশনাল লাইন। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমাকে সুরা কেরাত পড়ে মাথায়, বুকে ফুঁ দিয়ে দিতেন। আমার জীবনের সর্বোচ্চ কঠিন পরীক্ষাগুলোও কেমন যেনো সহজ হয়ে যেতো।

আম্মা, এবারো আপনি একটা ফুঁ দেন, যাতে আমার সব কাজ সহজ হয়। আপনার ফুঁ আমাদের বুককে বড়ো করে, সাহস বাড়ায়।

 

আম্মা আপনাকে বলি, আমাদের সকল অর্জন আপনার। আমাদের সকল উপার্জন আপনার। সন্তান হিসেবে আপনার কদমে সব উৎসর্গ। আপনার মতো উৎফুল্ল-আহ্লাদি মা দুনিয়াতে বিরল। আম্মা, জানেন? কলম থেকে বের হওয়া প্রতিটি কালির ফোটা বেয়ে আমার চোখের জল কাগজে টপটপ করে পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের মতো। আপনার প্রিয় শব্দ। আপনাকে কদমবুসি, আম্মা।

১৬-০৭-’২১

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না