বুক রিভিউ বলতে আজকাল যেসব রিভিউ দেখা যায় আমি তার ঘোরবিরোধী। আমি আসলে সেই ‘তথাকথিত’ রিভিউতে বিশ্বাসী নই বরং আমি মনে করি প্রত্যেকটা বইয়ের গদ্যের ধরণ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ছোট বিষয়েরও আলাদা বিশেষত্ব আছে।
আমি যখন কিনেছিলাম তখন বইটির নাম ছিলো ‘নিছক গল্প কিংবা আখ্যান’। এই নামটার মাহাত্ম্য নিয়ে পরে কথা বলছি। তার আগে বলি বইটি লিখেছেন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। যারা বাংলাদেশী মৌলিক থ্রিলার ঘরানার বই পড়েন এবং বাংলা থ্রিলার নিয়ে খোঁজ-খবর রাখেন তারা হয়তো অনেকে তাঁর নাম শোনে থাকবেন। বলা যায় তিনি কোলকাতা ও ঢাকায় সমান জনপ্রিয়। তার লেখা বিখ্যাত ট্রিলজি ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ ইতোমধ্যে দুই বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছে। বাংলা ভাষার ওটিপি প্ল্যাটফর্ম হইচই ইতোমধ্যে এই ট্রিলজির প্রথম বই নিয়ে ওয়েব সিরিজ তৈরীর ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ২০০৫ সালে নিজে একটি প্রকাশনী খোলেন যার নাম দেন ‘বাতিঘর প্রকাশনী’। তার এখন পর্যন্ত দশের অধিক বই বেরিয়েছে। বলাবাহুল্য তার একটি বাদে সবই জমাট থ্রিলার। বাকী একটি বই নিয়েই আজকের কথাবার্তার বিষয়।
নিছক গল্প কিংবা আখ্যান বইটি বের হয় ২০১৯ সালে। তার কিছুদিন পর ভিন্ন নামে কোলকাতার অভিযান পাবলিশার্স থেকে একই বই বেরোয়। তারও কিছুদিন পর পরিবর্তিত নাম দিয়েই বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হতে শুরু করে। আমি বেশ আগ্রহী ছিলাম বইটার প্রতি এজন্য যে, তাঁর থ্রিলারের বাইরের গল্প আদৌ কেমন! খুলে বুঝলাম এটা একটা গল্পগ্রন্থ। হাতে গুনে দেখলাম গল্পের সংখ্যা আঠারো ছুঁয়ে গেছে। কিছু গল্প নিয়ে কয়েক লাইন লেখার লোভ সামলাতে পারছি না।
বইটির দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘লেখকের আসন’। বলা যায় থ্রিলারেরই একটি সাব-জনরা। বেশীরভাগ দার্শনিকরা পৃথিবীর সবকিছুকেই চক্রে আবদ্ধ করে তাদের দর্শন-চিন্তা প্রকাশ করেছেন। সক্রেটিস থেকে ফুকো সবার ক্ষেত্রেই। আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, ছোটবেলা থেকেই আমরা আসলে চক্রের বিভিন্ন আকৃতি পড়েই বড় হই। যেমন ধরুন খাদ্যচক্র। অথবা ধরা যাক বাস্তুসংস্থান। একটু বড় হয়ে যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করি তারা তো পরমাণু মডেলের ভুল-শুদ্ধ খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই এক কঠিন চক্রে পরে যাই। অন্যান্য গ্রুপের শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রত্যেক বিষয়ে বড় এক চক্রের খোঁজ পান। আমরা অবচেতন মনে তা লক্ষ্য করি না। আপনি সকালে বের হচ্ছেন, ঘুরছেন, খাচ্ছেন, ফিরে আসছেন এই অসম চক্রের গতিশীলতা কখনোই আপনি বুঝবেন না। কিন্তু আপনি ঠিকই চক্রের একটা অংশমাত্র। আমার মনে হয় এই গল্পটা সেরকমই এক ভয়ংকর চক্রের ইঙ্গিত দেয়। আর বেশি কিছু বলার তেমন প্রয়োজন নেই।
উপরে যেই গল্প নিয়ে বললাম সেটি বইটির দ্বিতীয় গল্প তা আগেই বলেছি। প্রথম গল্পের নাম ‘ছিট ফিরোজের বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতার উপাখ্যান’। সত্যি বলতে এই গল্পটার নাম ততটাই জটিল মূল গল্পটি আসলে ততটাই সাদামাটা। আমি বুঝতেই পারিনি আসলে এখানে ‘গল্পটা’ কী! কিন্তু আপনি এরকম একটা গল্প পড়ে বিরক্ত হয়ে যখন দ্বিতীয় গল্পটা পড়ে মৃদু ধাক্কা খাবেন তখন আপনি নড়েচড়ে বসতে বাধ্য। গল্পগ্রন্থ লেখার সময় কোন গল্প আগে বসবে আর কোনটা পরে বসবে এটা নিয়ে লেখকেরা পাজল করেন। এর অনেকগুলো বিখ্যাত ও কার্যকর পদ্ধতি আছে। এই বইটিতে প্রবলভাবে এই বিষয়টার উপস্থিতি দেখা যায়।
যেমন আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি যখন যথাক্রমে সাদামাটা ও মৃদু ধাক্কা মার্কা গল্প পড়ে আশাবাদী হয়ে পরের গল্প পড়বেন তখনই লেখক আপনাকে পড়ের গল্পে নিয়ে যাবে যার নাম ‘যে কারণে লাশ ভেসে উঠতে পারে’। নামেই মৃদুভাবে থ্রিলারের গন্ধ আছে। আদতেও তাই। পরবর্তী প্রায় গল্প তিনেক আপনাকে থ্রিলারের বৈচিত্র্যময় গল্প পড়তে হবে। তবে একঘেয়েমি লাগার আগেই আবার একটি ফুলটস ডেলিভারি দেয়া হবে। ‘পিথিকোফেবিয়া কিংবা অন্দরে বান্দর’ সেরকমই একটি গল্প। জনরায় ফেলতে গেলে বড়জোর এটাকে ফ্যান্টাসিতে ফেলা যায়। সফট থ্রিলার থাকায় ফ্যান্টাসি থ্রিলার বললে খুব বেশী অপরাধ হবে না। কিন্তু আপনি আগের গল্পের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
এতক্ষণ এসব পড়ে আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? এই বইয়ের গল্পের নামগুলো বেশ অন্যরকম। তা নাহলে আবার গল্পের নামগুলো পড়ুন। আরো কয়েকটা নাম বলতে পারি। যেমন-
• রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরন্ময় নীরবতা
সুন্দরবনে যেভাবে শূয়রের দল জায়গা করে নিলো
এই বইয়ের আরেকটি দিক হলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যা আমরা সায়েন্স ফিকশন নামে চিনি। নিছক একটি ট্যুরিং টেস্ট সেরকমই একটি গল্প। গতানুগতিক সায়েন্স ফিকশনগুলোতে কিছু হাবিজাবি জিনিস দিয়ে খিচুড়ি তৈরী করা হয়। এগুলোকে হাবিজাবি বলি কারণ আমি নিজে প্রচুর সায়েন্স ফিকশন পড়েছি এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি কেউ কেউ ঘুরে ফিরে একই কনসেপ্টের উপর গল্প ফাঁদে বৈ আর তেমন কিছুই করে না। যেমন সায়েন্স ফিকশনের সবচেয়ে সস্তা একটি পয়েন্ট হলো পৃথিবীর বাইরে চলে যাওয়া। অথবা কোন এলিয়েন আসা। এগুলো এখন বর্ণমালা বইয়ের স্বরে-অ পড়ার মত পানসে লাগে। কিন্তু এই বইতে প্রত্যেকটা সাই-ফাই গল্পে বেশ বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়। শেষ থার্টিফাস্ট নামের অন্য একটি গল্পে পৃথিবীর বাইরের এলিয়েন নিয়ে এলেও শেষে বুঝতে পারবেন আসলে আমাদের প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্পদিক নিয়েই এর মূল আলোচনা।
এই বইয়ের সবচেয়ে অসাধারণ দিকটি হলো গল্পগুলোর নিজস্ব ছন্দ থাকা। অনেক সময়ই গল্পের ভেতরের বর্ণনা সহজে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এতে পাঠক বুঝতে পারে এর পরের লাইন কী হতে চলেছে। এটা আমার কাছে বিরক্তিকর। আমি এখানে এর উল্টোটা পেয়েছি। একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে এখানে যার নাম ‘মেকানিক’। সেখানে দেখা যায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত বাবুল নামের একজনের প্রাথমিক জীবনের সাদামাটা গল্প। যে কিনা বাবার অনুপস্থিতিতে ধোলাইখালের একটি গ্যারেজে কাজ নেয়। তখন সে চোখে সানগ্লাস পরা গ্যারেজের মালিক ‘আবু ওস্তাদ’কে দেখে অবাক হয়। কারণ সে গাড়ির তাবৎ কাজ জানতো। হঠাৎ শুরু হয় দেশে যুদ্ধ। পাকিস্তানি মিলটারিরা গাড়ি ঠিক করাতে আসে আবু ওস্তাদের কাছে। দেশে তখন তুমুল রক্তক্ষয় হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে বাবুল তার হতদরিদ্রতা নিয়ে গ্যারেজের কোনায় বেঁচে থাকে। আর আবু ওস্তাদ মিলিটারিদের সাহায্য করে, গাড়ি ঠিক করে দেয়। হঠাৎ একদিন তার ওস্তাদ পালিয়ে যায়। কারণ জানা যায়, তার ওস্তাদ আসলে গাড়ি ঠিক করার বদলে পাক-শত্রুদের গাড়িগুলো বিগড়ে দিয়েছে। সেগুলো ব্রেকফেল হয়েছে অজায়গায়। আবু ওস্তাদ এখন সাক্ষাত মৃত্যুর অপেক্ষায়। পুরো গল্পজুড়ে বাবুলের এরকম মর্মস্পর্শীতার বর্ণনা পেয়ে গেলেও গল্প শেষে আপনি বুঝতে পারবেন আসলে গল্পটা বাবুলের না। গল্পটা সেই মেকানিক আবু ওস্তাদের। যিনি ১৬ই ডিসেম্বর দেশ বিজয়ের পর একদিন হঠাৎ করে পুরান ঢাকার গলি কাঁপিয়ে তার একটি পুরনো বাইক নিয়ে ভটভট আওয়াজ করে গ্যারেজে ফেরেন। তার চোখে সানগ্লাস। আসল নায়কের বেশে। এই দৃশ্য আপনাকে মৃত্যশয্যায় থাকা সেই বাবুলের গল্প ভুলিয়ে দেবে।