একাত্তরের সাবিহা

বই: একাত্তরের সাবিহা ; লেখক: মো. রেজাউল করিম ; প্রকাশক: জলধি ; প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২০ ; মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০

0

 

বাঙালির ইতিহাসে গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। নয় মাসে লাখো শহীদের রক্তস্নাত যুদ্ধ এ জাতির ইতিহাসে শৌর্য, ত্যাগ ও সম্মানের মুকুট। এমন মুকুট সকল জাতির ইতিহাসে নেই। পৃথিবীর সকল দেশে সংঘটিত স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা বিপ্লব সে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মনন ও মনস্তত্ত্বে এমন কিছু উপাদান যোগ করে, যা ভিন্ন মাত্রার শিল্প-সাহিত্য প্রস্তুতে ব্যাপক অবদান রাখে। শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্প-সাহিত্যের সকল শাখায়-ই বিস্তর সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত গৌরবগাথা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা-বোনের অশ্রুবিধৌত। এমন এক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্ছিত্র, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালেই আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আখ্যানভিত্তিক গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। হয়ত বিশ্বমানের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য এখন পর্যন্ত রচিত হয়নি, কিন্তু দেশীয় প্রেক্ষাপটে শিল্প-সাহিত্যের সকল শাখায়-ই কালোত্তীর্ণ সাহিত্য তৈরি হয়েছে, সেই প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

 

১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে রচিত রেজাউল করিমের একাত্তরের সাবিহা উপন্যাস পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে অক্ষরের জালে বুনা এ এক নারীর বীরত্ব গাথা। এই উপন্যাসের ব্যাতিক্রম দিক হলো মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানটা ফুটে উঠেছে উজ্জ্বলতরভাবে। ১৯৭১ সালকে কেন্দ্র করে রচিত অধিকাংশ বইয়ে নারীদের দেখা যায় অসহায় অবস্থায় অথবা অনুপ্রেরণা দানকারীর ভূমিকায়। এই উপন্যাসে সাবিহাকে সাহসী ভূমিকায় উপস্থাপন করা হয়েছে।

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের একমাত্র হল ছিল রোকেয়া হল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের মতো রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে শত্রু মোকাবিলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। সেই ফটোগ্রাফ আজ দুর্লভ নয়। খবর পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছেও। তাই ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে অন্যতম টার্গেট ছিল রোকেয়া হল। ৭ মার্চের ভাষণের পর একটা বড়ো কিছুর আশংকায় হল ছেড়েছিলেন প্রায় সব ছাত্রী। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের দীপ্ত শপথে বলীয়ান ৭ ছাত্রী হলেই থেকে যান।

 

গণহত্যার তাণ্ডব শুরুর পরপরই হলের প্রোভাস্টের নির্দেশে রাত ১২টার দিকে হাউস টিউটর মরহুম অধ্যাপক সাহেরা খাতুন হলে অবস্থানরত ৭জন ছাত্রীকে নিজ কোয়ার্টারের স্টোর-রুমে লুকিয়ে রেখেছিলেন। স্টোর রুমের বাইরে তালা আটকে দরজার সামনে মালামাল এমনভাবে রাখেন যেন কেউ দেখলে ভাবে দরজাটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত। ছাত্রীদের না পেয়ে পাকিস্তানী সেনারা হলের কর্মচারি কোয়ার্টারে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালায়। কর্মচারি ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৫ জন নিহত হয়। শিশু-নারী কেউ সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। ২৬ মার্চ ঢাকা শহরে ছিল কারফ্যু। ২৭ তারিখে কারফিউ শিথিল করা হলে ৭ ছাত্রী হলের পেছন দিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

পরবর্তীতে ঐ ৭জনের কেউ সীমান্তের ওপারে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পেশার সূত্রে তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ। এখনও তিনি নিজ পেশায় নিয়োজিত আছেন। কেউ-বা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত হন। একজন সাবিহাকে ঘটনাক্রমে কুষ্টিয়া জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়ে টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি নিতে হয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগান মুক্তিবাহিনির জন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের মতো দুঃসাহসী কাজে। তার দেয়া তথ্যে অনেকগুলো ছোটো-বড়ো যুদ্ধে পাকবাহিনির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিটি দিন, প্রতিটি তথ্যপাচারের ঘটনাই ছিল শ্বাসরুদ্ধকর।

 

মুক্তিবাহিনীর নিকট সাবিহার তথ্য পাচারের প্রতিটি প্রক্রিয়াই ছিলো শ্বাসরুদ্ধকর। উপন্যাসের এক পর্যায়ে সাবিহা তার পরিচয়-সংকট উপলব্ধি করে। মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের গোয়েন্দা হিসেবে সে  কাজ করেছে গোপনে, প্রকাশ্যে সে ছিলো পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসের কর্মচারী। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তি বাহিনী মেরে ফেলবে পাকিস্তানি দালাল ভেবে, আর সত্য জানলে পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত হতে হবে।

 

নানা ঘটনার দোলাচালে সাবিহা ৭ ডিসেম্বর অর্থাৎ কুষ্টিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধের আগেই ধরা পরে যায়। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বয়োজ্যেষ্ঠ লে. হাশমি মেয়েতুল্য স্নেহ করতো সাবিহাকে, অপরদিকে অপারেশনাল কমান্ডার মেজর মিশ্র যুদ্ধের শুরুর দিকেই তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। মিশ্র ভেবেছিল, বাঙালিদের বিদ্রোহ অচিরেই দমন করা যাবে। এর পরে সে সাবিহার সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হবে। দুজনের বিশ্বাস ভঙ্গের পরিণতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিলো নাকি নেয়নি, সাবিহা কি পেরেছিলো তার সম্ভ্রম রক্ষা করতে! নানা চিন্তায় উপন্যাসের এই পর্যায়ে পাঠক-মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।

উপন্যাসের প্রতিটি অক্ষরে যেনো বারুদের গন্ধ, মুহুর্মুহু গুলির ঝংকার, বুটের শব্দ, অজানা আশংকায় অদ্ভূত সব চাপা কষ্ট।

আরও রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা, লোভাতুর চাহনি, বিনিদ্র রজনী। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয় প্রধান নারী চরিত্র সাবিহা যেনো আমি নিজেই। দেশ মাতৃকার বিজয়ের লক্ষে আমার যত প্রচেষ্টা।

একেকটা তথ্য পাচারে সাবিহার সাথে পাঠককে নিয়ে যাবে একাত্তরের অগ্নিঝড়া দিনে। ১৯৭১ এ জন্ম না নিয়েও আমাদের অন্তরে এই গভীর অনুভূতি তৈরি লেখকের লেখনীর বিশেষ ক্ষমতার ফল।

আমার জানা মতে একাত্তরের সাবিহা ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে প্রথম কোন নারীপ্রধান চরিত্র নিয়ে রচিত উপন্যাস।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না