রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে বের হয়ে বাঙলা ভাষার আধুনিক কবিতার সূচনা করেছিলেন যারা তাঁদের একজন বুদ্ধদেব বসু। বিষয়-প্রকরণে নিজস্বরূপে আবিভূত হয়েছিলেন। পঞ্চপাণ্ডব হিশেবে যারা পরিচিত তাঁদের মধ্য থেকে জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতাই আমাকে প্রবলভাবে টেনেছে। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা আমাকে অতোটা টানেনি। তাঁদের কাব্যভাষায় মুগ্ধ হইনি। বলা যায় অনেকটা বিরক্তিকর ঠেকেছে। হয়তো বা তাঁদের কবিতা গ্রহণ করার মতো বোদ্ধা পাঠক হতে পারিনি অথবা আমি তাঁদের কবিতা আবিষ্কার করতে না পারা একজন। মেনে নিচ্ছি আমারই অযোগ্যতা। কবিতা পরিবর্তনশীল। কবিতা অনেক ধরনের হয়/হতে পারে বলেই।
বুদ্ধদেব বসু একটি গদ্যে বলেছেন, ‘পূর্বসুরীদের মতো লিখবার চেষ্টা করতে-করতেই বাক্যরচনার নীহারিকায় হঠাৎ একদিন তারকার জন্ম হয়, অনুকরণের কলরোল ছাপিয়ে বেজে ওঠে নতুন সুর, নিজস্ব সুর।’ বুদ্ধদেব বসুর প্রথমদিকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখের প্রভাব ছিলো বলে জানা যায়। কিন্তু আমরা তাঁর কবিতা পাঠ করে বুঝতে পারি তিনিও অনুকরণের কলরোল ছাপিয়ে বাজাতে পেরেছিলেন কবিতার নতুন ও নিজস্ব সুর। কঠোর অনুশীলনই হয়তো তাঁকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতায়। অনুশীলনে তিনি ব্যর্থ হননি। সতীর্থদের থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করতে পেরেছেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা। জীবনানন্দ দাশকে বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি হিশেবে বিবেচনা করা হয়। জীবনানন্দের পরে বুদ্ধদেব বসুকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তাঁর কবিতার চিত্রকল্প আমাকে গভীর মাদকতা এনে দেয়। মনে হতে থাকে মুগ্ধতা চাদরের মতো যেন ঘিরে আছে আমাকে। শরীরী বিষয়ের নান্দনিক উপস্থাপন ও রোমান্টিকতা আমাকে মুগ্ধ করে বেশ।
রবীন্দ্রভাষ্য মতে, “বুদ্ধদেব বসুর কবিতা যেন একটি দ্বীপ। এই দ্বীপের বিশেষ একটি আবহাওয়া, ফলফুল, ধ্বনি ও বর্ণ। এর সরস উর্বরতার বিশেষ একটি সীমার মধ্যে এক জাতীয় বেদনার উপনিবেশ। দ্বীপটি সুন্দর কিন্তু নিভৃত। হয়তো ক্রমে দেখা যাবে দ্বীপপুঞ্জ, হয়তো প্রকাশ পাবে উদার বিচিত্র মহাদ্বীপে ‘তমালতালী বনরাজিনীলা’ তটরেখা।” পাঠক হিশেবে বলতে চাই, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পাঠ আমাকে নিরিবিলি এক দ্বীপে বসার অনুভূতি ও আনন্দ দেয়। কল্পনার সেই দ্বীপ পরিণত হয় দ্বীপপুঞ্জে। চোখের সামনে চারদিক উন্মোচিত হতে থাকে। কখনো সমুদ্রের সাথে মিতালি হয়ে যায় যেন। কখনো বা গ্রহ-নক্ষত্রের কাছাকাছি হই, কখনো বাস্তবতার। আবার কখনো প্রেম, প্রকৃতি ও গভীর জীবনবোধের। আম্পায়ারের ওয়াইড সংকেতের মতো আমার চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে থাকে ক্রমশ। অনুধাবন করতে পারি তাঁর কবিতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। দ্বীপ থেকে দ্বীপপুঞ্জে পরিণত হয়ে উর্বরতার মহাদ্বীপ হিশেবে প্রকাশ পেয়েছে। কবিতাযাপন মূলত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। যা বুদ্ধদেব পেরেছেন। আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি তাঁর কবিতায়-
“কত কালো রাতে করাতের মতো চিরে
ভাঙাচোরা চাঁদ এসেছে ফিরে
তীক্ষ্ণ তারার নিবিড় ভিড়ে
ভাঙন এনে,
কত কৃশ রাতে চুপে-চুপে চাঁদ এসেছে ফিরে
সাগরের বুকে জোয়ার হেনে
তোমাকে আমাকে অন্ধ অতল জোয়ারে টেনে
মনে কি পড়ে?”