‘সফলতা’ বিষয়টার নিরীক্ষণ ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নরকমের হয়। কারো কাছে উচ্চ শিক্ষা, কারো কাছে সামাজিক উচ্চাবস্থান, ক্ষমতার আকাঙ্খা, আবার কারো কাছে ধনদৌলতের প্রাচুর্যই হলো জীবনের প্রকৃত সফলতা। কিন্তু যিনি এই মহা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা; রাব্বুল আলামিন এর কুদরতি নজরে সফলতা কী?
ইরশাদ হচ্ছে: “হে আমাদের রব, আর আপনি তাদেরকে স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন। আর তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়। এবং আপনি তাদেরকে পাপ হতে রক্ষা করুন, আর সেদিন আপনি যাকে পাপের শাস্তি / আযাব হতে রক্ষা করবেন, তাকেই তো অনুগ্রহ করবেন। আর এটাই তো মহাসাফল্য”।১
আল্লাহ পাক শিখিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে নিজেকে এবং নিজের পরিবারবর্গকে পাপে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করে জান্নাতের সুশোভিত জীবনকে আপন করে পাওয়া যায়। আর পৃথিবীতে সৎকর্ম করে চিরস্থায়ী শান্তির ঠিকানায় পৌঁছতে পারাকেই আল্লাহ পাক বলছেন মহাসাফল্য।
তবে এই সাফল্যকেই কি ‘রেজায়ে ইলাহি’ বলা যায়? উত্তর হলো- রেজায়ে ইলাহি আসলে ভিন্ন একটা প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিতে রয়েছে নিজের প্রভুর নুরকে আপন হৃদয়ে ধারন করতে পারার পরম অমৃত সুধা। জান্নাত লাভের চেষ্টা করা এবং জান্নাতের স্রষ্টার প্রেম অর্জনের চেষ্টার মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। রেজায়ে ইলাহি কবরের আযাব, বা আখেরাতে মিজানের পাল্লা কিংবা জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আগুন থেকে বাঁচতে চাওয়ার নাম নয়। হৃদয়-কাননে প্রভু-প্রেমের গোলাপ প্রস্ফুটিত করা, দুনিয়ার প্রাচুর্যতা বিলীন করে প্রভুর প্রেমে বিলীন হয়ে যাওয়া, দুনিয়ার সমস্ত মোহকে প্রভুর প্রেমের কাছে পরাভূত করা, ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি প্রদক্ষেপই প্রভুর ইয়াদগারির উপর থাকা, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস প্রভুর সন্তুষ্টচিত্তের প্রতি উদগ্রীব হয়ে থাকা। মূলত জীবন নামক মহাপ্রাণকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর রঙে রঙিন করাকে ‘রেজায়ে ইলাহি’ হিসেবে প্রতিবেদিত করা যায়।
ইরশাদ হচ্ছে: “তোমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হও। কেননা, তাঁর রঙের চেয়ে উত্তম রঙ আর কার হতে পারে?”২ প্রভুর রঙের মতো রঙ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারোরই হতে পারেনা; সম্ভবও না। সেই রঙে রঙিন হওয়ার পূর্ণ মনোস্কাম বা তাড়না একজন ব্যক্তিকে ‘রেজায়ে ইলাহির’ দিকে ধাবিত করে। ‘রেজায়ে ইলাহি’ অর্জন করার অন্যতম শর্ত হলো ‘মুমিনে কামেল’ হওয়া। আর মুমিনে কামেল হওয়ার শর্ত স্বরূপ হযরত রাসুল পুরনুর (দ:) বলেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদ্বার হতে পারবেনা যতক্ষণ না আমি তোমাদের স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও অন্যান্য সমস্ত কিছু হতে অধিক ভালোবাসার পাত্র না হবো।”৩
‘মুমিনে কামেল’ হয়ে ‘রেজায়ে ইলাহি’ পাওয়ার জন্য কীভাবে, কোন পথে, কাদের অনুসরণ করতে হবে তা রাব্বুল আলামিন সহজবোধ্য ভাষায় পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়ে বলছেন: “আমাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখান / সরল সঠিক পথের হেদায়ত দিন/ সরল সঠিক পথের উপর অটল রাখুন। তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন / যাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন। যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।”৪
রাব্বুল আলামিনের সুস্পষ্ট বর্ণিত তাঁর অনুগ্রহ ও নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে: “যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তবে সে তাঁদের সঙ্গলাভ করবে যাঁদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন- অর্থাৎ, নবীগণ, সিদ্দীকগণ(সত্যনিষ্ঠগণ), শহীদ এবং সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ। তাঁরা কতই উত্তম সঙ্গী।”৫
সুতরাং, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিপূর্ণ আনুগত্যকে সামনে রেখে ‘রেজায়ে ইলাহি’ যারা অর্জন করেছেন সেই সৎকর্মশীল / সত্যান্বেষীরা সাথী হিসেবে আখিরাতে সাথে পাবেন নবীগণকে, সত্যের সিদ্দিকগণকে, শহিদগণকে। ‘রেজায়ে ইলাহি’র মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে ব্যক্তি যেমন তাঁর নিজের ক্বলব আল্লাহর আরশে সম্পূর্ণীকৃত করেন আবার শেষ মিলনের দিবসে নবী, সিদ্দিক, শহিদ, সালেহিনদের সঙ্গী হয়ে প্রভুর সম্মুখে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেন। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককেই প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
১। সূরা আল-মুমিন: ৮-৯ নং আয়াত।
২। আল বাকারাহ : ১৩৮
৩। কিতাবুল ঈমান : বোখারী, ও মুসলিম
৪। সুরা ফাতেহা-৬-৮
৫। সুরা নিসা ৫৯