প্যান-ইসলামিজম বা সর্ব-ইসলামবাদ কী? প্যান-ইসলামিজম মূলত মুসলমানদের মধ্যে জাতিকেন্দ্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যেখানে সাংস্কৃতিক বা ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। উনিশ শতকের ইসলামি ভাবধারার রাজনৈতিককর্মী জামাল উদ্দিন আফগানিকে এর অন্যতম প্রবক্তা ও পুরোধা মনে করা হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে যখন মুসলমানদের সর্বশেষ ‘খিলাফত’ উসমানী সাম্রাজ্য পতনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, তখন মূলত খিলাফত টিকিয়ে রাখতে ও মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিরোধের প্রয়োজনে জামাল উদ্দিন আফগানি প্যান-ইসলামিজমের ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। কাজেই, শুরুতে প্যান-ইসলামিবাদ বলতে মোটামুটি ধারণা ছিল, একটি একক ইসলামি রাষ্ট্র তথা খিলাফত (সাম্রাজ্য) ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। তবে এ মতবাদ এখনও কট্টর শরিয়াহপন্থীরা ধারণ করে। কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আধুনিক ইসলামবাদীদের দ্বারা এর ধারণা কিছুটা বিবর্তিত হয়েছে; বর্তমানে মনে করা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের দ্বারা মুসলমানদের জাতিকেন্দ্রিক ঐক্যের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্ভব। তবে কিছু কিছু ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী ইমাম গাজ্জালি ও ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী ‘উম্মাহ’ শব্দটিকে রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহার করেছেন দাবি করে মনে করেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগ তথা রাশিদুন খিলাফত থেকে প্যান-ইসলামিজমের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল।
আধুনিকযুগে নেতৃস্থানীয় ইসলামি নেতা যেমন সাইয়েদ কুতুব, আবুল আলা মওদুদি ও আয়াতুল্লাহ খোমেনি প্রমুখ প্যান-ইসলামিজমের সমর্থক ছিলেন; কিন্তু তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের চাক্ষুষ ও নিরেট বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেননি। তারা প্রত্যেকেই ট্রাডিশনাল শরিয়া আইনে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মুসলিমদের ঐক্যের ব্যাপারে বিশ্বাস করতেন, যদিও এটা বাস্তবতাকে অস্বীকারের নামান্তর। তবে দু’দশক আগে আধুনিক ইসলামবাদী নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে প্যান-ইসলামিজমের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নেচমেত্তিন এরবাকান।
একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, প্যান-ইসলামিজম নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে তুরস্কের রাজনৈতিককর্মীদের বেশি উৎসাহী হতে দেখা গেছে। নেচমেত্তিন এরবাকানের সরকার তুরস্ক, মিশর, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ নিয়ে ডি-৮ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলে। এটির লক্ষ্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একক মুদ্রা (ইসলাম দিনারি), যৌথ বৈমানিক ও প্রতিরক্ষা কার্যকলাপ, পেট্রোকেমিকেল প্রযুক্তি উন্নয়ন, আঞ্চলিক বেসামরিক বিমান নেটওয়ার্ক ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে ঐক্য সৃষ্টি করা। তবে ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কথিত অভ্যুত্থানের পর এরবাকান সরকারের পতন ঘটলে সংগঠনটির কার্যকলাপের গতি প্রায় স্থবির হয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে প্যান-ইসলামিজমের কোনো প্রভাব বা সম্ভাবনা আছে কি? হ্যাঁ, আছে। নেচমেত্তিন এরবাকানের আকস্মিক পতনের পর এ আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়লেও ২০০০ সালে রিসেপ তায়িফ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির’ (একেপি) উত্থানের পর তুরস্কের রাজনীতিতে নতুনভাবে প্যান-ইসলামিজমের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। একেপির উত্থানের পর তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতেও বেশকিছু বদল ঘটতে থাকে। এদিকে তুর্কিদের দমিয়ে রাখা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পাদিত লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে আগামী ২০২৩ সালে। উল্লেখ্য, ১৯২৩ সালে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে সম্পাদিত ১০০ বছর মেয়াদী এ চুক্তির মাধ্যমে ওসমানী সাম্রাজ্যের বিভাজন হয় ও নতুন অনেক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে বসফোরাস প্রণালীর আন্তর্জাতিকরণ করা হয় ও তুরস্কের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বলা বাহুল্য, এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তুরস্ক বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। তবে এর মাধ্যমে ‘নব্য অটোম্যান’ পররাষ্ট্রনীতির ধারক তুরস্ক যে প্যান-ইসলামিজমের পথেই হাঁটবেন, তা সহজে অনুমেয়। এর তৎপরতা ইতোমধ্যে চোখে পড়েছে। ২০০৮ সালে তুর্কি-আফ্রিকা সহযোগিতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আফ্রিকার ৫০টি দেশ অংশ নেয়। সৌদি আরব মনে করছে, ‘নব্য অটোমান’ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে হর্ন অব আফ্রিকা দখল করতে চাইছে তুরস্ক। অসীম সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয়তাবাদী যাঁতাকলে পড়ে আঁটকে যাওয়া ওআইসির বিকল্প বৈঠক করে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দেখাতে চাইছেন এরদোয়ান। সম্প্রতি এরদোয়ান ২০০৮ সালের সাদৃশ্য আরেকটা সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিলে পাকিস্তান ও মালেশিয়ার মতো দেশগুলো ইতিবাচক সাড়া দেয়।
এছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ওসমানী সাম্রাজ্যের উপর নির্মিত তুরস্কের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘দিরিলিস আর্তুগুল’ পাকিস্তানে সরকারি অর্থায়নে প্রচারের উদ্যোগ নেন। এ ঘটনাও প্যান-ইসলামিজম আন্দোলনের সাথে প্রাসঙ্গিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত দিয়েছেন।
সম্ভাবনা ছাপিয়ে প্যান-ইজলামিজমের বেশ কিছু সংকট লক্ষ্য করা যায়। এ আন্দোলনের প্রধান ও প্রথম অন্তরায় হলো ভৌগলিক জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আরব-অনারব দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে প্যান-ইসলামিজম আড়ালে চলে যায়। আরব বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ প্যান-আরব দল যেমন বাথ পার্টি ও নাসেরিস্ট পার্টি প্রায় সব আরব দেশে বিস্তার লাভ করে এবং মিশর, লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ায় ক্ষমতায় আসে। প্যান-ইসলামপন্থীরা এসময় নির্যাতনের স্বীকার হয়। এ আন্দোলনের তৎকালীন চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব বন্দি ও নির্যাতিত হন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মিশরীয় রাষ্ট্রপতি নাসের আন্দোলনকে আরব জাতীয়তাবাদের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিলেন। অবশ্য শুধু আরবরাই নয়, প্যান-ইসলামিজমকে কেন্দ্র করে তুরুপের তাস মনে করা তুর্কিরাও জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। দেশের বাইরে সর্ব-ইসলামবাদ আন্দোলনে ক্ষমতাসীন একেপি দলের নেতা এরদোয়ানকে সক্রিয় দেখা গেলেও নিজ দেশে কুর্দিদের তিনি শক্ত হাতে দমন করছেন। প্যান-ইসলামজিমের দ্বিতীয় ও অন্যতম আরেকটি সংকট হলো শিয়া-সুন্নিকেন্দ্রিক বৈশ্বিক বিরোধ। ইসলামের দ্বিতীয় খিলাফত কালে উদ্ভাবিত ও সেসময় হতে চলমান এ বিরোধ থেকে মুসলমানদের মুক্তি মিলছে না। প্যান-ইসলাম আন্দোলনের প্রবক্তা জামাল উদ্দিন আফগানি সমস্যাটির গূঢ়ার্থ বুঝতে পেরে এ সংকট হতে উত্তোরণের জন্য নিজেই চেষ্টা করেছিলেন। তার জীবনীগ্রন্থ অনুসারে তিনি শিয়া মতাদর্শী হলেও নিজেকে সুন্নি বলে দাবি করতেন। প্যান-ইসলামিজমের তৃতীয় সংকট হলো কট্টর শরিয়াহপন্থীদের তাকফিরি ফতোয়া। তাকফিরি ফতোয়া বলতে মূলত নিজেদের একমাত্র সত্য মনে করা ও অন্যদের মুসলমান মনে না করাকে বুঝায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর হিজবুত তাহরির মধ্য এশিয়ায় একটি প্যান-ইসলামি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এদের মধ্যে এ সমস্যা প্রকট এবং পরবর্তীতে এ সংগঠন জঙ্গীবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত হয়।
এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনাটি ছিল মূলত তথ্য ও তত্ত্ব নির্ভর। তবে এখন কিছু ‘তবে’-‘যদি’-‘কিন্তু’মূলক কথা দিয়ে সংকট ও সম্ভাবনাকে তুলে আনার মাধ্যমে আলোচনার উপসংহার টানার চেষ্টা করবো। প্যান-ইসলামিজমকে বর্তমান সময় বিবেচনায় অপরিহার্য মনে করা হলেও মূলত এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সামনে মুসলমানদের মাথা নত করার সমার্থক। কেননা, মুসলমানদের ঐশীগ্রন্থ কোরান কখনও কাঁটাতারে ঘেরা রাষ্ট্রকে সমর্থন করে না। আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে মূলত পাশ্চাত্যে এনলাইটমেন্ট উদ্ভবের পর থেকে। তবে তাই বলে নিশ্চয় মুসলিমরা তাদের রাজনীতি বন্ধ করে দেবে না।
প্যান-ইসলামিজমের ধারণার আলোকে আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে কি বিশ্ব পরিচালনা আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উদারনীতিবাদীদের (Liberals) তত্ত্ব অনুসারে তা সম্ভব। তারা মনে করে, আগামীর পৃথিবী ‘অর্গানাইজেশন’ বা আন্তর্জাতিক সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হবে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাস্তব দৃষ্টান্ত ধরা হয়। তবে রাজনৈতিক বাস্তববাদীরা (Realists) এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। যদিও-বা চলমান ‘কভিড উনিশ’ মহামারিতে বাস্তববাদীদের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। কারণ, কভিড উনিশকালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলোর তৎপরতা খুব বেশি দৃষ্টিগোচর হয়নি। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র টিকে থাকার সম্ভাবনা আরও দৃঢ় হয়েছে। এ থেকে আরেকটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, কাঁটাতার তুলে দেওয়ার লড়াইয়ে বিজয়ী হতে চাইলে প্যান-ইসলামবাদী ও উদারনীতিবাদীদের এক কাতারে আসতে হবে।
বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে অগত্যা পাশ্চাত্যমুখী হচ্ছে; তবে প্যান-ইসলামিজমের ভেতর দিয়ে মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা-ব্যবস্থায় সম্মিলিত অর্থায়নের সুযোগ রয়েছে যদি এ আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে একটি ইকোনোমিক চেইন তৈরি করতে পারে। শিল্প-সাহিত্যে খ্রিস্টান কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকের পাশাপাশি মুসলিম লেখক-দার্শনিকরাও সাহিত্য-সিনেমায় খোরাক হয়ে উঠতে পারে সমন্বিত প্রয়াসে। ‘দিরিলিস আর্তুগুল’ সিরিয়ালের সম্মিলিত প্রচারকে এর প্রাথমিক বিপ্লব ধরা যায়। তবে এসব সম্ভাবনা বাস্তবে ধরা দিবে কিনা এবং প্যান-ইসলামিজম ধারণার অগ্রসরতা কতটুকু তা নির্ভর করবে মূলত মুসলিম দেশগুলো জাতীয়তাবাদী স্বার্থ কতটুক বিলুপ করতে পারে তার উপর। শেষ কথা হলো, প্যান-ইসলামিজম ধারণাটি সম্পূর্ণভাবে কোরান দিয়ে বিচার ও বৈধ করা না গেলেও মুসলমানদের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় পুঁতে রাখা খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণে এ আন্দোলনকে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।