মজলিশের গদ্য || ধর্মীয় উন্মাদনার ‘পাগলা ঘোড়া’র লাগাম টানবে কে? : মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

0

 

বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও বাতাসে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষ সামান্যতমও মানবিকতার সংকট উপলব্ধি করছে না। ধর্মীয় হানাহানির কদর্যতা যেন ক্রমশ বাড়ছে। তীব্র বেগে ছুটে চলা ধর্মীয় উন্মাদনার লাগামহীন পাগলা ঘোড়াকে থামাবে কে?

 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির আতুড়ঘর বলা যায়। তার উপর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িকতা যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী ব্যাঙ্গালুরুতে সম্প্রতি ভয়াবহ এক কাণ্ড ঘটে গেছে। বিজেপিপন্থী এক রাজনীতিকের নিকটাত্মীয়ের দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। আর তাতেই দাঙ্গা বেঁধে যায়। বিক্ষোভ, বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশের গুলি—সবমিলিয়ে মুহূর্তেই ঝড়ে পড়ে অনেকগুলো প্রাণ। এর কয়েকদিন আগে পাকিস্তানে নবী দাবি করা এক ব্যক্তিকে বিচার চলাকালীন আদালত প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্যা করে খালিদ নামের জনৈক যুবক। নবী দাবি করা বিষয়কে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকট। কাদিয়ানী নামক একটি দল খতমে নবুয়াত বা নবী আগমনের সমাপ্তিকে স্বীকার করে না। ইসলামী অন্যান্য গোষ্ঠী এদেরকে মুসলমান মনে করে না। বিষয়টা এতটুকু পর্যন্ত যথেষ্ট হতে পারত, কিন্তু কাদিয়ানী গোষ্ঠীর সাথে অন্যান্যদের বছরজুড়ে হানাহানি লেগে থাকে। কাদিয়ানীপন্থী পরিবারের এক শিশুকে সম্প্রতি কবর থেকে তুলে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। কাজেই, নবী দাবি করা ও নবী দাবিকৃত ব্যক্তিকে খুন করা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা আইন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক থাকার সত্ত্বেও আইনটি পাকিস্তানে বহাল আছে।

নবী দাবি করা যদি ধর্মীয় অবমাননার আওতাভুক্ত হয়, তবে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় আদালত উল্লিখিত আইনে তার শাস্তির ব্যবস্থা করবে; কিন্তু বিচারবহির্ভূতভাবে এবং অপরাধ প্রমাণের আগে কাউকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হত্যা করা স্বয়ং ধর্মগুলোও সমর্থন করে না। আর সে হত্যাকারী খালিদকে ইসলামের রণবীর বানানোর উগ্র প্রয়াস বিশ্বের কাছে মুসলমানদের নিয়ে ভুল বার্তা দিচ্ছে কিনা তাও ভেবে দেখছে না খালিদ সমর্থকরা।

ধর্মগুলোর উদাররূপ সাম্প্রতিককালে ধর্মানুসারীরা প্রায় ভুলতে বসেছে। ভারতের অযোধ্যায় ৫০০ বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানোর পক্ষে কাজ করছে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ভারত সরকার। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রীয় মদদে চলছে সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ। কথিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন যে ভগবান রামের কাজ না করলে আমার শান্তি কিসে হবে?”—এ দৃশ্য বড়ই আশ্চর্যের! ভারতের আদালত মেনে নিয়েছে যে, ৫০০ বছর ধরে এ জায়গায় মসজিদই ছিল; কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরে বিজেপিপন্থী জঙ্গিদের হামলায় মসজিদটিকে ভেঙে ফেলা হয়। এ নিয়ে আদালত নিন্দাও করেছে। অথচ এরপরেও আদালত মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দিয়েছেন! বিচারপতিরা ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া) একটি রিপোর্টও উল্লেখ করেছেন, যাতে বলা হয়েছিল বাবরি মসজিদের নিচে একটি স্থাপনা ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে—তবে সেই কাঠামোটি ঠিক কিসের, তা স্পষ্ট নয়। এমন একটি অস্পষ্ট বিষয়ের উপর কেন্দ্র করে যখন কোনো কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সাম্প্রদায়িক রায় দেয়, তখন আর বুঝার বাকি থাকে না যে, দেশটির বিচারবিভাগ, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের গর্ভনরসহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের আসনে বসা সকল ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কাজ করছেন। আবার এ রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে বিজেপি ও আরেক কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার আন্তঃকোন্দলও তীব্র!

 

ধর্মীয় হানাহানির চিত্র যে শুধু উপমহাদেশে এমন প্রখর তা নয়; সমগ্র পৃথিবীজুড়ে বিরাজ করছে সাম্প্রদায়িকতার রুদ্ররূপ। তুরস্কের হাইয়া সোফিয়া বা আয়া সোফিয়া যে খ্রিষ্টিয় পঞ্চদশ শতকে তথা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ক্যাথিড্রাল ছিল, এ কথা সবাই মানে। পরে তৎকালীন কন্সটান্টিনোপল বিজয় করে করে ইস্তাম্বুল প্রতিষ্ঠা করে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকরা। তখন এ ক্যাথিড্রাল কিনে নিয়ে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ওসমানীয় শাসকরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানী সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে এবং আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের উত্থান ঘটলে আয়া সোফিয়াকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়। পরে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। অনেকটা বাবরি মসজিদকেন্দ্রিক রায়ের মতো মিলিয়ে তুরস্কের আদালত এটিকে মসজিদে

 

গ্রিসের এথেন্স ইউরোপের একমাত্র রাজধানী যেখানে এখনও কোনো অফিসিয়াল মসজিদ নেই৷ তবে হেমন্তের শেষে একটি মসজিদ উদ্বোধনের কথা রয়েছে৷ কিন্তু সম্প্রতি তুরস্কে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরের ঘটনায় এথেন্সের মসজিদ উদ্বোধন আরো পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার মুসলমানরা৷ ইমাম আতা-উল নাসের নামের এথেন্সের একটি অস্থায়ী মসজিদের ইমামকে উদ্ধৃতি করে তারা লিখেছেন, এই ঘটনার পর আমার মনে হচ্ছে গত দশ বছর ধরে আমরা যে মসজিদের জন্য অপেক্ষা করছি সেটা চালু করা আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।” স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, তুরস্কের স্থানীয় মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে ‘অহং’-এর জয় হলেও বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য এ রায় উদ্বেগের। ভারতে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠায় ভারতীয় উগ্র হিন্দুদের দাবি, এ জায়গা হিন্দুধর্মীয় ভগবান শ্রী রামের জন্মস্থান; আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের পক্ষে কট্টর ধর্মপন্থীদের দাবি, এ জায়গা তাদের পূর্বপুরুষদের খরিদকৃত নিজেদের সম্পত্তি। মূলত এভাবে ঐতিহাসিক বিবেচনায় বিরোধটা বাঁধে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) যে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার রাজনীতি আছে, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের পেছনেও তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টির (একেপি) একই জাতীয় রাজনীতি রয়েছে।

বাবরি মসজিদকে রাম মন্দিরে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি বসেছিল দিল্লির মসনদে; তুরস্কের বিগত স্থানীয় নির্বাচনে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের ইস্তেহার দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে নেয় একেপি। দুই দেশেই ধর্মীয় উন্মাদনার সদ্ব্যবহার করেছে জাঁদরেল রাজনীতিকরা।

 

ইজরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ নতুন করে প্রকট হচ্ছে। মূলত জেরুজালেম-কেন্দ্রিক এ যুদ্ধের সূচনা ১৯৬৭ সালে; সেবারই প্রথম আরব-ইহুদী বা আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ লাগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্ট গণহত্যার স্বীকার ইহুদীদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে সেবারে বিশ্ব নেতৃত্বের সহানুভূতি ছিল ইজরায়েলের পক্ষে। সে-সুবাদে তারা স্বাধীন ভূখণ্ডও অর্জন করে নেয়। কিন্তু ক্রমশ তারা উগ্র ইহুদীবাদী রূপ দেখাতে থাকে। মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদী তিন ধর্মের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ স্থান জেরুজালেম। কিন্তু ইজরায়েল এ স্থানকে নিজেদের করে নেওয়ার পায়তারা সে-শুরু থেকেই করে আসছে। শেষ পর্যন্ত চলতি বছরে জেরুজালেমকে তারা নিজেদের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। অবশ্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতা লঘু ছিল ফিলিস্তিনি আরবদের মাঝেও। অথচ সব ধর্মীয় জনগণ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ছাড় দিলে প্রধান তিন ধর্মের অনুসারীরা জেরুজালেমকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারত!

 

করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কায় সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারীদের তালিকায় অনেকদিন যাবৎ শীর্ষে ছিল ফ্রান্স। মূলত এর পেছনেও ছিল ধর্মীয় উন্মাদনা। ডাব্লিউএইচও (WHO) ঘোষিত করোনার ভয়াবহতার কঠোর হুশিয়ারি সত্ত্বেও ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ফ্রান্সের মুলহাউস শহরে ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জায় অর্থডক্স খ্রিস্টানদের হাজার হাজার সদস্য নিয়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আর এদের মধ্যে যেকোনো একজন ছিল করোনা আক্রান্ত।  এর মাধ্যমেই ফ্রান্সজুড়ে করোনা খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে এবং এর চড়া মূল্য হিসেবে ফ্রান্স মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় অল্পদিনের মাঝে। ভারত-পাকিস্তান-মালেশিয়ায় তাবলীগের সমাবেশ থেকে বিশাল পরিমাণে করোনা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে। ইসরায়েলের সাবেক রাজধানী তেল আবিবের পাশের বেনি ব্রাক নামের যে-শহরে গোঁড়া ইহুদীদের বাস, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে-অঞ্চলে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় সমাবেশ থেকে প্রকট আকারে করোনা ছড়ানোর অভিযোগ আছে। সবমিলিয়ে পৃথিবীজুড়ে সব ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ধর্মীয় উন্মাদনার চিত্র প্রায় অভিন্ন।

 

স্রষ্টায় বিশ্বাসী সব ধর্মের আদিপুরুষরা মূলত মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছেন নিজ নিজ যুগে। ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর ঐশীবাণীও উদারতা-মানবিকতার পক্ষে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার করাল গ্রাস ক্রমশ পৃথিবীকে অবাসযোগ্য করে তুলছে। ইজরায়েল-ফিলিস্তিনের চরম দ্বন্দ্বের মাঝেও ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনি নারীদের যৌথ উদ্যোগে শান্তির সুবাতাসের পক্ষে র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাদেরকে অনুসরণীয় জায়গায় রেখে ধর্মীয় কদর্য বাড়াবাড়ি ভুলে সব ধর্মীয় অনুসারীরা একই শান্তির সামিয়ানায় আসতে না পারলে আগামীর বিশ্বে ধর্মীয় বাড়াবাড়ি ও হানাহানির ফলে সৃষ্ট সংকট আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

 

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না