উত্তপ্ত মরুরপথ। আশেপাশে নেই মানব। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু ধুধু মরুভূমি। মনে হচ্ছে যেন অনেক দূরে গিয়ে তা আকাশের সাথে হাত মিলিয়েছে। মাঝে মাঝে উঁচু ডিবি। বালি এতটাই উত্তপ্ত যে, পা রাখলেই ফোস্কা পড়ে যাবে। এই মরু অঞ্চলে উত্তপ্ততার একক সার্বভৌমত্ব। তাই পানির দেখা প্রায় মিলেই না। যে পানিগুলো রোদের থাবা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে গভীর কূপে আশ্রয় নেয়, তৃষ্ণার্থ পথিকরা তাদের দিয়েই পিপাসা নিবারণ করেন।
আজ মুসলিম জাতির জনক এই মরুপথে চলছেন। সাথে আছেন ফেরেশতাকুল-সর্দার জিব্রাইল (আ.)। আরো আছেন, স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও পুত্র ইসমাঈল (আ.)। সুদূর সিরিয়া থেকে তাঁদের এই যাত্রা। গন্তব্য (বর্তমান) মক্কার বাইতুল্লাহ। দৃঢ় পায়ে চলতে লাগলেন গন্তব্যে। অবশেষে পৌঁছলেন। নির্জন স্থান। কাঁটাযুক্ত বন আর বাবলা গাছ ছাড়া তেমন কিছু নেই। আল্লাহর আদেশেই আজ তাঁরা এখানে। আদেশটা কঠিন। এসেছে তো সবাই। কিন্তু ফিরে যাবেন কেবলই হযরত ইব্রাহিম (আ.)। স্ত্রী-সন্তানকে একা রেখেই চলে যেতে হবে তাঁকে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) বহু কষ্টে এই কাজ করতে নিজেকে বোঝালেন। খোদার আদেশ আজ পর্যন্ত তিনি উপেক্ষা করেননি। প্রত্যেকটা পরিক্ষাতেই তিনি সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই তো মুসলিম বিশ্বে তিনি ‘খলিলুল্লাহ’। আর আজকের এটাও একটা পরিক্ষা। অতএব, থলে ভর্তি কিছু খেজুর আর মশকে সামান্য পানি দিয়ে বিদায় নিলেন। হযরত হাজেরা (আ.) তাদেরকে এভাবে রেখে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে স্রেফ এতটুকুই বললেন, “এটি আল্লাহর আদেশ।” নবীপত্নী খোদার আদেশের কথা শুনে প্রভুর প্রতি তাওয়াক্কুলের সবটুকু প্রকাশ করলেন।
স্বামীর ওপর বিশ্বাস করে থেকে গেলেন। খোদার ওপর ভরসা করে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু সামান্য কিছু পানি আর খেজুরে কতদিন চলে? শেষ হয়ে যাওয়ায় সন্তানকে আর দুধ দিতে পারছেন না। মা আছে তবুও শিশু দুধের জন্য ছটফট করছে। হযরত হাজেরা আর সহ্য করতে পারলেন না। পানির সন্ধানে সাফায় আরোহন করলেন, দূর-দূরান্তেও কোন পানির দেখা মেলে না। সাফা থেকে নেমে মারওয়ায় গিয়ে থামলেন। সেখানেও নিরাশ হয়ে ফিরলেন।
ইতোমধ্যে সাত চক্কর হয়ে গেল। হঠাৎ, মারওয়ায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ শুনতে পেলেন। ফিরে দেখলেন সেই ফেরেশতা যিনি আসার সময় সঙ্গী ছিলেন, হযরত জিবরাইল (আ.) এর পদাঘাতে মাটি হতে পানি উথলে পড়ছে। অসহায় মায়ের মুখে হাসির বসন্ত খেলে গেল। দৌঁড়ে নেমে এল পুত্রের পাশে। পানির গতি প্রচুর। কোন কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে হযরত হাজেরা (আ.) বললেন, “যম যম।” জন্ম হল যমযমের।
যমযমের পানি অন্যান্য পানির চেয়ে আলাদা। স্বাদে এবং গুণে দুইভাবেই আলাদা। এর ওযন স্বাভাবিক পানির চেয়ে একচতুর্থাংশ বেশি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে এতে এমন একপ্রকার উপাদান আছে যা ক্ষুধা নিবারক। বিশ্বপতি প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পানি পানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মদিনায় হিজরত করলে সেখানে এই পানি পাঠানোর নির্দেশ দেন। কেননা, এটি বিশুদ্ধ নিয়তে পান করলে রোগমুক্তি ও যাবতীয় আশা পূর্ণ হয়।
হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যমযমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য ও রোগীর জন্য ঔষধ।” অন্যান্য পানি বসে খাওয়ার নির্দেশ থাকলেও এটি দাঁড়িয়ে পান করতে হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমযমের পানি পান করেছেন দাঁড়িয়ে।” এই হল যমযমের পানির বিশেষত্ব। মহান প্রভু, আদি অন্তহীন স্রষ্টা আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ আর বিস্ময় আবে যমযম।