সমকালীন বাংলা কবিতার জগতে অতিচেনা মুখ কবি হাসান রোবায়েত। যে কোনো বিষয়কে গৌণ রেখে শিল্পকে মুখ্য করে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার- অন্তত সমকালীন বাংলা কবিতায়। এবং তার একান্ত-চাওয়াটাই এটা যে, শিল্পই হয়ে উঠুক মুখ্য, আমরা পাই একটি ভালো কবিতা। এখনো পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে পাঁচটি: ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে (চৈতন্য, ২০১৬), মীনগন্ধের তারা (জেব্রাক্রসিং, ২০১৮), আনোখা নদী (তবুও প্রয়াস, ২০১৮), মাধুডাঙাতীরে (ঐতিহ্য, ২০২০), এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে (ঐতিহ্য, ২০২১), ; প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ তারাধূলিপথ। বলা চলে আসলে, কবিতাতেই বসবাস তার। এমন একজন কবির সাথে আলাপ করা, তাও কবিতা নিয়ে, নিঃসন্দেহে দারুণ তৃপ্তিদায়ক। আলাপে আছি আমি, মোহাম্মদ আবু সাঈদ। পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য, সংলাপে কবির কথাগুলো ‘বোল্ড’ করে দেওয়া হয়েছে। আলাপের রস উপভোগ্য করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য বক্তার উচ্চারণ-ভঙ্গি হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। আশা করি পাঠককুল আলাপের প্রথম অংশটি উপভোগ করবেন।
আলাপ
যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করে, তারা বলতেছে বর্তমান সময়টা ফ্যাসিবাদের সময়, চারদিকে শোষণ, নিপীড়ন, এই, সেই, হ্যাঁ?; মানে ফ্যাসিবাদের জামানা বললেই চলে— এই সময়টা আসলে কবিতার জন্য, বা শিল্পের জন্য কতটা সুবিধাজনক আর কতটা অসুবিধাজনক?
শিল্পের জন্য সুবিধা বলতে আসলে আপনি কি মিন করতেছেন?
মানে, আপনি যে কোনো শিল্পই করেন ওইটার জন্য তো আসলে সমাজটা গুরুত্বপূর্ণ; সময়টা গুরুত্বপূর্ণ?
তো আপনি কি চাচ্ছেন লেখার টেবিল একদম শান্তশিষ্ট থাকুক?
মানে, আমি বলতে চাচ্ছি সময় তো আসলে লেখাকে প্রভাবিত করে— বিষয়কে; যেমন কুদরত-ই-হুদা যে বিষয়ে থিসিস করছেন যে, ষাটের দশকের কবিতায় জাতীয়তার প্রভাব, উনি বলতেছেন ঐ সময়ের কবিতায় দেখতেছি রাইফেল আসতেছে, ট্যাঙ্ক আসতেছে, মানে ঐ সময়টাকে ধরা যাচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতেছি আর কি…
হ্যাঁ, আমাদের সাহিত্যে তো সেটা আসতেছেই।
মানে এইটা সাহিত্যের জন্য, শিল্পের জন্য সুবিধাজনক বা অসুবিধাজনক…
এখানে দুইটা ব্যাপার আছে আমার যেটা মনে হয়। সেটা হলো, ধরেন, যে কোনো ঘটনার ভিতর যখন আমরা থাকি তখন আসলে ঐ ঘটনার যে তাৎক্ষণিকতা সেটা আমাদেরকে আক্রান্ত করে।
আচ্ছা!
সেইটা আক্রান্ত করে। আরেকটা ব্যাপার হইতে পারে, একটা ঘটনা ঘটে গেছে সেটা অনেক দিন আগের, সেই ঘটনাও আপনাকে আক্রান্ত করতে পারে। আগের যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেটা কিন্তু অনেক বেশি ফিল্টার্ড হয়ে আপনার কাছে আসতেছে। মানে অনেক টাইম পাচ্ছেন আপনি বিষয়টাকে আর্টিস্টিক করবার জন্য। এখন আপনার উদ্দেশ্য হয় যদি আর্ট— আর্ট যদি আপনার উদ্দেশ্য হয় তখন আসলে দূরের ঘটনাটাকে আসলে আপনার আর্টে অনেক ভালোভাবে উপস্থাপনের চান্স বেশি থাকে। কারণ হচ্ছে যেটা ইন্সট্যান্ট যে ঘটনাটা, তাৎক্ষণিক যে ঘটনাটা ওইটা হয় কি ওইটা আপনাকে অনেক বেশি ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়, হ্যাঁ, আপনার আসলে হিতাহিত আর্টের যে জ্ঞান সেটাকে অনেক বেশি বাধাগ্রস্ত করার চান্স থাকে। ঠিকাছে? ধরেন, ইন্সট্যান্ট তো, আমাকে এই মুহূর্তে লিখে ফেলতে হবে, একটা গা গরম করার ব্যাপার-স্যাপার আছে।
তাড়না?
হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা আর্টের জন্য ক্ষতিকর, ক্ষতি হয় কিন্তু এতে। আরেকটা ব্যাপার হলো যে, হ্যাঁ, কেউ যদি এটাকে ডিল করতে পারে সেইভাবে, মানে কেউ একজন এই ব্যাপারটাকে আর্টিস্টিকভাবে সে ডিল করতেছে, তার মেধা দিয়ে, তাইলে কিন্তু ওইখান থেকেই গ্রেট আর্ট তৈরি হওয়া সম্ভব।
যেমন জয়নুল আবেদীনের স্কেচটা…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এরকম। মানে আমার কথা হচ্ছে যে, সময় আসলে যদি অনেক বেশি ফার্মেন্টেশন হয়ে আপনার কাছে আসে, অনেক বেশি গাঁজানো সিস্টেমে যদি আপনার কাছে আসে, মদের মতো আর কি, তাইলে জিনিসটাকে হ্যান্ডেল করতে, ওইটাকে ডিল করতে আপনার কাছে ইজি হবে। কিন্তু যদি কোনো কারণে আপনি সমসাময়িক বিষয় নিয়েই কাজ করতে চান তাহলে আপনাকে ঐখানে অনেক বেশি কনশাস থাকতে হবে।
সতর্ক?
হ্যাঁ, এইটা আসলে শিল্পের কোনো ক্ষতি করে কি-না!
তো আপনি কি মনে করেন বর্তমান সময়ে যারা কবিতা করতেছে, গদ্য করতেছে, উপন্যাস লিখতেছে, গল্প লিখতেছে মানে মোটামুটি সাহিত্য, মানে এই জগতটা কি শিল্পের চেয়ে সমসাময়িক বিষয়টাই কি মুখ্য হয়ে উঠতেছে না?
এখন তো আসলে সেভাবে চোখেই পড়ে না আমার। কারা করতেছে আসলে? ধরেন, এই যে আপনি ফ্যাসিজম বলতেছেন, সমাজতাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবীরা বলতেছে এইটা ফ্যাসিস্টের সময়— এই টাইমটাকে স্কেচ করে বা এই টাইমটাকে ফ্রেমিং করে আসলে কারা লিখছে? কোন্ উপন্যাস, কোন্ গল্পে, কোন্ কবিতায় বা কাব্যগ্রন্থে এগুলো আসলে আসছে?
মানে কওমি মাদ্রাসার সমকামিতার যে হাঙ্গামা এটা নিয়ে একজন লিখছে, অলরেডি সেটা ব্যানও হয়ে গেছে। আমি একটা উদাহরণ হিসেবে বললাম আর কি!
না, আমি বুঝছি। এইটা কাহিনী হইলো, এই লোক নিজে লেইখা নিজেই ব্যান করাইছে। ঠিকাছে? ওটা আসলে ব্যান হয় নাই— নাম্বার ওয়ান। ব্যান হয়নাই বলতে, এইটা সরকারের সমস্যা, সোসাইটির সমস্যা যার কারণে ব্যান হইছে ব্যাপারটা আসলে তা না, এটা আসলে চাতুরি করেই উনি কাজটা করছে। আর ওখানে আসলে শিল্পের মান নাই, কিচ্ছু নাই, ফাউল লেখা। সো, ওগুলো আমাদের আলাপের বাইরের।
আর যেমন আপনার কবিতার নাম চলে আসতেছে, এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে, হ্যাঁ, তারপরে অনেকে গল্প লিখতেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, ঐ যে শোষণ নিপীড়নের যে ব্যাপারটা এইটা এখনো, ঐ যে পঞ্চাশ বছর পূর্তি হইলো না বাংলাদেশের স্বাধীনতার, এখনো এইটা অটো চলতেছে, ঐ যে শোষণ নিপীড়নের ব্যাপারটা কিন্তু সমাজ থেকে এখনো যায় নাই। তো ঐ প্রভাবটা তো গল্পের মধ্যে থাকতেছেই…
দ্যাখেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়াই আমাদের গ্রেট কোনো কি কাজ আসলে হইছে?
হইছে, দুয়েকটা হইছে তো! ওঙ্কার হইছে না? আহমদ ছফার ওঙ্কার?
আহমদ ছফার ওঙ্কার আমি যখন পড়ার চেষ্টা করছিলাম, পড়ছিলাম…
একেবারে ছোট লেখা…
হ্যাঁ, আমি বুঝছি, ওঙ্কার, ওইটা নিয়া একটা সিনেমাও মনে হয় হইছে। তো গ্রেট কাজ নাকি আহমদ ছফা লিখছে বলে ভালো কাজ…
না, আহমদ ছফা লিখছে বলে না। এটার যে ভাষাটা, ভাষার চঞ্চলতা, উপন্যাসের যে কাঠামো, তারপর ঐ সময়টাকে তুলে ধরা, সবমিলিয়ে আসলে…
শোনেন, সময়টাকে তুলে ধরার মতো লেখা তো আরও অনেকেরই আছে,
কিন্তু ওইটার মতো তো আসলে আমি দেখি না!
আচ্ছা, আমি বলতেছি, গ্রেট আর্ট হইছে কি না! আচ্ছা, সেটা না হয় বাদ দিলাম। আমার কথা হইছে যে, মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, মানে কেন মুক্তিযুদ্ধ হইলো, মানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচারের যে আলাপ, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের, সেটা তো ফয়সালা এখনো হয়নি। সো, মুক্তিযুদ্ধের যে কনসেপ্ট সেটা নিয়ে আসলে আমার মনে হয় তো লেখা হওয়া উচিৎ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি দেখবো কিন্তু আর্টের জায়গা থেকে। যে এটা আসলে কতটা গ্রেট আর্ট হয়ে উঠতেছে। গ্রেট আর্ট না হয়ে উঠলে ওইটা আসলে আমার কাছে ট্র্যাশ ছাড়া আর কিছুই না। এখন আপনি কোন বিষয় নিয়ে লিখলেন সেইটা আমার কাছে মাইনর।
বিষয়টা আসলে গৌণ?
ওটা আমার কিছু যায় আসে না।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, অনেকে বলেন তো, সমাজের জন্য সাহিত্য সংস্কৃতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখন সাহিত্যের মূল অংশ হিসেবে, সাহিত্যের যদি একেবারে মাথা বলি— কবিতা, তো সমাজের মধ্যে কি সে প্রাপ্য মর্যাদা পায়?
ঠিক কি ধরনের মর্যাদা পাইতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
মানে, যত সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়া, বা সমাজ নিয়া আমি যত বক্তৃতা, সেমিনার, অভিভাষণ সব জায়গায় বলতেছে সমাজের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকাছে? তো এখন সে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেছে— একজন সমাজতাত্ত্বিক বলেন, একজন প্রফেসর, একজন সম্পাদক— যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেছে সমাজের জন্য সাহিত্যটা, তো এখন সাহিত্যের মূল অংশ হিসেবে কবিতা কি ঐ গুরুত্বটা পায়? মানে যেভাবে আমরা চাউড় করে তুলি ওভাবে কি আমরা গুরুত্ব দেই?
আমার মনে হয় না যে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কিছু আছে। মানে, কেন্ গুরুত্ব দিবে আলাদাভাবে? হ্যাঁ— শিল্প সাহিত্য যেটা করে, ধরেন যে একজন কবি, বা একটা টেক্সট আসলে কি করে, একটা সময় তো সিভিলাইজেশনের একটা অংশ হয়ে যায়। একটা কালচারের অংশ হয়, সে জায়গা থেকে ঠিকাছে। হ্যাঁ, সিভিলাইজেশনের একটা অংশ, সেটা একসময় হয়ে উঠে। কিন্তু সোসাইটিকে ধরেন এ কারণে তাকে অনেক গুরুত্ব দিতে হবে! আপনি একটা মুঁচিকে কেন আলাদা গুরুত্ব কেন দিবেন?
আলাদা গুরুত্ব দেবেন না তাইলে?
আমার কাছে মনে হয় এটা আসলে অনেকটা রাজা-বাদশাহী আমলের আলাপ। যে, একটা রাজকবি থাকবে, এরে অনেক কিছু দিতে হবে…! শোনেন, আমার সহজ আলাপটা হচ্ছে, একটা সোসাইটিতে, সে সোসাইটির মানুষগুলো তারা যেন ঠিকঠাক তাদের অধিকারটা পায়। এখন তারা যদি অধিকার পায়, একজন কবি যদি সে সমাজের একজন নাগরিক হয়ে থাকে তাহলে একজন নাগরিক হিসেবে যতটুকু অধিকার পাওয়ার ততটুকু কবিও পাবে। উচিৎ হইলো, সব নাগরিকের জন্য একটা ইনসাফভিত্তিক রা
আচ্ছা! তো একটা সময়ে যখন সমাজে জুলুম, শোষণ চলতেছে তখন কি সে তার কবিতায় বিষয়গুলো নিয়ে আসতে পারে না?
হ্যাঁ, তার যদি মনে চায় সে আনবে।
মানে, কোনো দায়বদ্ধতা নাই?
আমার মনে হয় নাই। আপনার যদি দ্বিমত থাকে তাহলে আপনি তর্ক করতেই পারেন। আসলে কি কারণে তার দায় থাকা উচিত?
আচ্ছা! আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, শিল্পের জন্য শিল্প আর সমাজের জন্য শিল্প— কোনটাকে আপনার শিল্প সাহিত্যের জন্য বেশি…
আচ্ছা, আমার কাছে প্রথম কথা হচ্ছে, একটা শিল্পকে তার জায়গা থেকে শিল্প আগে হয়ে উঠতে হবে; এরপর যদি সে কোনো কারণে সে সোসাইটির অংশ হয়ে উঠে তাহলে সেটা আসলে মেঘ না চাইতেই জল ব্যাপারটা টাইপের আর কি! হ্যাঁ, সহজ আলাপটা হচ্ছে এরকম যে, শিল্পকে তার জায়গা থেকে শিল্প আগে হইতে হবে, এরপর সে যদি সোসাইটির কোনো উপকারে আসে, খুবই ভালো। আমরা তো আসলে মানুষ, মানুষেরই কোনো উপকারে যদি আসে, তাহলে তো খুবই ভালো। না আসলেই বা কি যায় আসে!
একজন কবির উপর অন্য একজন কবির যে প্রভাব সেটাকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন বা কিভাবে বিবেচনা করেন?
প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা তো আসলে আসমান থেকে আদমের মতো পড়ি না যে, আমরা আসলে স্বয়ম্ভূ টাইপের, ১০০% ওকে, আমাদের কারো উপর কারো প্রভাব নাই-! আমরা যেহেতু একটা সোসাইটির অংশ, আমাদের ডিএনএ’র মধ্যে কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের নানান ইশারা আছে। দেখবেন যে, আমার হয়তো কোনো একটা ভঙ্গি আমার দাদার মতো, বা আমার সিগনেচার হয়তো আমার নানার মতো, এই যে বংশ থেকে আমরা যে পরম্পরাটা পাচ্ছি এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এটা বায়োলোজিক্যাল ওয়েতেই আমার কাছে আসতেছে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা ওরকমই। গ্রেট কবিরা বা আমার আগের যে কবিরা বা সমসাময়িক কবিরাও এরা কিন্তু আসলে আমাকে প্রভাবিত করতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে, কাহিনীটা আমার কাছে এরকম যে, তাদের প্রভাব নিয়েই আপনি আবার আলাদা একটা ফিগার হয়ে উঠেছেন কি-না, সেটা আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট। মানে ধরেন, আমার কোনো একটা লেখা কেউ পড়লো, পড়ে তার যদি মনে হয় যে, এটা তো আসলে মধুসূদনের কবিতা— তাইলে আমি মনে করি এগুলো আসলে কোনো প্রভাব না, খেয়ে ফেলা আর কি! এই খেয়ে কেউ না ফেলুক। মানে, সে প্রভাবিত হোক কিন্তু সে নতুন একটা আর্ট তৈরি করুক।
মানে, তাকে যেন ধরা যায় তার কবিতায়…
ডেফিনেটলি! যে হ্যাঁ, এটা তারই কবিতা। কিন্তু তার পূর্বপুরুষের বা কবির একটা ছাপ থাকতেই পারে, এটা নিয়ে আমার কোনো…
মানে এটা সমস্যাজনক না?
এটা সমস্যাজনক না, বরং আমার মনে হয়, এতে করে শিল্প আরও রিচ হয়। মানে ধরেন যে, নতুন একটা ব্যাপারের সাথে পুরনো যদি একটা ব্যাপার যোগ হয়, হয়ে যে ক্যামিস্ট্রিটা তৈরি হয়, আমার ধারণা ওটা বেশ পাওয়ারফুল কেমিস্ট্রি।
তো, এই যে কেমিস্ট্রির কথা বলতেছেন, এই কেমিস্ট্রিতে আমাদের বাংলা কবিতায় কার অবদান সবচেয়ে বেশি মনে করেন?
একজনের নাম বলা তো মুশকিল।
দুয়েকজনের নাম বলেন।
না না, সব গ্রেট কবিরই আসলে এখানে অবদান আছে।
মানে, আপনি যে কেমিস্ট্রির কথা বললেন, আগের কারো ছাপটাও থাকলো আবার নিজের সিগনেচারও থাকলো। এরকম আর কি!
আমাদের এখানে কিন্তু অনেক কবিরই নিজস্ব সিগনেচার আছে।
সিগনেচার তো আছে, কিন্তু প্রথমে তো আর বলয়টা কাটাইয়া উঠতে পারে না!
ব্যাপারটা হইছে কি, যখন একটা টেক্সট বের হয়ে গেল কোনো কবির, এখন সেই টেক্সটে অন্য কোনো কবির প্রভাব-ট্রভাব আছে, এটা হয় কি জানেন, অটোমেটিক্যালি ওই টেক্সটটা আসলে নাই হয়ে যায়। ওই টেক্সটাই টিকে থাকে যেটাতে তার নিজস্ব সিগনেচারটা প্রকট হয়ে থাকে। যেমন ধরেন আপনি যদি জীবনানন্দ দাশের কথা চিন্তা করেন, তার প্রথম বইতেও নজরুল সত্যেন্দ্রনাথ এদের প্রভাব ছিল। সেই বইটাকে কিন্তু আমরা মনে করি না! আমরা ওই বইটাকে আর গুরুত্বই দেই না। যা প্রভাবিত, আসলে উৎকট যে প্রভাব তা নিয়ে আসলে আমাদের ভাবার কিছু নাই।
তো মাইকেলের যে মেঘনাদবধ কাব্য, তাতে কিন্তু তার নিজের সিগনেচারের চাইতে, মানে তার ব্যক্তিত্ব, কবি-সত্তা ওইটার চাইতে কিন্তু প্লট, চরিত্র এগুলা নিয়া বেশি মাথা ঘামাইতে হইছে তাকে।
মহাকাব্যের যে প্রজেক্ট, বুঝছেন, মহাকাব্যে কবি অনুপস্থিত থাকে। কবি আসলে ওখানে ন্যারেটর, সে বর্ণনা করে; ধরেন যে একটা যুদ্ধের প্লট সে বর্ণনা করতেছে, ওখানে কবি নাই কিন্তু! কবি যেটা করতেছে, জাস্ট বর্ণনা করতেছে। উনি তো জাস্ট বর্ণনা দিচ্ছেন, উনার ভঙ্গিমাতে।
তো মহাকাব্য হয়ে উঠার জন্য তার বর্ণনার ভঙ্গিমাটা, কবিত্ব ব্যাপারটা— এটা কি গুরুত্বপূর্ণ না?
সেটা উনার আছে।
তো ওই ব্যাপারে কি এটা (মেঘনাদবধ) গুরুত্বপূর্ণ?
হ্যাঁ, অবশ্যই। মেঘনাদবধে বলার যে স্টাইলটা, ওইটা একদমই মধুসূদনের। ওইটা আপনি বাংলা কবিতায় আগে আর পাবেন না। এর আগের কবিতা অনেক বেশি বরং বাংলাঘেঁষা, বাঙালিঘেঁষা।
মানে, একটা জনপদের…
হ্যাঁ, মানে উনি অনেক বেশি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজঘেঁষা আর কি! ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যে ধরনের ভাষার প্রস্তাব করতেছে…
সংস্কৃতবহুল…
উনি সে ধরনের একটা প্রজেক্টের অংশ।
তো এটা কি একটা ভাষার জন্য, সাহিত্যের জন্য হুমকি মনে করেন না আপনি?
না, হুমকি আমার কাছে মনে হয় না এই কারণে যে, দ্যাখেন, কবি সাহিত্যিকরা ভাষাকে টিকাইয়া রাখে এইটা আমার কাছে একটা ফাউল আলাপ মনে হয়। ভাষাকে টিকাইয়া রাখে আসলে ঐ জনপদের সাধারণ মানুষগুলা।
তো ঐ জনপদের সাধারণ মানুষের ভাষাকে ডিনাই করে যদি আমি সাহিত্য করি, সেটা তো সমস্যাজনক।
না, এটাতে কোনো সমস্যা বলে মনে হয় না। সেইটা আসলে, একটা জনপদকে তুষ্ট করবার ইচ্ছা আপনার নাই।
না তুষ্ট না; আমি বলতেছি, আমি যখন বাংলায় লিখতেছি তখন বাংলার পাঠক পড়ুক, এটা তো একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা।
হ্যাঁ, কিন্তু আপনার জনগোষ্ঠী যে সাধারণ ভাষায় আলাপ করে, যেই সিগনেচারে তারা আদান-প্রদান করে, সেইটাতে আমি লিখিনি, ফাইন! হয়তো অল্প মানুষ বিষয়টাকে এক্সেপ্ট করবে।
তো বেশি মানুষ এক্সেপ্ট করলে কি সেটা বাংলা কবিতার জন্য ভালো হইতো না?
আমার মনে হয় না, কবিতার ভালো মন্দ এক্সেপ্টেন্সের উপর ডিপেন্ড করে।
না, কবিতা তো শেষ পর্যন্ত মানুষেরই। মানুষের উপরেই তো ডিপেন্ডেবল, পাঠকের জন্যই তো কবিতা।
তা ঠিক।
কবিতা তো আর এরকম না যে লিখলাম, ফেলে দিলাম, যার কাছে গিয়ে পৌঁছলো সে পড়লো, না পড়লে নাই— ব্যাপারটা তো এরকম না।
ব্যাপারটা কিছুটা এরকমই। হ্যাঁ, মানুষ যদি পড়ে, এইটা ঐ মানুষের উপকারে লাগে, এতে কবিতার কিছু যায় আসে না।
এখন কবিতার তো টিকে থাকতে হবে, কবিতা কিভাবে টিকে থাকবে? পাঠকের মধ্য দিয়ে না?
পাঠকের মধ্য দিয়ে থাকে, এ কথা যেমন সত্যি; আমার ধারণা, কবিতা আসলে তার নিজের যোগ্যতা দিয়েই টিকে থাকে।
না, পাঠক পড়ে বলেই তো শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, তার যোগ্যতাটা, পাঠককে সে তুষ্ট করতে পারতেছে কি-না, এখানেই তো তার সার্থকতা।
না, এটা ঠিক আছে। কিন্তু কোন্ পাঠক? পাঠক তো নানান কিসিমের আছে।
আমি বলতেছি, মূলত যারা শিল্প সাহিত্যটা বুঝে, ঐ পাঠকের কথাই।
বোঝা বা না বোঝার ব্যাপার না। ধরেন, কাউকে, কোনো একজনকে সে তুষ্ট করছে…
ঐ তার কাছেই তো সে টিকে থাকবে।
হ্যাঁ, থাকলো!
সে একদিন মারা যাবে তো! তার মৃত্যুর সাথে সাথেই তো ঐ কবিতা মারা যাবে!
ফাইন! এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি, যেহেতু আমরা এখন লিখিত টেক্সট পাই, এখন হারানোর, ভয়ের কি আছে! হ্যাঁ, জনপ্রিয়তা হারাবে, সেটা সে হারাতেই পারে।
আচ্ছা, বুদ্ধদেবদের যে দল, মানে তিরিশের কবিদের, তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যে কবিতায় হৈচৈ বেশি থাকে ঐ কবিতা বেশিদিন টিকে না। এই ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
আমার এটা ঠিক মনে হয় না। কারণ হচ্ছে যে, হৈচৈ কি শিল্প সাহিত্য হইতে পারে না?
হ্যাঁ, হইতে পারে।
সো? ওরা আসলে হইছে কি, ইউরোপের সন্তান তো, ওরা এক ধরনের ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকছে। ওদের কাছে মনে হইছে যে, হ্যাঁ, এটাই মনে হয় আর্ট; হৈচৈ হইতে পারে না।
আচ্ছা, তিরিশের কবিদের থেকেই, বুদ্ধদেবদের একটা দল, সুকান্তদের একটা দল, দেশভাগের পর কলকাতায় একটা দল, আর ঢাকায় একটা দল— সবমিলিয়ে এই যে, গোষ্ঠীভিত্তিক যে কবিতা চর্চা এটাকে আপনি কিভাবে দ্যাখেন?
সেটা গোষ্ঠীর উপকার হয়তো হইতে পারে, কবির ব্যক্তি-উপকার মনে হয় হয় না। বা, কবির না; কবিতার উপকার হয় কি-না আমি জানি না। আমার মনে হয় এটাতে ঝামেলা আছে।
ঝামেলা বলতে দ্যাখেন: রবীন্দ্রনাথ থেকে তিরিশের কবিদের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার যে বিকাশ, বাংলা কবিতার যে ইতিহাস সেখানে গোষ্ঠীভিত্তিক চর্চার যে ব্যাপার, এইটার মধ্য দিয়াই কিন্তু কবিতাকে আসতে হচ্ছে।
ফাইন। এখন কাহিনী হইছে কি দ্যাখেন, যাদের কথা বললেন তাদের কবিতা পড়ার সময় কি আমরা গোষ্ঠীবদ্ধতার কথা কি ভাবি, ভাবি না। বা, এই কবিতাটা আসলে বাংলাদেশে না কলকাতায়, বাংলাদেশের পলিটিক্সকে সে তুষ্ট করতে পারতেছে কি-না, এটা কি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে গেল না বিপক্ষে গেল এসব দিয়ে তো আসলে আমরা কবিতার হিসাব করি না।
এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলতে চাইতেছি, এই গোষ্ঠীবদ্ধতা কি শিল্প সাহিত্যের জন্য সুবিধাজনক না অসুবিধাজনক? এই ট্রেন্ড কিন্তু এখনো চলতেছে…
এইটা হইছে কি দ্যাখেন, শিল্প সাহিত্যের তো নানান ধরনের ঘরানা আছে। এখন কেউ যদি মনে করে যে, তার আর আমার ঘরানা তো এক, তো তারা বন্ধুবান্ধব হয়ে উঠে, হয়ে তারা হয়তো একসঙ্গে চর্চা করে। কিন্তু যার যার চর্চা তার তার নিজের কিন্তু আসলে, আপনি টাইম ফ্রেম দিয়ে এটাকে বাঁধাই ভালো; মানে গোষ্ঠী না বলে। যেমন আমরা বলি না, ভিক্টোরিয়ান এজ, বা রোমান্টিক এজ, এভাবে; ধরেন কোনো সমালোচক যদি বলে এজ অফ ফ্যাসিজম, এই সময়ের কবিতাটা আসলে কি ছিল, ধরেন এই সময় দেখা যাবে অনেকেই এ কাজগুলো করে যাবে, তার মানে কি এই যে, তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কাজ করছে? তা কিন্তু না। একটা সময় হয়তো আক্রান্ত করছে এদেরকে। আমার মনে হয় টাইম ফ্রেম ধরে ধরে যদি বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে সাহিত্য বুঝতে হয়তো সুবিধা হবে।
আমরা যখন দেখি তিরিশের কবিদের আলাদা একটা দল হয়ে উঠছে, তারা কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধভাবে পশ্চিমা অনেক কিছু কিন্তু এখানে নিয়ে আসতেছে, অনুবাদের মাধ্যমে। এখন এই যে সঙ্ঘবদ্ধতা, এখান থেকে বাংলা কবিতার উপকার কিছু না কিছু তো হইছে।
অবশ্যই হইছে।
তো এরকম পরবর্তীতে অনেক কিছুই দেখি। এটাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়ার আছে? এই যে উপকার হইতেছে শিল্প সাহিত্যের।
গোষ্ঠীবদ্ধ হলে হয় কি, পারস্পরিক চিন্তার যে আদান-প্রদান, আড্ডা, ইন্টেলেকচুয়ালিটির আদান-প্রদান, আমার মনে হয় এগুলোর সুবিধা হয়। লেখা তো আসলে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি নিজেই লেখে।
মানে, একটা বিষয়কে বুঝতে, সময়কে বুঝতে এটা গুরুত্বপূর্ণ?
অবশ্যই। মানে, সিস্টেমটা হইছে যে, যে বিষয়টা আমি বুঝি না সেটা হয়তো আমার কোনো বন্ধু বুঝে, তার সঙ্গে যদি আমি বিষয়টা নিয়া আলাপ আলোচনা করি, লাভটা হইলো, জিনিসটা আমার কাছেও ক্লিয়ার হইলো। এভাবে শিল্প সাহিত্য ধরেন, বা ঐ সময়ের যে পলিটিক্স, ঐ সময়ের যে সমাজতত্ত্ব সেগুলো কিন্তু একটা গোষ্ঠী থাকলে হয়তো আদান-প্রদানটা ভালো হইতে পারে। একটা চিন্তা বা ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গা হয়তো গ্রো করতে পারে। এদিক থেকে নিশ্চয়ই এটার সুবিধা আছে।
তো সেজন্য, একজন উঠতি কবিতার পাঠক, কবিতার প্রতি তার আগ্রহ জন্মাইছে, ভালোবাসাও বলতে পারেন, তার কি একলা কবিতা চর্চা করা সুবিধাজনক না একটা দলের মধ্যে ঢুকে পড়া?
এটা আসলে তাকেই বাছতে হবে যে, আমি আসলে কি করতে চাই।
ওইটার উপর নির্ভর করবে?
হ্যাঁ, আপনি এক হাজার জন লোকের সাথে মিশেও কিন্তু এক লাইনে নিজের কাজটা করে ফেলতে পারবেন। এখন আপনি যদি চিন্তা করেন যে, আমার তো জানার অনেক ল্যাক আছে, তথ্যের ল্যাক আছে, বা শিল্প সাহিত্যের অনেক কিছুরই হয়তো সোর্স জানি না। আমার কি পড়তে হবে, আমার কি পড়া উচিত, প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু এগুলোর ধারণা আসে সোসাইটির কাছ থেকে, বা দল গোষ্ঠী যাই বলেন না কেন, এটা তো সে পাইতেই পারে। একটা সময় কিন্তু তাকে আলাদা হইতেই হবে।
হইতেই হবে? মানে, শেষ পর্যন্ত সে নিজেই নিজের?
অবশ্যই। প্রাথমিক পর্যায়ে এটা (দল, গোষ্ঠী) নিশ্চয়ই তাকে হেল্প করে।
কবিতার যে গতানুগতিক ধারা, মানে যারা শিল্প সাহিত্য চর্চা করে, তাদের মধ্যে আমরা দেখি, মার্কস পড়ো, লেনিন পড়ো, এই পড়ো, সেই পড়ো, সমাজতন্ত্র বুঝো, গণতন্ত্র বুঝো— মানে এই যে পড়াশোনার ব্যাপারটা কি কোনো কবির জন্য মাস্ট?
না। আমার মনে হয় না।
তো এগুলো কি থাকলে ভালো, না থাকলে নাই এরকম?
সোসাইটিকে বোঝার জন্য আপনি অনেক কিছু পড়তেই পারেন। কিন্তু আপনার নিজের লেখার জন্য সেগুলো উপকার করতেও পারে, নাও করতে পারে; এমন অনেক দেখা গেছে যে, মার্কসিজম পড়তে গিয়ে তার কবিতাই পুরো মার্কস বানাই ফেলছে। বা ধর্ম ধর্ম করতে গিয়ে তিনি পুরো ধর্মেরই হয়ে গেলেন, তিনি আর কবি থাকলেন না। যেমন ফররুখ আহমদ। ধর্ম ধর্ম করতে গিয়ে তিনি পুরা ধার্মিক হয়ে গেলেন, তিনি আর কবি থাকলেন না এবং কবিতার ক্ষতি করে ফেললেন। এটা তো ঝামেলাই।
ফররুখ আহমদকে যেই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে টানলেন, এখানে কি আল মাহমুদকেও আনা যায়?
না।
কেন?
আল মাহমুদ চালাক। আল মাহমুদ হইছে কি, তার শিল্পের প্রতি, কবিতার প্রতি বা গদ্যের প্রতি ঠিকঠাক ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করছে একটা বয়স পর্যন্ত; পরে হয়তো নানানভাবে সে বায়াসড হইছে। কিন্তু হইছে কি, ঐ বায়াসড টেক্সটগুলো কিন্তু আসলে আমরা পড়িও না। আল মাহমুদ চালাক।
তো পড়াশোনার কথাটা যে বললাম, বর্তমানে যারা শিল্প সাহিত্য করে, তাদের কাছে গেলেই তো বলে, এইটা পড়ো ওইটা পড়ো, বা অনেক কবিরা— শেষ বয়সে আইসা যখন তাদেরকে বক্তৃতা দিতে বলা হয় বা সম্মাননা দেওয়া হয় তখন বলে, ছোট বয়সে আমরা এই পড়তাম, সারাদিন বই পড়তাম, এই যে পড়াশোনার যে ট্রেন্ড, এটাকে কিভাবে দ্যাখেন?
তাদের এই ট্রেন্ড ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় না এটার কোনো জরুরত আছে।
কবিতার জন্য ব্যাপক পড়াশোনা লাগে না— এরকম?
হ্যাঁ, আমার কাছে মনে হয়, কবিতার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরী হচ্ছে, তার আশপাশের যে মানুষ, তার পরিবেশ প্রতিবেশ, তার নিজের সাথে নিজের যে বোঝাপড়া— এইগুলান মনে হয় বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।
আচ্ছা, স্বাধীন বাংলাদেশে কবিতার যে ব্যাপারটা— সরকার বদল হইছে, পলিটিক্স চ্যাঞ্জ হইছে— আমার মনে হয় রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, আপনার কি তা মনে হয়?
যেমন, উদাহরণ দেন তো!
একটা সময় গিয়ে দেখি আল মাহমুদ কবিতা লিখতেছে সেটা জামাতে ইসলামীর পক্ষে, যখন তার জামাত ক্ষমতায়, আবার যখন জামাতে ইসলাম ক্ষমতায় নাই তখন তার সুর পাল্টাচ্ছে; আবার শামসুর রাহমানেরও একই সমস্যা দেখি—যখন সে একটা রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে কবিতা লিখে এবং ঐ আদর্শের দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তার কবিতায় অটোমেটিক্যালি ওই কণ্ঠস্বর চলে আসে। এই ধারাটা কিন্তু আমরা দেখি…
প্রতিটা মানুষই তো আসলে পলিটিক্যাল পার্সন, কেউই তো আসলে পলিটিক্সের বাইরে না। তো সেগুলো যদি ভালো কবিতা হয়ে উঠে তাহলে তো আমি কোনো সমস্যা দেখি না।
কবিতা যদি রাজনৈতিক হয়ে যায় তাহলে কবিতা ও রাজনীতির মধ্যে আলাদা করতে একটা সমস্যা তৈরি হয় না?
কবিতা রাজনৈতিক হয়ে উঠার আগে একটা কবিতাকে কবিতাই হয়ে উঠতে হয়। একটা কবিতা যদি কবিতা না হয়ে কেবল রাজনৈতিক প্যাচাল পারা শুরু করে সেই কবিতা কিন্তু আমরা নেই না, আমি নেবো না।
মানে দলের সাথে সাথে ঐ কবিতারও মৃত্যু ঘটবে, এরকম?
নিশ্চিত। এরকম কত কবিতাই তো লেখা হইছে পৃথিবীতে, কই সেগুলা? হ্যাঁ, সেটা যদি কবিতা হয়ে উঠে, সেটা রাজনীতি নিয়ে হোক আর যে নিয়েই হোক সেটা কিন্তু আর ভেরি করে না।
আচ্ছা! তিরিশের কবিদের যে প্রজেক্ট ছিল, সেটা বাংলা কবিতার জন্য বেশি সুবিধাজনক না অসুবিধাজনক?
এটা বলা আসলে অনেক টাফ; এগুলো আসলে থিসিসের ব্যাপার। আমার কাছে তো শেষ পর্যন্ত মনে হয়, আমরা যে ভিন্ন ধরনের কবিতা পাইছি, সেই কবিতাগুলোও হয়তো লেখা হইতো না, যদি তারা ঐ প্রজেক্ট না নিতো। হয়তো হইতো না তা না, অনেক সময় লাগতো। তো খারাপ কি? আমাদের কবিতা বরং রিচ-ই হইছে।
রিচ হইছে, কিন্তু তাদের পরবর্তী কবিদের ঐ প্রভাব কাটাইয়া উঠতে অনেকটা সময় লাগছে।
এটা ঐ কবির সমস্যা; ওদের সমস্যা না। আপনি কাঁটাইয়া উঠতে না পারলে নাই। এখন ধরেন আমি যে ঘরানায় লিখি, এটার পরবর্তী কেউ যদি প্রভাব না কাঁটাইয়া উঠতে পারে এটা তার সমস্যা। এখন কেউ যদি কয় পরে আইসা যে, রোবায়েত তো ক্ষতি কইরা দিয়া গেছে, সে বলতেই পারে, কিন্তু কথা হইছে, আপনি প্রভাব কাঁটাইয়া উঠতে পারতেছেন না এটা আপনার সমস্যা।
এই প্রসঙ্গে বলি, সলিমুল্লাহ খান বলতেছেন, যে মনীষী তার পরবর্তী কারো পথ সুগম করে যেতে না পারেন তার প্রতি তো একটা অভিযোগ থেকেই যায়।
আচ্ছা, উনার জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে ব্যাপারটা কেমন আমি জানি না।
আমার কাছে তো সেই কবিই গ্রেট যে তার পরবর্তী কবিকে আটকাইয়া রাখে।
সে তার কাজটা করতে দেয় না।
তখন সেখানে ফ্যাসিজম হয়ে যায় না?
না না, এটা ফ্যাসিজম হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, নজরুলের প্রভাব, জীবনানন্দের প্রভাব আপনি কাটাইয়া উঠতে পারেন না সেইটা আসলে আপনার সমস্যা, তাদের সমস্যা না।
তো আপনি কি মনে করেন, জসীম উদ্দীন অনেক বড়ো কবি?
জসীম উদ্দীন নিশ্চয়ই বড়ো কবি।
মানে এই দিক থেকে যে, রবীন্দ্র-বলয়, নজরুল-বলয় সব অতিক্রম করে— মানে তার কবিতা পড়লে ধরা যায় না সে ঐ সময়ের কবি। এদিক থেকে কি আপনার তাকে বড়ো কবি মনে হয়?
উনি নিশ্চয়ই বড়ো কবি। কারণ উনি অন্যদের প্রভাব কাটাইয়া তো উঠেছেন-ই; আমার কাছে বড়ো কবির যে ডেফিনেশন— পরবর্তী কবিদের আটকাইয়া দেওয়া, এটা কিন্তু উনি পারছেন। এখনও অনেকে জসীম উদ্দীন স্টাইলে লেখে। ঘটনা হচ্ছে যে, জসীমের স্টাইলে লেখা, এটা তো জসীমেরই সুবিধা।
এখন জসীম যদি না আসতো তাহলে হয়তো সে একটা নতুন ধারা তৈরি করতে পারতো…
পারতো না, যে জসীমকে এড়াইতে পারতেছে না সে নতুন আবার কি করবে!
ব্যাপারটা কি এরকম যে, সলিমুল্লাহ খান বলতেছেন, যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুঝে না সে আহমদ ছফাকে কিভাবে বুঝবে— আমি তো এটার সাথে একমত না।
না, ওইটার সাথে আমি একমত না। বোঝাবুঝি তো এক জিনিস; আমি বলতেছি,
আপনি তো একজন ক্রিয়েটর, একজন স্রষ্টা, এখন আপনি যদি আপনার পূর্ববর্তী স্রষ্টাকে অতিক্রমই না করতে পারেন তাহলে আপনি কিসের স্রষ্টা? আপনি তো অনুকারক।
তো আপনি অনুকারক হিসেবেই থাকেন। সে না থাকলে আপনি ফাটাইয়া ফেলতেন… আসলে সে ফাটাইতে পারতো না। বরং তার সামনে অনেক দুয়ার খোলা ছিল, দুয়ারগুলো দেখে এসে আরেকটা নতুন দুয়ারের সন্ধান সে করতে পারতো।
আচ্ছা, বাংলা কবিতায় অনুবাদের যে ব্যাপার, এই জায়গায় কাকে বেশি সফল ও সার্থক মনে হয়? অন্য ভাষা থেকে বাংলায়।
একসময় বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ, বোদলেয়ারের যে অনুবাদটা সেটা তো একসময় ব্যাপক প্রভাব ফেলছিল এখানে। যদিও ইদানিং চিন্ময় গুহরা বলেন যে, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ এ্যাকচুয়াল ভালো অনুবাদ না, অনেক ঝামেলাপূর্ণ অনুবাদ। হ্যাঁ, আজকে এসে সেই আলাপ তোলা যেতেই পারে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, ওই অনুবাদটা আমাদের আধুনিক যে কবিতা— বিশেষ করে শামসুর রাহমানরা যে ধরনের কবিতা চর্চা করছেন, মানে একটা সময় বোদলেয়ারের অনুবাদটা প্রচুর প্রভাব ফেলেছিল। এখন আর ওই প্রভাবটা নাই। সেজন্য আমার কেন যেন মনে হয়, এই মুহূর্তে যেটা মনে পড়লো, বাংলা কবিতায় একটা ব্যাপক সাড়া ফেলছে। মানে ওই এসথেটিক্স এখানে আমদানি করতেছেন। ধরেন, মূল বোদলেয়ারকে এখানকার কবিরা পড়েই নাই, তাহলে সে কোন্ বোদলেয়ারকে পড়তেছে? সে পড়তেছে বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ারকে।মানে ঐ বোদলেয়ারীয় যে এসথেটিক্স এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে…
বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমে…
ডেফিনেটলি, বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমেই ঘটছে ব্যাপারটা।
এখানে অনুবাদকের মুনশিয়ানাই প্রধান!
আপনি তো সেটাই চাচ্ছেন।
তো অনুবাদের দিক থেকে জীবনানন্দকে কি আসলে শিল্প বা কাব্যের দিক থেকে আরও ব্যাপক ভূমিকায় দেখা যায় না?
কিরকম অনুবাদ?
তার বেশ কিছু অনুবাদ তো আমরা দেখছি, ইংরেজি থেকে…
না, উনি কিন্তু এটা অনুবাদ বলেননি কখনো। উনি যেটা করেছেন, উনি উনার কবিতাই বানাইয়া ফেলছেন।
মানে, ওটাকে ভেঙেচুরে নিজের করে ফেলছেন— ওরকম?
হ্যাঁ, উনি বলতেছেন না যে, এটা অমুক কবির, তমুক কবির; উনি বলতেছেন, এটা আমার লেখা।
তো আমি যার থেকে ধার নিলাম, একটা ব্যাপার, এটা স্বীকার না করা…
কোনো সমস্যা নাই এতে।
মানে শিল্পের জন্য কোনো সমস্যা না?
না। শিল্পের জন্য সৎ থাকা কি জরুরী? জরুরতটা কী?
শেষ পর্যন্ত শিল্প তো মানুষেরই…
না, এখন আপনি কি আমাকে এই সততা দিয়ে বেহেস্তের টিকেটের খবর দিবেন?
বেহেস্তের টিকেটের জন্য তো কেউ সৎ থাকে না।
তাইলে এই সততা দিয়ে আমি কি করবো?
মানে এখানে যে ক্লিন থাকার যে একটা ব্যাপার…
আমার মনে হয় না সেটার কোনো দরকার আছে।
মানে কবিতার জন্য কোনো দরকার নাই?
কোনো দরকারই নাই। আমার কাছে পইড়া মনে হইতেছে অনেক ভালো লেখা, সে কোত্থেকে নিয়ে এসে অনুবাদ করে ফেলছে, এখন ওই টেক্সট থেকে রস নেওয়ার জন্য ওইটা জানা আসলে জরুরি না। হ্যাঁ, তথ্যের জন্য জরুরী হইতে পারে, পাণ্ডিত্যের জন্য জরুরী হইতে পারে, বাগ্মীতার জন্য জরুরী হইতে পারে ; দেখো আমি জানি এইটা যে, জীবনানন্দ ইয়েটস থেকে এইটা মারছে, জীবনানন্দ এটা আসলে কীটস থেকে মারছে— ফাইন, তথ্য হিসেবে অনেক সুন্দর, অনেক সাড়া জাগানো ব্যাপার-স্যাপার, কিন্তু আমি যখন পড়ি যে,
হায় চিল
সোনালী ডানার চিল
তুমি আর ওড়ে ওড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
এটা ইয়েটসের একটা কবিতার বলা হয়ে থাকে, একদম ট্রান্সলেট। তাতে আমার কি যায় আসে? ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে তো আমার ভাল্লাগে।
কবির দায়বদ্ধতার একটা জায়গা থাকে না?
না, দরকার নাই। কেন, সে বললে কি হইতো?
মানে, ঋণ, কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকে…
তার যদি মন চায় সে প্রকাশ করতে পারে। করলে এটা তার বদান্যতা যে, ভাই আমি কিন্তু এইটা এখান থেকে নিছিলাম, বলে দেই। না বললে কি যায় আসে! আমার কথা হচ্ছে, ওই টেক্সটটা পড়ার সময় কি সেটা আমার মাথায় থাকবে? যদি না থাকে বরং সেটাই ভালো।
আচ্ছা, সিগনেচারের যে কথাটা আমরা শুরুতে বলছিলাম, যে কবিতার মধ্যে তার নিজের ব্যাপারটা থাকবে; একটা সময় দেখা যায় কি, একটা কবির নির্দিষ্ট পথ তৈরি হয়ে যায়, সে পথে কবিতা লিখতে লিখতে এমন হয়ে যায় যে, কবিতাটা পড়লেই ধরে ফেলা যায় যে, এটা হাসান রোবায়েত লিখছে। এই ব্যাপারে…
এইখানে দুইটা ব্যাপার আছে, বুঝছেন? সেটা হলো, এটা অবশ্যই একটা কবির বড়ো অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু এই অ্যাচিভমেন্টটা আবার ডিস্টার্বও করে। কিভাবে? তাকে আসলে একঘেয়ে করে তোলে। মানে সে যখন একটা চাবি পেয়ে যায়, ঐ চাবি সে তখন বারবার ইউজ করা শুরু করে— তখন কি হয়, কোনো না কোনোভাবে তার লেখাগুলো একঘেয়ে হয়ে যায়। ঐ বিষয়টা আবার বাজে হয়ে উঠে। একটা টেক্সটের যে সিগনেচার যে এটা অমুকের টেক্সট— খুবই ভালো, ভালোই লাগে বিষয়টা ভাবতে। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে কবিকে তার নিজের সিগনেচারই আটকাইয়া দেয়।
মানে, এর বাইরে সে যাইতে পারে না…
সে যাইতে পারে না— এক।
মানে, তার সাহসটা হয় না?
হ্যাঁ, সে ভাবে কি যে, তাহলে আমার নিজের যে কমফোর্ট জোন সেখান থেকে আমি বের হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একজন কবি আসলে তখনি দীর্ঘদিন লিখতে পারে যখন বারবার সে তার ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করে। এখন সবগুলো ট্র্যাকেই কিন্তু তার সিগনেচার তৈরি হওয়ার চান্স থাকে, সে যদি ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করে। যেমন আমি আমার লেখা দিয়ে আপনাকে উদাহরণ দেই: আপনি আমার মাধুডাঙাতীরে পড়ছেন, এবং তারাধূলিপথ’র পাণ্ডুলিপি পড়ছেন— আপনি খেয়াল করলে দেখবেন যে, তারাধূলিপথের লেখক যে আসলে মাধুডাঙাতীরের লেখক বা মাধুডাঙাতীরের লেখক যে আসলে তারাধূলীপথের লেখক এটা কিন্তু একদমই মিলানো যাবে না। মানে হবেই না যে, এটা আসলে মাধুডাঙাতীরের লেখক, ঠিকাছে? এই যে ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করে নিজের জায়গাটাকে আলাদা করে ফেলা— এইটা আমার কাছে মনে হয় দীর্ঘদিন কাজ করবার জন্যে। হ্যাঁ, এখন আপনি যদি শহীদ কাদরীর মতো দুইখান বই লিখতে চান তাইলে ঠিকাছে, আপনি একই চাবি দিয়ে বারবার একই তালা খুলেন আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার যেটা মনে হয়, দীর্ঘদিন কাজ করবার জন্য নানান ধরনের নানান ধরনের চাবি দরকার নানান ধরনের তালা খোলার জন্য।
এবং সেজন্যই কি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় লিখিত কবিতাকেও আমরা টেক্সট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি?
রবীন্দ্রনাথ তো ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করছেন, স্টাইল চ্যাঞ্জ করছেন, ফর্ম চ্যাঞ্জ করছেন এবং তার সময়ে উনিই মনে হয় সর্বপ্রথম গদ্যে কবিতা লিখলেন; যদিও বাংলায় টানাগদ্যে প্রথম কবিতা লেখেন বঙ্কিম। তখন কিন্তু ব্যাপকভাবে বাংলার কাব্য-আকাশে বিরাজ করতেছে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুধীন এরা…
নজরুল?
হ্যাঁ। দ্যাখেন, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আপনাকে টেক্সটের ভ্যারিয়েশন দেখাচ্ছেন, গদ্যকবিতা লিখতেছেন, টানা গদ্যে লিখতেছেন, তখনো কিন্তু এগুলো ঐ তরুণ তুর্কী যারা তারাও পারতেছে না। সো, উনার এই টেক্সটের যে ভ্যারিয়েশন এটা মারাত্মক ব্যাপার। ধরেন, জীবনানন্দের ব্যাপারে বলা হয় না এরকম? যে, একঘেয়ে— সব টেক্সট একই ধরনের— এটার ভালো ও মন্দ দুটো দিগই আছে। কিন্তু আমি চাই, আপনি যখন দীর্ঘদিন কাজ করবেন তখন ভিন্ন ভিন্ন ফর্ম যদি দাঁড় করাতে পারেন, ভিন্ন ভিন্ন জগত তৈরি করতে পারেন, ভিন্ন ভিন্ন ল্যাঙ্গুয়েজের যে স্বাদ সেটা যদি দেখাইতে পারেন— এটা কিন্তু মজার, অনেক বড়ো ব্যাপারের লক্ষ্মণ এটা।
আচ্ছা, কবিরা যে গদ্য লিখে, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ; অনেক সময় বলা হয়, তারা গদ্যের মাধ্যমে মূলত কাব্যিকতারই চর্চা করতেছে। মানে, তাদের ভাষাটা কাব্যিক হয়ে উঠতেছে, এটা কি ঐ কবির জন্য ক্ষতিকর মনে করেন?
ব্যক্তিগতভাবে কিন্তু আমি পোয়েটিক যে প্রোজ, মানে যে গদ্যের মধ্যে কবিতার ভাব আছে, এটা আমার খুব পছন্দের। সেটা আমি কবি বলেও হইতে পারে। যে গদ্যে আসলে কবিতা নাই সে গদ্য আমি পড়ি না। আমার কিন্তু গদ্য না পড়ার পিছনে এটাই বড়ো কারণ। আমি কিন্তু বারবার বলি, গদ্য আমি পড়তে পারি না। আসলে খটমটেমার্কা জিনিসপত্র যায় না আমার সাথে। আর ওইটা তার সমস্যা কেন হবে? ওইটা তো একটা স্টাইল। আমরা যদি এটাকে স্টাইল হিসেবেই দেখি তাহলে এটা একটা ডিফারেন্ট স্টাইল না? কেন আপনাকে ঝরঝরে, খটমটে— যাই বলি না কেন— ঐ ধরনের গদ্যই কেন লিখতে হবে। আমি এইখানে একটা আলাপ তুলি: একজন সাধারণ গদ্যকারের পক্ষে কি একটা কাব্যিক গদ্য লেখা সম্ভব?
কঠিন।
কিন্তু দ্যাখেন, গদ্যে যদি কাব্যের যে ছাঁচ সেটা যদি থাকে তাহলে তো আপনি একটা ডিফারেন্ট গদ্য পাচ্ছেন। মানে, আপনি গদ্যকারের কাছ থেকে তো গদ্য পাচ্ছেনই, সেটা তো অলরেডি আপনার কাছে আছেই, কিন্তু আপনি একটা ডিফারেন্ট গদ্য (কাব্যিক গদ্য) পাচ্ছেন না? তো সেই গদ্যকে তো আমার সেলিব্রেট-ই করা উচিত।
আচ্ছা, প্রথমে গদ্য করে পরে কবিতা করা আর প্রথমে কবিতা করে পরে গদ্য করা— কোনটা বেশি কঠিন মনে হয়?
এটা যার যার নিজস্ব স্টাইল, এটা আসলে আমার পক্ষে বলা মুশকিল।
মানে, কোনটা কঠিন মনে হয়?
বলতেছি তো, এটা আসলে ব্যক্তির উপর ডিপেন্ড করে। কেউ কেউ এমন আছে যে, প্রথম জীবনে গদ্য করছে পরে কবিতায় নেমে আসছে, যদিও এই উদাহরণ খুবই কম। অধিকাংশ-ই এমন যে, প্রথমে কবিতা করতে গেছে, ধরা খাইছে, মনে হইছে যে, না এটা আমার দ্বারা সম্ভব না, তারপরে সে গদ্যে চলে গেছে।
মান্নান সৈয়দকে কি আপনার এমন মনে হয়?
তার গদ্য আসলে পড়া হয় নাই…
না না, গদ্য না; মানে কবিতা থেকে একসময় গদ্যে চলে গেল পুরোপুরি…
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই উদাহরণ তো আছেই।
আপনার কি এটা মনে হয় যে, সে আর করতে পারতেছে না, নতুন কিছু বলতে পারতেছে না, সেজন্য গদ্যে চলে গেছে নাকি গদ্যটাই তার ভালো লাগতেছে?
সেটা উনিই ভালো বলতে পারতেন। আসলে কাহিনীটা কি!
তবে, গদ্যের চাইতে কিন্তু কবিতা বেশি লোভনীয় ব্যাপার। কেউ যদি কবিতা করতে পারে— আমার ধারণা আর কি, আমার ধারণা ভুলও হইতে পারে, আমি আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বলতেছি— আমার একটা ভালো কবিতা লেখার পাওয়ার থাকে, আরেকটা ভালো গদ্য লেখার পাওয়ার থাকে তাহলে কিন্তু আমি ভাই আগে ভালো কবিতাটাই লিখবো; এবার গদ্য লেখা হয় হোক, না হয় না হোক। আমার মনে হয় যে, ভালো কবিতা লেখার চান্স থাকলে কেউ ভালো গদ্যের দিকে যেতে চাইবে না। মানে, কবিতা একটা লোভনীয় ব্যাপার।
আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন, কবিতা ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার? মানে, ঐশ্বরিক বলতে বোঝাচ্ছি, এটা সবার কাছে থাকে না, সাধনা করে সম্ভব না, থাকতে হয় ভিতরে এরকম?
ব্যক্তিগতভাবে যেহেতু আমি বিশ্বাসী মানুষ, তো আমার যেটা মনে হয় যে, একটা ব্যাপার ঘটে, যে এটা আসলে আল্লার পক্ষ থেকে কাউকে দেওয়া হয়।
মানে, নাজিল হয়, এরকম?
না, নাজিল না, পাওয়ারটা। মানে, আপনি লিখতে পারেন, আপনাকে লেখার ক্ষমতা আমি দিলাম, এখন আপনি কী লিখবেন না লিখবেন সেটা পরের আলাপ, কিন্তু লিখতে পারার পাওয়ার সম্ভবত… মানে সবাই বীর হবে না, কেউ কেউ বাই বর্ন বীর।
আপনি কি বাই বর্ন কবিত্ব জিনিসটা বিশ্বাস করেন?
আমার মনে হয় যে, কবিতা জিনিসটা বাই বর্ন।
মানে, চেষ্টা করে কেউ কবি হইতে পারে না, এরকম?
আই থিংক, পারে না।
চলবে…