প্রাচীনকালে মানুষকে বিনোদিত করার জন্য এক শ্রেণির মানুষ নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতো। তাদের কেউ বিনোদন প্রদানকে পেশা হিসেবে বেছে নিতো স্বেচ্ছায়, আবার কেউ বেছে নিতো নানাবিধ পারিপার্শ্বিক কারণে, অনিচ্ছায়। কেউ মানুষকে বিনোদিত করতো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে। যেমন: কুস্তি, লাঠিখেলা ইত্যাদির মাধ্যমে। আবার কেউ বিনোদিত করতো যাত্রাপালা, শাহী রাজ-দরবার কিংবা হেরেমে নেচে গেয়ে। লক্ষণীয় যে, একই ধরনের কাজ যাত্রাপালায় ও রাজসভায় করে বেড়াতো যে সকল নারীরা তাদের সামাজিকভাবে এক চোখে দেখা হতো না; স্থানের কারণে দেখা হতো ভিন্ন চোখে। অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সম্মানের মাপকাঠিও পাল্টে যেতো অবলীলাক্রমে। ইতিহাসের পাতায় উল্লেখিত আম্রপালির মতো বিখ্যাত নর্তকী, প্রখ্যাত বাইজি ও বহু কুস্তিগীরের কাহিনি আজও মানুষকে আমোদ যোগায়।
হোমো সেপিয়েন্সরা যতই দিন দিন আধুনিক ‘সভ্য মানুষ’ হিসেবে গড়ে উঠছে, ততই বেড়ে চলেছে তাদের বিনোদনের চাহিদা। বিনোদনের চাহিদা বাড়ার কারণটা সম্পর্কে সমাজচিন্তকরা বেশ ভালোভাবেই অবহিত আছেন। রাজ্যের হতাশা সৃষ্টিকারী পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে এর উপর ভিত্তি করে। বর্তমান পৃথিবীর প্রবল বৈষম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা একদিকে যেমন তৈরি করে প্রবল আক্ষেপ, হতাশা, দুঃখ, দারিদ্র্য এবং সীমাহীন যৌন অবদমন এবং তেমনি অপরদিকে এর ‘নিরাময়’ হিসেবে সাময়িক সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়ে ‘বিনোদিত’ করার জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছে হলিউড-বলিউড, স্পোর্টস-মিউজিক ও পর্নোগ্রাফির মতো বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিশাল ‘এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি’গুলো।
ইন্ডাস্ট্রির রক্ষাকবচরা নিয়ন্ত্রাধীন ‘কর্পোরেট মিডিয়া’ ব্যবহার করে নিজ খেয়ালখুশি-মতো এন্টারটেইনারদের মধ্যে থেকে বেছেবেছে ‘স্টার’, ‘সেলিব্রেটি’ এবং ‘আইডল’ বানিয়ে জনমানুষের সামনে ‘অতিমানব’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এই সময়ে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে মানুষ নিজে নিজেও ‘সেলেব্রেটি’ বনে যাওয়ার বিশেষ বিশেষ সব তরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
প্রাচীনকালে যেমন প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত ‘এন্টারটেইনার’ ছিলো, তেমনি এ-যুগেও তা বিদ্যমান রয়েছে; শুধু নাম-ধাম ও পদবী বদলে গেছে এবং একইসাথে আগাগোড়া বদলে গেছে বিনোদন প্রদানের মাধ্যমও। বর্তমানে পূর্বের মতো বিনোদনদাতাকে সশরীরে দর্শকের সামনে উপস্থিত হতে হয় না; আধুনিক স্যাটেলাইট-ইন্টারনেট কালচার বিনোদন জগতে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব এনেছে। এটা জলের মতো পরিষ্কার যে, ‘এন্টারটেইনার’ বা ‘সেলেব্রেটি’ শ্রেণীর লোকেরা প্রাচীনকালে ছিলো, এ যুগেও আছে এবং মানুষের বিনোদনের চাহিদা যেহেতু একেবারেই শেষ হবার নয়, তাই আমজনতাকে বিনোদন প্রদানের জন্য বিনোদনদাতারা ও বিনোদন-মাধ্যম ভবিষ্যতেও অক্ষত অটুট থাকবে ও এর সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে।
হালের গ্লোবাল ভিলেজে সেলিব্রেটিরা যেনো পরিণত হয়েছে ‘পাবলিক প্রোপার্টি’তে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। বিনোদন সংবাদদাতাদের ধারণা, তাদের সবকিছুই সাধারণ মানুষ জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে। ফলশ্রুতিতে বিনোদনের পাতায় কোন অভিনেত্রী একসাথে কয়টি আম খেলো, কোন অভিনেতার ছেলে কাকে বাবা ডাকলো, কোন তারকা সশব্দে বায়ুত্যাগ করলো; এসবের সবই গুরুত্বের সঙ্গে ঠাঁই পায় সংবাদমাধ্যমের বিনোদন পৃষ্ঠায়, অনলাইন পোর্টালের ফেসবুক পাতায়। ছলে বলে কৌশলে সেলিব্রেটিদের পরিণত করা হয়েছে একেকটি ‘কাল্ট ফিগারে’। যার ফলে চেতন কিংবা অবচেতন মনে কোটি ভক্ত, ফ্যান-ফলোয়াররা তাদের মতো হতে চাইছে, তাদের পোশাক-আশাক, হেয়ার-স্টাইল অনুকরণ করছে; কেউ রীতিমতো সকাল দুপুর বন্দনাগীত গাইছে, পূজা অর্চনা করছে, কেউ বাণী চিরন্তন আওড়াচ্ছে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। কেউ কেউ এও ভুলে গেছে যে, পূজিত দেবতাসম ব্যক্তিরা তাদের মতোই আহারাদি করে, প্রাকৃতিককাজে সাড়া দেয় এবং স্বাভাবিক মানুষের মতোই ভুল-ভ্রান্তি দ্বারা আচ্ছাদিত হয় ও ক্ষেত্রবিশেষে পাপও করে থাকে!
বহু প্রচারমুখী এ যুগের একজন ‘এন্টারটেইনার’, ‘সেলিব্রেটি’ কিংবা ‘আইডলে’র শিক্ষিত-অশিক্ষিত-মূর্খসহ নানা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা ও বয়সের দর্শক-অনুসারী-গুণগ্রাহী বিদ্যমান। এদের মধ্যে সকলেই যে সকাল বিকাল সন্ধ্যা সেলিব্রেটিকে মাল্যদান করবে, তার ফেসবুক পোস্টে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার ছবি কমেন্ট করবে, দিবানিশি শয়নে স্বপনে তার স্মরণে স্তুতিবাক্য গাইবে তা আশা করাটা সমীচীন তো নয়-ই বরং বড়সড় একটা বোকামি। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমান সময়ে সেলিব্রেটি হবার অলিখিত সাংবিধানিক নিয়ম হচ্ছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ‘হেটার্স’ থাকা। নানা কারণে এইসব হেটার্স তৈরি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক সেলিব্রেটির ফলোয়ার হলে আরেক সেলিব্রেটির হেটার্স হওয়া ফরজে-আইন। আধুনিক ‘সভ্য ভার্চুয়াল’ জগতে এ এক অদ্ভুত অলিখিত নিয়ম, অলঙ্গনীয় বিধি।
তো এইসব হেটার্সদের কাজ হচ্ছে বিরামবিহীনভাবে জলে-স্থলে, শহরে-মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কমেন্টবক্সসহ সর্বত্রই অপছন্দের সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো, খিস্তি-খেউড় উড়ানো ও ক্যাপিটালিস্ট নাগরিক জীবনে সঞ্চিত রাগ, ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত রাজ্যের ক্ষোভ-হতাশা হরহর করে বমি করে উগড়ে দেওয়া। কমেন্টবক্সে ঠিক কিভাবে কোন ভাষায় কোন বিশেষ তরীকায় তাদের ক্ষোভের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির পুঞ্জিভূত লাভাটা উদগীরিত হবে তা অবশ্য নির্ভর করে ব্যক্তিটির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সামাজিক পদ-মর্যাদার উপর।
অনেক বন্ধুদের দেখি, সেলিব্রেটি এন্টারটেইনারদের কমেন্টবক্সে লোকজন কেনো গালি-গালাজ করে, মন্দ কুৎসিত বাজে কথা বলে এটা নিয়ে গালে হাত দিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকতে, দুঃখী ব্যথিত কাতর হৃদয়ে জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখে স্ট্যাটাস দিতে। আমি অবশ্য এতে মন খারাপ করার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। এসব সীমাহীন খিস্তিখেউড়, আজাইরা প্যাঁচাল, অতলান্তিক ফেতনা-ফ্যাসাদ এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করি। আইন করে মানুষকে কমেন্ট বন্ধ থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। মানুষের মুখের উপর তো সবসময় বন্দুক ধরে বসে থাকা যায় না। সুপ্রাচীনকাল থেকে ‘এন্টারটেইনাররা’ জাগতিক টিককারি, অশ্লীল বচন, তীর্যকবাক্য সহ্য করে এসেছে। কিছু মানুষ তাদের ভালোবাসবে, সম্মান করবে; আবার কিছু মানুষ ঘৃণা করবে, তীব্র বাক্যবাণে বুকের পাঁজর জর্জরিত করবে, শব্দের আঘাতে জ্যান্ত কবরে পুঁতে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। এসবে তাদের মানিয়ে নিতে হয়। যারা মানিয়ে নিতে পারে না, সহ্য করতে জানে না, তাদের জন্য এই ঝকঝকে রূপালী ফাঁপা অন্তঃসারশূন্য সেলিব্রেটি জগত কিংবা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড নয়।
হলিউডের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী অভিনেত্রী ক্যাথরিন হেপবার্ন, যিনি প্রায় অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং কমপক্ষে এগারোবার অস্কার পুরষ্কারের জন্য মনোনীতা হয়ে চারবার পুরষ্কার লাভ করেন; চিন্তার অনেক খোরাক পাওয়া যায় যখন তিনি সন্দেহাতীত ভাষায় সদন্তঃকরণে বলেন,
“I’m an actress which means I sell myself, my personality. I share myself, and that’s a form of prostitution.” অর্থাৎ, “আমি অভিনেত্রী, তার মানে আমি আমার নিজকে, আমার ব্যক্তিত্বকে বিক্রি করি। আমি আমার নিজেকে প্রদান করি, আর তা হচ্ছে এক রকমের পতিতাবৃত্তি।”