চার
এখন তুরস্কের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উল্লেখ করা যেতে পারে যা তুরস্ক এবং বহির্বিশ্বের উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এটা হচ্ছে তুরস্কের জাতীয়তাবাদের অধ্যায়। একে নিঃসন্দেহে তুর্কীদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। তাঁদের এ ধরনের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ বিপ্লবেরই ফলশ্রুতি, যার সূচনা কামালের হাতে হয়েছিল। তখন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তুর্কীদের মনে একটা অস্পষ্ট, অবাস্তব ও কাল্পনিক ধারণা ছিল। ১৯২১ সালের ১লা ডিসেম্বরে মুস্তফা কামাল এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে এই ভাষায় সে ভুল ধারণাটি ভেঙ্গে দেন:
“সুধীবৃন্দ, আমরা মরীচিকার পশ্চাতে ছুটে বেড়াবার লোক নই এবং মুখোস ধারণ করাও আমাদের পেশা নয়। যে কাজ আমরা করতে অসমর্থ তা করবার ভান করে আমরা-এতদিন কেবল বিশ্ববাসীর ঘৃণা এবং বিদ্রুপই কুড়িয়েছি। বরং যে সমস্ত পরিকল্পনা আমরা বাস্তবে রূপ দিতে পারিনি, এমন কি রূপ দেবার চেষ্টাও করিনি, তার পশ্চাতেই আমরা ছুটে বেড়িয়েছি। আসুন, আমরা এখন আমাদের স্বাভাবিক, যথাযথ সীমায় ফিরে যাই, আমাদের ক্ষমতার সীমা সম্বন্ধে সচেতন হই। সুধীবৃন্দ, আমরা কেবল একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবার আকাঙ্ক্ষাই পোষণ করি এবং কেবল মাত্র তার জন্যেই আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করতে পারি।”
এর থেকে এখন পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, বর্তমান তুরস্ক নামে অভিহিত যে সীমিত এলাকায় তুর্কী জনগণের বসবাস সে ধরনের সীমানা ভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা তুর্কীদের নিকট সম্পূর্ণ নতুন ছিল ; এবং এ ধারণা এত নতুন যে তুর্কী ভাষায় “জাতীয়তাবাদ” বা দেশ-অর্থবোধক “তুর্কীয়ে” নামে কোন শব্দই ছিল না। কামাল কর্তৃক প্রবর্তিত প্রজাতন্ত্রই “তুর্কীয়ে” অর্থাৎ তুরস্কবাসীদের দেশ, এই ধারণাকে প্রজাসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। এইভাবে আধুনিক অর্থে “জাতীয়তাবাদ” কথাটি তুরস্কে প্রসার লাভ করে এবং পরবর্তী আমলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অনুপ্রবেশ করে। তখন থেকেই নূতন অর্থে ‘জাতীয়তাবাদ’ কথাটি তুরস্কবাসীদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে এই বিরাট শক্তি হয়ে রয়েছে। জাতীয়তাবাদের অপূর্ব শক্তি তুরস্কের সাংস্কৃতিক জীবনে এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন, বদলে দিয়েছে তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক আচারানুষ্ঠান, শিক্ষা-দীক্ষা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, শিল্প এবং ভাষা ও সাহিত্য।
তুর্কী জাতীয়তাবাদের প্রভাব বহির্বিশ্বে কি রূপ ধারণ করেছে সে প্রসঙ্গে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, তা সাধারণভাবে পাক-ভারত উপমহাদেশের, এবং বিশেষভাবে বাঙালী মুসলমানের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। সমগ্র উপমহাদেশ তখন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জাতাকালে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে সংগ্রাম করে যাচ্ছিল। আসন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্যে মুসলিম লীগও জোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। এ ছাড়া, স্বধর্মাবলম্বী তুরস্ক সাম্রাজ্যের জনগণের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে খিলাফত আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল। এই সব আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তুর্কীদের জাতীয়তাবাদী বিপ্লব থেকে প্রবল অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন এবং নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে এ উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছিল।
পাক-ভারত উপমহাদেশের রূপ পরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণে তদানীন্তন বাংলা দেশ বিশেষ ভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাড়িয়েছিল। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা নিষ্ফল, এ-ধারণা এই সব সন্ত্রাসবাদীদের মনে বদ্ধমূল ছিল বলে তারা সুযোগ সুবিধে মত ইংরেজ হত্যা অভিযান করতে আরম্ভ করল। অস্ত্রাগার এবং অফিস আদালত আক্রান্ত এবং লুষ্ঠিত হতে লাগল, রেলগাড়ি ধ্বংস করে এই সমস্ত বিক্ষোভকারী রেল বিভাগের কর্মচারীদেরও জীবন বিপন্ন করে তুলল। আতাতুর্কের অনুগামী তুর্কীদের মত এই সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ছেলেমেয়ে দেশের মুক্তিপণে হাসিমুখে প্রাণ উৎসর্গ করার সংকল্প নিয়েছিল। এদের মধ্যে সকলেই ছিল শিক্ষিত এবং প্রতিভাবান তরুণ।
তারা বিশ্বের সমসাময়িক ঘটনাবলী, বিশেষ করে তুরস্কের “ইয়ং টার্কস” (Young Turks)-দের কাছ থেকে উদ্দীপনা ও সাহস সঞ্চয় করেছিল।
আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রেও কামালের নেতৃত্বে সংঘটিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিল। তুর্কী বিপ্লবের মত আর কোন বিপ্লবই আমাদেরকে এত প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করতে পারে নি। এ বিপ্লবের প্রভাব যে আমাদের সত্তার অণুতে পরমাণুতে প্রবেশ করেছিল তার প্রতিফলন আমরা আমাদের শিক্ষা, সমাজ এবং সাহিত্যের প্রতি স্তরে দেখতে পাই।
আতাতুর্ক শিক্ষা বিভাগের যে সংস্কার আনয়ন করেছিলেন আমাদের কাছে তা ছিল দূর দিগন্তে এক খণ্ড মেঘের মত। তবু তা আমাদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল এবং অন্তত ছায়ার মত তাকে অনুসরণ করার প্রেরণা দিয়েছিল। আতাতুর্কের নামানুসারে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল, অশিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্যে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন এবং অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত উৎসাহজনক ভাবে এগিয়ে যেতে লাগল। অর্থাভাবের দরুন এই ধরনের বিদ্যালয়ের বেশী ভাগই অবশ্য দুই এক বৎসরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল, কারণ দরিদ্রতাহেতু বাঙালী মুসলমানেরা তাদের ব্যয়ভার বহনে অপারগ ছিল ; তা ছাড়া ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাও এ ব্যাপারে তাদের প্রতি তেমন সহানুভূতিশীল ছিল না। তবু এদের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের নোয়াখালী জেলার ফেনীতে অবস্থিত “আতাতুর্ক হাই স্কুল” এই সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বর্তমানের মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। “আতাতুর্ক জুনিয়র মাদ্রাসা” নামে অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরে কিছু দিন আগেও চালু ছিল।
বাঙালী মুসলমানদের নিকট তখনও স্ত্রী শিক্ষা প্রায় অজ্ঞাত ছিল। প্রদেশের মুসলমানদের তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নানা প্রকার কুসংস্কার প্রচলিত থাকার ফলে কেহ তাদের কন্যাসন্তানদের বিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার দুঃসাহস করতেন না। আমাদের দেশের মহিলা সম্প্রদায় তখন পর্দাপ্রথা পালন করে বোরকা ব্যবহার করতেন। প্রধানতঃ এই সকল সামাজিক বাধার জন্যেই আমাদের দেশের মহিলা সম্প্রদায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু যখন তুরস্কের এক সরকারী নির্দেশক্রমে মহিলা সম্প্রদায়ের সকল প্রকার সামাজিক অসামর্থ্য তুলে দিয়ে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হল, তখন বাঙালী মুসলমান মহিলাদেরও দৃষ্টি খুলে গেল। রংপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের পর্দানশীন মহিলা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) নারীদের মুক্তির জন্যে প্রকাশ্যভাবে পর্দার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। “অসির চেয়ে লেখনি শক্তিশালী” ইসলামের এই মূলনীতি অবলম্বন করে তিনি একাদিক্রমে বাংলায় কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। পরবর্তী কালে এই সব বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে যথাক্রমে তাঁর “অবরোধ বাসিনী”, “মতিচুর” এবং “পদ্মরাগ” এই তিনটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। তদানীন্তন বাংলার রাজধানী কলিকাতায় তিনি একটি মহিলা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মুসলিম নারী সমাজের মুক্তির অগ্রদূতী এবং নারী শিক্ষার একজন প্রধান সেবিকা হিসাবে তাঁকে বেশ কিছুকাল প্রবল বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তুরস্কে ব্যাপক সমাজ সংস্কারের ফলে “পর্দা” এবং “বোরকা”র মত এই সামাজিক বাধাগুলো বহুলাংশে শিথিল হয়ে পড়ল এবং বাংলার মুসলিম মহিলাদের জন্যে স্কুল কলেজের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। শীঘ্রই বেগম এম. রহমান, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ (১৯০৯-১৯৬৪) এবং বেগম সুফিয়া কামাল (জন্ম ১৯১১) প্রমুখ সমাজ সেবিকাবৃন্দ বেগম রোকেয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে এগিয়ে এলেন। প্রথমোক্ত মহিলাদ্বয় সুবিখ্যাত সমাজ সেবিকা ছিলেন এবং বেগম সুফিয়া কামাল এখন বাঙলার অন্যতম প্রসিদ্ধ কবি।
আরবী বর্ণমালার স্থানে রোমান বর্ণমালার প্রবর্তন সম্ভবত তুরস্কের শিক্ষা বিভাগের সর্বাপেক্ষা বৈপ্লবিক সংস্কার। এর একটা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল এবং গোটা সভ্য জগৎ এর কার্যকারিতা অত্যন্ত কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিল। তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে বিক্ষুব্ধ এই উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক ঐক্যবিধানে যে সমস্যা বাধাস্বরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল চিন্তানায়ক ও নেতৃবৃন্দ তার সমাধান খুজতে সচেষ্ট ছিলেন। বর্ণমালা সংস্কারে তুর্কীদের সাফল্য লক্ষ্য করে পাক-ভারত উপ-মহাদেশের পণ্ডিতদের মনেও এই পন্থা অবলম্বন করার উৎসাহ জাগল। ভারতের প্রধান ভাষাতাত্ত্বিকদের অন্যতম ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৮৯০) পাক-ভারতীয় বর্ণমালার রোমানিকরণকে ভারতের জাতীয় অনৈক্যের অন্যতম সমাধান হিসেবে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কয়েকজন সভ্য সেই সময় তুরস্ক সফর করেন। তাঁরা-ও সুনীতি কুমারের এই পরামর্শের প্রতি সমর্থন জানালেন। বাঙালী বৈজ্ঞানিকদের অন্যতম ড: মুহমমদ কুদরত-ই-খুদাও ( ১৮৯৮) পাক-ভারতীয় বর্ণমালার রোমানীকরণ পরামর্শটিকে সমর্থন করেছিলেন।
ভাষা সংস্কারের এই প্রচেষ্টার ফল কি দাঁড়াত তা নিয়ে আজ আর মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তবে, সে যুগে চিন্তাধারার গতি কোন দিকে ছিল, এর থেকে তা জানা যায়।
তুরস্কের সামাজিক সংস্কারের প্রভাব বাংলা দেশের মুসলিম সমাজের উপরই সর্বাপেক্ষা বেশী পড়েছিল। মুসলমানেরা তাঁদের মধ্যে কামালের মত একজন বীর নায়কের আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছিলেন যিনি তাঁদেরকে ইংরেজ ও ইংরেজ সাহায্য পুষ্ট হিন্দু শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবেন। সেই সময়ে যে সব ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছে তাদের নামকরণের মধ্যে আমাদের এই ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। কেননা শীঘ্রই আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নাম তুরস্কের বীর ও বীরাঙ্গনাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখার প্রথা অনুসরণ করতে শুরু করলাম। বর্তমান ঢাকা হাই কোর্টের একজন প্রতিশ্রুতিশীল ব্যারিষ্টার মোস্তফা কামাল, পূর্ব-পাকিস্তানপরিষদের একজন তরুণী পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী বেগম খালিদা খানুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক জনাব আনোয়ার পাশা এবং প্রদেশের আরো অনেকের নামে এ কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
বাংলায় “তুর্কী টুপী” নামে পরিচিত ‘ফেজ’ তখন আভিজাত্য ও পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হত। সাধারণতঃ জুমার নামাজে, ঈদের দিনে অথবা মিলাদ অনুষ্ঠানে এই ‘ফেজ’ টুপির ব্যবহার দেখা যেত। যখন থেকে তুরস্কে ‘ফেজ’ টুপীর ব্যবহার নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হল তখন আমাদের দেশেও ‘ফেজ’ টুপীর ব্যবহার প্রায় উঠে গেল। তখন জনসাধারণ কিছু দিন ‘কামালী টুপীর’ ব্যবহার করতে লাগল এবং এ ধরনের টুপী বিশেষ অনুষ্ঠানাদিতে পরিধান করার রীতি দাঁড়িয়ে গেল। ১৯২৪ সালে কামাল যে টুপী পরিধান করেছিলেন তার সাথে সাদৃশ্য রেখে এই টুপী প্রস্তুত করা হ’ত। অবশ্য এই ধরনের টুপীর ব্যবহার আমাদের দেশে তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
পাঁচ
সাহিত্য, বিশেষ করে যে সমস্ত সাহিত্য চলতি শতাব্দীর বিশ থেকে ত্রিশ দশকে রচিত হয়েছে, সে প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে বলতে হয় যে এ সাহিত্য প্রধানতঃ তুরস্কের সাংস্কৃতিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। বলা বাহুল্য যে এই সবের সাথে সাথে ক্রুশেডের প্রখ্যাত বীর গাজী সালাহ উদ্দীনের ন্যায় আতাতুক সম্বন্ধেও বাঙালী মুসলমানের মনে একটা মহৎ ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলমানদের জাতীয়তাবাদ, ইসলামবাদ ও যা কিছু তাদের কাম্য আতাতুর্ক তার একটা জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিভাবে আতাতুর্কের ব্যক্তিত্ব আমাদের সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে কবি আবদুল কাদিরের (জন্ম ১৯০৬) একটি সুন্দর কবিতায় তার প্রকাশ ঘটেছে।
“গাজী মুস্তফা কামাল পাশা,
তুমি নির্জিত জাতির আশা।
ঝলে সংগ্রামে তোমার অসি
যত ভয়-মোহ পড়ুন খসি।
পুনঃ ইসলামী আগুন জ্বালো,
হবে এই ধরা উজল আলো।”
মুসলমানদেরকে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্যে ১৯১২ সালে “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি” নামে যে প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তা খুব একটা ফলপ্রসু হয় নাই। যখন বিভ্রান্ত মুসলমানেরা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছিল না ঠিক সেই সময়ে তদানীন্তন বাংলার দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকা নগরীতে কয়েকজন প্রবীণ মুসলমান সাহিত্যিকের একটি দল “রেনেস সমিতি” নামে একটি সমিতি গঠন করেন। আনোয়ারুল কাদির (১৮৮৯-১৯৫০), কাজী আবদুল ওদুদ (জন্ম ১৮৯৪), কাজী মোতাহার হোসেন (জন্ম ১৮৯৭) প্রমুখ ব্যক্তিবৃন্দ ছাড়া আরও অনেকে এ সমিতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। অবশ্য তাঁদের সাহিত্যিক তৎপরতা কেবল মাত্র চিন্তার ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল, তবু তাঁরা সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁদের অন্ধকারে আচ্ছন্ন স্বজাতির মানসিক জড়তা ও কুসংস্কারে আঘাত করে তাদের মোহনিদ্রা ভাঙাতে চেয়েছিলেন।
ঠিক এই সময়ে সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের (জন্ম ১৮৯৯) নেতৃত্বে অপর একদল তরুণ সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। স্বদেশপ্রীতির এক নতুন জীবনাদর্শে এঁরা ছিলেন বিভোর। সমসাময়িক অন্যকোন প্রতিষ্ঠান বা দলের সঙ্গে এঁদের বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের এই আদর্শবাদকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বলা যেতে পারে যার প্রকাশ হল সাহিত্যে। এবং এই আদর্শের জন্যে সর্বপ্রকার ত্যাগ, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। ১৯২৪ সালে “ভারতী” পত্রিকায় প্রকাশিত “বিদ্রোহীর বাণী” কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই এই আদর্শবাদের ব্যাখ্যা করেছেন :
“যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথাই বিদ্রোহ!
ধামাধরা! জামাধরা! মরণ ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি, – মরব শেষ।
নরম গরম প’চে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিম্বা পাতাল-তল!”
নজরুল ইসলামের যুগ-বাণীর এটাই ছিল সারাংশ। প্রখ্যাত কবি ও সমালোচক আবদুল কাদির “নজরুল রচনাবলীর” প্রথম খণ্ডে ভূমিকায় নিম্নলিখিত ভাষায় নজরুল ইসলামের আদর্শবাদ বিশ্লেষণ করেছেন :-
“নজরুলের দেশাত্মবোধের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা নানা জনে নানা ভাবে করেছেন। রাজনীতিক পরাধীনতা ও অর্থনৈতিক পরবশতা থেকে তিনি দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীন মুক্তি চেয়েছিলেন ; তার পথও তিনি নির্দেশ করেছিলেন। সে দিনের তাঁর সেই পথকে কেউ ভেবেছেন সন্ত্রাসবাদ, – কারণ তিনি ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের উদাহরণ দিয়ে তরুণদের অগ্নিমন্ত্রে আহ্বান করেছিলেন ; কেউ ভেবেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিয়মতান্ত্রিকতা – কারণ তিনি ‘চিত্তনামা’ লিখেছিলেন ; কেউ ভেবেছেন প্যান-ইসলামিজম কারণ তিনি আনোয়ার পাশার প্রশস্তি গেয়েছিলেন ; আবার কেউ ভেবেছেন মহাত্মা গান্ধীর-চরকা-তত্ত্ব – কারণ তিনি গান্ধীজীকে তাঁর রচিত চরকার গান শুনিয়ে আনন্দ দিয়েছিলেন। কিন্তু, একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, এসব ভাবনার কোনটাই সত্যের সম্পূর্ণ স্বরূপ উদঘাটনের সহায় নয়। প্রকৃতপক্ষে নজরুল তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম যুগে ছিলেন কামালপন্থী, – আতাতুর্কের সুশৃঙ্খল সংগ্রামের পথই তিনি ভেবেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য সর্বাপেক্ষা সমীচীন পথ। ১৩২৯ সালের ৩০ শে আশ্বিন তারিখের ১ম বর্ষের ১৪শ সংখ্যক ‘ধূমকেতু’তে তিনি ‘কামাল’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, – ‘সত্য মুসলমান কামাল বুঝেছিল যে ‘খিলাফত উদ্ধার ও দেশ উদ্ধার করতে হলে ‘হায়দরী হাঁক হাঁকা চাই’ … “ওসব ভণ্ডামি দিয়ে ইসলাম উদ্ধার হবে না।’…‘ইসলামের বিশেষত্ব তলোয়ার’। কামাল আতাতুর্কের প্রবল দেশপ্রেম, মুক্ত বিচার-বুদ্ধি ও উদার মানবিকতা নজরুলের এই যুগের রচনায় প্রভূত প্রেরণা যুগিয়েছিল।”
মানসিকতায় নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী, বিশ্বাসে মুসলমান, প্রকাশ ভঙ্গিতে প্রচলিত নিয়ম বিরুদ্ধ, লিখন ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নতুন এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সর্বহারাদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম সহানুভূতি।
অচিরেই আদর্শবাদী তরুণ সমাজ সে যুগের সাহিত্যের গতানুগতিক ভাবধারা পাল্টে দেওয়ার জন্যে নজরুল ইসলামের চতুষ্পার্শে এসে জড় হলেন। এদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী কবি বেনজির আহম্মদ১ (জন্ম ১৯০৩) কবি মহিউদ্দীন (জন্ম ১৯০৬) প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এঁরা আদর্শের জন্যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের হাতে অকথ্য লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন। ফররুখ আহম্মদ২ নামে অপর একজন কবি মুসলমান আদর্শবাদে বিশ্বাসী তাঁর গুরু নজরুল ইসলামের প্রতি এখনও সশ্রদ্ধ রয়েছেন।
মোট কথা, মুসলিম বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ পরিধি – কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী ইত্যাদির বিভিন্ন শাখা, একই সঙ্গে এমন এক জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যাতে বাঙালী মুসলমান তাদের নিজেদের বলে গৌরব বোধ করতে পারে। অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খান “কামাল পাশা” ও “আনোয়ার পাশা” নাটক রচনা করেন তুরস্কের এই দুই বীর সেনানীর কৃতিত্ব ও আদর্শের ভূয়সী প্রসংসা করেন। অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর উপন্যাস ‘চৌচির’ ও আরো কয়েকটি ছোট গল্পে এই প্রদেশের মুসলিম সমাজ জীবনের অন্যায় অবিচারগুলি ফুটিয়ে তোলেন। ড. গোলাম মকসুদ হিলালী হালীদে এদিব হালুমের জীবনচরিত রচনা করেন। এ ছাড়া আরো অনেকে কামাল আতাতুর্কের জীবনচরিত রচনা করেন। তুর্কীদের নিকট থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অনুপ্রেরণা লাভের জন্যে বাঙালী মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থার সাথে তুলনা করে তুরস্কের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিভিন্ন দিকের উপরও অসংখ্য প্রবন্ধ রচিত হয়েছিল। ১৯৩৮ খৃ. আতাতুর্কের মৃত্যু সংবাদে বাঙালী মুসলমান শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। বাড়ীতে, রাস্তা-ঘাটে এবং শোক সভায় জনগণকে, বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়কে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও দেখা গিয়েছিল। আতাতুর্কের জীবনী ও তাঁর বিভিন্নমুখী সংস্কারমূলক কার্যাবলীর উপর ভিত্তি করে অনেক সাময়িক পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিল। যারা তাঁর উপর শোক-গাথা লিখেছিলেন তাদের মধ্যে কবি শাহাদৎ হোসেন, (১৮৯০-১৯৫৩), বেগম সুফিয়া কামাল, কবি তালীম হোসেন ও দিলীপ দাস গুপ্তর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১. মূলত নাম হবে ‘বে-নজীর আহমদ’।
২. মূলত নাম হবে ‘ফররুখ আহমদ’।