গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে, এবার বাড়ি না গিয়ে খালামনির বাসায় এসেছি। বাসায় ঢুকতেই খালামনির সহকর্মী ফেরদৌসী খালার সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো। উনারা দু’জনেই কল্যাণপুর গার্লস স্কুলের শিক্ষক। আমাকে দেখার পর দু’জনে কেমন ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলেন। কী একটা অস্বস্তি! আমি সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। ফেরদৌসী খালা হেসে বললেন, ‘যুঁথি, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে! বেশ বড় হয়ে গেছো, আমাকে চিনতে পেরেছো?’
‘জি খালা।’
‘তো কোথায় পড়াশুনা করছো এখন?’
‘ইডেন কলেজে, ইংরেজি সাহিত্যে।’
আমার রুনা খালামনি যেন অন্য কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছিলেন। আমাকে বললেন, ‘ঘরে যা মা, তাড়াতাড়ি কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নে। একসাথে খাবো।’ আমি ভেতরের ঘরে চলে গেলাম। খালামনির কোন ছেলেমেয়ে নেই, আমাকে উনি নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। আমিও মনে করি, উনি আমার মায়ের মতোনই।
গোসল সেরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। মাঝেমাঝ টিভির শব্দ ছাপিয়ে খালাদের হাসির শব্দ আমার কানে আসছে। বেশ খিদেও পেয়েছে, কিন্তু উনারা এখনও উঠছেন না কেন কে জানে! দু’টো বেজে গেছে, রাস্তায় আজ বেশ যানজট ছিল, কলেজ থেকে কল্যাণপুর আসতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। খালাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য পাশ থেকে হেঁটে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে পান করলাম। রুমে ফিরে আসার সময় রুনা খালার কণ্ঠ কানে এলো, ‘রুমনের সাথে যুঁথিকে কিন্তু বেশ মানাবে!’ আবার দু’জনে হেসে গড়াগড়ি।
খাবার টেবিলে তিনজনে অনেক গল্প করলাম। বিকেলে আমি চা আর পাস্তা তৈরী করেছি সবার জন্য। এ বাসায় আসলে চা-নাস্তা, রান্না-বান্না যখন যেভাবে খুশি নতুন রেসিপি বানানোর চেষ্টা করি, খালামনি খুশি হন। আজকের নাস্তা নিয়েও প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন দু’জনে।
সন্ধ্যায় ফেরদৌসী খালা উনার বাসায় চলে গেলেন। খালমনির বাসাটা বেশিরভাগ সময় নীরব থাকে। খালু ব্যাংকার, সকালে বের হন, ফিরতে ফিরতে রাত আটটা-নয়টা। খালমনিও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তবে আমি এলে গল্পের ঝুলিটা খুলে বসেন, কয়েকটা দিন আমাদের বেশ আনন্দেই কেটে যায়।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে খালামনি আমার রুমে এলেন। কোনরকম সূচনা ছাড়াই বলতে শুরু করলেন, ‘তুই কী কখনও রুমনকে দেখেছিস, যুঁথি?’
‘রুমনটা আবার কে?’
‘ফেরদৌসীর বড় বোনের ছেলে।’
‘কি জানি, মনে পড়ছে না।’
‘অনেক সুন্দর দেখতে! এবার মার্কেটিং এ মাস্টার্স শেষ করে গার্মেন্টস এ একটা বড় পদে চাকরি নিয়েছে। রুমনের মামাদের তিন-চারটা নামকরা গার্মেন্টস আছে, ওর মধ্যে একটায় জয়েন করেছে, নামটা আমর ঠিক মনে নেই। তোর পড়াশুনা তো বছরখানেক পরে শেষ হবে, তাই না?’
‘হুম!’
‘আচ্ছা, এখন ঘুমিয়ে পড়। কালকে গল্প করবো।’
সকালে উঠে দেখি, খালামনি অনেক কিছু রান্নার আয়োজন করেছেন। আমি হেসে বললাম, ‘বাপরে! তুমি আমার জন্য এত কিছু করছো কেন?’
‘তোর জন্য তো অবশ্যই, সাথে আরও একজন মেহমানও আসবে।’
‘কে সে?’
‘ফেরদৌসী আর ওর বোন।’
‘উনি তো গতকালই এসেছিলেন, আজ আবার…!’
‘ওর বোন আসতে চেয়েছে, তাই আর মানা করিনি।’
আমার খুব অস্বস্তি লাগছে! কালকের কথাটাও কানে বাজছে। মনে হচ্ছে এখনই হলে চলে যাই। কিন্তু গতকাল এসেই তো বলে ফেলেছি, সাতদিন থাকবো।
বিকেলে ফেরদৌসী খালা আর উনার বড় বোন এলেন। ওমা! উনি একেবারে আমার গা ঘেষে বসলেন। পড়াশোনা নিয়ে অনেক কথা বললেন, আমার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন, বাহ! বেশ সুন্দর তো তোমার চুল, নিশ্চয়ই অনেক যত্ন করো? তা পড়াশুনা শেষ করে কি করতে চাও, মা?
‘আমার চাকরির ক্ষেত্র তো বলতে গেলে নির্দিষ্ট, মার্চেন্ডাইজার হতে চাই।’
এরপর উনাদের অন্যদিকে কথা বলতে দেখে সন্ধ্যা ৭.৩০ এ চ্যানেল আই-এর খবরটা ছেড়ে মন দিলাম টিভির পর্দায়। রাতের খাবার খেয়ে উনারা চলে গেলেন।
মেহমান চলে যাবার পর খালা এসে বললেন, ‘রুমন- উনার একটাই ছেলে। ফেরদৌসী আর ওর বোন তোকে খুব পছন্দ করেছে, রুমনের সাথে তোর বিয়ের কথা বলছিল।’
‘কিন্তু আমি তো পড়াশুনা শেষ করে বিয়ে করতে চাই, আর মাত্র একটা বছর আছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, কথা হচ্ছে হোক, যা নসীবে আছে তাই তো হবে।’
এক সপ্তাহ পর হলে চলে এলাম। এরপর আরও তিন-চারবার বিভিন্ন ছুটিতে খালার বাসায় গিয়েছি কিন্তু রুমনদের প্রসঙ্গে আর কোন কথা হয়নি। ওদিকে আবার আমার আব্বু -আম্মু বিয়ের জন্য জবরদস্তি করছে, খুলনাতে এক ছেলের পরিবারের সাথে প্রায় পাকা কথা দিয়ে ফেলেছে তারা।
খালাকে বললাম – ‘তোমাকে তো কতবার বলেছি, আমি এখন বিয়ে করবো না, তুমি একটু আব্বু-আম্মুকে বোঝাতে পারছো না?’
‘কি করবি বল? সবই তো নসীবের খেলা। রুমনের কথাও ওরা আর কিছু বললো না। শুনেছি, কয়েকদিন আগে হুট করে যশোরে দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে ছেলের।’
আমি আর কোন কথা বাড়াইনি, ইচ্ছেই হলো না। আমার মন খারাপ কি না সেটা ভেবে খালা বললেন, ‘তুই তাহলে বল তোর কী পছন্দ? আমি না হয় ফোন তোর মাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।’
‘আমি তো সবসময় তোমাকে বলেছি, মা’কে সারাজীবন অনেক কষ্ট করতে দেখেছি, এত বেশি অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি, কাজেই এখন আর অভাবের কথা শুনলেও ভয় হয়। আমি এখন চেহারা বা আবেগের চেয়ে, অর্থের গুরুত্বও ভালো করেই বুঝি। তুমি সময়ে-অসময়ে আমাকে পড়ার খরচ না দিলে অনেক আগেই হয়ত লেখাপড়াটা বন্ধ হয়ে যেত।’
মাসখানেক পরের কথা। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো সাগরের সাথে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে, উচ্চতায় আমার সমানই বলা চলে, ওর চেহারাটা তেমন আকর্ষণীয় নয়। তবে সংসারটা নতুন হলেও খাট-পালং, সোফা, শো-কেস, আলমারী, টিভি, সবকিছু একেবারে পরিপাটি করে সাজানো। ভাগ্য ভালো যে, রুনা খালার বাসার কাছে একটা বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছে। একটু মন খারাপ হলে বা কারণে-অকারণে তাঁর কাছে ছুটে যাই। সেদিন খালা জানতে চাইলেন, ‘কিরে যুঁথি, সাগরের সাথে তোর ভাব হয়েছে?’
‘ধুর! কি যে বলো, ওর দিকে তাকালেই আমার রাগ ওঠে।’
‘কেন? তুই-ই তো একদিন বলেছিলি, চেহারা যাই হোক, টাকা-পয়সা থাকলেই চলবে।’
‘হুম! বলেছিলাম। কিন্তু ওর তো কিছুই নেই। যেনন কৃপণ, তেমনি সারাক্ষণ নিজের মায়ের রান্নার সাথে আমার রান্নার তুলনা করে। কথায় কথায় মাকে ফোন করে আমার নামে বিচার দেয়। আমার বোধয় আর জীবনে শান্তি হবে না, খালা।’
‘কিন্তু দুইজনের সংসারে এত কৃপণতা কোথা থেকে আসে, আর কার সাথেই বা করে?’
‘ওর ধান্ধা একেবারে কাছে না থাকলে কেউ ধরতে পারবে না। এই ধরো, ফ্রিজে মাছ-মাংসের অভাব নেই, ও কি করবে জানো, অফিস থেকে ফেরার সময় দু’হাত ভরে শাক-পাতা, হাবিজাবি নিয়ে আসবে, আর ঘুরে ফিরে বলতে থাকবে, এগুলো আগে রান্না করো, না হলে নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘থাক মা, সংসারে যা আছে তাই মেনে নিয়ে মন দিয়ে সংসার কর, দেখবি এর মধ্যেই একদিন মায়ার জালে জড়িয়ে যাবি।’
‘তুমি তো নসীবের উপর ছেড়ে দিয়েই সারাজীবন পার করে দিলে।’
রুনা খালার ধৈর্য্য আকাশ সমান, বুদ্ধির গভীরতা সমুদ্রকেও হার মানায়। উনি পাশে ছিলেন বলেই এখনও নানারকম ঝামেলা উতরে ভালোভাবেই সংসারটা করতে পারছি। কখনও পজিটিভ পরামর্শ দিয়ে, কখনও অর্থ দিয়ে, সবসময় আমাকে আগলে রাখেন। একবার সাগরের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল, ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে রাতেই খালার বাসায় চলে আসতে চেয়েছিলাম।
খালা বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। সবকিছু গুছিয়ে রাখ, সাগর বাসায় এলে ওর সামনে দিয়ে আসিস। না বলে এত রাতে আসলে মানুষ তোকে তো খারাপ বলবেই, আমাকেও ছেড়ে দেবে না।’
আমি অপেক্ষা করছি, সাগর আর বাসায় আসে না, আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেল। এত রাতে একা বাসা থেকে বের হবার সাহস হলো না। না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম, সকালে উঠে দেখি রাগ কমে গেছে। এখন আমার মিষ্টি একটা ছেলে হয়েছে, ওর জন্যই বোধহয় সংসারটা টিকে যাবে। খালা এখনও মাঝেমাঝে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কী সাগরের সাথে তোর ভাব হয়েছে?’
‘ধুর! ওর দিকে তাকালেই আমার রাগ ওঠে। হাড় কিপটুস! ছেলেটার জন্য একটা দামী ড্রেসও কিনতে চায় না। বলে, এখন তো দুই-তিন মাস পরপর সব কাপড় ছোট হয়ে যাবে, এত দামী জিনিসের দরকার কী?’
খালা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘রুমনের কথা মনে আছে তোর?’
‘হুম!’ মনেমনে বলি, মনে থাকবে না আবার, আমাকে বিয়ের কথা বলে ঝুলিয়ে রেখেছিল কতদিন।
‘ওর নসীবটা কেমন দেখ, ফেরদৌসী কত আগ্রহ করেছিল, অথচ তোর সাথে বিয়েটা হলো না। যশোরে যে মেয়েকে বিয়ে করেছিল, ঐ বউটা প্রথমবার বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফেরেনি, এটা নাকি ওদের ঐতিহ্য। মেয়ের বাবাও না কি বলেছেন, মেয়ে-জামাইকে তিনি কাছে রাখবেন। একমাত্র ছেলেকে কি কেউ ঘরজামাই থাকতে দিয়ে চায়! তিনমাস অপেক্ষা করার পরও আর এলো না, ডিভোর্স হয়ে গেছে। এরপর ছেলের মুখের দিকে বাবা-মা তাকাতে পারেন না। হন্যে হয়ে মেয়ে খুঁজেছে, আমাকেও দেখতে বলেছিল। যা হোক, শেষমেষ যশোরেই আর একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিয়েটা হয়েছিল বছর খানেক আগে। এ-বছর জানুয়ারিতে একটা বাচ্চা হয়েছিল, সাতদিন আইসিইউ তে থাকার পর মারা গেছে!’
‘আহা!’
‘এখানেই কি শেষ? ফেব্রুয়ারির আটাশ তারিখ বৌয়ের ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে যশোর গিয়েছিল, ফেরদৌসীদেরও দু’দিন পরে যাবার কথা ছিল, পঁচিশ তারিখ কেনাকাটা করে খুলনা থেকে ফেরার সময় মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় দুই বোনসহ এক ভাইয়ের বউ মারা গেছে। এমন মর্মান্তিক একটা ঘটনা ঘটে গেছে, ওরা ভীষণ ভেঙে পড়েছে! আমিও খবরটা জানার পর খুব কষ্ট পেয়েছি!’
‘বলো কী! এই খবর তো মনে হয় টিভিতে দেখেছিলাম। কিন্তু একবারও ভাবিনি, দুর্ঘটনাটা তোমার এত চেনা কোন মানুষের সাথে ঘটেছে।’
এই প্রথমবার আমার নসীবটাকে সবকিছুর উপরে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে হলো। মনের উপর চাপা দেয়া অদৃশ্য পাথরটা নিমিষেই সরে গেল, রুমনের উপর জমে থাকা অভিমানগুলোও ভাটার জলের মতো নামতে শুরু করেছে, ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল- রুমনের নসীবে ছিল ওর স্ত্রী ডিভোর্সড হবে, মারা যাবে…, আর আমার নসীবের বদৌলতে এখনও বেঁচে আছি, তাহলে ওর সাথে বিয়েটা হবে কি করে?
নিজের ভেতরে আবারও ভীষণ কষ্ট অনুভূত হলো, তবে নিজের জন্য নয়!