প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র বিবেকসম্পন্ন-কারো বিবেকের সাথে কারো ভাগাভাগি নেই। প্রত্যেককে নিজের মতো চিন্তাভাবনা করার জন্য পৃথক-পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়েছে। গ্লাসের অর্ধেক পানির মতো-কেউ বলে অর্ধেক খালি, কেউ বলে অর্ধেক ভর্তি, আবার কেউ বলে অর্ধেক থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। এভাবেই একটি বিষয়কে আমরা প্রত্যেকে ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, দেখতে অভ্যস্ত এবং এটাই স্বাভাবিক। একটি ঘটনাকে যেভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, একটি বইকে যেভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রেখে পাঠ করা হয় তদ্রূপ কারবালার মতো একটি শ্রেষ্ঠ স্পর্শকাতর, মর্মান্তিক ঘটনাকেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। এই যে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, এটা অন্তত বাংলায় অনুপস্থিত ছিল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কারবালার ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত পুঁথি-পাতার স্রোতে অবরুদ্ধ ছিল মীর মশাররফের বিষাদ সিন্ধুর আবির্ভাব পর্যন্ত। উনিশ শতকের শেষদিকে (১৮৮৫-১৮৯১) বিষাদ সিন্ধুর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাংলায় কারবালার প্রতি কোনো বাঙালির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পতিত হয়েছে- এই দৃষ্টিভঙ্গি সামান্য ভিন্ন বিধায় এটাকে বৈপ্লবিক বলা চলে না। ষোলো শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ এবং দৌলত উজির বাহরামের মাধ্যমে কারবালার ঘটনাকে উপজীব্য করে যে ‘মর্সিয়া সাহিত্য’ ভূমিষ্ট হয় বাঙালি-মুসলমান তাকে বহুত আদরযত্নে লালন-পালন করেছিল উনিশ শতক পর্যন্ত। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালি-মুসলমানের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র দু’টি লাইনে সেই ‘মর্সিয়া সাহিত্য’র মায়া থেকে মুসলমানদের উত্তরণের জন্য সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলেন। ‘ফিরে এলো আজ সেই মহরম মাহিনা – ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’ পঙক্তির মাধ্যমে তিনি কারবালাকে স্মরণ করে কেবল শোক-বিলাপের প্রথা থেকে বাঙালি-মুসলমানকে বের করার কার্যক্রম হাতে নেন। এটাকে আমি চিন্তাধারার ক্ষেত্রে বিপ্লব বলতে চাই। কারবালার প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির এ বৈপ্লবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা বিশিষ্ট করেন দু’জন কবি- বে-নজীর আহমদ এবং ফররুখ আহমদ। বাঙালি-মুসলমান কবি হিসেবে চিন্তাধারায় এবং জীবন-যাপনে উক্ত দু’জনকে ‘বিপ্লবী’ বলে চিহ্নিত করলে সভ্য পাঠকের মোটেই আপত্তি থাকার কথা নয়।
বে-নজীর আহমদ (১৯০৩-১৯৮৩)
কবি বে-নজীর আহমদ কারবালাকে উপলক্ষ করে কবিতা লিখেছেন দু’টি১। কবির জিন্দেগী কাব্যগ্রন্থে সে দু’টি কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। কবিতা দু’টিতে কবি কারবালাকে দেখেছেন সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, মজলুম-জালিমের জয়-পরাজয় হিসেবে। শরীয়তকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে, বাবার ওয়াদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে জালেম এজিদ যখন মজলুম প্রতিবাদী ইমাম হুসাইনকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন তখন তো এ ঘটনাকে সত্য-মিথ্যার লড়াই, ন্যায়-অন্যায়ের এসপার-ওসপার হিসেবে দেখা যায় খুব সহজেই।
মহরম সেই বেদনার স্মৃতি-নিখিল জাহান স্মরিছে আজ-
মানুষ কেমনে মানুষেরই লাগি নির্ভয়ে পরে মৃত্যু-তাজ;
নিত্যেরে স্মরি,সত্যেরে স্মরি কেমনে মানুষ সর্ব সুখ
হেলায় ত্যজিয়া ব্যথার-বজ্র উল্লাসে লয় পাতিয়া বুক!
এ চার লাইনে আমরা দেখছি,কবি কারবালার শহীদদেরকে দেখছেন ‘মানুষেরই লাগি নির্ভয়ে মৃত্যু-তাজ’ পড়তে। অর্থাৎ,তাঁদের জীবন যে তাঁরা নিঃস্বার্থে কোরবান করেছেন,তাঁরা যে ‘হেলায় ত্যজিয়া ব্যথার-বজ্র’ বুক পেতে নিয়ে আগত পৃথিবীবাসীর নিকট ন্যায়ের পুলসিরাতে দণ্ডায়মান থাকার একটি আদর্শ স্থাপন করে গিয়েছেন তা-ই কবির চোখে বড়ো হয়ে ধরা দিয়েছে।
মান চাহে শুধু প্রাণ নাহি চাহে, চাহে না বিত্ত, চাহে না ধন
মুক্তা নহে রে মুক্তির লাগি কেমনে করে সে সর্বপণ!
অত্যাচারীর দণ্ডেরে নহে-ন্যায়দণ্ডেরে করে সে ভয়-
মহরম সেই অমর-অভয় ব্যথা-গরিমার গাহিছে জয়।
কারবালার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে উক্ত চার লাইনে: ‘মান চাহে শুধু প্রাণ নাহি চাহে’- কেবল বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকাতে যে কোনো মহত্ত্ব নেই, একজন মহৎ মানুষ যে কেবল বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকতে চায় না, থাকে না, একজন মহামানবের জীবনে যে প্রাণের চেয়ে মান বড় হয়ে উঠে তার সরাসরি দর্শন কারবালার মধ্যে দেখতে পেয়েছেন কবি। ইমাম হুসাইন সপরিবারে বেঁচে থাকতে পারতেন আরও অনেকদিন, আরাম-আয়েশে রাজার হালে কাটাতে পারতেন বাকি জীবন; কিন্তু তিনি মানকে কোরবানি করে প্রাণকে আগলে রাখেননি, প্রাণকে কোরবানি করে মানকে চড়িয়েছেন অমরত্বের শিখরে। কারবালার মাধ্যমে ইমাম হুসাইন প্রমাণ করেছেন, মহৎ জীবনের তরে প্রাণের প্রশ্নে আপস চলতে পারে কিন্তু মানের প্রশ্নে কখনোই ন্যূনতম আপসও নয়। সক্রেটিস বলেছিলেন: “যে কোন মূল্যে বেঁচে থাকাই শেষ কথা নয়, শেষকথা সৎভাবে বেঁচে কথা”- এর বাস্তবতা গড়ে গিয়েছেন ইমাম হুসাইন।
পরের দু’লাইনে তো দর্শন আরও গভীর! কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে ইমাম হুসাইন তো অত্যাচারীকে ভয় পাননি বিন্দুমাত্রও, ভয় পেয়েছেন ন্যায়কে-ন্যায়ের ভয়েই শেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন সপরিবারে কারবালায় নৃশংসতম উপায়ে শহীদ হলেন। মজলুম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ন্যায়াশ্রয়ী যে কখনোই অত্যাচারীর দণ্ডকে ভয় করে না, মূলত ন্যায়দণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত ভয়েই সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, ‘মহরম সেই অমর-অভয় ব্যথা-গরিমার’ জয় গাইবে চিরকাল।
কারবালা শুধু নহে সে আরবে নিখিল জুড়িয়া বাজে সে আজ!
জালেম এজিদ জুলুম আনিছে ব্যথিতের বুকে হানিয়া বাজ।
এস বীর এস, শহীদ হোসেন! যেথায় রহ না সুদূর ঠাঁই-
মজলুম ধরা চাহিছে তোমায়-চাই বীর সূত, শহীদ চাই।
ধরায় আজও যে জালিম এজিদ আছে, জালিমদের বিরুদ্ধে ন্যায়ের তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য যে আজও হুসাইন দরকার সে-কথা স্মরণ করিয়ে কবি কারবালার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরার মাধ্যমে এ কবিতার ইতি টানলেন।
কারবালাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেখে কবি রচনা করেছেন ‘কারবালা নবতর’ কবিতা। আজকের বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বও যে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার কারবালায় পরিণত হয়েছে, সে ময়দানে যে আমাদের ইমাম হুসাইনের আদর্শকে প্রেরণা হিসেবে শিরে নিতে হবে, সে ময়দানে যে ন্যায়ের পক্ষে ১৩০০ বছর পূর্বের কারবালা আমাদের জন্য তাজা নিদর্শনরূপে হাজির হয় তার দরস দিলেন কবি বে-নজীর আহমদ।
তেরোশ বরষ পর-
মহরম আজ এলো ফের লয়ে
কারবালা নবতর।
তেরশ বছর পার হয়ে ফের
আমাদের আছমানে-
নূতন আশার নব বাঁকা চাঁদ
জীবনের জ্যোতি আনে।
মানুষ আমরা সবাই হেথায়
বাদশাহ-নফর কেহ
নাই হেথা ভাই।-এক জাতি মোরা
এক প্রাণ এক দেহ।
দুনিয়া জুড়িয়া চলিয়াছে আজ
সবলের রাহাজানি-
তারে না দলিয়া হবে না নীরব
আল্লার মহাবাণী।
বয়েছে ধরায় পূত যে শোনিত
সীমারের খঞ্জরে
তারি সয়লাবে ডুবিবে এজিদ-
আছি জাগি তারি তরে।
নাহি নাহি সংশয়
প্রতি কারবালা শেষে ইসলাম
নব সে জন্ম লয়।
ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৮৭৪)
কারবালাকে কেন্দ্র করে ফররুখ আহমদ কবিতা লিখেছেন চারটি- নতুন মোহাররাম (আজাদ করো পাকিস্তান : ১৯৪৬) শহীদে কারবালা (সিরাজাম মুনীরা : ১৯৫২), শহীদে কারবালা (মুহূর্তের কবিতা : ১৯৬৩), এজিদের ছুরি (কাফেলা : ১৯৮০)২।
কারবালাকে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন ফররুখ আহমদ- এবং তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গির রূপায়ন ঘটেছে একাধিক কবিতায় বিক্ষিপ্ত অংশে। সিরাজাম মুনীরা কাব্যগ্রন্থে ‘শহীদে কারবালা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
বাজে রণ-বাজা, মাতে দুশমন কাঁপে শংকিত পৃথ্বীতল
দাও সাড়া দাও মুজাহিদ সেনা! সত্য পথের সাধকদল।
মুহূর্তের কবিতা কাব্যগ্রন্থের ‘শহীদে কারবালা’ কবিতায় দেখি:
স্মৃতির পাথরপটে সে কাহিনী র’য়েছে অম্লান
উজ্জ্বল রক্তের রঙে,মোছেনি তা মরু সাহারায়,
লোভের পঙ্কিল পথে অথবা রাত্রির তমসায়
যেখানে জ্বালালো দীপ সত্যাশ্রয়ী আদম সন্তান।
নির্ভীক মুসার পণ, খলিলের সুদৃঢ় ঈমান
যেখানে দেখেছি দীপ্ত, মসীকৃষ্ণ রাত্রের ছায়ায়
কুতুব তারার মত প্রোজ্জ্বল আপন মহিমায়
যেখানে দেখেছি চেয়ে সর্বত্যাগী হুসেনের দান
যেখানে শুনেছে প্রান মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের গান
পুঁথির পাতায় নয় জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় \
উক্ত কবিতায় আমরা দেখি, কারবালার দর্শনকে জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন কবি ফররুখ আহমদ- তিনি কারবালাকে দেখেছেন ‘সত্যাশ্রয়ী আদম সন্তান’র প্রজ্জ্বলিত প্রান্তর হিসেবে আর ‘জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়’ অঙ্কিত কারবালার লহুসফেন।
কারবালা তো জালেম-মজলুমের লড়াই- একপাশে জালেম এজিদের ঘাঁটি আরেক পাশে মজলুম হুসাইনের সপারিবারিক উপস্থিতি। উনিশ শতক পর্যন্ত বাঙালি-মুসলমান কেবল কারবালার কাহিনী স্মরণ করে বুকের ছাতি পিটিয়েছে, বিলাপ করতে করতে মূর্ছা গিয়েছে, শোকে বিধ্বস্ত হয়েছে শতকের পর শতক- কবি ফররুখ আহমদ কারবালার মর্মশাঁস উপলব্ধি করে ‘জালেম-মজলুমের’ তত্ত্ব বিকশিত করেছেন কবিতায়।
এজিদরূপে প্রতি যুগে জালেম আসে এবং প্রতি যুগেই হুসাইনরূপে আসে সত্যাশ্রয়ী বীর, যারা রুখে দেয় জালেমদের জুলুম- এ বোধ বাংলা কবিতায় প্রবেশ করেছে খুব বেশিদিন হয়নি। যেসব কবিগণ কারবালা-নির্গত এ বোধ কবিতায় বিকশিত করেছেন তাঁদের মধ্যে ফররুখের স্থান অতিউঁচুতে।
সিরাজাম মুনীরা কাব্যগ্রন্থে ‘শহীদে কারবালা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
উতারো সামান, দাঁড়াও সেনানী নির্ভীক-সিনা বাঘের মত।
আজ এজিদের কঠিন জুলুমে হ’য়েছে এ প্রাণ ওষ্ঠাগত,
মুমিনের দিল জ্বলছে বে-দিল জালিম পাপীর অত্যাচারে,
নিহত শান্তি নিষ্কলঙ্ক শান্তিপ্রিয়ের রক্তধারে,
হেরার রশ্মি কেঁপে কেঁপে ওঠে ফারানের রবি অস্ত যায়!
কাঁদে মুখ ঢেকে মানবতা আজ পশু শক্তির রাজসভায়!
আজাদ করো পাকিস্তান কাব্যগ্রন্থে ‘নতুন মোহাররাম’ কবিতায় লিখেছেন:
আজিকে জেহাদ এজিদের সাথে,
দল বেঁধে এসো খুনেরা-প্রভাতে
ভাঙো জুলুমের জুলমত : হোক
জালিমের শিরে বজ্রপাত \
চল্লিশের দশকের পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য কারবালাকে জালেম-মজলুমের দৃষ্টিতে দেখে সেখান থেকে অনুপ্রেরণা ঋণ নিয়েছেন ফররুখ- উক্ত কবিতাংশটি তার প্রমাণ বহন করে। কাফেলা কাব্যগ্রন্থের ‘এজিদের ছুরি’ কবিতায় ফররুখ আহমদের রূপ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং গভীর শৈল্পিকতায় নিমগ্ন:
আমার দুঃস্বপ্নে আজ ফেরে ক্রুর এজিদের ছুরি
আজ সীমাহীন তীক্ষ্ম খঞ্জরের নীচে কাঁপে সংখ্যাহীন
ভারাক্রান্ত প্রাণ
আবার সম্মুখে মোর ঘনালো এ কোন্ মৃত্যু কারবালা ময়দান?
মানুষের মুক্ত মাঠে আনিয়াছে কা’রা
এজিদের ছুরির পাহারা!
সম্মুখে মৃত্যুর বাধা পশ্চাতে ক্রন্দন অগণন…
ঢাকা প’ড়ে গেছে আজ নর্তকীর নূপুর নিক্বণে
কোরানের ধ্বনি
জালিমের বজ্রমুষ্টি ঢাকিয়াছে নবীজীর উন্মুক্ত সরণি।
জালেম-মজলুমের তত্ত্বকে পুঁজি করে ফররুখ আহমদ আজও কারবালাকে স্বচক্ষে অবলোকন করছেন, আজও ‘এজিদের ছুরির পাহারা’র তলায় ক্লিষ্ট হওয়া ‘সংখ্যাহীন ভারাক্রান্ত প্রাণ’র আর্তনাদ শুনতে পান তিনি। সমকালের প্রতিটি জালিমকে এজিদ-সীমার এবং প্রতিটি মজলুমকে হুসাইন হিসেবে গণ্য করে কারবালাতে উপস্থিত হয়েছেন ফররুখ, যে-কারণে কারবালাকেন্দ্রিক প্রতিটি কবিতায় কারবালার ছদ্মাবরণে ফররুখের প্রতিবাদী-মানস প্রকাটাকারে ভেসে উঠে এবং তাঁর প্রতিবাদী-মানসের ভিত্তি এতোটাই পোক্ত ও আকার এতোটাই চওড়া যে, চাইলেই পাঠক এড়িয়ে যেতে পারে না। একজন আধুনিক কবি হিসেবে কারবালার প্রতি এ দৃষ্টিভঙ্গি ফররুখ আহমদের কাব্য-জীবনের একটি সফলতা হিসেবে গণ্য না করে উপায় থাকে না।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিকতা কাকে বলে? একটি ঘটনা, বিষয় ও প্রসঙ্গকে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বহিরাগত কোনো দৃষ্টিতে দেখে অভিনব কিছু বের করা এবং ধর্মীয় বোধকে গৌণ রেখে মানবীয় বোধকে প্রাধান্য দেওয়াকেই হাল-আমলে আধুনিকতা বলে চিহ্নিত করা হয়। আধুনিকতার এ সংজ্ঞায়নের ভিত্তিতে কবি বে-নজীর ও ফররুখকে কারবালাকেন্দ্রিক কবিতায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্মাতা না বলে পারা যায় না। যখন দেখি বে-নজীর উচ্চারণ করেন: মানুষ কেমনে মানুষেরই লাগি নির্ভয়ে পরে মৃত্যু-তাজ; মান চাহে শুধু প্রাণ নাহি চাহে; অত্যাচারীর দণ্ডেরে নহে–ন্যায়দণ্ডেরে করে সে ভয়; তখন তো তাঁকে কারবালার প্রতি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কবি না বললে বড্ড জুলুম হয়ে যায়। যখন ফররুখের কণ্ঠে শুনি: পুঁথির পাতায় নয় জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়; আজ এজিদের কঠিন জুলুমে হ’য়েছে এ প্রাণ ওষ্ঠাগত; আমার দুঃস্বপ্নে আজ ফেরে ক্রুর এজিদের ছুরি; মানুষের মুক্ত মাঠে আনিয়াছে কা’রা এজিদের ছুরির পাহারা; তখন তো তাঁর আধুনিকতাকে অস্বীকার করা মানে হুসাইনের গলায় সীমার হয়ে ছুরি চালানো!
বাংলা সাহিত্যে কারবালাকেন্দ্রিক কাব্য রচনা হয়েছে অঢেল, কিন্তু বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গির পর্যবেক্ষণে আধুনিক কবিতার ময়দানে কারবালাকে আমদানি করেছেন গুটিকয়েক লেখক, তন্মধ্যে উক্ত দু’কবির স্থান বিশিষ্টরূপে চিহ্নিত। কারবালার ঘটনা ধর্মীয় বেধরেখা অতিক্রম করে মানবীয়-বোধে আচ্ছন্ন এক আকর্ষণীয় উন্মত্ততায় প্রলুব্ধ করে সকলকে, মাইকেল মধুসূদন বন্ধু রাজনারায়ণকে লিখেছিলেন: We have just got over the noise of the Mohurrum. I tell you that:- if a great Poet were to rise among the Mussulmans of India, he could write a magnificent Epic on the death of Hossen and his brother. He could enlist the feelings of the whole race on his behalf. We have no such subject. সরল তর্জমা: “আমরা কেবল মহররমের বিলাপের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছি। আমি আপনাকে বলছি যে, ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে যদি কোনও মহান কবির আবির্ভাব ঘটতো, তবে তিনি হোসেন এবং তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুতে একটি দুর্দান্ত মহাকাব্য লিখতে পারতেন। তিনি তার পক্ষ থেকে পুরো জাতির অনুভূতি কাব্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। আমাদের তেমন কোনো বিষয় নেই (মহাকাব্যের জন্য)।”৩
বাংলা সাহিত্যে কারবালাকে নিয়ে সে-রকম উপাদেয় মহাকাব্য কেউ লিখতে পেরেছেন কি-না সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। কিন্তু কারবালাকে আধুনিক কাব্যের মঞ্চে উপাদেয় আকারে হাজির করার প্রধান কৃতিত্ব উক্ত দু’কবির, সে-বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করাও বোধহয় জুলুম হবে।
*প্রতিটি কবিতাই প্রাসঙ্গিক আলোচনার প্রেক্ষিতে খণ্ডিত অংশ মাত্র, কোনো কবিতাই সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হয়নি। তথ্যসূত্র অনুসারে আগ্রহী পাঠকগণ পড়তে পারেন।
তথ্যসূত্র:
১. বে-নজীর আহমদ রচনাবলী : শাহাবুদ্দীন আহ্মদ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ২০০৭, ১৭১-১৭৩ পৃষ্ঠা
২. ফররুখ আহমদ রচনাবলী প্রথম খণ্ড : আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী,১৯৯৫, ৯৩, ২০৫ ও ৪৭৬ পৃষ্ঠা, দ্বিতীয় খণ্ডঃ ১৯৯৬, ৫০ পৃষ্ঠা
৩. মধুসূদন রচনাবলী : অজিতকুমার ঘোষ, হরফ প্রকাশনী, ১৯৪২, ৮৪৯ পৃষ্ঠা