উপমহাদেশের তিন শ্রেষ্ঠ কবির অভ্যুদয় উনিশ শতকের শেষার্ধে। এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষার কবি, আর ইকবাল তার কাব্য সৃষ্টি করেছেন উর্দূ ও ফার্সী ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ এবং ইকবাল প্রায় সমবয়সী- রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন, ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দে, ইকবালের জন্মের কয়েক বছর পূর্বে। ইকবালের জন্মসন ১৮৭৩। বয়সের দিক দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম দু’জনেরই কনিষ্ঠ; নজরুল জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সনে। ইকবাল এবং রবীন্দ্রনাথের কবিজীবন সুদীর্ঘ বলা যায়। নজরুল ইসলামের যখন আমাদের সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটলাে তখন রবীন্দ্রনাথ তার কবিজীবনের মধ্য-আকাশ অতিক্রম করেছেন। ইকবালের কবিকীর্তিও তখন তাঁর সৃষ্টির ঐশ্বর্য এ সফলতার শীর্ষে উপনীত। অথচ এই তিন কবির মধ্যে রয়েছে একটা মিল- তিনজনই মানবতার কবি, তিনজনই বিশ্বাসের কবি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস তাকে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের প্রবর্তনা দেয় না, তাকে দিয়েছে ঋষির ভূমিকা। পার্সুয়েশানের [Persuation] মাধ্যমে তিনি সমন্বয় সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। ভেঙে গড়ার ভূমিকাতে তাঁকে আমরা দেখি না। তিনি অনেকটা ‘স্ট্যাটাসকো’র কবি; যা আছে তাকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি অন্তর্বিরােধ দূর করতে চেয়েছেন। সাম্য তার কাম্য নয়; পরস্পরের মধ্যে মিলন এবং সম্প্রীতিই তার অন্বিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের একাডেমিক শিক্ষা বেশি দূর অগ্রসর না হলেও রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিবেশ ও আবহাওয়া ছিলাে তাঁর গীতিধর্মী কবিপ্রতিভা বিকাশের অনুকূল। ইংরেজী সাহিত্যের সঙ্গে এবং ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে ঘটেছিল তার নিবিড় পরিচয়। এছাড়া ভারতীয়, বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পারিবারিক ঐশ্বর্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং আবহাওয়ায় লালিত হয়েছিল তাঁর এই গীতি-ধর্মী প্রতিভা। বাংলাদেশে পৌত্তলিক ধর্ম-বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম মতবাদ জন্মলাভ করে, রাজা রামমােহন রায়ের আনুকূল্যে ও নেতৃত্বে, কবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন তারই নেতৃপুরুষ। এই উপনিষদীয় আধ্যাত্মিকতার পরিমণ্ডলে বিকশিত হয় রবীন্দ্রনাথের মন, মানস ও প্রতিভা। ব্রাহ্ম মতবাদ সনাতন হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ বলা যায়। কিন্তু এ ধর্ম ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করেই বিকশিত হয়।
ইতিপূর্বে, এদেশে, পৌত্তলিক ও বর্ণাশ্রমবাদী হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে, শাসক ইংরেজ ও খ্রীস্টান মিশনারীদের প্রভাবে আরাে একটি বিদ্রোহ ঘটে। একশ্রেণীর শিক্ষিত হিন্দু সেদিন স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ শুরু করে। যুগন্ধর প্রতিভা মহাকবি মধুসূদন দত্ত পিতৃধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান হয়ে পড়েন, মদ ধরেন এবং মেম বিয়ে করেন। কবি বাংলা সাহিত্যে যে বিপ্লবের ঝান্ডা উড়িয়ে দিলেন, তা আকাশে হঠাৎ আবির্ভূত ধূমকেতুর পুচ্ছের সঙ্গেই তুলনীয়। কল্পনায় স্বর্গ-মর্তে আলােড়ন সৃষ্টি করে বিদায় নিলেন মধুসূদন; এর পর বাংলা কাব্যে শুরু হলাে গীতি-কবিতার কোমল রাগিণী। মধুসূদনের পর রবীন্দ্রনাথ নামেই ‘রবি’ বাস্তবে দেখা গেল। আকাশ জুড়ে তিনি পূর্ণিমার চাঁদের মতাে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছেন, পূর্ণিমার চাঁদের মতােই তিনি স্নিগ্ধ- সূর্যের দহন বা তেজ তার মধ্যে অনুপস্থিত। বুদ্ধি, মেধা এবং মননের কবি রবীন্দ্র ‘বিদ্রোহ’ বা বিপ্লবে কুণ্ঠিত; বিদ্রোহ তাঁর কবি-প্রকৃতির বিরােধী। তাঁর প্রথম দিকের কিছু কবিতায়, যেমন- ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ প্রভৃতিতে সহজ সরল ভাবোচ্ছ্বাসের প্লাবনে আমরা ভেসে যাই; কিন্তু ধীরে ধীরে আবেগের উপর মননের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এক পর্যায়ে মননই হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যের প্রধান লক্ষণ। এজন্য, রবীন্দ্রকাব্য বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েও শান্ত ও স্নিগ্ধ; প্রলয়ের তােলপাড় সৃষ্টি করা সামুদ্রিক তরংগাভিঘাত এ কাব্যে পাওয়া যায় না।
কবি হিসাবে কে বড়াে, কে মহৎ এ প্রশ্ন অবান্তর। মােদ্দা কথা এই যে, ইকবাল ও নজরুল-কাব্যের সুর এবং মেজাজ আলাদা। রবীন্দ্র-কাব্য এঁদের কাব্য থেকে স্বতন্ত্র। ইকবাল এবং নজরুল ইসলাম দু’জনই বিদ্রোহী; তাঁরা প্রচলিত সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছেন। নজরুলের ক্ষেত্রে কেবল Pious wish নয়, তিনি হাতুড়ি শাবল নিয়ে এ শােষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, তার স্থানে নতুন সমাজ সৃষ্টির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সবাইকে ডাক দিয়েছেন। দু’কবিরই জন্ম মুসলিম পরিবারে, মুসলিম ঐতিহ্যের পরিমণ্ডলে। ইসলাম অসত্যের সঙ্গে, শােষণ, জুলুমের সঙ্গে আপােস করে না, দাসত্বকে মনুষ্যত্বঘাতী বলে গণ্য করে। তাই ‘পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সব নিবে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।’ এ ধরনের কোনাে আহ্বান নজরুল ইসলাম বা ইকবালের কাব্যে আমরা দেখি না। ‘এসাে ব্রাহ্মণ শুচি করাে মন, ধর হাত সবাকার’ এমন আর্তি নজরুল ইসলামে অকল্পনীয়, কারণ নজরুল ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণবাদ ও জাতি-পাতির অচলায়তন ভেঙে চুরমার করে দিতে চান। তিনি বলেন, ‘গাহি সাম্যের গান—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ কবিগুরু যখন বলেন, ‘হে মাের দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছে অপমান/অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান’, তখন আমরা দেখি এক হুশিয়ারী, তিনি সুবিধাভােগী উচ্চবর্ণের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন, তাই অনিবার্য অপমান থেকে তাদের বাঁচানাের জন্য ভবিষ্যদ্রষ্টা কবির এই সময়ােচিত সতর্কবাণী।
নজরুল ইসলাম এবং ইকবাল যে বিশ্বাসের পরিমণ্ডলে জন্ম নেন, তাতে মানুষ সৃষ্টি জগতে তার স্রষ্টার প্রতিনিধি; সমগ্র সৃষ্টিই মানুষের অধীনে স্থাপিত। সে বিশ্বস্রষ্টার প্রতিনিধি বলেই তাে, আসমান-জমিনে যা কিছু আছে- চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা সমস্ত কিছু এমনকি, দিন-রাত্রি তথা সময়ের উপর পর্যন্ত মানুষকে দেয়া হয়েছে কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, মানসিক দাসত্বের প্রভাবে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। সে তার স্বরূপকে চেনে না। গাছপালা বা ইতর জীব-জন্তুর মতাে জন্ম-মৃত্যুর অধীনতাকেই সে নিজের নিয়তি বলে মনে করে। কিন্তু মানুষ যখন নিজের স্রষ্টাকে চেনে তখনি তার স্বরূপ নিজের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন তার এই উপলব্ধি ঘটে যে, তার ও তার স্রষ্টার মাঝে এমন কোনাে শক্তি, ব্যক্তি বা সত্তা নেই, যার কাছে সে সিজদায় অবনমিত হতে পারে, সে স্রষ্টার সামনে সিজদায় নুয়ে পড়ার পর, গােটা সৃষ্টিই তার প্রতি সিজদায় নত হয়ে পড়ে!
এই অবস্থায় মানুষের বন্ধনমুক্তি ঘটে। সে তখন দেখে, তার সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। তখন ‘কারার লৌহকপাট’ লাথি মেরে গুড়া করে সে বিশ্বের মুক্ত আঙিনায় বেরিয়ে আসে- তখনি সে বলে ওঠে ‘আমি চিনেছি আমারে, সহসা আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ এই বন্ধনমুক্ত মানুষই নিজেকে দেখতে পায় তার আদি সত্তায়; এই মানুষই সৃষ্টির আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে এই ভাষায়- ‘মাের চোখ হাসে, মাের মুখ হাসে, মাের টগবগিয়ে খুন হাসে, আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’ মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারি, এই কবির সৃজন-বেদন কতাে জেনুইন, কতো অব্যর্থভাবে এর অভিব্যক্তি ঘটেছে তাঁর কাব্যে!
ইকবাল এবং নজরুল বিশ্বাসের যে পরিমণ্ডলে লালিত ছিলেন, তার একেবারে মূলেই রয়েছে সৃষ্টির গােড়াতে এই স্বীকৃতি যে, মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে রাজাধিরাজ হয়ে, পৃথিবীকে, সৃষ্টিকে সে নিয়ন্ত্রণ করবে, সে কারাে দাসত্ব করবে না। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা তার এই স্বরূপ উপলব্ধির, তার এই আত্ম-সাক্ষাৎকারের বজ্রনির্ঘোষ। এই মুক্ত মানুষই ইকবালের ‘ইনসানে কামিল’, নজরুলের ‘পুরুষােত্তম সত্য’। মনগড়া বিধি-বিধান, কল্পিত দেব-দেবীর প্রভূত্ব, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দাসত্ব, সমাজ ও সংস্কারের গােলামি, রীতি-নীতির অন্ধনিগড় এসবই সৃষ্টিতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষকে তার মুক্ত চেতনার আঙিনায় নিজেকে চিনতে দেয় না। অথচ, সৃষ্টিমূলে মানুষই হচ্ছে বিশ্বের নিয়ন্তা। এই মুক্ত মনুষ্যত্বের বলিষ্ঠ উদাত্ত ঘােষণা আমরা দেখি নজরুল ও ইকবালের কাব্যে। সংস্কার, রীতিনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক নিগড়ে বন্দী, ঔপনিবেশিক জগদ্দল পাথরের নীচে পিষ্ট মানবতার মুক্তির জন্য কবি পুরাতন পৃথিবীকে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে চান। ইকবাল বলেন, এ আকাশ পুরােনাে, জীর্ণ হয়ে পড়েছে, তিনি একটা নতুন আকাশ চান। নজরুলের বিদ্রোহ শান্ত হবে না, যদি না পৃথিবী থেকে সর্বপ্রকার শােষণ জুলুম নিশ্চিহ্ন হয়েছে, অত্যাচারীরা নির্মূল হয়েছে। অর্থাৎ শােষণমুক্ত, স্বাধীন মানুষের পৃথিবী যতােদিন না সৃষ্টি হয়েছে। কবির সংগ্রাম চলতেই থাকবে। কবি চিরন্তন সংগ্রামের সৈনিক। ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’, বলে নজরুল করুণা উদ্রেক করতে চান না, তিনি অত্যাচারী রাজা ও শােষকের হাত গুড়িয়ে দিয়ে রক্ষা করবেন শােষিত ও দরিদ্রকে।
মানুষের খেয়ালী আইন, তথা বিধি-বিধান, যা ভেদবৈষম্য, শােষণ-জুলুমকে চির-স্থায়িত্ব দানের জন্য উদ্ভাবিত, তাই মানুষকে জিন্দাননায় বন্দী করে রাখে চিরকালের জন্যে। মানুষ যখন তার স্বরূপের মুখামুখি হয়, যখন তার ব্যক্তিসত্তা বা জ্ঞান বিকাশের পর পরমােৎকর্ষ অর্জন করে, তখন তার হাতই আল্লাহর হাত হয়ে ওঠে। তখন স্রষ্টাই তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত বা কর্মের শুরুতে বান্দাকে জিজ্ঞেস করেন, কী করলে বান্দা খুশী হবে। অর্থাৎ মানুষের যখন এই বিকাশ ঘটে তখন আল্লাহর ইচ্ছা আর মানুষের ইচ্ছায় কোনাে ভেদ থাকে না। খুদীর চরম উৎকর্ষের বদৌলতে মানুষ হয়ে ওঠে স্রষ্টার সহকর্মী। ঠিক তেমনি মানুষ যখন তার স্বরূপকে চিনতে পায়, তখন সংস্কারের সমস্ত বন্ধন, জাগতিক মানসিক দাসত্বের সকল শৃঙখল টুটে যায়। তখনি সে সােল্লাসে চিৎকার করে ওঠে- ‘জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষােত্তম সত্য’। জগদীশ্বর মানে জগতের অধিপতি, নিয়ন্ত্রক, শাসক। মােগল বাদশাহদের যখন বলা হতাে ‘দিল্লীশ্বরই জগতের ঈশ্বর’, তখন দিল্লীর রাজা বা অধিপতিই জগতের অধিপতি বা সম্রাট বুঝাতাে। নজরুল ইসলামের জগদীশ্বরও এই অর্থেই ‘ঈশ্বর’, সে জগতে কারাে গােলাম নয়, সে সৃষ্টিতে কারাে অধীন নয়, সে সৃষ্টির অধীশ্বর, তাইতাে কবি বলেন, ‘বলাে বীর চির উন্নত মম শির’। তার ললাটে, ‘রাজ রাজটীকা’, সৃষ্টিতে মানুষের এই নেতৃত্ব ও প্রভুত্বই কি প্রমাণ নয় যে, সে দাসত্ব করতে আসেনি, সে রাজাধিরাজ? নজরুল ইসলাম ও ইকবালের কাব্য সৃষ্টির অভিজাত, জগতের রাজাধিরাজ, এই মুক্ত স্বাধীন মানুষেরই বন্দনা। এই মুক্ত মানুষই সকল প্রকার দাসত্বের নিগড় থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য চিরন্তন জেহাদে লিপ্ত রয়েছে।
[প্রেক্ষণ (কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণ) : ঢাকা সাহিত্য শতদল, ১৯৯৫- সাহিত্য-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত।]