আম্মা- আমাদের আটপৌরে জীবনের কর্ণধার

0

 

আমাদের বাড়িটা ঠিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বাড়িগুলার মতো। যেই বাড়িতে মানুষে মানুষে গিজগিজ করে। কিচ্ছু নাই কিসিমের দুঃখ নিয়েও সব থাকার উল্লাসে মাতে। ঘরময় খিলখিল করে গোটা পরিবারশুদ্ধ হো হো করে হাসে, একসাথে আনন্দে দিন কাঁটায়। যেখানে সুখ-দুঃখের গল্পরা একত্রে বসবাস করে, আশা ও আনন্দের কথা গোটা-গোটা অক্ষরে দেয়ালে ছাপা থাকে, ব্যর্থতা ও সফলতার ফটোগ্রাফও টানিয়ে রাখে। বলতে গেলে আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে সব আছে, সব। যেমন ধরেন হুমায়ূন আহমেদের  ‘কোথাও কেউ নেই’র মুনা আছে, ‘নক্ষত্রের রাত’র মনীষা আছে, ‘আজ রবিবার’র কঙ্কা আপু, তিতলি আপু আছে। পড়তে পড়তে প্রায়ই পাগল বনে যাওয়া আনিস ভাই আছে, প্রিয় গৃহকর্মী যিনি নিজের মর্জি মতো চলেন সেই মতি মিয়া আছে, ‘এইসব দিনরাত্রি’র নীলু আছে, রোবটিক বর শফিক আছে, ভবঘুরে বেকার দেবর রফিকও আছে, সবাই আছে। শুধু ‘জননী’র ওই মা’টা নাই, তবে ছিলো। যতটা সময় ছিলো থাকার মতোই ছিলো, আষ্ঠেপৃষ্ঠে ছিলো।

 

আম্মা, দুই দুইটা বছর হতে চলল আপনাকে ছাড়া। আপনার রেখে যাওয়া ভালোবাসা বেচেই আমরা বেঁচে আছি। আপনি যতদিন ছিলেন শুধু দিয়ে গেলেন, এখন না থাকা আবস্থাতেও দিয়ে যাচ্ছেন। আম্মারা কি আজন্মকাল শুধু দিয়েই যান?

 

আমার আম্মা। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি সোজাসাপটা শক্ত কিসিমের মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্ব আকাশছোয়া। তাঁর জীবন ছিলো সংসার আর মেয়েদের ঘিরেই, তাদের জীবন সংস্কৃতি ঘিরেই। আম্মারে আমরা বলতাম- আম্মা আমাদের চলন্ত সুপারউইম্যান, আমাদের বাটুল দ্যা গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। আমি যখন প্রথম প্রথম স্কুলের বিভিন্নরকম প্রোগ্রামে বক্তব্য দেওয়া শুরু করি তখন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শুধু কাঁপতাম আর আমতা আমতা করতাম। আম্মার শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্যর কানাকড়িও বলতে পারতাম না। কিছুতেই কিছু হতো  না। তারপর আম্মা আমাকে একটা ম্যাজিক শিখিয়ে দিলেন, বললেন তুমি যখন বক্তব্য দিবা, মাইক্রোফোন হাতে জাস্ট ইমাজিন করবা- পোডিয়ামের সামনে শুধু একজন দর্শক। আমি, আমি আর আমি। বাদবাকি সব ব্লার, একদম ঝাপসা।

বিশ্বাস করেন আমার আম্মার এই ম্যাজিকের প্রথা অবলম্বন করে, আমি বেশ কয়বার সেরা বক্তব্যদাতার পুরস্কারও পেয়েছি। এইসব ম্যাজিক্যাল ব্যাপারগুলো যখন ঘটতো তখন মনে হতো আম্মা বোধহয় আমাকে আপাদমস্তক তরজমা করে রেখেছেন। এতো চমৎকার আর এতো নিখুঁত তরজমা ইহজন্মে আমারে আর কেউ করতে পারবে না।  

 

স্কুল লাইফে অলওয়েজ ফার্স্ট গার্ল হতাম, ফলত ফার্স্ট গার্লের তকমাটা রক্ষা করার জন্য হলেও একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করতাম না৷ কিন্তু আম্মা ছিলেন আগাগোড়া একজন সৌখিন মানুষ, আধুনিক মানুষ। সময়ের সাথে নিজেকে মানানসই করে নেওয়া অর্থে আধুনিক।  স্কুলের পড়াশোনার বাইরে সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপারে তাঁর ভিতরে এক ধরনের দরদ ছিলো। কার্যত আম্মার সৌখিনতার প্রভাব পড়ল আমাদের বোনদের উপর। নিজ মর্জিমতো ভর্তি করালেন হামদ শেখার প্রোগ্রামে, ভর্তি করালেন হারমোনিয়ামে গান শেখার একাডেমিতে, দিলেন আবৃত্তি চর্চা করতে, নিজ হাত ধরে ছবিও শেখাতেন। এসব চর্চার ভিতর দিয়ে কখন যে আমরা তিনবোনও সৌখিন হয়ে উঠেছি টেরও পাইনি।

 

 

আমাদের আম্মা আমাদের তিন বোনের জন্মদিন গোটা গোটা অক্ষরে মনে রাখতেন। মস্তিষ্কে না কেবল, কলবেও গেঁথে রাখতেন। একটু বড়ো হওয়ার পর যখন বুঝতে শিখি; তখন যা দেখতাম তা হলো—নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাস ডুকলেই আম্মা ঘনঘন ক্যালেন্ডার দেখতেন আর খুব খোশমেজাজে থাকতেন। জন্মদিনের দিন যত ঘনিয়ে আসতো আম্মার খোশমেজাজের খুশবু— আমাদের চারপাশে তত বেশি মৌ-মৌ করত। আম্মা আপনি জানেন নভেম্বর মাসে সায়মা-আরিফার জন্মদিনের এইসব দিনগুলোতে আমার খুব হাসফাস লাগে। সব আয়োজন থাকে, কানায় কানায় সব ভরপুর থাকে কিন্তু আপনি যে থাকেন না, আপনার যে অনুপস্থিতি আমাদের কাঁদায় আম্মা, আমাদের পোড়ায়। জন্মদিনে রান্না করা আপনার পায়েসের রঙটা এখনো কেউ আনতে পারে না। আপনার রান্না করা পায়েসে কি মেশাতেন আম্মা? এটা কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? জন্মদিনে, আমাদের খুব পায়েস খেতে ইচ্ছে করে, আম্মা।

 

 

আমি আমার পরিবারের পারিবারিক কৃষ্টি কালচার নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। আল্লার ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি ধর্মীয় কিছু কালচার আমাদের পরিবারে প্রতিষ্ঠিত আছে৷ দলবেঁধে খানকাতে যাওয়া, বৃহস্পতিবারের মিলাদ পড়া, শবে মেরাজ রাত উদযাপন, শবে বরাতে হালুয়া রুটির আয়োজন আর স্পেশালি ঈদে মিলাদুননবী। ঈদে মিলাদুননবীতে আপনি আমাদের বুঝাতেন, এটা আমাদের সবচে বড়ো ঈদ, আনন্দের দিন। আমাদের ঈদে মিলাদুননবীর প্রতি প্রেম, মোহাব্বত আপনি অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন।  আমরা বছরে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন সর্বোচ্চ ভালো পোশাক পড়ার চেষ্টা করি, তারমধ্যে ঈদে মিলাদুননবী একটি। সবচে ভালো জামাটা ধুয়ে আম্মা নতুনের মতো করে রাখতেন আর আমরা সেটি পড়ে মিলাদ উদযাপন করতাম। সবচে ভালো ভালো পদ রান্না করতেন, মিষ্টান্ন তো থাকতোই। তারপর সন্ধ্যায় সবাই মিলে নাত গাইতে বসতাম। প্রতিবছর একই নাত, একই সুরে।

 

“আসমানোহি পর সব নবী রাহ গেয়ে,

আরশ আযমপে পৌঁহছা হামারা নবী…

ছবছে আওলা ও আলা, হামারা নবী,

ছবছে বালা ও আলা, হামারা নবী”

 

এই নাতটা গাওয়ার পর প্রথমে আম্মাই মুঠো ভর্তি করে হাদিয়া দিতেন। এইসব এখনো হয় আম্মা। এইসব কালচার আমাদের পরিবারে এখনো মজবুত। হৈহৈ রৈরৈ করে উদযাপন করা হয়।  আপনি যে নিশান লাগিয়ে দিয়েছেন তা আমরা সানন্দে বয়ে বেড়াচ্ছি আম্মা। আমাদের আনন্দ হয় এটাতে। এইবারে মিলাদুননবীতে খুব বৃষ্টি ছিলো আম্মা৷ জামেয়ার ময়দানে আব্বুর চোখের পানি বৃষ্টির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে৷ এই পানি ভেসে ভেসে যদি আপনার কবর ছুঁয়ে যায়, জানবেন- এটা আমার আব্বার চোখের পবিত্র পানি, যেই পানি প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে দরুদের সাথে ঝড়ে পড়ে।

 

 

এইতো সেদিনকার সন্ধ্যার আলাপ, আম্মা। ফ্লোরে সবাই বসে বসে এটা-ওটা আলাপ করে যাচ্ছিল, আর আমি খাটে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বেমালুম পড়ে আছি। মাঝেমধ্যে হু-হা করে আড্ডায় নিজেকে শামিলও রাখছি। হঠাৎ সায়মা বলে উঠল, “আপা— এবার সামনের ঘরের পুরোনা খাটটা ভেঙে ফেলব। এই খাটটা বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ-মাসেই এখানের জন্য আব্বুকে বলে নতুন একটা খাট কিনব।” আমার বুকটা মড়মড় করে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। চোখের পানিটা লুকাতে লুকাতে, দুই হাত দিয়ে খাটটাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছিলাম—শক্ত করে।

ফজরের নামাজের পর আম্মা এই খাটের কোনে বসত। এই খাটেই জায়নামাজ বিছিয়ে আম্মা নামাজ পড়ত আর মনভরে আমাদের জন্য দোয়া করত। প্রায়ই ঠিক দুপুরে, মাথার উপরে হাইস্পিড পাখা চলছে, আম্মা তাঁর ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এসে এই খাটে কিছুক্ষণ বসত আর বলত— আহ শান্তি!

 

সামনের রুমে এই খাটটিতে আমরা তিন বোন মিলে-ঝিলে ঘুমাতাম। এই খাটটি বেসিক্যালি আমাদের তিন বোনেরই। আম্মা প্রায়ই গল্প করতেন, এই খাটটির বয়স আর আমার বয়স নাকি সেইম-সেইম। কিন্তু আম্মার চলে যাওয়ার মাসখানেক আগে থেকে আম্মা নিয়মিত আমাদের সাথে এই খাটে ঘুমাতে শুরু করেন। তার আগে, আম্মা নিজের রুমেই ঘুমাতেন যার ফলে— আমি তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব একটা দেখতাম না। তবে সেইসময় আমাদের সাথে থাকায় আমি রোজ আম্মাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছি। আমি চোখের সামনে আমার জান্নাত দেখতাম। প্রাইসলেস দৃশ্য! সারাদিনের প্রাণচঞ্চল মানুষটা কত শান্তির সহজ ঘুম ঘুমাচ্ছেন—কি মুগ্ধতা আহ! আমার কলিজার মাঝে গোটাগোটা হরফে খোদিত সেই দৃশ্যকাব্য।

 

সায়মাকে বলতে ইচ্ছে করছে—আমাদের সামনের ঘরের খাটটি ভাঙ্গিস না প্লিজ।

এই খাটটি আমাদের সাথে বুড়ো হোক। পঁচে, গলে যাক। তারপরও রেখে দিস— যেমন সন্তান রাখে তাঁর বৃদ্ধা বাবা-মা’কে।

 

এই খাটে এখনো রোজ যখন উপুড় হয়ে শুই— মনে হয় আমি আমার আম্মার বুঁকে শুয়ে আছি। সেই হিম হয়ে আসা বুঁকের পাঁজর, আমিতো এটুকু নিয়েই বাঁচি। 

 

আম্মা যেদিন চলে যাবেন, সেদিন সকালবেলা কবুতরের স্যুপ খাওয়ালাম নিজ হাতে, এই খাটেই বসে। আব্বাকে বললাম রাতের জন্য ইলিশ আইনেন। রাতে আম্মাকে ইলিশ দিয়ে ভাত খাওয়াবো। মাগরিবে আম্মার জানাজা হলো। এখন—আমাদের বাসায় ইলিশ আসে, কিন্তু আমাদের আম্মা আর আসে না।

 

আম্মার খুউব পেট ব্যাথা হলে যে বালিশটা পেটে চেপে ধরে ঘুমাতো, সেই বালিশটা থেকে আমি একটি প্যাচপেচে মালিশের তেলের গন্ধ পাই। আম্মা পেটে যে তেলটা মালিশ করতেন—সেটিরই গন্ধ। আমি বালিশটা না ধুয়ে রেখে দিয়েছি আলমারিতে। সময়ে-অসময়ে বের করে আমার পেটের সাথে লাগিয়ে রাখি। আম্মার গায়ের  ঘ্রাণ পাই। জান্নাতি ঘ্রাণ।

 

আমি বলি, আমার আম্মা— আমি যেন দম আটকে মরে না যাই তার জন্য কত কিছু রেখে গেছে। আমি এখনো তাই বেঁচে আছি। হাপিয়ে পড়ি না এক মুহূর্তের জন্যেও। আম্মা, দেখেন— আপনার শক্ত কিসিমের একরোখা কন্যা কত নরম হয় গেছে। শিমুল তুলার মতো নরম।

 

 

আমাদের আম্মা আমার দেখা সবচেয়ে বিস্ময়কর নারী। আমার মনে আছে আমি প্রথম সারির ছাত্র হলেও একটু ভীত প্রকৃতির ছিলাম। আর আম্মার চোখ-মুখে সাহস। পরীক্ষার আগের রাতে দুআ করতাম আমার সিট যেনো জানালার পাশে পড়ে। ভাগ্য সবসময় সুপ্রসন্ন। বরাবরই আমার সব পরীক্ষার সিট পড়তো জানালার পাশে। প্রশ্ন ভুলে গেলেই জানালা দিয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকাতাম, সব উত্তর গড়গড় করে মনে পড়ে যেতো। ভার্সিটিতে শেষ বর্ষের পরীক্ষার সময় যেখানে সিট পড়লো তাঁর আশেপাশে কোনো জানালা নাই। প্রশ্নের উলটো পিঠে লিখলাম,  আচ্ছা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা কি করে জানলো জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিস্ময় আমার আম্মাটা আর নাই!

 

আপনার  কাজ করার ক্ষমতা আমাকে অবাক করতো আম্মা। একটা মানুষ এত প্রাণশক্তি কোত্থেকে পায়? আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আপনার পাকা চুল দেখার। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে বৃদ্ধ হওয়ার। আন্দরকিল্লা যখন যেতাম আপনার সাথে খয়েরি রঙের ওয়াকিং স্টিকগুলা দেখলে  বলতেন- “আমারে বৃদ্ধ বয়সে এই লাঠিগুলো কিনে দিস।” আম্মা আপনি যতদিন ছিলেন তরতাজা ছিলেন। প্রানচঞ্চল ছিলেন। স্বতস্ফুর্ত ছিলেন। আপনার কারোর উপর ভর করে চলার দরকার পড়েনি কোনোদিন। বরঞ্চ আপনার উপর ভর করে গোটা একটা পরিবার চলেছে। আম্মা- আপনি আমাদের খয়েরী রঙের ওয়াকিং স্টিক। আমাদের পথচলার লাঠি।

 

 

আম্মা, আমরা কত সঙ্গপ্রিয় ছিলাম তাই-না? সত্যজিৎ রায়ের পথের পাচালি, অপুর সংসার , ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম, তারেক মাসুদের মাটির ময়না, তারপর, আমাদের মা-মেয়ের প্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবন মেঘের দিন- এরকম কতশত কালজয়ী সিনেমা আমরা একসাথে দেখেছি, তা-না আম্মা? অল্পবয়সে যখন ওইসব সিনেমা দেখতাম সবাইকে বলে বেড়াতাম- আমি পরিচালক হবো। সিনেমার পরিচালক।  আপনি মিটমিট করে হাসতেন। মানাও করতেন না আবার সাঁইও দিতেন না৷ কিছু বছর খুব করে চাইতাম সিনেমার পরিচালক হবো, হবোই৷ একটা কালজয়ী সিনেমা বানাবোই। কিন্তু কিছুদিন পর, সিনেমার পরিচালক হবার ভূত যেতে না যেতেই আরেকটা ভূত এসে হাজির। ভূত এফএম৷ আরজে রাসেল এবং আরজে আলী আরমানের প্রোগ্রাম, রেডিওতে। মোবাইলে লাউডস্পিকার দিয়ে আমি আপনি একসাথে শুনতাম ভূত এফএম। আরজে শারমিন আর লাভ সিক বিপির প্রেম রোগ শুনতাম একা, হেডফোন দিয়ে৷ আর সবচে প্রিয় ছিলো আরজে কিবরিয়ার জীবনের গল্প। গল্পের শেষে আম্মা আর আমার দু’জনের চোখে জল থাকতো, মুছতে মুছতে ঘুমিয়ে পড়তাম। আরজে কিবরিয়ার শো শুনার পর বুঝলাম, অডিও হচ্ছে সবচেয়ে পাওয়ারফুল এবং জীবন্ত একটা মাধ্যম। তখন থেকে জীবনের লক্ষ্য পাল্টে গেলো, সিনেমার পরিচালক হবো না, আমি বিখ্যাত আরজে হবো। এসব ভূত একে একে নামলো।  আব্বার ইচ্ছে তার মেয়েরা স-ব শিক্ষক হবে। আম্মার স্পেসিফিক কোনো চাওয়া ছিলো না৷ আব্বার চাওয়াই তাঁর কাছে সব। পরিশেষে, সিনেমার পরিচালক হওয়া হলো না, আরজে টারজেও বাদ। এখন আব্বার ইচ্ছেতেই শিক্ষক হওয়ার প্রথম ধাপে। এখন প্রায় মনে হয় উড়োনচণ্ডী আমি কত কাম আর কুল, আম্মা দেখে যেতে পারলে খুব খুশি হতেন৷ তবে আমি জানি, আম্মা দেখেন আর মিটমিট করে হাসেন। হয়তো বলেন, তুমি আমার জীবন নিয়ে নির্মিত সিনেমার পরিচালক, তুমি আমার জীবনের গল্প বলা বিখ্যাত আরজে৷ আম্মা, আমি রোজ এখন আপনার স্মৃতি মাথায় নিয়ে ঘুমাই। আমার ঘুম ভালো হয়৷

 

 

মনে আছে ছোটোবেলায় বৃত্তি পরিক্ষার সময় আপনি শর্ত দিতেন, এবার বৃত্তি পেলে তুমি যা চাও তাই দিবো৷ সেইবার বৃত্তি পেলাম।  আপনার কাছে আমি চাইলাম মাউথ অর্গান। বললাম আপনি রান্নাঘর বা দূরে কোথাও গেলে আমি মাউথ অর্গান বাজাবো, আপনি চলে আসবেন। আপনি বললেন, আমি তো কখনোই তোমাদের থেকে দূরে যাবো না। কিন্তু আম্মা, এখন তো আপনি অনেক দূরে। কেন সেদিন মাউথ অরগান কিনে দিলেন না? আমি বাজালে আপনি আর আসতে পারবেন না সেই দুঃখে? বুকের ভিতর কোনো একটা জায়গায় আমার খুব কস্ট হচ্ছে, সেই জায়গাটার নাম কি আম্মা?

 

আমাদের খেলার সাথী, আমাদের সিনেমা দেখার সাথী, আমাদের রাত জাগা, আমাদের জুলুস করা, আমাদের আড্ডা দেওয়া, আমাদের বই পড়া, আমাদের জন্মদিন, আমাদের একসঙ্গে বেঁচে থাকা সবেতেই আপনি ছিলেন, ছিলেন গোটা উৎসবের মহীরুহ।

 

একজন সেকেলে মা কি করে এতো স্মার্ট হতে পারে তাঁর উত্তম উদাহরণ আপনার জীবনযাপন। আপনার চিন্তা চেতনা অন্য চার-পাঁচজন থেকে একদম আলাদা। ছোটো থেকেই দেখেছি আপনি ভাবেন, তবে ভিন্নভাবে। আপনার ভাবনার একটা পরিষ্কার জগৎ আছে। যেই জগতটা অনেক সমৃদ্ধ, অনেক উঁচুমানের। আম্মা, আমি আপনার সবটা পেতে চাই৷ জিন প্রক্রিয়ায় যদি সবটা দিয়ে যেতেন, আমিও হতাম আপনার মতো- মুশকিল আসান৷

 

এতোসব জীবন সংগ্রাম, এতোসব চড়াই-উতরাইয়ের পরও আপনি দাঁড়িয়ে ছিলেন খুঁটির মতো৷ যেটুকু সময় ছিলেন তরতাজা একটা প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিলেন। আমিও এভাবেই বাঁচতে বাঁচতে শেষ ট্রেন ধরে চলে যেতে চাই।

 

আম্মা, আপনার তিন কন্যা আপনার দেখানো পথেই চলছে৷ সহজ-সরল পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করছে। মানুষের কাছাকাছি বসবাস করবার জীবনযাপন করছে। আপনি বলতেন, পরিবারের সাথে সবসময় থাকা আর উৎসবের আমেজে একসঙ্গে থাকা একেবারেই আলাদা৷ আসলেই তাই আম্মা৷ আমরা এখন এটা ফিল করি। থাকা আর একসাথে থাকা বিস্তর ফারাক।

 

আম্মা, আজো আমি আবাবিল পাখির অপেক্ষায় আছি। যদি তারে দিয়ে আপনার কাছে আমাদের সুখে থাকার বার্তাটা পৌঁছানো যায় তাই।

বিশ্বাস করেন—আখেরে আপনার চলে যাওয়া আমাদের কাছে আপনার থেকে যাওয়ার মতোই রঙীন। চান্নিপসর রাতের ঢঙে ফকফকে রঙীন।

 

আম্মা আপনাকে বলি, আমাদের সকল অর্জন আপনার। আমাদের সকল উপার্জন আপনার। সন্তান হিসেবে আপনার কদমে সব উৎসর্গ। আপনার মতো উৎফুল্ল-আহ্লাদি মা দুনিয়াতে বিরল। আম্মা, জানেন? কলম থেকে বের হওয়া প্রতিটি কালির ফোটা বেয়ে আমার চোখের জল কাগজে টপটপ করে পড়ছে। আমার কলবে ‘আম্মা’ নামে যে গাছটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন আপনি, তা নাড়া দিলাম, আর এতগুলা ফলমূল পড়লো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের মতো- আপনার প্রিয় শব্দ- বেজে উঠে আমার কলবে। আপনাকে কদমবুসি, আম্মা।

১৬-৭-’২২

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না