স্মৃতিবিলাস : পঞ্চদশ পর্ব

0

চতুর্দশ পর্বের পর…

 

জিদ থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে জিদও ভালো!

 

আব্বা বলতেন, ‘সবার উপরে রাগ করতে নেই। কার উপর রাগ করার অধিকার আছে সেটা যেমন ভাবা উচিত, তেমনি রাগের ফলে নিজের লাভ-ক্ষতির বিষয়টিও অবশ্যই আগে ভেবে দেখা উচিত। মনে করো, তোমার বসের উপর যদি তুমি রাগ দেখাও, তাতে তোমার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি এর ফলে তোমার চাকরিরও বারোটা বাজিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আমি যদি তোমাদের উপর রাগ করি, তাতে কোন ক্ষতি নেই আমার, উল্টো তোমরা চিন্তা করবে কিভাবে এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যায়। কারণ তোমাদের সবরকম প্রয়োজনে আমাকে ভীষণ প্রয়োজন।’

 

কথাটা মাথায় রেখেছি জীবনভর। রাগ করেছি, জিদ করেছি মেপে মেপে। নিজের কষ্টগুলোকে সবসময় লুকিয়ে রেখে হাসি আর আনন্দকে বিলিয়ে দিয়েছি সবার মাঝে। অনেকটা ঝলমলে রোদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘনকালো মেঘের মতো। নির্মম সত্যি কথাটাও আব্বা বাস্তব জীবনের আলোকে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন। একটা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নয়, তিনি ছিলেন আমাদের সারাজীবনের শিক্ষক। এমনকি মৃত্যুর সময় নিজ হাতে লিখে লেমিনেটিং করে প্রত্যেক ছেলেমেয়ের নামে ফাইলে রেখে যাওয়া অছিয়তনামাটি এখনও আমাদের আলোর পথ দেখায়।

 

তখন আমি বেশ ছোট, স্কুলে ভর্তি হইনি। মেজো আপা একটা বাসায় টিউশনি করতে যেতেন। আমিও তাঁর সাথে যেতাম। আপার ছাত্র -ছাত্রীরা আমাকে গাছ থেকে রঙ্গন, বেলিফুল তুলে মালা গেঁথে দিত। ওরা বারান্দায় পড়তো। আমি সিঁডিতে বসে নিজের মনে খেলতাম। পড়ানো হয়ে গেলে পেট্রোল পাম্পের সামনে দিয়ে হেঁটেহেঁটে বাসায় ফিরতাম। প্রতিদিন একই পথ, একই বাড়ি, একই খেলার উপাদান, তবুও আপার পিছু ছাড়িনি। পথে চলতে চলতে রাস্তার যানবাহন দেখিয়ে আপা আমাকে গণনা করা শিখিয়েছিলেন।

 

একদিন আপা কলেজে যাবেন, এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জরুরী কাজ রয়েছে তাঁর। বায়না ধরলাম, আমিও যাবো। আপা এটা ওটার লোভ দেখান, কিছুতেই কাজ হয় না। সময় চলে যাচ্ছে দেখে অবশেষে তিনি আমাকে বললেন, ঠিক আছে, চলো আমার সাথে। বাসা থেকে বের হয়ে কবরস্থানের পথ ধরে এগিয়ে মোড়ের কাছে ছুটেমিয়ার দোকান, তার একটু সামনে গেলেই সেজো খালাম্মার বাসা। ঐ বাসার গেটে এসে আপা বললেন, তুমি ভেতর থেকে সুন্দর করে পা ধুয়ে এসো, পায়ে এমন ময়লা দেখলে লোকে আমাদের খারাপ বলবে। আমি সরল বিশ্বাসে হাত-পা ধুয়ে গেটের কাছে ফিরে এসে দেখি, আপা সেখানে নেই। পরের গল্পটুকু আপার মুখেই অনেকবার শুনেছি। তিনি আমার প্রতি নিজের স্নেহ-মমতার কথা বোঝাতে গিয়ে এই একই ঘটনা কতবার যে বলতেন, ‘সেদিন কলেজে গিয়ে কাজের চাপে আর অন্যকিছু মাথায় ছিল না। বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ জিনুর কথা মনে পড়লো। প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে খালাম্মার বাসায় ঢুকে শুনি ও নেই! একছুটে বাসায় যাই, বাসায়ও যায়নি সে। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে একা একা কোথায় গেল! ভয়ে আব্বা-আম্মা’র কাছেও কিছু বলি না। হন্যে হয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি খুঁজতে থাকি। একই পথ ধরে দশ-বিশবার খুঁজি। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ধীরেধীরে হাঁটছি, হঠাৎ ছুটেমিয়ার দোকানের নিচ থেকে কেমন ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আসে। ছোট্ট মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে সুপারি পাতার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দোকানের নিচে ঢুকে পড়েছে। চার-পাঁচ ঘন্টা সময় কি আর কেউ একটানা কাঁদতে পারে! সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে কেবল জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। একটানে বের করে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে নিজেও কাঁদতে থাকি, ‘যদি তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে যেত?’
‘তাহলে আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলে চলে গেলেন কেন?’
এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার শক্তি আপার ছিল না। তিনি আমাকে এটা সেটা কিনে দেবার কথা বলেন। নতুন জামা বানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিছুতেই কাজ হয় না। অবশেষে তখনই বাজারে নিয়ে জামা বানিয়ে দেয়ার শর্তে বাসায় যেতে রাজি হই। জমজম বস্ত্রালয় থেকে খুব সুন্দর হলুদ রঙের মধ্যে কালো চেকের একটা রুমাল ছাটের ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমি চোখ বন্ধ করলে এখনও অবিকল জামাটা দেখতে পাই।

 

ছোটবেলায় মেজো আপার কাছেই আমার সব আবদার ছিল, খাওয়া, ঘুম, পড়াশুনা, নতুন কাপড়… সবকিছু। বড়বেলায়ও সেসব কথা বলতেন তিনি নিজে, আদর করতেন নিজের সন্তানের মতো, কখনও মনে হতো তারচেয়েও বেশি, যখন তিনি বাসায় আমাদের দাওয়াত দিয়ে মেয়েদের বলতেন, “আজ তোমাদের খেতে বলবো না, আজকের সব আয়োজন কেবল আমার ভাই-বোনদের জন্য।”

 

আমার জন্মের কিছুদিন পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশাল সংসারের দায়িত্ব, শারিরীক অসুস্থতা সবদিক মিলিয়ে পেরে উঠছিলেন না। তখন ছোট ভাই-বোনদের ছোটখাট সব কাজ বড়রা করে দিতেন। যেহেতু আমার জন্মের অনেক আগে বুবুর বিয়ে হয়ে যায়, তাই মেজো আপাই আমার দেখভাল করতেন তখন। মা এবং আপা, দু’জনের প্রতি মায়া, ভালোবাসা ঐ বয়সে একইরকম মনে হত আমার কাছে।
বাগেরহাট পৌঁছালে যেখানেই থাকি, কিছুক্ষণের মধ্যে আপাও সেখানে হাজির হতেন। জোর দাবী নিয়ে এসে বলতেন, “ আমার বাসায় কবে যাবে? যত কম সময়ই থাকো না কেন, একদিন কিন্তু থাকবে আমার সাথে।”

 

আপার জীবনে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। উনার মেজো মেয়েটি তার প্রথম সন্তান জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। সিজারের পর একদিনে ১৪ ব্যাগ রক্ত তার শরীরে দেয়া হয় মাত্র আট ঘন্টায়। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। রাত এগারোটায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেয়েটা। শরীরের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হয়ে মুহূর্তেই সব শেষ। মাত্র ২৮ বছর বয়সে হারিয়ে যায় চিরতরে। সৌভাগ্যক্রমে ফারজানার মেয়ে শিশুটি বেঁচে আছে, মায়ের রেখে যাওয়া নামটি নিয়েই বড় হচ্ছে। আয়াত সেই নাম, চেহারাও পেয়েছে অবিকল তার মায়ের। রাস্তার ওপাশেই দাদার বাড়িতে থাকতো বাচ্চাটা। আপার দ্বিতলার ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িটা দেখা যেত। সারাদিন ঐ চেয়ারে বসে থাকতেন তিনি, নাতনিটাকে দেখার জন্য।

 

আমার সাথে শেষবার যখন আপার কথা হয় তাঁর বাসায়, ফারজানার ছোটবেলার ফ্রক পরা ছবিগুলো নিয়ে এসে দেখালেন। সবগুলো ছবি লেমিনেটিং করে হাতের কাছে রেখে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরপর ছুটে গিয়ে দেখেন। কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “তুমি কী এত লেখালেখি করো, আমার মতো অভাগার কথা লিখতে পারো না? জলজ্যান্ত মেয়েটা খুন হয়ে গেল…।”
সে কি কান্না! আমরা তিন বোন সেদিন একসাথে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম!

 

প্রচণ্ড পরিশ্রমী মানুষটির সমস্ত সত্ত্বা অল্পদিনেই বিকল হতে শুরু করে। স্ট্রোকের পর স্ট্রোক। এলোমেলো কথা বলা, মাসের পর মাস নির্ঘুম রাত, দুলাভাইয়ের অসুস্থতা, আর নিতে পারেনি আপার শরীর। একেবারে বিছানায় পড়ে যান। প্রথম প্রথম একটু একটু কথা বলতেন। ছেলেমেয়ে, ভাইবোনদের চিনতে পারতেন। ধীরেধীরে মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের সমস্ত অঙ্গ অকার্যকর হতে শুরু করে। খাওয়া দাওয়া করেন না ঠিকমত। প্রায় নিষ্প্রাণ অবস্থায় একবার দেখা হয়েছিল। কি যে নির্মম বাস্তবতা! কাউকে চিনতে পারেন না, কথা বলেন না কারো সাথে। কিছুক্ষণ পরপর জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আল্লাহ!
করোনাকালে প্রায় একই সময়ে বড় দু’বোনের স্ট্রোক হবার পরে ভয়াবহ বিষাদ নেমে আসে আমাদের জীবনে। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে মেজো আপা ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর পরপারে পাড়ি জমান।

 

যদি কারো জানতে ইচ্ছে হয়, আমি কখনও জিদ করেছি কি না, তবে বলবো হ্যাঁ, সারাজীবন জিদ করেছি। অবশ্যই নিজের সাথে এবং মেপে মেপে। নিজের খারাপ সময়ের শিক্ষা নিয়ে ভালো সময় খুঁজেছি। আব্বার শেখানো পথ ধরে মানুষ হবার চেষ্টা করে চলেছি কেবল। তুলনা করি নিজের সাথে। এখনও নিজের বর্তমান আর অতীতের শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ বুনি।
চলবে…
আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না