স্মৃতিবিলাস – দশম পর্ব

0

বম পর্বের পর…

 

দূরে কোথাও গিয়ে উচ্চশিক্ষার অনুমতি পাওয়া গেলো না পরিবার থেকে, তাই অন্য অনেক সহপাঠির মতো মেডিকেল বা বুয়েটের কোচিং করা হলো না আমার, এমনকি ফর্মও পূরণ করা হলো না। নাই মামার চেয়ে কানামামা ভালো, এই বিশ্বাসে অতঃপর খুলনা বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগটাকে মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ যেন নেমে এসেছিল আমার হাতে। প্রাণীবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিলাম, প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হলাম উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে। কিন্তু থাকবো কোথায়? ১৯৯৩ সালে বাগেরহাট থেকে খুলনা, দৌলতপুরে যাওয়া-আসা এত সহজ ছিল না। বাসা থেকে রিকশায় বাসস্ট্যান্ড, এরপর বাসে করে রূপসা ঘাট, লোকাল বাস হলে কাটাখালি গিয়ে আবার বাস পরিবর্তন করতে হতো। নৌকা বা ফেরীতে করে রূপসা নদী পার হয়ে আবার লোকাল বাস বা টেম্পুতে করে কলেজ গেটে নামতে হতো। এ তো কেবল যাওয়া, ফেরার সময় আবার একই পথ।

মানুষ যত সহজভাবে কোনকিছু চিন্তা করে, জীবন কখনো কখনো তারচে’ও অনেক অনেক বেশি জটিলতায় পূর্ণ হয়ে যায়!

 

খুলনা বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তখনও মেয়েদের জন্য কোন হল চালু হয়নি। একটা নতুন হল নির্মাণ হয়েছে, তবে কবে চালু হবে সে ব্যাপারে কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। একেবারে অচেনা জায়গায় কোন মেসেও আব্বা রাখতে চান না, ফলে খুলনায় থাকার বিষয়টা নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।

 

ভর্তি হবার পর কয়েকদিনের জন্য আব্বা আমাকে খুলনায় এক খালার বাসায় রেখে গিয়েছেলেন। কিন্তু এক-দুইদিন যেতে না যেতেই খালা আমাকে ডেকে একটা চিঠি হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমার আব্বার কাছে পাঠিয়ে দিও।  আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী রবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল, ওদের বাসাও আমাদের বাসার কাছাকাছি। রবি তখন খুলনা-বাগেরহাট যাওয়া আসা করছিল প্রতিদিন। ওর হাতে-হাতে চিঠিটি দিতে বলেছিলেন। ঐ সময় আমি একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম, আসলে আমার সন্দেহ হয়েছিল! মাত্র দু’দিন হলো আব্বা গেছেন, সপ্তাহ শেষে আবার আসার কথা, এর মধ্যে কি এমন জরুরী প্রয়োজন হলো যে, চিঠি পাঠাতে হচ্ছে? চিঠিটি খুলে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম জেনে, যে আমাকে বাসায় রাখতে তাদের খুব সমস্যা হচ্ছে, আব্বা যেন এসে আমাকে দ্রুত নিয়ে যান সেই অনুরোধের কথা দিয়ে চিঠিটি আদ্যোপান্ত সাজানো। খালু বেশ রাগী মানুষ ছিলেন, তাই হয়ত খালা ওভাবে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 

তখনও কিশোরী মন আবেগে পরিপূর্ণ, খুব অভিমান হয়েছিল। রবিকে দিয়ে বাসায় খবর পাঠিয়েছিলাম, আমি আর খালার বাসায় যাচ্ছি না। ক্লাস শেষ করে ইতি’র সাথে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ইতি আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী। ওরা একসময় বাগেরহাট ছিল। ওর আব্বা বাগেরহাট জেলার তথ্য অফিসার ছিলেন, তখন আমার আব্বার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ইতির তিনবোন আমাদের তিনবোনের সাথে পড়াশোনার করতো, সেভাবেই ওদের পরিবারের সাথে আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ইতির আব্বা-মা আমাকে তাদের বাসায় থাকার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন কিন্তু ওদের বাসায় তেমন পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না। দুটোরুমের একটাতে কাকু-কাকিমা থাকতেন, অন্যটাতে তিনবোন ও ওদের ছোট ভাইটা থাকতো। এরমধ্যে একদিন থাকাও সমীচিন নয়, তবুও আব্বা আসার অপেক্ষায় তিনটি দিন কাটিয়ে দিলাম।

 

আব্বা সম্ভবত আগেই বিভিন্ন জনের সঙ্গে আমার থাকার বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন, এরপর তিনি এসে আমাকে খালিশপুরে দুঃসম্পর্কের এক ফুপুর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করলেন। অনার্স প্রথম বর্ষ এভাবেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে কেটে যাচ্ছিল। ফুপা মারা গেছেন, ফুপুকেও তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ টানাটানির মধ্যে চলতে হতো, তাই কিছুদিন পরে তিনিও আমাকে রাখতে অপারগতার কথা জানিয়ে দিলেন।

 

আমি বাড়িতে যাবার পর চিকেন পক্স হয়েছিল, বেশ কিছুদিন তখন বাড়িতে ছিলাম। এরমধ্যে আব্বা একবার খুলনায় গিয়ে বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়েছেন কোথায় আমার থাকার ব্যবস্থা করা যায়। দুঃশ্তিন্তাগ্রস্থ হয়ে তিনি বেশ অন্যমনস্কভাবে খালিশপুর কাস্টমস হাউসের সামনে দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন পেছন থেকে একটা গাড়ির মধ্য থেকে কেউ একজন ‘স্যার…, স্যার…’ বলে ডাকছেন। আব্বা বিস্মিত হয়ে তাকালেন, এখানে কে তাঁকে ডাকবে এভাবে! ততক্ষণে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে সামনে এসে সালাম দিয়ে বললেন, “আমাকে চিনতে পেরেছেন, স্যার? আমি জালাল। নোনাডাঙা বাড়ি, আপনার স্কুলের পিয়ন ছিলাম। এখন কাস্টমস কালেক্টরেট স্যারের গাড়ি চালাই। আমার সাথে চলেন, পাশেই আমার বাসা।”

জালাল ভাই আব্বার মুখে সব কথা শুনে বললেন, “স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে বোনকে আমার বাসায় আপাতত রাখতে পারেন। অবশ্য কাঁচা মাটির ঘর, গোলপাতার ছাউনি দেয়া, কাস্টমস অফিসের ভেতরে পরিত্যক্ত জায়গায় আমার মতো অনেক ড্রাইভার এমন ঘর তৈরী করে আছে।”

আব্বা বাসায় ফিরে সব বললেন, শুনে আমি বেশ আশাবাদী হলাম।

কারণ ঐ মুহূর্তে আমার কাছে ভালো কোন বাসায় থাকার চেয়ে পড়াশুনার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভয়ও হচ্ছিল, যদি শেষমেষ পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ আমার বড় পাঁচবোনের প্রায় সবারই এইচএসসি পরীক্ষার আগে বা পরে বিয়ে হয়ে গেছে। জালাল ভাইয়ের কাঁচা মাটির ঘরে থাকতেই রাজি হয়ে গেলাম। ভাই-ভাবী দু’জনেই অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তাদের চমৎকার সাহচর্য ও আতিথেয়তা আমাকে শুধু মুগ্ধ করেনি, বাস্তব জ্ঞান অর্জনেও সহায়তা করেছিল। গোলপাতার ছাউনি দেয়া বড় একটা ঘর, ভেতরে আসবাবপত্র দিয়ে পার্টিশন করা ছিল, উনাদের তিনটি ছেলেমেয়েসহ থাকতেন, সাথে আবার স্বেচ্ছায় আমার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ঘরটির বাইরে একটা ঝুল বারান্দার মতো ছিল, সেখানে জালাল ভাই ও ভাবীর ছোট ভাই দু’জন থাকতো। একজন খবরের কাগজ বিলি করতো, অন্যজন কিছু একটা করার জন্য ট্রেনিং করছিল সম্ভবত। ঐ ঝুল বারান্দার মধ্যে একটা চৌকি ও একটা টেবিল গায়েগায়ে লাগানো ছিল। ঐ টেবিলে উনাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সন্ধ্যায় আমি পড়তে বসতাম। ওরা আমাকে ফুপু বলে ডাকতো। আমিও ঐ পরিবারের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম। তবে ভাগ্যে বোধহয় একটানা সুখ লেখা ছিল না। কিছুদিনের মধ্যে আবার আশ্রয়স্থল নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম…!

 

চলবে…

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না