৭১ এর আগের বাঙ্গালি বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস খুব একটা গৌরবে উজ্জ্বল নয়। দীর্ঘকালের পরাধীনতার ইতিহাসে বাঙ্গালি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধনে-মানে, সব দিক দিয়েই মোটামুটি পিছিয়ে আছে, যা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যুদ্ধের সময় আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রচুর। পরাধীনতায় গায়ে লেপ্টে যাওয়া অপূর্ণতা দূর করে এবার সৌন্দর্যমণ্ডিত স্বরূপ প্রকাশ করার যে ইচ্ছা শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছিল, গত ৪৯ বছরেও তা যে অর্জিত হয়েছে, সেটা বললে সত্যের অপলাপ হবে। আর এই যে অর্জনের কথায় অপ্রাপ্তির ঢেকুর, এ বড়ই দুঃখ-বেদনা, লজ্জা ও গ্লানির। তোষণ আর পোষণে আমাদের গ্রহণের ব্যর্থতা আঙ্গুল দিয়েই যেন দেখিয়ে দেয় এই গ্লানি। এই যে অপূর্ণতা, এই অপূর্ণতার মূল কারণ অনুসন্ধানপূর্বক উদঘাটন জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন।
যেখানে বিশ্বপরিসরে উন্নয়নশীল পিছিয়ে পড়া দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে অশ্বগতিতে, সেখানে আমরা দিন-দিন পিছিয়ে যাচ্ছি ক্রমান্বয়ে। যার প্রাথমিক ও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হলো আমাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানের দারিদ্র্যতা। এই দারিদ্র্যতা আর্থিক দারিদ্র্যতার চাইতেও মারাত্মক; ঘাতক ব্যাধির চাইতেও ভয়ঙ্কর। সমাজের মন-মানসিকতা গঠনের পক্বতার স্থানে পঁচন ধরিয়ে দেওয়া এর ভয়াবহ পরিণতি। যা দৃশ্যমান হয় একেবারে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে।
আমরা এখনো নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটা আমাদের শিক্ষার্থী বা অন্যান্যদের কাছে পরিষ্কার করতে পারিনি। সুস্থ্ মানসিকতা বিকাশে নিতে পারিনি কার্যকর পদক্ষেপ। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছেঁয়ে গেছে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনায়। গণতন্ত্রের ধারক-বাহক সেজে বসে থাকা আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ, তদীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বর্তমানে এই অশ্লীলতা, বেহায়া ও বেলাল্লাপনাকে পৃষ্ঠপোষণ করে যাচ্ছেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। এরিস্টটল এরূপ দর্শনে বলেছেন, “গণতন্ত্রে দরিদ্ররাই শাসন করবে; তবে দরিদ্র থাকার জন্য নয়, সম্পদ ও সংস্কৃতিতে ধনী হওয়ার লক্ষ্যে।” এক্ষেত্রে এরিস্টটলের ইচ্ছা কিংবা বাণী সত্যতা পাওয়ার মতো সামাজিক কাঠামো বা ব্যবস্থা, কোনটিই আমরা একেবারে মৌলিক পর্যায় থেকেই শুরু করতে পারিনি। আর যার ভিত্তির নিশ্চয়তা নেই, তার ছাদ দেওয়া ভাসমান সমুদ্র দেখার মতই কাল্পনিক। আর যদি আকাশ কে সমুদ্র কল্পনা করে তৃপ্ত হতে চান, তবে যুক্তি-তর্ক বৃথা।
দর্শনের বরাতে বলতে গেলে আচরণকে আমরা অনেকটা স্ব-নির্ধারিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হিসেবে পেয়ে থাকি। তবে এই স্ব-নির্ধারিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দিকটি অনেকটা প্রভাবিত হয় তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার রোষানলে পড়ে। সুতরাং, পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি আমার চিন্তা-চেতনায় অশ্লীলতা ইঞ্জেক্ট করতে চায়, তবে আমার আচরণে তার সামান্য হলেও প্রভাব যে পড়বে, তা বহুলাংশেই স্বাভাবিক। আর এই সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়ন, মূল্যবোধের অঙ্গিকারবিহীন নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা, এসব আমাদের সমাজের মানসিক পরিপক্কতার পথের অন্যতম অন্তরায়। ধর্মীয় দিক থেকেই শুধু না, বাঙ্গালিত্বের মৌলিক পর্যায় বিবেচনায় আনলেও এই দিকটি আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির উপর বড় ধরণের হুমকি।
ফেসবুকের কল্যাণে চ্যাট হচ্ছিল ফিলিপাইনের এক ভদ্র-মহিলার সাথে। কথাপ্রসঙ্গে ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, বাঙ্গালি যে-সমস্ত মানুষের সাথে তিনি ইতোপূর্বে চ্যাট করেছেন, অধিকাংশই উনার কাছে কথার এক পর্যায়ে গিয়ে অশ্লীল ছবি চেয়ে থাকেন, পাঠাতে বলেন ‘ন্যুড’। ফলে উক্ত ভদ্রলোকেদের স্থান হয় ব্লকলিস্টে। আর এই লেখার প্রেক্ষিতেই আমি মনে করি, এই যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, এই আগ্রাসনের পরিণামেই ফিলিপাইনের মেয়ের কাছে ‘ন্যুড’ চাইতে দু’বার ভাবছেনা আমাদের ‘সোনার ছেলেরা’। যার ফলে, নিজের দেশের মানুষের ভাবমূর্তি অন্যের সামনে খুব বাজেভাবে ফুটে উঠছে।
হিসেব কষতে বসলে দেখা যাবে, এ তো সামান্য ফলাফল, একটা জেনারেল সিনড্রোম মাত্র। এর বাইরেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের অভাব আমাদের সকল ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে ধীরে-ধীরে। যার পরিণাম হয়তো অদূর ভবিষ্যতে গিয়ে এমন হতে পারে, ‘বাঙ্গালির সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায়, তাও আমাদের আগামি প্রজন্ম জানবে না’।
দাঁত থাকিতে দাঁতের মূল্য না বোঝা মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। কিন্তু এক্ষেত্রে না বুঝলে তা হবে আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতির উপর চরম অন্যায়। নিজেদের চোখের সামনে এভাবে উলঙ্গপনাকে প্রশ্রয় দিয়ে আমাদের শুদ্ধ সংস্কৃতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। বস্তুত, এমন কার্যকলাপ চিন্তাশীল মানুষ সহ্য তো করতে পারেন-ই না, বরং বহুলাংশেই ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় এনে বিচলিত, বিস্মিত, এমনকি আতঙ্কিত পর্যন্ত হয়ে পড়েন। সুতরাং, সময় থাকতেই এসব ক্ষেত্রে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ একান্তই জরুরি। পচন যা ধরছে, তা যেন সারা অঙ্গে ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে সকলের সাবধানতা একান্তই জরুরি বলে মনে গাঢ় ধারণা জিইয়ে রেখে দিলাম এ ক্ষণে।