মাস্টার আবুল কাশেম: অনবদ্য এক পথিকৃৎ

0

 

ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের তরে বিশেষণের সমারোহ থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ গুণসমূহের আধিপত্যের কারণে তাঁদের সাধারণ জীবন হয়ে যায় অনন্য, অনুস্মরণীয়। কেউ সেসব গুণ দিয়ে আত্মোন্নয়ন করেন, কেউ বা আবার গুণের বিস্তারে পরোপকারের মাধ্যমে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করেন। স্বীয় গুণের পরিধির বিস্তারে জগত যতবেশি উপকৃত হয়, ততই এসব ব্যক্তিত্ব অনুভব করতে থাকেন পরম সুখ, অপার তৃপ্তি। এই সুখের আবহ তাঁদের নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। জীবন নিয়ে ভাবনার পূর্বে স্রষ্টার সৃষ্টি, সৃষ্টির উপাদান নিয়ে ভাবনাটাকে তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা জ্ঞান করে থাকেন। তাই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের মাঝেও তাঁরা হয়ে থাকেন অনন্য পর্যায়ের, যাঁদের পরিচয় প্রদানে বিশেষ কোনো বিশেষণের উল্লেখ প্রয়োজন পড়ে না।

অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কাশেম এমন ব্যক্তিত্বের তালিকায় শীর্ষে অবস্থানকারী একজন সত্তা। শিক্ষকতার অবয়বে গঠিত এই সত্তা লালন করেছেন আরো বিবিধ, বিচিত্র চরিত্র। এই চরিত্র সমাজের প্রয়োজনে, সমাজের উপাদানের উপকারে। শিক্ষকতা তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হলেও এই পেশাকে তিনি পরিণত করেছেন অনবদ্য নেশায়। যে নেশায় তিনি ডুবন্ত ছিলেন, সূর্য কিরণ কিংবা সূর্য গমন কোনোকিছুই তাঁর নেশায় হতে পারেনি অন্তরায়। পরোপকারে মেতে উঠা এই চরিত্র শেষ শ্বাস গ্রহণ অবধি কাটিয়েছেন প্রকৃতির আলয়ে।

 

দক্ষিণ চট্টলার অসংখ্য ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, অগুনিত জ্ঞানী-গুণীর সমারোহে মুখরিত পটিয়া উপজেলার ইয়াকুবদণ্ডী গ্রামে বিংশ শতাব্দীর (১৯৫৭) কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে ধরায় তাঁর আগমন। শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনায় হামেশা মেতে থাকতো তাঁর আপনালয়। পাড়ার পটু-দাপুটে ছেলে হিসেবে যেমন পরিচিত ছিলেন, তদ্রুপ সমাদৃত ছিলেন পাড়ার মেধাবী, চৌকস ছাত্র হিসেবে। প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলই এই খ্যাতির আনুষ্ঠানিক প্রমাণ বহন করে। শিক্ষাজীবনের কোনো অংশেই শ্রেণির প্রথম অবস্থানটা হাতছাড়া হতে দেননি আবুল কাশেম। চরিত্র মাধুর্যতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধার বিকাশসহ বিবিধ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমে আবুল কাশেম ছিলেন প্রথম সারির অন্যতম একজন। তাই তো শিক্ষাজীবনের পরতে পরতেই শিক্ষকবৃন্দের সুনজরে তিনি উজ্জ্বল ছিলেন, খ্যাতি ছিলো তাঁর বিচক্ষণতার। একজন আদর্শ ছাত্রের সমুদয় গুণের বৈচিত্র‍্যময় উপস্থাপন ছিলো তাঁর শিক্ষাজীবনে। প্রাথমিক পড়াশোনা বাবা-মার ছায়া ও গ্রামের মক্তবে শেষ করেন দুরন্ত কাশেম। সর্বোচ্চ সফলতার সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাবিলাসদ্বীপ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে গিয়েও ধারাবাহিক সাফল্য অব্যাহত থাকে। ক্লাসের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় সাফল্য অর্জনকারী কাশেম ১৯৭৬ সালে হুলাইন ছালেহ নুর ডিগ্রি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষা সমাপ্ত করেন। শিক্ষা জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দুই অধ্যায়ে ধারাবাহিক সাফল্যের পর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য অনার্সে যুক্ত হন পটিয়া কলেজে। দীর্ঘদিন যাবৎ একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাজীবন পার করায় ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়েছে কাশেম পুষ্পের সৌরভ। ক্লাসের সিনিয়র-জুনিয়র নির্বিশেষে অনেকেই তাঁর কাছে আসতো পড়াশোনা সংক্রান্ত বিবিধ সমাধা’ নিতে। আবুল কাশেমও পরম যত্নে পরিচয় নির্বিশেষে সবার প্রতি আন্তরিক থাকতেন। বহুমুখী প্রতিভাধর আবুল কাশেম ১৯৮২ সালে পটিয়া কলেজের পাঠ চুকিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৮৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়ও কাটিয়েছেন এক বর্ণাঢ্য সময়। মেধার স্বাক্ষর রেখে অর্জন করেছেন বিবিধ স্কলারশীপ। রঙিন শিক্ষাজীবনের সমাপ্তিতেই শুরু হয় নতুন অভিজ্ঞতা। শিক্ষাজীবনেই তিনি অন্যান্য ছাত্রদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এবং অপরকে শেখানোর প্রতিও ছিলো তাঁর আগ্রহ বিশেষ। তাই শিক্ষাজীবনের সমাপনান্তেই শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন ১৯৮৪ সালে। দক্ষিণ চট্টলা তথা চট্টলার প্রাচীন মাদরাসা, ঐতিহ্যবাহী শাহচান্দ আউলিয়া কামিল মাদরাসায় অধ্যাপনার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর শিক্ষকতার জীবন। শিক্ষকতার এই পেশা রূপান্তরিত হয় তাঁর নেশায়। তাই অধ্যাপনার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে এক বিশেষ স্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। মানবিক আবুল কাশেম শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাদির কথাও মনোযোগ দিয়ে জেনে নিতেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর এই মানবিক আচরণ তাঁকে শিক্ষার্থীদের হৃদয় গহীনে পৌঁছে দেয়। তাঁর এই উদারতা, মানবিকতা ও আন্তরিকতা ছিলো জীবন আঙিনায় প্রতিটি মুহূর্তে, এমনকি শেষ মুহূর্ত অবধি।

 

পরবর্তীতে তিনি আরো কিছু প্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়ান। রাউজান নুরুল উলুম, চট্টগ্রাম সোবহানীয়া কামিল মাদরাসা ও চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদরাসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার মাধ্যমে লব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৯ সালে যোগ দেন মহাদেশখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসায়। তাঁর শিক্ষকতার মূল আবেগ-অনুভূতি, শিক্ষকতার প্রকৃত ঘ্রাণ যেন তিনি এই প্রতিষ্ঠানে আবিষ্কার করেন। অতীত অভিজ্ঞতা ও চলমান অনুভূতির সমন্বয়ে সর্বোচ্চ উদ্যমে জামেয়ায় শুরু করেন নতুন এক পরিক্রমা। এই পরিক্রমা সময়ের পরিক্রমা, শিক্ষকতার পরিক্রমা, মানবিকতার পরিক্রমা, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মানের পরিক্রমা। চেষ্টায় সাফল্য আনে- প্রবাদটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জামেয়া আঙিনায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি স্তরেই ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করে নেন। বিশেষত, শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি করে নিয়েছেন বিশেষ অবস্থান। পেছনের সারির কোণের ছাত্রটাও গভীর মনোযোগী হতো তাঁর ক্লাসে। ক্লাস চলাকালীন শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরে থাকতো পিনপতন নীরবতা। ছাত্রদের মাঝে তাঁর বৈচিত্র্যময় সুপ্ত প্রতিভার যেমন প্রকাশ ঘটতো, অনুরূপ ছাত্রদেরও বিবিধ প্রতিভার প্রকাশে, প্রকাশ পরবর্তী লালন-পালনে তিনি ছিলেন অনন্য। প্রতিজন ছাত্রের প্রতিই তিনি ছিলেন আন্তরিক, স্নেহমহী ও উদার। শিক্ষকতা, মানবিকতা ও অগুনতি বিচিত্র গুণ তাঁকে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছে গভীরতম স্থানে। অনুরূপ, সহকর্মী-সহযোদ্ধা, পথের পথিক পরিচয় নির্বিশেষে সবাই পেতো তাঁর কোমল আচরণ, আন্তরিক দৃষ্টি। সর্বোপরি, শিক্ষকতার দায়িত্বের পাশাপাশি মনুষ্যত্বের অবস্থানেও তিনি খ্যাতিমান, সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অত্যন্ত সফলতা ও নিষ্ঠার সাথে জামেয়ায় প্রায় দুই দশক খেদমত করে যান। জীবনের শেষ শ্বাস গ্রহণ অবধি তিনি কাটিয়েছেন এই আঙিনাতেই।

 

শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য সাধনায় ব্রতী ছিলেন এই গুণী। বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকাসহ বাৎসরিক ম্যাগাজিনে তাঁর শব্দসম্ভারের মিলন ঘটতো অনবদ্য লেখনীর দ্বারা।

শিক্ষার্থীরা তাঁর শব্দচয়নে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সম্বোধন করে ‘শব্দসম্রাট’ হিসেবে।

তাঁর লেখনী সত্তাটা আলাদা করে বর্ণনাযোগ্য। মনোমুগ্ধকর শব্দের সমাহার, বাক্য গঠনের বৈচিত্র্যময় ধারা, সর্বোপরি প্রবন্ধ, কবিতাসহ সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিনা বাঁধায় লিখতে পারতেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিভিন্ন লেখনী সংশোধন করিয়ে নিতো তাঁর দ্বারা। বাচনভঙ্গিতে তিনি যেমন দৃষ্টিনন্দন, লেখনীতেও ছিলো তাঁর সমান পারদর্শিতা। বিশেষত, তাঁর হাতের লেখা ছিলো চোখজুড়ানো। শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রকাশ ঘটিয়েছেন কতিপয় লেখনী।

“প্রজ্ঞা, পারমিত ও অন্যান্য” নামে তাঁর একখানা কাব্য পুস্তক আছে। তাছাড়া “চেনা পথ অচেনা পথিক” নামে আছে আরেকটি চমকপ্রদ বই। মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা ব্যাকরণে বিষয়ে তাঁর আছে তিনটি স্বরচিত ব্যাকরণ বই। জীবনকালের সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি চেষ্টা করে গেছেন সাহিত্য সাধনায় আপন কিছু ছোঁয়া রেখে যেতে। জীবন ঘড়ি যদি আরো দীর্ঘ হতো, তবে এই সাধনার তালিকা হতো আরো দীর্ঘতর; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর দুনিয়ার আকাশ পেরিয়ে গহীন অন্ধকারে যাত্রা করেন তিনি। একজন মাদরাসা শিক্ষিত আলেমে দ্বীন না হয়েও তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামেয়ার হাজারো শিক্ষার্থীদের দ্বারা তাঁর শেষ বিদায় মুহূর্তের দৃশ্য, বিবেকবান মানুষমাত্রই নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবনার উদ্রেক ঘটাবে নিঃসন্দেহে। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত আপন গ্রাম হুলাইন এয়াকুবদণ্ডীতে তিনি শায়িত আছেন। বছরব্যাপী তাঁর অগুনতি শিক্ষার্থী কবর যিয়ারতে যায় এবং বাৎসরিক একবার ওফাতবার্ষিকী আয়োজন হয়। রাব্বুল আলামিন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চাসনে সমাসীন করুন। আমিন বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না