মজলিশের আলাপ || কবি হাসান রোবায়েতের সাথে আলাপ : ব্যক্তি-মানস-জগত

0

সমকালীন বাংলা কবিতার জগতে অতিচেনা মুখ কবি হাসান রোবায়েত। যে কোনো বিষয়কে গৌণ রেখে শিল্পকে মুখ্য করে তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার- অন্তত সমকালীন বাংলা কবিতায়। এবং তার একান্ত-চাওয়াটাই এটা যে, শিল্পই হয়ে উঠুক মুখ্য, আমরা পাই একটি ভালো কবিতা। এখনো পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে পাঁচটি: ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে (চৈতন্য, ২০১৬), মীনগন্ধের তারা (জেব্রাক্রসিং, ২০১৮), আনোখা নদী (তবুও প্রয়াস, ২০১৮), মাধুডাঙাতীরে (ঐতিহ্য, ২০২০), এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে (ঐতিহ্য, ২০২১), ; প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ তারাধূলিপথ। বলা চলে আসলে, কবিতাতেই বসবাস তার। আলাপে আছি আমি, মোহাম্মদ আবু সাঈদ। পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য, সংলাপে কবির কথাগুলো ‘বোল্ড’ করে দেওয়া হয়েছে। আলাপের রস উপভোগ্য করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য বক্তার উচ্চারণ-ভঙ্গি হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। আশা করি পাঠককুল আলাপের দ্বিতীয় অংশটিও উপভোগ করবেন।

 

আলাপ

সাহিত্যের মধ্যে তো অন্য অনেক কিছু ছিল— কবিতাকে আপনি কেন বেছে নিলেন?

ব্যক্তিগত জীবনে আমার খুব ইচ্ছা ছিল, অ্যাস্ট্রাফিজিক্সে গবেষণা করা। কবির চাইতে ম্যাথমেটিশিয়ান , সায়েন্টিস্টকে আমার বেশি মেধাবী মনে হয়, এইটা আমার কুসংস্কারও হইতে পারে।

কবির জন্য কি মেধা জরুরী?

এটা তো ডেফিনেটলি মেধার ব্যাপার।

মেধা বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন, তার অনেক কিছু জানতে হবে…

না না, মেধার ব্যাপারটা ওইটা না; ওই যে বললাম, বাই বর্ন বা গড গিফটেড একটা ব্যাপার। 

আমার হ‌ইছে কি, ফিজিক্সের প্রতি একটা টান ছিল, সেই টানটা এখনো আছে। তো একটা পর্যায়ে আমার মনে হ‌ইলো, একজন ফিজিসিস্ট বা পদার্থবিজ্ঞানের কোর টাইপের কোনো বিজ্ঞানী, ওই টাইপের কোনো ব্যাপার আমার দ্বারা সম্ভব না, মনে হয় আমার ভিতরে নাই। ওইটার প্রতি আমার ভালবাসা আছে, কিন্তু ওই মেধাটা আমার নাই। যার কারণে কবিতার দিকে আমার ঝুঁকে পড়া। 

এখন কবিতার জগৎটা কেমন লাগতেছে?

আসলে আমি তো কিছু একটা হ‌ইতে চাইছিলাম, হয় পদার্থবিজ্ঞানী নয়তো অন্য কিছু।

অন্য কিছু বলতে…

অন্য কিছু বলতে ধরেন, আমি কবিতা লিখি, দুই চারজন আমাকে কবি হিসেবে গুরুত্ব‌ও দেয়। হ্যাঁ, এটা আমি এনজয় করি। 

আপনি কবে থেকে কবিতা লেখা শুরু করছেন?

যদি ওইভাবে বলেন ছোটবেলাতেই তো লিখছি দুই চারটা ছড়া… 

না, আমি বলতেছি…

হ্যাঁ, সেটা হচ্ছে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। সিরায়াসলি আমার মনে হলো লেখালেখিই করবো আমি, করা যায়। 

মাঝে কি কোনো বিরতি ছিল?

হ্যাঁ, অনেকদিন তো লিখিনি। 

আপনার প্রথম ব‌ই কবে প্রকাশ?

২০১৬ সালে, ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে— এটা প্রথম প্রকাশ হয় চৈতন্য থেকে। এই ব‌ইটাই আবার ২০১৮ সালে ভারতীয় সংস্করণ বের হ‌ইছে। 

ওইটাতে কেমন সাড়া পাইছিলেন, প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে?

ব্যাপক। ধরেন যে, একজন তরুণ কবি যেভাবে সারা পায়, আমাদের সোসাইটিতে জিনিসটা যেভাবে ফুলে উঠে আর কি, ব্যাপারটা এমন না যে লাখ লাখ মানুষ… হ্যাঁ, কবিতার সোসাইটিতে প্রথম ব‌ই থেকেই একটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হ‌ইছে আমাকে। 

আচ্ছা, এখনো পর্যন্ত কয়টা ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করছেন?

ট্র্যাক তো চ্যাঞ্জ করার চেষ্টা করছি, এখন সত্যিকারর্থে ট্র্যাক চ্যাঞ্জ হ‌ইছে কি না তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল, এটা পাঠকরা বলতে পারবে। যেমন ধরেন আমার প্রথম বই ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের পর বের হলো মীনগন্ধের তারা, ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে। এখানে ব্যাপার হচ্ছে, ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের হাসান রোবায়েত বা টেক্সট, মীনগন্ধের তারায় কিন্তু ওই টেক্সটটা আর নাই। একদমই ভিন্ন একটা ট্র্যাকে চলে গেলাম— এটা আমার মনে হয় আর কি! পাঠক কিভাবে দ্যাখে সেটা আমি জানি না। এবার মীনগন্ধের তারার পর আসলো এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে, সেটা তো আমার মনে হয় মানুষ জানেই যে, মীনগন্ধের তারা থেকে এটা একদম আলাদা। 

হ্যাঁ।

এরপরে মাঝখানে কলকাতা থেকে একটা বের হলো আনোখা নদী— ওটা একদমই আলাদা। তারপর মাধুডাঙাতীরে— মাধুডাঙাতীরে যেহেতু আপনি নিজেই পড়ছেন, তো আপনি বুঝতে পারবেন, মাধুডাঙাতীরের ট্র্যাক কিন্তু আগেরগুলোর সাথে মিলবে না। সো, আমি বারবারই ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করছি। আমার ব‌ইয়ের যে ব্যাপারটা— ব‌ই থেকে ব‌ইতে— ফর্মে বলেন, স্টাইলে বলেন, এগুলো চ্যাঞ্জ করার চেষ্টা করছি। আমি চাইছি, আমার একটা ব‌ই যেন আরেকটা ব‌ইয়ের ছায়া না হয়। 

এই ছায়া পড়াটাকে কি সমস্যাজনক মনে করেন, কবিতার জন্য?

আমার নিজের কাছে মনে হয়।

মানে, সেইদিক থেকেই আপনি চ্যাঞ্জ করেন?

হ্যাঁ, আমি একটা জিনিস ঘুমন্ত মার্কারি ফুলেতে পাই, সেটাই যদি আমি মীনগন্ধের তারায় পাই তাহলে আমি মীনগন্ধের তারা কেন পড়বো? আমার কিসের ঠ্যাকা পড়ছে, অ্যাজ অ্যা পাঠক। ওই জায়গা থেকে আমি বারবার ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করার চেষ্টা করি। এই ব্যাপারগুলো আমার মধ্যে আসছে আসলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা থেকে। রবীন্দ্রনাথ‌ও বারবার ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করছেন।

 

আচ্ছা, একজন কবি কোনোভাবে ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করতে পারছে না, অনেক চেষ্টা করেও— নিজের সিগনেচার বা পথকে সে কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারতেছে না— এখন তার কি লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া উচিত?

অবশ্যই না। কারণ সে তো তার আনন্দের জন্য লেখে প্রথমত; আপনাকে আনন্দ দেওয়া তো তার আলটিমেট উদ্দেশ্য না। হ্যাঁ, ফাইন, আপনি আনন্দ পাচ্ছেন না তাহলে কমেন্ট করতে পারেন— ভাই আপনার লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া উচিত— 

সে লিখতেই পারে…

সে কি করবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার ভালো না লাগলে আপনি তাকে নিয়েন না! দ্যাখেন, আমি আমাকে নির্দেশ দিতে পারি যে, রোবায়েত তুমি আর লিখো না, তোমার লেখা হচ্ছে না; কিন্তু আমি আমার সমসাময়িক বন্ধুকে নির্দেশ দিতে পারি না যে— এই, তুমি আর লিখো না, তোমার কিছু হচ্ছে না! এটা আমি বলবো না কখনো। কারণ, সে ভাই তার জন্য লেখে। তার জন্য মানে, তার আনন্দটাই প্রথম। 

না, অনেকে তো সমাজের জন্য‌ও লেখে…

তাহলে সমাজের লোকেরা তাকে বলবে।

 

কবিতা দিনশেষে কবিতার জন্য‌ই শুধু?

আমি প্রথম থেকেই একটা কথা বলে আসছি, কবিতাকে একটা আর্ট হয়ে উঠতে হবে। এরপর সমাজ যদি কবিতা থেকে কিছু পায় তাহলে ঐটা সমাজের একটা বিরাট পাওয়া হবে আর কি! 

 

আচ্ছা, আপনি যে বললেন প্রথম ব‌ইতে অনেক সাড়া পাইছেন আপনি; এখন কবির জন্য পাঠকের মন্তব্যটা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

পাঠকের কোন্ মন্তব্য— মাতবরিমার্কা মন্তব্য? 

না, শিল্প সাহিত্যের জায়গা থেকে, মানে সে বুঝে কবিতার ব্যাপারটা— ও‌ইরকম।

এটা তো কাইন্ড অফ মাতবরিমার্কাই হবে। পাঠকের মাতবরিমার্কা মন্তব্যকে আমি কখনোই গুরুত্ব দেবো না— নম্বর ওয়ান। কারণ, তার কাছে আমি যাবো না, সে আমার কাছে আসবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, তার যদি খারাপ লাগে সে বলবে, বলা উচিত— কারণ তার নিজের খারাপ লাগা থেকে সে বলবেই যে, ভাই এটা ভালো লাগে নাই। পাঠককে এতো গুরুত্ব দেওয়ার আসলে আমার মনে হয় কিছু নাই। হ্যাঁ, কেউ যদি বলে যে, আপনার ব‌ইটা পড়ে ভালো লাগছে— এটা শুনতে নিশ্চয়ই ভালোই লাগে। কিন্তু মাতবরিমার্কা কথাবার্তা…

পছন্দ না?

আমি নেবো না। কারণ, সে আমাকে কী দেবে আসলে? উপদেশ? তার উপদেশ দিয়ে আমি কি করবো? 

দিনশেষে যারা পণ্ডিতপাঠক তার তো উপদেশ‌ই দেয়।

পণ্ডিতদেরকে আমি আরও টাইম দেই না। এইখানে আমার একটা ব্যাপার আছে, কবিতা লেখার ব্যাপারে সে কি আমার চেয়ে বেশি ক্রিয়েটিভ? 

আপনার অগ্রজ, সিনিয়র কবি— সে যদি উপদেশ দেয়? সে তো আপনার চেয়ে ভালো বুঝবে।

সে আমার চেয়ে কবিতা বেশি বুঝলে সে আমার চেয়ে ভালো লিখছে নিশ্চয়ই। সে যদি আমার চেয়ে ভালো লিখে থাকে তাহলে তার দুয়েকটা কথা শোনার চেষ্টা করলেও করতে পারি।

কিন্তু জরুরত না?

তা অবশ্যই না। আর  তার যদি ভালো লেখা না থাকে, তাইলে  তো তার সাথে কবিতা নিয়া কোনো আলাপ‌ই নাই।

 

উৎসাহ, অনুপ্রেরণার জায়গা থেকে কি পাঠকের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ না?

ওটা কৈশোরকালীন কবিদের জন্য দরকারি। কিন্তু যারা কাজ করে বসে আছে, বা কাজ করতেছে তাদের জন্য আসলে পাঠকের ইন্সপায়ারেশন কিছু যায় আসে না। 

আপনি এ পর্যন্ত কোন্ ব‌ইয়ের ব্যাপারে পাঠকের দিক থেকে বেশি সাড়া পাইছেন?

এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে। 

সেটা কি নামের কারণে না টেক্সট…

না, নামের কারণে নিশ্চয়ই শুধু না, তবে নাম একটা ফ্যাক্ট ছিল। কিন্তু যখন পাঠক আমাকে জানাইছে— লিখিতভাবে জানাইছে তো; আমার কাছে এই ব‌ইয়ের উপর লিখিত প্রায় আট থেকে নয় হাজার শব্দের রিভিউ আছে। যেগুলো আমি নানান ধরনের পাঠক থেকে পাইছি। অনেকে আমাকে কবিতার লাইন ধরে ধরে জানাইছে; সেজন্য আমার মনে হয় না এটা কেবল নামের কারণে ঘটছে। আপনি নাম দেখে যেটা কিনলেন, ভেতরে ভালো না লাগলে সেটা ফেলে দিবেন; কিন্তু ভালো লাগলে সেটা ফেলবেন না। ব‌ইটার দ্বিতীয় সংস্করণ এসেছে ঐতিহ্য থেকে; তার মানে ব‌ইটার সেলিব্রেশন আসলে কমে নাই। আমার ধারণা, এইটার সেলিব্রেশন আরও বাড়তে থাকবে, আস্তে আস্তে। 

 

কেউ যদি বলে, রোবায়েতের একটা কবিতা দাও—আমি তাকে বুঝবো, আপনি কোনটা দিতে বলবেন?

আমি যখন ব‌ইয়ে কোনো কবিতা রাখি— লেখার কথা বলতেছি না— ব‌ইয়ে যখন রাখি তখন প্রত্যেকটা কবিতার ব্যাপারেই মনে করি, এইটা আমার সবচেয়ে ভালো কবিতা।সো, একটা কবিতা দেওয়া আমার জন্য মুশকিল। 

যদি একটা কাব্যগ্রন্থের কথা বলি…

হ্যাঁ, এখানে একটা ব্যাপার আছে; যেহেতু আমি ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করছি। আপনি আপনার পছন্দের জায়গা থেকে বলতে পারেন যে, এইটা আমার ভালো লাগছে। কিন্তু ওইটাই সবচেয়ে ভালো কাজ আমার— এটা বলা মুশকিল। কারণ আমি ট্র্যাক চ্যাঞ্জ করি। হ্যাঁ, একেক ট্র্যাকে একেক ধরনের ভালো লেখা আছে। 

কোন্ ট্র্যাকে কাজ করে সবচেয়ে বেশি সফল, সার্থকতা, ভালো লাগছে?

আমি বললাম তো, ব‌ইতে যখন কোনো কবিতা রাখি তখন সেটা আমার‌ই কবিতা। 

সেটা বুঝছি। তারপরও একটা গড়পরতার ব্যাপার আছে, ১-২-৩’র ব্যাপার আছে…

এটা বলা মুশকিল আমার জন্য। এটা আসলে ঠিক করবে যারা ব‌ইগুলো নেবে। আমি কাউকে বলবো না যে, আপনি এটা নেন। আমার যা আছে আমি সব‌ই বলে দিবো; আমি তো বলবো, আমার সব‌ই পড়েন। কারণ, ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট থেকে আপনি কেন বঞ্চিত হবেন।

তাহলে কি আপনি কোনো কবির কবিতা বাছাই করতে নারাজ?

আমার নিজের কবিতা বাছাই করতে অবশ্যই আমি নারাজ। তারপরও যদি ধরেন, করতেই হয়, জোর করে— প্রথমত তার জোর মানতে চাইবো না; দ্বিতীয়ত বাধ্য হয়ে কিছু কবিতা তো বাছব‌ই। এখন আসলে কোনো কবিতা নিয়ে ইন্সট্যান্ট বলা যাবে না, সব পড়ে বলতে হবে। 

 

বেশ কিছুদিন ধরে আপনি রাসুলকে নিয়ে, কুরআনের বিভিন্ন আয়াত কবিতায় ঢেলে সাজাচ্ছেন; ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা টোন হিসেবে ইউজ করতেছেন। কিন্তু শিল্প সাহিত্যে ‘প্রগতিশীল’ যে দল আছে, তাদের মতে ধর্মকে কবিতার বিষয় হিসেবে নেওয়া মানে পশ্চাৎপদতা। এই ব্যাপারে কি বলবেন?

প্রথম কথা হচ্ছে, শিল্প সাহিত্যে ধর্মকে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করলে সেটা পশ্চাৎপদতা কেন হবে আসলে? তারা কেন মনে করে?

তারা আধুনিক জীবনে ধর্মটাকে কোনো বিষয় হিসেবে দেখে না, যেটা কোনো বিষয় হিসেবে দাঁড়াইতে পারে। মানে, তারা মনে করে আধুনিকতার জন্য ধর্মটা হুমকিস্বরূপ।

দ্যাখেন প্রথম কথা হলো, আমি তো মিশনারী না, পয়গম্বর না, আমি তাবলিগের লোক‌ও না যে, ইসলাম প্রচার করার জন্য রাস্তায় নামছি। আমি কবিতা লিখবো, এখন আমার কবিতার বিষয় একটা ধূলা কণা থেকে শুরু করে মিল্কি ওয়ে— আকাশ গঙ্গা যেটাকে বাংলায় বলে— বিষয় হিসেবে আমি কোনটা নিচ্ছি সেটা জায না করে তাদের উচিৎ পড়ে বলা বা অনুভব করে বলা যে, এটা আসলে কতটুকু কবিতা হয়ে উঠছে। আমি কিন্তু বারবার বলতেছি, আমার কাছে কবিতাটা ইম্পর্ট্যান্ট।

বিষয়টা না?

অবশ্যই না। আমি ওই বিষয়টাকে কবিতা করে তুলতে পারতেছি কি না সেটা আপনি দেখেন। 

এখন আমাদের মধ্যযুগ থেকে শুরু করে তো রাসুলকে নিয়ে অনেকেই লিখছে; এখন আপনি কেন লিখতেছেন?

কারণ আমি নতুন করে লিখতে পারি।

মানে, নতুনভাবে, নতুন স্টাইলে?

ডেফিনেটলি! নবীজিকে নিয়ে আমার যে প্রেজেন্টেশন সেটা তো একদমই নতুন। এরকম প্রেজেন্টেশন তো আমার চোখে পড়ে নাই; আপনার চোখে পড়লে বলতে পারেন। আমি তো নবীজির জীবনি লিখি নাই; আমাদের বাংলাদেশে নবীজিকে নিয়া যে ধরনের লেখা হ‌ইছে তা মূলত দুই ধরনের: এক. উনার জীবন দুই. স্তুতিমূলক। আমার জায়গাটা কিন্তু ভিন্ন; আমি যখন বলি গুহার‌ও হেরা থাকে যেমন মানুষের মোহাম্মাদ— এখানে আমার মনে হয় ভক্তির জায়গাটা নাই, এখানে জীবনটাও নাই। যেমন আমি যখন বলতেছি— যেখানেই ডাকা যায় মোহাম্মাদ সেখানেই মদিনা— এই মদিনাটা আসলে কি? এই মদিনাটা কি আসলে সৌদি আরবের মদিনা? আমি নবীজিকে দেখতে চাইছি বাংলার পারেস্পেক্টিভ থেকে, এই অঞ্চলের মানুষের কালচার থেকে, যেটা অবশ্যই নতুন। ব্যাপরাগুলো আমার মনে হয় নতুন করে ভাবা দরকার। রাসুলের যে গতানুগতিক সিরাত— এখন পর্যন্ত আমি করতে চাই নাই, ভবিষ্যতে করবো কি না জানি না। ভাববো আর কি! এখন পর্যন্ত রাসুলের যে প্রেজেন্টেশন করতেছি কবিতায়— আনডাউটেডলি সেগুলো আসলে কবিতাই। এবং সেগুলো আমার-ই কবিতা। 

এখন যারা দলবদ্ধভাবে বিষয় হিসেবে কবিতাকে দেখে— শিল্প, রূপ না দেখে কেবল বিষয়টাকে মুখ্য করে বিচার করা, এই টেন্ডেন্সি তো বাংলাদেশে বা বাংলা কবিতায় নতুন না— এই বিষয়টাকে কিভাবে দ্যাখেন? এইটা কি ক্ষতিকর না কবিতার জন্য?

আসলে কবিতার জন্য ক্ষতির কিছু নাই, যদি কবিতার নিজস্ব আর্টের যে জায়গা সেটা থাকে। আর ওটা হচ্ছে ভণ্ডামি— এটা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা, কবিতার সাথে ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার সমস্যা। আমার কবিতার সমস্যা হিসেবে আমি ফিল করি না। 

তারা তো এটা চাপাইয়া দিতে চায়, জোর জবরদস্তি…

সেটা তারা পারবে না তো! 

যদি কবির শক্তিশালী জায়গাটা থাকে?

ডেফিনেটলি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, রাসুল যে ব্যাপারটা— আমি তাকে ফিল করি, আমি তাকে ভালোবাসি। এখন আমার ভালোবাসার জায়গা থেকে আমি কী নিয়ে লিখবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। আমি আবারও বলছি, আপনি জায করেন আপনার যতটুকু কবিত্ব বোঝার ক্ষমতা আছে যে, ওইটা আসলে কবিতা হ‌ইছে কি-না! যদি কবিতা হয়— আপনার মন যদি কয় যে, এগুলা কবিতা হ‌ইছে, তাহলে আপনি চুপ থাকেন। আর যদি আপনার প্যাচাল পারার শখ থাকে তাহলে পারেন, আমার কিছু যায় আসে না।

আচ্ছা, আপনি তো কবিতা করতেছেন গত ৭-৮ বৎসর ধরে; আপনার উপর কোন্ বাংলা কবির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে?

এ পর্যন্ত যতগুলো ব‌ই প্রকাশিত হ‌ইছে— সবচেয়ে বেশি আসলে বলা মুশকিল— তবে কয়েকজন আছেন: উৎপল কুমার বসু, রবীন্দ্রনাথ, চণ্ডীদাস এবং অবশ্যই জীবনানন্দ ; যদিও অনেকে আমার উপর আল মাহমুদের প্রভাব নিয়ে কথাবার্তা বলে, কিন্তু এ পর্যন্ত প্রকাশিত ব‌ইগুলোর কোথাও আসলে আল মাহমুদের অবস্থান নাই, একদমই নাই। যদি কেউ বলে তাহলে তার পড়াশোনা নিয়া আমার সন্দেহ আছে।  

বুদ্ধদেবের কোনো প্রভাব আছে?

অবশ্যই না।

সমকালীন কোনো কবির কি প্রভাব আছে?

সমকালীন, আমার মধ্যে কারো প্রভাব নাই; সম্ভবত অন্য দুই চারজনের উপর আমার প্রভাব আছে।

এটা কি আপনি এনজয় করেন?

হ্যাঁ, এনজয় তো অবশ্যই করি। আমি প্রচারিত হ‌ইছি খুব অল্প— মার্কেট ওয়াইজ কথা বলতেছি— যখন অনেক বেশি প্রচার হবে তখন অনেক বেশি প্রভাব আসলে পড়বে, এটা বেশ মজার। 

 

আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপারে আসি। সাহিত্যের একদল বলতেছে, আধুনিক কবিতার সাথে নজরুলের কোনো সম্পর্ক নাই ; আরেকদল বলতেছে, আধুনিক কবিতা করতে হলে রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল হয়েই আসতে হবে। এখন আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

প্রথম কথা হচ্ছে, আমি আধুনিক কবিতা করি না; কবিতা করি। 

না, মানে আধুনিক বলে যেটাকে বোঝানো হয়…

আচ্ছা, আমাদের এখানে তো একটা জনপ্রিয়, ট্রেন্ডি ধারণা তো আছেই যে, নজরুল আধুনিক না। আমার মনে হয়, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব প্রমুখের টেক্সটের যে সিগনেচার, বিষয়, রূপকল্প— এটার উপর বেইজ করেই মূলত আধুনিকতাকে ডিফাইন করছে— এই ডেফিনেশন থেকে তো নজরুলকে আধুনিক বলার কোনো কারণ নাই, জসীম উদ্‌দীনকেও বলার কোনো কারণ নাই। কিন্তু আমি যখন কবিতা পড়ি, সেটা আধুনিক না পোস্ট-মডার্নের কবিতা না মধ্যযুগের কবিতা— এসব মাথায় রাখি না আসলে। 

আর, একজন কবির জন্য তো আধুনিক কবিতা লেখা জরুরীও না?

অবশ্যই না। হ্যাঁ, তার জন্য নতুন কবিতা লেখা জরুরী। নতুন বলতে যে কবিতাগুলো আগে লেখা হয় নাই। সেটা আধুনিক হোক আর মধ্যযুগের স্টাইলে হোক তা পরের আলাপ। 

 

ধরেন আমি কবিতায় নতুন; আমি জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব অনেককে পড়লাম— এখন তাদের প্রভাব আমার উপর প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ হলেও থাকবে— এটা কি আপনি মনে করেন?

শুরুর দিকে আসলে এটা (প্রভাব) থাকেই। 

এটা কাটাইয়া উঠতে কি অনেক সময় লাগে?

কারো কারো ক্ষেত্রে সময় লাগে, কারো ক্ষেত্রে লাগে না। আমরা জীবনানন্দকে দেখি, প্রথম বইয়ের মেবি নয় বছর পর দ্বিতীয় ব‌ই বের হ‌ইছে। মানে হলো, তিনি এই নয় বছর স্ট্রাগল করেছেন— আমার যেটা মনে হয়। তার একটা লম্বা সময় ধরে স্ট্রাগল করতে হ‌ইছে, আবার কারো ক্ষেত্রে হয়তো লাগে না, প্রথম ব‌ই থেকেই আলাদা। 

আচ্ছা, সামগ্রিক বাংলা কবিতায় কোন্ কবির প্রভাব সবচেয়ে বেশি? (এখনো পর্যন্ত)

সবচেয়ে বেশি জীবনানন্দের। 

কারণটা কি?

বাংলার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভালো কবিতা সম্ভবত জীবনানন্দের। 

এখন কেউ যদি না পড়ে, তাহলে তো প্রভাবটা পড়তেছে না?

(হেসে) কিছু কিছু প্রভাব আছে, বুঝছেন— ধরেন, আমি জীবনানন্দ পড়ছি, আমার মধ্যে সে আছে, কিন্তু আপনি জীবনানন্দ পড়েন নাই কিন্তু আমারে পড়ছেন, তো আমার ভেতরকার জীবনানন্দ কিন্তু আপনার ভেতর যাচ্ছে, কিন্তু আপনি টের পাচ্ছেন না— এমন কিছু কিছু প্রভাব থাকে। যে জীবনানন্দ সরাসরি পড়ে নাই, তার‌ও কিন্তু পড়ার সম্ভাবনা থাকে; পড়বেই তা বলতেছি না…

মানে, একটা সম্ভাবনা আছে?

তা নিশ্চিত। কারণ, আপনি জীবনানন্দ পড়েন নাই, কিন্তু অন্য কাউকে তো পড়ছেন— এখন সে-ও তো কারো দ্বারা প্রভাবিত— এভাবে তো আসতেই পারে। 

 

ভবিষ্যতে কি আপনার গদ্য— মানে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ— এসবে যাওয়ার ইচ্ছা আছে?

অলরেডি কিন্তু একটা আত্মজীবনীমূলক গদ্য আমার লেখা আছে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হাজারের বেশি শব্দের। ইতিমধ্যে শিরিষের ডালপালায় আমার একটা গল্প‌ও প্রকাশিত হ‌ইছে। আত্মজীবনীটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ, গদ্যে তো অলরেডি আছিই। 

গদ্য বলতে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে…

ইচ্ছা তো অবশ্যই আছে। এখন আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ দেবেন কি-না তা জানি না।

 

আপনার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ তারাধূলিপথ— এটা নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

যে ব‌ইটা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে একটাই বলার থাকতে পারে আর তা হলো: বেশি বেশি মানুষ কেনেন, বেশি বেশি পড়েন, আপনার মন্তব্য জানান। 

একটা ব্যাপার থাকে না যে, নতুন কিছু বলতে, নতুন কিছু শোনাইতে…

নিশ্চয়ই! আমি তো চাইছিই। এখানে একদমই ভিন্ন একটা জগতকে উপস্থাপন করছি। যে জগত হয়তো বা বাংলা কবিতায় এর আগে উন্মোচিত হয়নি। কাজটা যেহেতু হ‌ইছে, আমি ওয়েলকাম জানাবোই যে, এই জগতে ঢুকেন। 

আপনি সদর দরজাটা খুলে দিচ্ছেন— ওইরকম?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি যখন একটা ব‌ই পড়ি তখন সেই জগতে ঢুকে যাওয়া তো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 

আপনি কি প্রত্যাশা করেন যে, শিল্প সাহিত্যের জগতে ব‌ইটা নিয়া বেশ জমকালো আলোচনা হবে?

না, আমি প্রত্যাশা করি না। কারণ, আমাদের এখানে যারা শিল্প সাহিত্য করে তাদের অধিকাংশ‌ই  হিপোক্রেট। সো, এই প্রত্যাশা করে আমার লাভ নাই। আমার ব‌ইটা রিয়েলি ভালো হয়ে থাকলে সেটা আজকে বোঝা যাবে না; একটা ব‌ইকে অ্যাটলিস্ট একটা যুগ দেওয়া উচিত— আমার ধারণা। এক যুগ পর যদি একটা ব‌ই ফিরে আসে, তার অবস্থান আবার ঘোষণা করে তাহলেই সেটা ভালো ব‌ই। আজকে কিভাবে বলি! তবে সাড়া ফেলতেই পারে; আর সাড়া ফেলাটা খুবই ইন্সট্যান্ট একটা ব্যাপার। কিন্তু সাড়া ফেলা মানেই যে  গ্রেট আর্ট তা না; সো, সময় দেওয়া উচিত। 

(সমাপ্ত)

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না