একটি প্রত্যাবর্তনের গল্প : দিলীপ কুমার থেকে এ আর রহমান

0

 

‘আল্লাহ রাখা রহমান’ নামের কাউকে চেনেন? নাও চিনতে পারেন; চেনার কথাও নয়। কিন্তু এ আর রহমানকে নিশ্চয়ই চেনেন। হ্যাঁ, মিউজিক্যাল লিজেন্ড এ আর রহমানের কথাই বলা হচ্ছে। ৮১তম অস্কারের মিউজিক ক্যাটাগরিতে ডাবল অস্কার বিজয়ী একমাত্র ভারতীয় সংগীত পরিচালক তিনি। তার সুরে কোটি প্রাণে ছড়ায় মুগ্ধতা, ছুঁয়ে যায় মন। তবে তাঁর তারকা হবার পেছনের গল্পটা অনেকেরই অজানা। এক তামিল হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও এ এস দিলীপ কুমার থেকে এ আর রহমান হয়েছিলেন তিনি। তার প্রত্যাবর্তনের সে গল্পই আজ আপনাদের শোনাব। তবে গল্পটা আমরা জানব তার একটি ইন্টারভিউ থেকে, যা AR Rahman : The Spirit of Music বই থেকে সংগৃহীত। ইংরেজি থেকে বাঙলান্তরে মোহাম্মদ আবদুল ক্বাহহার

নিজধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে এ এস দিলীপ কুমারের অনেকগুলো কারণ ছিল। তন্মধ্যে প্রধান কারণ তার পিতা কে. শেখর-এর অকালপ্রয়াণ। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি। পিতৃবিয়োগে তার পরিবার নিদারুন অর্থকষ্টে পতিত হয়। এই মিউজিশিয়ান প্রথমে কী-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার মা কস্তুরি (মুসলিম হওয়ার পর করিমা বেগম) ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ণ। পরিবারের এমন দুরবস্থায় তার মা হাজির হন পীর করিমুল্লাহ শাহ কাদেরীর সাক্ষাতে। বলা যায়, এ এস দিলীপ কুমার থেকে এ আর রহমান হিসেবে প্রত্যাবর্তনের সূচনা এখান থেকেই।

 

কীভাবে সুফিবাদী জীবনধারার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এতটা প্রভাবিত হয়েছিল?

এ আর রহমান: সুফিবাদ আমাকে শিখিয়েছে যে, বৃষ্টি এবং সূর্য যেভাবে সব মানুষের জন্য সমান, তেমন-ই সব মানুষ পরস্পর সমান। মানুষের মাঝে কোনোরূপ বিভেদ তৈরি করা আমাদের উচিত নয়। বিচিত্র সংস্কৃতির মধ্যকার সম্প্রীতি ও পারস্পরিক বন্ধুত্বের সাথে যখন আপনি পরিচিত হয়ে উঠবেন, তখনই আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, সব সম্প্রদায়-সংস্কৃতিতেই ভালো মানুষ রয়েছেন।

 

আপনার পরিবার যখন একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছিল, তখন এই সুফিবাদের বিশ্বাস কি আপনাকে সহায়তা করেছিল?

এ আর রহমান: হ্যাঁ, অবশ্যই অনেকটা সহায়তা করেছে। শুরু থেকেই আমার মা ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ হিন্দু নারী। আধ্যাত্মিকতায় ছিলেন গভীর অনুরক্ত৷ হাবিবুল্লাহ রোডের যে বাড়িতে আমরা বেড়ে উঠেছি, সে বাড়ির দেওয়ালে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রতীকি ছবি ঝোলানো থাকত। যিশখ্রিস্টকে কোলে নিয়ে বসে থাকা মাদার মেরি’র একটা ছবিও ছিল। তাছাড়া পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীর একটা ছবিও ছিল।

১৯৮৬ সালে, আমার বাবার মৃত্যুর দশ বছর পরে কাদেরি সাহেবের সাথে আবারও আমাদের সাক্ষাত হয়। পীর সাহেব তখন খুবই অসুস্থ ছিলেন; আমার মা উনার সেবাযত্ন করলেন। পীর সাহেব আমার মাকে নিজের মেয়ের মতোই সমাদর করতেন। আমাদের সাথে তাঁর গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। সে সময় আমি উনিশ বছরের ছিলাম এবং বিজ্ঞাপনের জন্য একটি জিঙ্গেল কম্পোজের কাজ করছিলাম।

 

সে পীর সাহেব কি আপনাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেছিলেন?

এ আর রহমান: না, তিনি আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। সুফিবাদের পথে ফিরে আসতে কাউকে জোর প্রয়োগ করা যায় না। যদি আপনার মন সায় দেয়, তবেই আপনি এ পথ অনুসরণ করবেন। কাদেরি সাহেবের সাথে সাক্ষাতের আরও একবছর পরে ১৯৮৭ সালে আমরা হাবিবুল্লাহ রোডের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কদমবাক্ষামে (ভারতের চেন্নাইয়ের একটি স্থান) চলে আসি। সেখানেই আমরা এখনও সপরিবারে আছি।

পুরানো বাড়ি ছেড়ে যখন আমরা চলে আসছিলাম, তখন যিশুখ্রিস্টের একটি কথা আমার মনে পড়ল, “আমি চাই, তুমি শীতল হবে কিংবা উষ্ণ। কিন্তু তুমি যেহেতু কুসুমগরম—পুরো শীতলও নও, পুরো গরমও নও; তাই আমি তোমাকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করব।” যিশুখ্রিষ্টের এ কথা দ্বারা আমি যা বুঝেছিলাম, তা হলো—বিভিন্ন মতাদর্শে দোদুল্যমান না থেকে একটা নির্দিষ্ট পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয়। আর সুফিপথই আমার মাকে ও আমাকে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে সহায়তা করেছিল। আমরা অনুভব করেছিলাম, সুফিবাদই আমাদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা হবে। তাই, আমরা সুফি ইসলাম গ্রহণ করি।

 

ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তনের পর মানুষের সাথে আপনার সম্পর্কে কীরূপ প্রভাব পড়তে পারে—সে ব্যাপারে আপনার ধারণা কেমন ছিল?

এ আর রহমান: আমার পরিবার তখন থেকে কাজ করা শুরু করেছিল এবং আমরা কখনোই কারও ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। আমাদের আশেপাশের মানুষজন আমাদের নিয়ে খুব উৎসুক ছিল তেমনটা নয়। আমরা বংশানুক্রমিকভাবে সংগীতপ্রিয় এবং সংগীতের প্রতি এ অনুরাগ আমাদের বৃহত্তর সামাজিক স্বাধীনতা অবলম্বনে সহায়ক ছিল।

 

আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই যে, আমি শিখেছি—সব মানুষ সমান এবং মহান সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয়। আপনি সৌভাগ্যবান কিংবা দুর্ভাগ্যবান, রাজা কিংবা প্রজা, বেঁটে কিংবা লম্বা, ধনী কিংবা গরিব, সাধু কিংবা চোর, সুশ্রী কিংবা বিশ্রী—ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহান আল্লাহ সকলের জন্যই অপরিমেয় নেয়ামতরাজি বর্ষণ করেন। মহান স্রষ্টার ব্যাপারে অজ্ঞতা, অন্তর্দৃষ্টির অপ্রতুলতার কারণেই আমরা তাঁর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।

 

আপনার নাম এ আর রহমান কেন হলো—এ নিয়ে নেটিজেনদের মাঝে নানান কথা প্রচলিত আছে। সত্যিকারের গল্পটি কি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?

এ আর রহমান: এ কথাটা সবিশেষ সত্য যে, আমি আমার নাম (এ এস দিলীপ কুমার) মোটেই পছন্দ করতাম না। বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই এ কথা বলছি। আমার কাছে মনে হতো, কেমন জানি আমার নামটা আমার ব্যক্তিসত্তার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

সুফিবাদের পথে আমাদের যাত্রা শুরুর কিছুকাল আগে আমরা একজন জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম আমার ছোটো বোনের জন্মপত্রিকা (কোষ্ঠী/হরস্কোপ) বিচার করাতে; কারণ আমার মা চেয়েছিলেন তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিতে। এটা মোটামুটি সেই সময়ের কথা, যখন আমি আমার নাম পরিবর্তন করে নতুন পরিচয় লাভের জন্য মনে মনে খুবই ব্যগ্র ছিলাম। সে জ্যোতিষী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ বালকটি ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক।”

তিনি আমাকে কয়েকটি নাম জানালেন— আবদুর রহমান, আবদুর রহিম এবং বললেন, “দুটো নামের যে-কোনোটিই তোমার জন্য ভালো হবে।” তৎক্ষণাৎ ‘রহমান’ আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু জ্যোতিষী, কিন্তু তিনিই আমাকে আমার মুসলিম নাম দিয়েছিলেন।

সেসময় আমার মায়ের মনে হয়েছিল, আমার নামের পূর্বে ‘আল্লাহ রাখা’ যুক্ত করা উচিত। ‘আল্লাহ রাখা’ অর্থ— আল্লাহ রক্ষা করুক। আর এভাবেই আমি হয়ে গেলাম ‘এ আর রহমান’।

 

AR Rahman : The Spirit of Music বই থেকে অনূদিত ও পরিশীলিত।

 

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না