মজলিশের বই-আলোচনা || বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা সংগ্রহ : পাঠ-পর্যালোচনা : আব্দুর রহমান

0

 

‘…তবু রচিলাম কাব্য। এই গর্ব বিদ্রোহ আমার’। ১৯২৮ এর নভেম্বরে রচিত ‘মানুষ’ কবিতার শেষ লাইন এটি। কাব্য রচনাকে কবি ‘গর্ব বিদ্রোহ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যিনি কাব্য রচনাকে বিদ্রোহ বলে গণ্য করেছেন তিনি আর কেউই নন, বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাতদের একজন বুদ্ধদেব বসু। ঢাকার বুদ্ধদেব বসু। বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় মানুষ হওয়া বুদ্ধদেব বসু। ইনিই সেই বুদ্ধদেব বসু যিনি বাংলা সাহিত্যে ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারকে পরিচিত করিয়েছেন। যিনি কালিদাসের মেঘদূত অনুবাদ করেছেন বাংলায়। ইনিই সেই বুদ্ধদেব যার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা পত্রিকা। কবিতা পত্রিকার নাম আলাদা করে বলার কারণ হলো, আব্দুল মান্নান সৈয়দ কবিতা পত্রিকা সম্পর্কে বলছেন, ‘যা পঁচিশ বছর ধরে (১৯৩৫-৬০) সচল থেকে বাংলা কবিতাকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে নির্মাণ করে’। এই যে আধুনিক বাংলা কবিতা নির্মাণ করার কৃতিত্ব কবিতা পত্রিকার কাছে যাচ্ছে সেটারও কেন্দ্রীয় চরিত্র বুদ্ধদেব বসুই; যদিও সাথে আরও অনেকেই ছিলেন। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে স্বতন্ত্র পরিচয়, তা প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন বুদ্ধদেব বসু। হারিয়ে যেতে বসা জীবনানন্দকে নতুন করে চেনানোর কৃতিত্বও অনেকটা এই বুদ্ধদেব বসুর।

 

রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মাণে বুদ্ধদেবের ভূমিকা নানাবিধ। সম্পাদক, সমালোচক এমনকি প্রকাশক হিসেবেও; রাসবিহারী এভিনিউয়ের ২০২, ‘কবিতা ভবন’ই তার প্রকাশনীর নাম। কেবল এসব ভূমিকার জন্যই তাকে বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলে আখ্যায়িত করা হয় তা কিন্তু নয়। কবি এবং সাহিত্যের অন্যান্য দিকেও তার বিচরণ দারুণ। কেবল কবি হিসেবেই তার নিজের ও অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ আছে পঁচিশটি। আজকে আমরা যে বইটি নিয়ে আলোচনা করবো সেটি হলো, বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা। বইটি সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি অশোক সৈয়দ বা আব্দুল মান্নান সৈয়দ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এতে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা আছে ৫০টি। অনুবাদ ও কিশোর কবিতাসহ আরও ১০/১২ টি কবিতা এই বইয়ে যুক্ত হয়েছে।

 

বুদ্ধদেব বসুর কবিতা যেনো মানবমুক্তির বার্তা গেয়ে বেড়ায়। আর তার সেই বার্তা প্রতিফলিত হয় এই বইয়ের প্রথম দু’টি কবিতা- বন্দীর বন্দনা আর মানুষ কবিতায়। মানুষ কবিতায় শেষ দিকে গিয়ে কবি বলছেন,

‘শুনিনু মানুষ শুধু জীবসৃষ্টিযন্ত্রমাত্র নহে,

ক্ষুদ্র খর্ব পশুসম ক্ষীণজীবী নহে তার প্রাণ;

বিধাতার চেয়েও বড় – শক্তিমান, আরও সে মহান।’

কবি এই দুনিয়ার বুকে মানুষকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ কেবল অন্য মানুষকে জন্ম দেবে তা নয় বরং মানুষ আরও সৃষ্টিশীল, আরও শক্তিমান। তার কর্মের পরিধি হবে জগৎব্যাপি। একই তিনি এও বলেছেন মানুষের এই কর্মময়তা কামের চেয়েও বেশি সুখকর।

এই বইয়ে প্রাপ্ত কবিতা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার। সেটি হলো, বুদ্ধদেব বসু জীবন, মানবিক প্রেম ও যৌনতাকে ইতিবাচকভাবেই দেখেছেন। এবং এসবের সমষ্টিতে যে জীবন উদ্ভাসিত হয় সে জীবনের কামনাই করেছেন এসব কবিতায়। মানুষ যেমন কর্মী, তেমনি আবার প্রেমিকও। প্রেমিকপ্রেমিকের প্রার্থনাকোনও মেয়ের প্রতিএকখানা হাতকঙ্কাবতী ইত্যাদি কবিতায় মানব-মানবীর প্রেমের দিকটিতে আলোকপাত করেছেন কবি। তুলে ধরতে চেয়েছেন মন-শরীরের যুগলবন্দী প্রেমের জয়গান।

 

প্রেমে বিরহ আবশ্যক। আর বিরহের মধ্য দিয়েই আসে প্রেমের পরিপূর্ণতা। এবং এই পরিপূর্ণতাই মানুষকে পৌঁছে দেয় নিজেকে চেনার এক নতুন দিগন্তে। বুদ্ধদেবের এই চিন্তাধারাই প্রকাশিত হয়েছে বিরহ এবং এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে কবিতা দু’টির মধ্য দিয়ে। বিরহ কবিতায় কবি বিরহে কাতর হয়ে প্রার্থনা করেন,

‘ভ্রমর কালো ভ্রমর, ফিরে আসিস আর-বছর

চুপ করে তুই শুনবি তখন আর-একজনের স্বর।’

 

এই বুদ্ধদেবই আবার এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে কবিতায় দুনিয়ার তাবৎ প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে মানব সভ্যতার এগিয়ে যাওয়াকে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। মূলত এই বইতে বুদ্ধদেব বসুর সকল কবিতাই এই দ্যোতনা দেয়। দময়ন্তী কবিতায় কবি উচ্চারণ করেছেন, জীবনকে দেখার নব অঙ্গীকার। যেখানে প্রদীপ্ত যৌবন জরা, বার্ধক্য আড়ালে ফেলে এগিয়ে যাবে বলেই তার দৃপ্ত উচ্চারণ। একই কথা আরো প্রবল উচ্চারণে জানাচ্ছেন নির্মম যৌবন কবিতায়। এই বইতে আছে তার প্রকৃতি, প্রেমের নিদর্শনও। বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ নিয়ে তিনি লিখেছেন ইলিশ নামের কবিতা। সমর সেন, রমাকে উৎসর্গ করে লিখিত হয়েছে আরও কয়েকটি কবিতা।

 

মানব জীবনের রূপান্তরকে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছেন কাব্যভাষায়। তাই লিখেছেন, রূপান্তর কবিতাটি। মানুষ চিরতরুণ থাকতে পারে না। তার জরা, বার্ধক্য আসে। যৌবন একদিন ফুরিয়ে মধ্যবয়স আসে। সেই মধ্যবয়সের দুঃসহ একাকীত্বকে নির্মাণ করেছেন চল্লিশের পরে শীর্ষক কবিতায়।

 

মূলত বুদ্ধদেব বসুর সব কবিতায় জীবনঘনিষ্ট। পাঠককে জীবনের সাথে নির্মমভাবে বেঁধে রাখে তার কবিতা। ফলে মনে হতে পারে, কবিতার যে মিহিন, মসৃণ এগিয়ে যাওয়া সেটি বুদ্ধদেবের কবিতায় নেই। অনেকটা চাঁছাছোলা ঢঙে বর্ণিত হয় বাস্তবতা; এগিয়ে যায় কবিতা। শব্দের সাথে শব্দের গাঁথুনি ব্যাপক ঝাঁকুনি দিয়ে যায় পাঠককে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক যারা তাদের কাছে এই কবিতাগুলো তাই নতুন ধাঁচের মনে হয়ে পারে। আসলেই তাই। সমকালীন এবং পূর্বের অন্য অনেক প্রধান প্রধান কবির প্রভাব তার উপর খুব একটা পড়েনি। তিনি তার কবিতা নিয়ে দারুণভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এবং তার কবিতায় এত বেশি বৈচিত্র্য আছে যে আব্দুল মান্নান সৈয়দ তার কবিতাকে, কবিতা লেখা শেখার সবচেয়ে বড় ওয়ার্কশপ বলেছেন।

 

গতানুগতিক অনুবাদ কবিতা কখনোই মূলের যে ভাব সেটা দিতে পারে না। ফলে কবি যখন অনুবাদক হিসেবে অন্য কারো কবিতা নিজের ভাষায় অনূদিত করেন তখন আসলে সেটা আর পূর্বতন কবির কবিতা-ই থাকে না। সেটা হয়ে উঠে অনুবাদকের নিজস্ব গঠনের কবিতা। সেখান অনুবাদকের চিন্তাই প্রতিফলিত হয়। তবে সেসব ছাপিয়ে অনুবাদক যখন নিজের চিন্তার মধ্য দিয়ে মূল কবির ভাবনাকে প্রতিফলিত করতে পারেন তখন সেটা হয়ে উঠে কালোত্তীর্ণ শিল্প। তাই বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক অনূদিত কবিতাগুলো কতটুকু কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে তার রায় সময় দেবে; দিয়েছে। তবে একথা নিশ্চিন্তে বলা যায় এই বইয়ে গ্রন্থিত অনুবাদিত কবিতাগুলো প্রাঞ্জল এবং বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে বিদেশী সাহিত্যের দ্যোতনা দেয়।

সর্বোপরি, বুদ্দদেব বসুর কবিতা নিয়ে নানাজন নানাকথা বলতে পারেন। কিন্তু, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সুখপাঠ্য, জীবনঘনিষ্ট। জীবনের কর্মময় এবং প্রেমময় দিকের সমন্বয় নির্দেশ করে তার কবিতাগুলো। জীবন আলাদা আলাদা কোনো খণ্ডে নয় বরং সামগ্রিকভাবেই জীবন পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠে।

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না