মজলিশের গল্প || ফেরা : মোঃ তানিম-উল-ইসলাম

0

 

উচ্চতা ভীতিতে আক্রান্ত মহিম ট্রেনের ছাদে বসে আছে! জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন বোকা মানুষ চালাক হয়, ভীতু মানুষ সাহসী হয়। মহিম এমন কোনো মুহূর্তের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে কিনা তা বলার আগে আমি আপনাদের পেছনের একটা গল্প শোনাই। তার আগে বলে নেই: “রিনির আজ বিয়ে!”

খুব বেশি আগের ঘটনা না। এবং আমি আপনাদের যে ঘটনা বলবো সেটাও যে আনকমন কিছু তাও কিন্তু না। অনেকের জীবনেই এমনটা ঘটে। আচ্ছা একটু মিলিয়ে নিন তো!

বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠা মহিমের হঠাৎ খেয়াল হলো জিম করার। যেই ভাবা সেই কাজ। বাড়ির ছাদটাকেই বানিয়ে ফেললো জিম। নিয়ম করে সকাল সন্ধ্যা সেখানেই নানা রকমের কসরত চলতে লাগলো। তো এমনি কোন এক বিকেলে মহিমের সাথে দেখা হয়ে যায় আমাদের গল্পের রিনির! দেখা হওয়া মাত্রই প্রেম, ব্যাপারটা কিন্তু তা না। কিন্তু এটা যদি নাও বলি, সত্য বলা হবে; ঘটনা কিন্তু তাও না! আপনি দেখবেন আপনার কিছু অনুভূতির উৎস আপনি নিজেও জানেন না। কেন হয়, কিভাবে হয়, কি হয়; এই এতসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আপনার মাথা খারাপের মত হয়ে যায়। তো যা বলছিলাম, সেদিন রিনির ছিল বার্থডে। মহিম রিনির পাশাপাশি ছাদ। পাশাপাশি ছাদ হতেই পারে তবে পাশের ছাদের একটা মেয়ে বান্ধবীদের নিয়ে মহিমেরই পছন্দের নজরুল সঙ্গীত গাইবে এটা বোধহয় নাও হতে পারতো। কিন্তু যা হবার তা আপনি আটকাবেন কিভাবে!

 

আচ্ছা এ ছাদের ঘটনা থেকে আমরা আবার একটু মহিমের ট্রেনের ছাদে ফিরে আসি। সাঁই সাঁই করে ট্রেন চলছে। মহিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু ভাল করে যদি দেখেন আপনি দেখতে পাবেন মহিম কাঁদছে। কিন্তু জানেন সে শেষ কবে কেঁদেছে? জন্ম থকেই তার মুখে কথা বাধে। আমরা যাকে তোতলা বলি মহিম ঠিক তাই। এটা নিয়ে মহিমের পরিবারের কোন মাথা ব্যথাই ছিল না। সবাইকে যে সুন্দরভাবে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের সংবিধানে এমনতো কোন অনুচ্ছেদ নাই, তাই না! মহিম তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, কলেজে এসেছে রসায়নের নতুন টিচার। এই টিচার শরীরে যেমনি মোটা, তার হাতে ধরা বেতগুলোর সাইজও তেমনি মোটা।

 

ঘটনা ঘটলো মহিমদের ক্লাসে, স্বয়ং মহিমের সাথেই! রগচটা জব্বার আলী ক্লাসে ঢুকেই মহিমকে গতক্লাসের পড়া থেকে পড়া ধরে। মহিম দাঁড়িয়ে রীতিমতো তোতলাতে থাকে। ব্যাস জব্বার আলীকে আর পায় কে! সপাৎ সপাৎ করে মহিমের পশ্চাৎদেশে বেতের কয়েকটা ঘা বসিয়ে দেন জব্বার আলী। এরকম ঘা মহিম এ জীবনে কম খায়নি, কিন্তু ঘাটা সে যেখানে খেয়েছে এবং যেমন করে খেয়েছে তা ভাবতেই মহিমের কান্না পায়। সেই রাতে মহিম কতো কেঁদেছে তা জানে মহিমের সৃষ্টিকর্তা আর জানে তার বালিশ!

 

যাইহোক এবার মূল ঘটনায় প্রবেশ করি। তার আগে ছোট্ট একটা কথা বলে নেই। আপনাদের জীবনে কখনো কি এমন হয়েছে- যেটাকে ভেবেছেন আপনার জীবনের সবচেয়ে দুর্বল দিক সেটাই হয়ে ওঠেছে আপনার জীবনের উপরে ওঠার সিঁড়ি! মহিমের তোতলানোকেই রিনি ভালবেসে ফেলে। ভালবাসা এক অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার। এখানে কখন কী হয়ে যায় বলা মুশকিল। তো মহিম-রিনির ভালবাসা ভালোই চলছিল। দুজনের মাথায় ঘুরছিল তখন নানা ধরনের প্ল্যান। এই করবে, সেই করবে, জগৎ তারা পাল্টে দেবে। মহিম জগৎ পাল্টাতে পেরেছিল কিনা জানি না, তবে তার রেজাল্ট যে পাল্টে গিয়েছিল সেইটা বলতে পারি। পড়াশোনা তার আর ভাল লাগছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোকে তার মনে হতো ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। মহিমের খুব কষ্ট হত- কেনই সে রিনির তিন বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে! তা না হলে তো আজ একসাথে পড়া যেত।

 

গল্পটা মনে হচ্ছে ‘লুতুপুতু’ ‘পুতুপুতু’ টাইপ হয়ে যাচ্ছে তাই না! আমাকে এ ব্লেইম থেকে বাঁচাতেই বোধহয় রিনির জীবনে আবির্ভাব ঘটে রাতুলের! একটু আগেই কিন্তু বলেছি- ভালবাসা ব্যাপারটা অদ্ভুত। আর কালজয়ী ঔপন্যাসিক জহির রায়হানতো স্রেফ বলেই দিয়েছেন: ভালোবাসা জীবনে একবার আসে না, দুইবার আসে না, তিনবারও আসে না। সে আসে শত শত বার।

 

রিনি আবারো প্রেমে পড়ে যায়। প্রেমে পড়ে তারই ক্লাসমেইটের বড় ভাই রাতুলের সাথে। রাতুল তখন ভাল চাকরি করতো। বান্ধবীর বাসায় যাওয়া আসার মাঝেই রাতুলের সাথে কথা। কথা শুনেই রিনির ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! হয়তো মহিমের তোতলানো কথা শুনতে শুনতে রিনি তখন ক্লান্ত। আর এভাবেই যা হবার তাই হলো। রিনি রাতুলের নতুন প্রেম আমাদের গল্পের মহিমকে দূরে সরিয়ে দিতে লাগলো। এতোটাই দূরে, মহিমও শেষ পর্যন্ত বুঝে যায় তার জীবন থেকে রিনি নামের মেয়েটা হারিয়ে যেতে বসেছে। মহিম অবশ্য গত কয়েকমাসে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে। রিনিকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে করতে জিম করা ভুলে গেছে, মা বাবার শাসন বারণ ভুলে গেছে। ভুলে গেছে- ক্লাসে কিভাবে ফার্স্ট হতে হয়!

 

তো আগেই বলেছি, রিনির আজ বিয়ে। বুঝতেই পারছেন বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে। গত দুইদিন আগে মহিমের সাথে রিনির লাস্ট কথা হয়। রিনি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বারবার বলে- মহিম যেন নিজের প্রতি যত্ন নেয়, সে যেন একটুখানি ভাল করে পড়াশোনা করে। রিনির কথা শুনে মহিম শুধু হেসেছে। মহিমের হাসি দেখে রিনি জানতে চায় তার কারণ। মহিম আবারো হাসে। হাসি দিয়েই প্রকাশ করে মহিম তার হাসির কারণ। রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারি ছেড়ে, মহিমকে একা রেখে রিনি যখন চলে যাচ্ছিল তখনই মহিম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় আজকের এ দিনটার!

 

 

ট্রেন চলছে! মহিমের চুল বাতাসে উড়ছে। পকেটে মোবাইল ফোন বাজে। সে সেলফোনটা বের করে নিচে ফেলে দেয়। জীবনটাই আর রাখতে চাচ্ছে না মহিম, ফোন রেখে হবে কী! মহিম আস্তে-ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এখন তাকে একটা লাফ দিতে হবে। মহিমও প্রস্তুত। কিন্তু হঠাৎ সে বুঝতে পারে ট্রেনের গতি কমে গেছে। ছোট্ট একটা স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে। সামনের স্টেশনে যাওয়ার আগেই তাকে ওপরে যাবার বন্দোবস্ত করতে হবে মনে মনে ঠিক করে নেয় মহিম! আর ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে লাফ দিবে তাও বেছে নেয় সে।

 

ট্রেন থেমে আছে। জীর্ণশীর্ণ একটা স্টেশন। সে ছাদ থেকে নেমে স্টেশনের সামনে চায়ের টং দোকানটায় গিয়ে বসে। তার বিকেলের সেই মন খারাপটা এখন আর নেই। হয়তো জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে আছে বলেই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে আছে। মহিমের পাশে বসে আছে সাদা লুঙ্গি পড়া মাঝবয়েসী এক লোক। লোকটার বোধহয় চুলকানি রোগ আছে। একটু পরপর লোকটা লুঙ্গির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে জোরে জোরে চুলকায়। চুলকানোর সময় আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। মহিম লোকটার পাশ থেকে উঠে অন্যপাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। দোকানী চা এগিয়ে দিয়ে সাদা লুঙ্গি ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে- ‘লাশ আইবো কহন?’ সাদা লুঙ্গি এখনো কথা বলে না। সে বোধকরি চুলকানোর ফাইনাল স্টেজে আছে। ঠিক এমন সময় চায়ের দোকানের পাশে যে বিশাল বটগাছটা আছে সেখান থেকে কান্নার মাতম শোনা যায়। সাদা লুঙ্গিওয়ালা এবার উঠে দাঁড়ায়। চায়ের কাপটা দোকানীকে দিয়ে বলে- ‘রফিকের মায় সব জাইনা গেছে। আমি কইছিলাম বুড়িরে কিছু কওয়ার দরকার নাই। লাশ আইলে পরে বুঝায়া কমুনে, না তাগো কইতেই হইবো। সামলাও, এহন বুড়িরে সামলাও।’

বলতে বলতে সাদা লুঙ্গি সামনের দিকে হাঁটা দেয়। মহিমও তার পিছু নেয়। সামনে জটলার কাছে যেতেই কালো মতোন এক বলশালী লোক মহিমকে জিজ্ঞেস করে- ‘আপনে কি সাংবাদিক?’ মহিম কিছু বলার আগেই লোকটা আবারো বলে- ‘কারখানার আগুনে পুইড়া মরছে নাকি হেগোরে পুড়ায়া মারছে হেইডা আমরা সবই জানি। তয় মনে রাইখেন, এইবার এর একটা বিহিদ না কইরা ছাড়তাছি না।’ মহিম দেখতে পায় ট্রেনের বগি থেকে কাঠের একটা বাক্স নামানো হচ্ছে। তাকে কেউ বলে দেয়নি কিন্তু মহিম বুঝে গেছে বাক্সের ভেতরে কী আছে!

 

কফিন নামাতেই প্রলাপ বকতে বকতে ছুটে আসেন একজন বৃদ্ধা মহিলা। আমার মানিকরে, আমার সোনারে বলে চিৎকার করে কাঁদছেন একজন মা। সে এক গগনবিদারী কান্না। এরই মাঝে কিছু লোকজন এসে জড়ো হয়। তাদের কারো কারো হাতে লাঠি, শাবল, কুড়াল। বেশ কয়েকজন ট্রেনের একটা বগিতে গিয়ে হামলা চালায়। মহিম বুঝে ফেলে তার মৃত্যু সিদ্ধান্ত আজ কার্যকর হচ্ছে না। হলেও, এ ট্রেন থেকে তার আর লাফ দেয়া হচ্ছে না!

 

মহিমের কান্নাকাটি ভাল লাগে না। সে আস্তে-ধীরে জটলা ছেড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে। ঘণ্টা আধেক হাঁটার পরে সে একটা পুকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতে পড়া ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সময় তখন রাত আটটা। এতোক্ষণে রিনির বিয়ে হয়ে যাবার কথা। বাসরে যাবার প্রস্তুতিও বোধহয় শেষ। আহ! এতো যন্ত্রণা কেন! মহিম এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়। পানিতে ডুবেই আজ সে সকল ব্যথা থেকে নিজেকে মুক্তি দিবে!

 

আকাশে তখন বিশাল এক চাঁদ উঠেছে। মহিম কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকায়। হঠাৎই তার মনে হলো- কষ্ট বেশি কার? মহিমের নাকি ওই মায়ের? যার ছেলে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে তার থেকেও কি মহিমের কষ্ট বেশি! আচ্ছা তার মাও কি এভাবে কাঁদবে না? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই তার সবকিছু ওলট-পালট মনে হয়। ওলট-পালট মাথা নিয়ে আবারো সে আকাশে চোখ রাখে। চাঁদটা তখন মেঘের আড়ালে। কিন্তু মহিমের মনের মেঘ বুঝি কেটে যাচ্ছে! সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে তার। তার চেয়েও তেষ্টা পেয়েছে মায়ের সাথে কথা বলার! মহিম খুব দেরিতে হলেও বুঝে ফেলে- তার পাশে থাকা মানুষগুলোর সত্যিকারের ভালবাসাকে ভালভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তাকে বেঁচে থাকতে হবে।

 

মাথার ওপরে রুপালি চাঁদ নিয়ে সে ছোট্ট স্টেশনটার দিকে হাঁটা দেয়। তার যে এখন বাড়ি যেতে হবে। তার যে এখন একটা ট্রেন দরকার!

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না