১.
গোপন কথা কদাচিৎ-ই গোপন থাকে। কথাটি যে সদ্যই গাঁয়ের মানুষের এ-কান থেকে ও-কান হয়েছে, তাও না। ইছামতি নদীর তীরে কাকমারা গাঁয়ের শেষ মাথায় চায়ের দোকানে কিংবা কোনও ভরা মজলিসে আলোচনা হয়েছে, তাও না। তবে শায়লার ঘরের আশেপাশে দু’দশ ঘরের হেঁসেলে বউ শাশুড়িতে কিংবা নিছক ঘুরে বেড়ানো যুবক ছেলেপেলের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হয়। দিনে দিনে এ-কান থেকে সে-কান হয়ে শায়লার শাশুড়ির কানেও কথাটি পৌঁছে যায়। শাশুড়ি বুঝে উঠতে পারলেন না এখন তার করণীয় কী। শায়লার মাকে ডেকে এনে বলবেন, নাকি শায়লাকে বলবেন, নাকি শায়লার শশুর অর্থাৎ তার স্বামীকে বলবেন?
শায়লার স্বামী সগীর পাঁচ বছর হলো মালয়েশিয়া গিয়েছে। সে কত কথা- ওখানে যাওয়ার পরে কিছুদিন লুকিয়ে কাজ করা, বেতন না দেয়ায় চাকরি ত্যাগ ও দীর্ঘ সময় বেকারত্ব, পুলিশের হাতে ধরা পড়া ও কারাগারে আটক- নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আজ অবধি মালয়েশিয়াতেই পড়ে আছে। যাওয়ার আগে দু’লাখ টাকা খরচ দিতে হয়েছে; এরপরেও বিভিন্ন সময়ে থাকা-খাওয়ার জন্য, জেল থেকে বের হওয়ার জন্য হুন্ডি করে যে টাকা পাঠানো হয়েছে তার পরিমাণও দু’লাখ ছাড়িয়েছে। বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছে বছরখানেক, সেই টাকার ভাগ নিয়ে রেষারেষিতে শায়লা এখন দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে পৃথক চুলায় খায়। বাঁশ, চাটাই, পাটকাঠি দিয়ে রান্নাঘর বানিয়ে নিয়েছে সে। বউ, শাশুড়ি ঝগড়া যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে শায়লা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছেলেকে নিয়ে পাশের গাঁয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে; কিন্তু সগীর অনুমতি না দেয়ায় বাপের বাড়ি যাওয়া হলো না, তবে নিজের আধাপাকা ঘরের পাশে এমনভাবে বেড়া দিয়ে দিল যে, তার ঘরে কে আসছে আর যাচ্ছে তা শাশুড়ির চোখের আড়াল হয়ে যায়।
শায়লার একমাত্র ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া সোহাগকে বিকেল বেলায় পড়াতে আসে গাঁয়ের গফুর মাওলানার বাড়িতে বসবাসকারী লজিং মাস্টার আরিফুল হক আরিফ। আরিফের বাড়ি ভিনগাঁয়ে, নিশ্চয়ই গরিব মানুষের ছেলে, তা না-হলে এ-যুগে কেউ লজিং মাস্টার হয়ে থাকে? আরিফ এ-গাঁয়ে থেকে কলেজে পড়ে বিএ ক্লাসে, ওদের বাড়ি ভাটি অঞ্চলে, সেখান থেকে কলেজ অনেক দূর; বাড়িতে সৎমায়ের সাথে বনিবনা না হওয়াও আরিফের গৃহত্যাগের আরেকটি কারণ।
আরিফ সোহাগকে পড়ায় ঘরের রোয়াকে পাটি বিছিয়ে। প্রথম ক’মাস শায়লা কদাচিৎ-ই এসেছে সামনে, যদিও ঘরের মধ্যে বসে দরজা দিয়ে আড়চোখে খেয়াল রেখেছে মাস্টার ঠিকমতো পড়াচ্ছে নাকি গল্পগুজব করে সময় পার করছে। শায়লা একসময় উপলব্ধি করে আরিফ ছেলেটার মুখাবয়বে একটা পুরুষালি ভাব আছে, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের নিচে চওড়া কপাল, চোখের ওপরে বেশ মোটা কালো ভুরু, সুগঠিত নাক, পুরুষ্ট ঠোঁট, শার্টের ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারা বুকের হালকা রোমশ চামড়াটুকুও যেন ওর পুরুষালি সৌন্দর্যেরই অংশ, ওর কান দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উঁচু। শার্ট-প্যান্ট পরে থাকলেও ওর শরীর মাঠে ফুটবল খেলা সবচেয়ে দ্রুতবেগে দৌড়ানো ছেলেটার মতোই মনে হয়।
শায়লা এক রাতে স্বপ্নে দেখে, তেজি এক আরবীয় ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, জোড়া পায়ে খটাখট খটাখট শব্দ তুলে, শরীরের পরতে-পরতে ভাঁজ, মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে ফেনা, দুই চোখে পৃথিবীকে টপকে যাওয়ার কঠিন পণ- ঘোড়াটির শরীরের পরতে-পরতে ভাঁজ বলে দিচ্ছে পৃথিবী সে জয় করবেই, ঘুমের মধ্যেই হাতটা বাড়িয়ে ছেলের স্পর্শ পায়, ঘুমটা ভেঙে যায়। আরবীয় ঘোটকের ছায়াচিত্র ক্ষণিকেই মনে উদয় হয়, পরক্ষণেই দেখে আরিফের মুখচিত্র। শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে- আজ পাঁচ বছর স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত শায়লা ঘরের টিমটিমে আলোতে মশারীর ওপরে তাকিয়ে অনিশ্চিত-অনপনেয় ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছু কল্পনা করতে পারে না।
এক ঘণ্টা পড়ানোর কথা। ঘড়ি দেখে সময় শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে শায়লা ঘরের মধ্যে একটা ছোট টুলে বসে আরিফের সাথে টুকটাক কথা বলে। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। দু’জনের কথামালা গড়াতে থাকে; সোহাগের বিরক্ত লাগে, সে উঠে খেলতে চলে যায় নদীর ধারে। আশপাশ দিয়ে যাওয়া দু’একজন পড়শির চোখে পড়ে আরিফ রোয়াকে পাটিতে বসে কথা বলছে আর সোহাগ মাঠে, তাহলে নিশ্চয়ই শায়লা ঘরের মধ্যে আড়ালে আছে। তাদেরই দু’একজন আয়োজন করে দিনের বেলায় শায়লার উঠোনে আসে, না পেয়ে হেঁসেলে ঢোকে, উদ্দেশ্য শায়লাকে নেড়েচেড়ে তার পেট থেকে কথা বের করা। উদ্দেশ্য হাসিল হলে আগে জানাতে হবে শায়লার শাশুড়িকে, পাড়া-পড়শিকে নিয়ে গালগল্প করার একটা খোরাকও পাওয়া যাবে। তবে শায়লা খুব সাবধানী কথা-বার্তায়, ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলে “আমি তো নিজেও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িছি, মাঝে সাঝে মাস্টারকে যাচাই কইরি দেখতি হয়, ছাওয়ালডাক ভালোভাবে পড়াচ্চে কিনা, পড়াশুনায় ছাওয়ালডার উন্নতি হচচে কিনা, সবকিছুই মাস্টরির উপড়ে ছাইরি দিলি হয়?” ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় মাস্টার হিসেবে আরিফকে সুবিধার মনে হচ্ছে না, হয়ত বিদায় করে দিতে হবে, “তুমাদের জানাশুনা কুনু ভালো মাস্টার থাকলি কইও তো। বছর শেষে পিএসসি পরীক্ষা। একটাই ছাওয়াল, কত কষ্ট কইরি ওর বাপে ট্যাকা পাঠাচ্চে। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো না হলি ওর বাপেক কী কবো আমি?”
পড়শিরা হতাশ হয়ে চলে যায়। তাদের কয়েকজন পৃথকভাবে কথা বলে হতাশা প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না, বলে- “মিয়াডার প্যাট গণ্ডারের চামড়া দিয়ি মুড়ানো-রে বাবা। কুনু কথাই কইলো না। আমি কই এক কথা, সে কথা ঘুরাইয়া কয় অইন্নি কথা। কী চালু হয়ছে মিয়াডা। স্বামী না থাকলি মিয়ামানুষ ভালো থাকপার পারে? আজ না-হয় কাইল মানুষ-তো জানবিই। তখুন শায়লার মুখি ঝ্যাঁটার বাড়ি দিয়ি আসবনে।” তাদের সন্দেহ শায়লার শাশুড়িকে জানাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করল না। শাশুড়ি একদিন এ-কথা ও-কথা বলে নানা অছিলায় শায়লার সাথে তুমুল বাকযুদ্ধ শুরু করল, শায়লার মা-কে নটী বলে গালাগাল করায় শায়লাও উত্তেজিত হয়ে শাশুড়িকে বলে বসল, “আপনের কথাবার্তাও তো নটীর মতোই।” শায়লার শাশুড়ি এটাই চাচ্ছিল। তিনি শায়লাকে উত্তেজিত করতে চাচ্ছিলেন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেটার বউ পৃথক থেকে যেন বাতাসে উড়ে বেড়ায়, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্ন দূরে থাক, সামান্য খোঁজটুকু নেয় না; মনে চাইলেই বাপের বাড়ি যায় শায়লা। শাশুড়িকে ‘নটীর মতো’ বলাতে তিনি মোক্ষম অস্ত্রটি পেয়ে গেলেন, এদিক-ওদিক চেয়ে ধারে কাছেই মরা সাপের মতো পড়ে থাকা নারকেল পাতার খিল দিয়ে তৈরি ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে এসে সপাৎ সপাৎ করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিলেন শায়লার পশ্চাৎদেশে, গালি দিতেও ছাড়লেন না, “হারামি মাগী, ছাওয়ালেক পড়াইনির নাম কইরি ঘরে নাগর রাখিছিস না? দুই দিন সবুর কর মাগী, তোর ভাতারেক কচচি, স্বামীর ট্যাকা খ্যায়া নাগরের সাথে লটরপটর, খাড়া কী করি দ্যাক।” জ্ঞান হওয়া অবধি যত গালিগালাজ শিখেছিলেন তিনি শায়লার বাপ-মাকে উদ্দেশ্য করে সেগুলোও ঝাড়তে থাকলেন। শায়লা আর উত্তেজিত না হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল।
সোহাগকে পড়ানোর জন্য শায়লার বাসায় আরিফের আসা বন্ধ হলো। সগীর মায়ের কাছ থেকে বিস্তারিত জানল, শুধু জানল না মা তার বউকে ঝাঁটাপেটা করেছে। শায়লা ফোন অফ করে রাখল। শুধু মা না, গাঁয়ে সগীরের কিছু বন্ধু যাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে তারা কষ্ট করে হলেও শ’খানেক টাকার ইন্টারনেট এমবি কিনে বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে সগীরকে আরিফের ব্যাপারটা জানাল। সাথে এ-ও জানাল, আরিফ যদি শায়লার ঘরের ধারে কাছে আসে তাহলে তাকে পিটিয়ে মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম থেকে বের করে দিবে। বন্ধুদের মধ্যে আসলাম সগীরের খুব বিশ্বস্ত- পুরনো দিনের গাঁজা খাওয়ার সঙ্গি, আসলামের সাথে সগীর গোয়ালন্দে নটীপাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল জীবনের প্রথমবারের মতো। সগীর ব্যাপারটা খেয়াল করার জন্য আসলামকে বিশেষ দায়িত্ব দিল। আসলাম হঠাৎ করে প্রায় প্রতিদিনই সগীরকে ফোন করে আরিফ-শায়লা বিষয়ক জটিলতা নিয়মিত জানাতে থাকল।
দিন তিনেক পরে শায়লা তার মোবাইল ফোন অন করে ইমোতে ঢুকেই দেখল সগীর তাকে অনেক বার ফোন করেছে। শায়লা সন্ধ্যায় ফোন করল, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তখন ঢাকা-কুয়ালামপুর নয়, যেন পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহের পরিমাপে। কথাবার্তায় সগীরের অনিচ্ছুক মনোভাব কাটানোর লক্ষ্যে শায়লা তাকে জানাল, শাশুড়ি তাকে ঝাঁটাপেটা করেছে, এ-জন্যই সে মনের দুঃখে ফোন অফ করে রেখেছিল। শায়লার মনে হলো সগীর বিষয়টা জানেই না। সে নিরাসক্ত নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল “মা তোক্ মারতি গ্যালো ক্যান্। কী করিছিলি তুই?” যা হয়েছে তাই বলল শায়লা, শাশুড়ি যে নিছক সন্দেহের বশে এই কাজ করেছে তা জানাতে ভুলল না। তবে ঘরের মধ্যে বসে বারান্দায় বসা আরিফের সাথে কথা বলার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। সে জানিয়ে দিল আরিফকে মাস্টার হিসেবে বাদ দেয়া হয়েছে সোহাগের জন্য মেয়ে শিক্ষক খোঁজা হচ্ছে। সগীরের নিস্পৃহতায় সেদিন ওদের মধ্যে কথা আর খুব এগুলো না। তবে শায়লা তার স্বামীর আচরণে ব্যথিত হলো। গত পাঁচ বছরের চার বছরই বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে মা আর বেটাতে খেয়েছে, সগীরের জেলবাসের সময় রাতের পর রাত কাটিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে, তার বাবা গরবি হলেও তার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়েছে যে টাকার জন্য তার বাবাকে জমি বিক্রি করতে হয়েছে। সগীর যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ায় শায়লার মনে ক্ষোভ, অভিমান পুঞ্জীভূত হয়- দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিরহ-বেদনা তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ঠিক সে-সময়ে আবারও আরিফের উদয় হলো, কাকামারা গ্রামের সরলা শায়লা ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হিসেবে ভাব-ভালোবাসা শুরু করল। গভীর রাতে আরিফের ফোনের জন্য শায়লার অপেক্ষা করে, মোবাইল ফোনের রিংটোন অফ করে প্রায়ান্ধকার ঘরে ফোন সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্দিষ্ট নম্বরের অপেক্ষায়- সোহাগ তখন গভীর ঘুমে। দিনের পর দিন দু’জনের কথামালা চলতে থাকে। প্রথমদিকে শায়লা তার বিগত দিনের একাকী জীবন-সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করে। আরিফ গভীর মনোযোগে তা শোনে, মাঝেমধ্যে সমবেদনা-সহমর্মিতা জানায়। কথায় ছেদ পড়লে আরিফ প্রশ্ন করে তাকে বলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কথা বলতে বলতেই যেন পাঁচ বছরের মৃত, স্রোতহীন নদীতে অনুরণন সৃষ্টি হয়, কম্পমান জলরাশিতে ঢেউ ওঠে। শায়লা কখনো ফুঁপিয়ে উঠলে প্রথম দু’-তিন দিন আগের অভ্যেসমতো বলেছে, “খালা আপনে ইভাবে কাঁদলি আমারো বুকির মইদ্যি জ্বালাপুড়া করে। সব একদিন ঠিক হয়ি যাবিনি। মন খুইলি কথা কন কিন্তুক কাদবার পারবেন না কইলাম আপনেক।” সপ্তাহখানেকের নিশিগল্পে আরিফ শায়লাকে আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করে। খালার পরিবর্তে ‘জান’ কখনো ‘সুনা’ (সোনা) বলতে শুরু করে। শায়লা আগপিছ না ভেবে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সঙ্গিহীন জীবনের একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করে সকলের অলক্ষ্যে রাতগভীরে নিশিগল্পে। আরিফ শায়লার ফোনে এমবি দিয়ে দেয়, কথা শেষ করার আগে দু’জন পরস্পরকে দেখে নেয়। এক পর্যায়ে দু’জনের মাঝে শরীরী আলাপও শুরু হয়, তা-ও আরিফেরই আগ্রহে, শায়লা ডুবে যায় নতুন মাদকতায়- তার মনে আরিফকে পাবার উদগ্র বাসনা জেগে ওঠে। আবারও সে স্বপ্নে দেখে সেই তেজি আরবীয় ঘোড়া।
সেদিন ছিল আষাঢ়ী অমাবস্যা। সারাদিন বৃষ্টি ঝরেছে বিরতিহীন- ঝমঝম। সন্ধ্যার পরে বৃষ্টির তোড় কিছুটা পাতলা হলেও টিপটিপ করে ঝরছে তো ঝরছেই। রাত বারটায় ফোনের নীল আলো জ্বলে উঠতেই শায়লা খাট থেকে নেমে পাশের ঘরে চলে যায়। হ্যালো, বলতেই শোনা যায় আরিফের কণ্ঠ, “আমি তুমার দরজায়।”
“মানে কী, তুমি কী কোচচো, আমি তো কিছুই বুঝতি পারতিছি না।”
“মানে আর কিছুই না। আজ সশরীরেই চইলি আইসিছি। বাইরি অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। বৃষ্টিত্ আমি ভিজ্যে জবজবা। দরজাডা খুলো, জার (ঠাণ্ডা) লাগতিছে।”
“কিডা-না-কিডা দরজা খুইলি মরতি কও?”
“আরে আমিই তো কথা কচচি। তুমার দরজায় পয়লা বার দুইডি টুকা দেবোনে, ইর পরে আর একটা। কারেন্ট নিই-কো সন্ধ্যাত থি। তামাম দুইন্যায় ঘুটঘুইট্টা আন্ধার। আশপাশ কুনু মানুষ নিইকো, শীগগির দরজাডা খুইলি দেও, জার লাগছে।”
সব ঠিকঠাক মতো এগিয়ে চলে। দরজা খুলে শায়লা আরিফকে পাশের ছোট্ট ঘরটাতে নিয়ে যায়। আরিফ শার্ট খুললে শায়লা গামছা দিয়ে ওর মাথা, পিঠ, বুক এমনভাবে মুছে দেয় মা যেমন তার স্কুল ফেরত বৃষ্টিতে ভেজা ছেলের সর্বাঙ্গ মুছে দেয়। ঘরে থাকা পুরনো একটা লুঙ্গি এনে দেয়। আরিফ প্যান্ট পাল্টে লুঙ্গি পরে। এ-সময়ে শায়লা ছোট্ট ঘরটাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে পাটি বিছিয়ে তার ওপরে একটা কাঁথা দেয়, একটা বালিশও নিয়ে আসে। মুখোমুখি বসে শায়লা বলে “ইডা তুমি কী করলা। এখুন যদি কুনু মানুষ আইসি হাজির হয়, কী হবিনি?”
“বাদ দি থও। আজরাইল ছাড়া এই বৃষ্টির মদ্যি কুনু মানুষ আসবার পারবি নানে।” শায়লার চোখ বন্ধ হয়ে আসে হাসতে হাসতে। চোখ বন্ধ হওয়া মাত্র সেই তেজি ঘোড়াটা দেখতে পায়। ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ করছে ‘চিঁহি, চিঁহি’। হাসতে হাসতেই শায়লা আরিফের বুকে গড়িয়ে পড়ে। আরিফ শায়লাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে নেয়। ঘনিষ্ঠ হয়, ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়। পাঁচ বছরের বিরহবিধুর যৌবন নিয়ে ত্রিশ বছরের শায়লা বিশ বছর বয়সী অমিত তেজি স্বপ্নের ঘোড়ার কাছে ধরাশায়ী হয়। রাত তখন তিনটা, অভিসার শেষে আবার ভেজা জামা প্যান্ট পরে আরিফ চলে যায়। জানালার ছিদ্র দিয়ে শায়লা তাকিয়ে থাকে, কিছুক্ষণের জন্য ঘোর অমবস্যার অমনিশায় একটা ছায়ামূর্তি দেখে, কিছুক্ষণ- তারপরে ছায়ামূর্তিটা হারিয়ে যায়। শাশুড়ির কাছ থেকে কঠোর কোনও প্রতিক্রিয়া আসে কিনা সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে পরের দিনটা পার করল সে। ও-বাড়ি থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না আসায় নিশ্চিন্ত হলো সে। পরদিন রাত ঠিক বারটায় নিশ্চিত হয় আরিফ নিরাপদে তার থাকার চালাঘরে পৌঁছে গিয়েছে ফজরের আজানের আগেই। এভাবেই মাস দুয়েক লোকচক্ষুর অন্তরালে আরিফ-শায়লার নিশি অভিসার চলতে থাকে।
বাড়িতে কাউকে কোনও খবর না দিয়ে সগীর মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসে। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে কুষ্টিয়ার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে উঠে বসে- সাথে একটা ছোটো ব্যাগ। সন্ধ্যায় শহরের মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে ইজিবাইক দেখেÑ সে খোঁজে অপরিচিত মুখ। একটা ইজিবাইক রিজার্ভ করে কাকমারা গ্রামে রওনা হয়, আধঘণ্টার পথ। বড়ো রাস্তা থেকে গ্রামের রাস্তাটা পাঁচ বছর আগেও ছিল মাটির, এখন হয়েছে পাকা। সহজেই পৌঁছে যায়। গ্রামের বাজার এড়িয়ে বন্ধু আসলামের আড্ডায় যায় সগীর। আড্ডা তখনও জমে ওঠেনি। আসলাম ছাড়া আছে মাত্র দুজন, তাসখেলায় মত্ত। আরও পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় তাস দিয়ে জুয়া খেলছে তারা। আসলাম বাজার থেকে পেঁয়াজু, বুটভাজা আনিয়ে কেরু এন্ড কোং-এর তৈরি বাংলা মদ দিয়ে সগীরকে আপ্যায়িত করে। সগীর পাকা খেলোয়াড়, তবে মদের নেশায় কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কিছু টাকা খুইয়ে বসে। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তির অজুহাতে খেলায় ক্ষান্ত দেয়। বিদেশ ফেরত বন্ধুর জন্য ভিতর ঘরে সন্ধ্যাতেই বলে রেখেছিল মুরগী জবাই করে পরোটা বানাতে। দীর্ঘদিন পর আসলাম দেশি খাবার পেট পুরে খেল। ক্লান্তি ও নেশায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুম ভাঙে রাত একটায়। এখান থেকে নিজের বাড়িতে হেঁটে গেলে দশ মিনিট লাগে। ছোটো ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে রওনা হয় নিজ বাড়িতে, দরজায় টোকা দেয়।
শায়লা তখন আরিফের সাথে মৈথুনে রত। দরজায় টোকাতে দু’জনেই হতভম্ব। আবারও টোকা। দু’জনেই তখন বেশভূষা ঠিক করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শায়লা দ্রুত মূল দরজার কাছে রাখা চেয়ারে উঠে ছিদ্র দিয়ে বাইরের আলো-আঁধারীতে তাকিয়ে দেখে সগীর দাঁড়িয়ে। তার শরীর কাঁপতে থাকে, ঘরে দ্বিতীয় কোনও দরজা নেই যেখান দিয়ে আরিফ বের হয়ে যেতে পারে। পাশের ঘরে এসে ফিসফিস করে দরজায় স্বামীর উপস্থিতির কথা জানায়। আরিফও বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। শায়লা কেঁদে ফেলে, “কী করবা এখুন। কমনে দিয়ে পলাবা?” আরিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে “তুমি দরজা খুইলি তাক জড়ায়া ধরবা। আমি দরজার পাশে লুকোয়ে থাকবোনে, তুমি তাক্ জড়ায়া ধইরি এই ঘরে নিয়ি আসবা, আমি তখুন চইলি যাবোনে।’
শায়লা দরজার কাছে গিয়ে কথা বলে, “অ্যাতো রাইতে কিডা।”
“ঘুম ভাইঙলো? আমি, দরজা খোল্।”
“তুমি এত রাইতে। কুতাতথি আইসলে?’
“আমার গলা চিনতি কষ্ট হচ্চে?”
“না, না, ঘুমির-তি উঠলাম তো। আর রাইত-বিরাতে কিডা না কিডা, গলা তো নকল করবারও পারে তাই জিগ্যাস করতিছি।”
শায়লা দরজার ওপরের ও নিচের ছিটকানি খুলে, মাঝে কাঠের খিলও খোলে, খিলের ওপরে কাঠের আড়াটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা ছিল, আরিফ থাকলে ওটা এভাবেই রাখা থাকে, যেদিন থাকে না, সেদিন ওটাও দরজায় আড়াআড়ি করে দেয়া থাকে। দরজা খুলে শায়লা সগীরকে জড়িয়ে ধরে, দরজার পাল্লা খোলা রেখেই সগীরকে পাশের ঘরে নেয়ার জন্য একরকম ঠেলতেই শুরু করে।
“কী আচ্চয্য, দরজাটা বন্দ না কইরি ওই ঘরে ঠেলতিছিস ক্যা? ছাওয়ালডাক আগে দ্যাখবার দিবি নে?” সগীর কিছুটা জোর করে শায়লার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দরজার পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে অন্ধকারে মূর্তির মতো একজন মানুষকে দেখে চমকে ওঠে। আরিফ শক্ত কাঠের আড়াটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়েছিল। প্রায়ান্ধকার ঘর। কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুই হাতে সজোরে আঘাত করে সগীরকে। আঘাতটা লাগে মাথার ঠিক নিচে ঘাড়ে। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে নেশাগ্রস্ত সগীর পড়ে যায় মাটিতে। ঘরের মাঝ বরাবর রশিতে ঝুলন্ত গামছাটা এক টানে নিয়ে সগীরের নাকে-মুখে চেপে ধরে আরিফ। কিছুক্ষণের মধ্যে সগীর নিঃসাড় হয়ে যায়, পাশে দাঁড়িয়ে শায়লা কাঁপছে থরথর। আরিফ তখন ঘোড়া থেকে দানব হয়ে উঠেছে। আরিফ হালকা-পাতলা সগীরকে টেনেহিঁচড়ে কাঁধে তুলে নেয়। কখনও কাঁধে করে, কখনও টেনে-হিঁচড়ে স্বল্প দূরত্বে গড়াই নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। নদীতীরে পড়ে থাকা একটা কাঠের গুঁড়ির সাথে গামছা দিয়ে সগীরকে শক্ত করে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়, ভরা বরষায় গড়াই নদীর পানি তখন দুকূল ছুঁইছুঁই। সগীরের দেহখানি রাতের অন্ধকারে নদীর গভীরে তলিয়ে যায়। আজ রাতের আকাশে চাঁদ দূরের কথা তারাও নেই। শুধু কিছু জোনাকী পোকা শরীরের আলোতে দেখল সুযোগসন্ধানী, কামুক, দুর্জন এক যুবক নিরপরাধ জীবিত অথবা মৃত এক মানুষকে শংকাহীনচিত্তে পানির অতলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বরষায় গড়াই নদীতে ঘ্যাইরে মাছের সমাগম ঘটে অধিক মাত্রায়, মাছগুলো বিপুল খাদ্য পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কিলবিল করে ঠুকরে ঠুকরে মানবশরীরের মাংস খেয়ে ফেলবে, পড়ে থাকবে তার কঙ্কাল।
পরদিন আসলাম সগীরকে ডাকতে আসে বিকেল বেলায়। সগীর বাসায় আসেনি শুনে তাজ্জব হয়ে যায়। পরদিন আবারও খোঁজ নিতে আসে, না- একই উত্তর শায়লার, “বাড়িত্ আসলি পরে কবো না কেন্? সে-ই কী ঘরে লুকোয়ে থাকপার মানুষ?” আসলাম দেয়ালের ওপাশে সগীরের বাবাকে জানায় সগীর এসেছিল। সগীরের বাবাও ছেলের বউ-এর কাছে ‘না’ উত্তর পেয়ে থানায় খবর দেয়। থানায় পুলিশের তালিকাভুক্ত জুয়াড়ি ও নেশাখোর আসলাম ও সেদিন যে দু’জন সগীরের সাথে জুয়া খেলেছিল তাদেরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়; রিমান্ডেও নেয়, রিমান্ড শেষে ওদেরকে কারাগারে পাঠায়। মাঝে মাঝেই শায়লাকে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলে; এক পর্যায়ে আরিফ ও শায়লাকেও গ্রেফতার করে, রিমান্ডে নেয়, রিমান্ড-শেষে তাদেরকেও কারাগারে পাঠায়, সগীরের কোনও হদীস বের করা যায় না। বছর পার না হতেই সগীরের বাবা মারা গেলেন। মামলা চালানোর টাকা দেয় কে? কোর্টেই-বা যায় কে? আরিফ, শায়লা ও আসলামের সঙ্গিরা জামিনে বেরিয়ে আসলেও আসলামের জামিন হয় না, তার পুরনো মামলাগুলোও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরপরেও বছরখানেক মামলার শুনানীর তারিখ পড়ে, সগীরের বাবার মৃত্যুর পরে এক-সময়ে মামলাটি ঝিমিয়ে পড়ে। শুনানীর তারিখও আর পড়ে না। আরিফ গ্রাম ত্যাগ করে শহরে চলে যায়। সেখান থেকে অনার্স পাশ করে পড়তে চলে যায় ঢাকায়।
পরিবারে নিরন্তর অভাব-অনটন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা- এত সবকিছুর মধ্যে সোহাগের নানা ওর মাথার ওপরে ছাতা হয়ে দাঁড়ায়। সোহাগের মা যখন জেলে সেই সময় নানা ওকে এ-বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। বছরখানেক পরে মা জেল থেকে জামিনে বের হয়ে এলে সে আবার মায়ের ঘরে ওঠে। দাদার স্নেহ থেকেও সে বঞ্চিত হয়নি। দাদা তাকে বলেছিল, “ভাই-রে তোর বাপকে কত বুঝোইছি পড়াশুনা কর, ট্যাকা যা লাগে আমি দেবোনে। শত অনুরোধ করার পরেও হেই ছাওয়াল পড়ালেহা কইরলো না। এ-পৃথিবীত্ তে কিভাবে হারায় গ্যালো কিডা জানে? পুলিশও তো কিছু করবার পাইরল না। তুই লেহাপড়া শ্যাষ কইরি বড়ো অফিসার হবি, গাঁও-গিরামে থাকতি পারবি না। শহরেত্ থাকবি- অফিসারের চাকরি করবি।” সোহাগ লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজেছে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ঢাকাতে।
২.
ইন্টারভিউ দিতে উপস্থিত হলো এক ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে। ইন্টারভিউ বোর্ডে মাঝখানের আসনে বসা মাঝবয়সী ফর্সা লোকটার দিকে বারবার তাকাতে থাকে সে। বেশ চেনা চেনা লাগে। মধ্যবয়স্ক হলেও পেটা শরীর, পুরু ঠোঁট, সবকিছু ছাপিয়ে খাড়া কান দুটো তাকে নিয়ে যায় পনের বছর আগে; তার মাস্টার ঘরের রোয়াকে বসে তাকে পড়াত, সেই মানুষটার চেহারার সাথে বেশ মিলে যায়। বোর্ডের আরও দু’জন সদস্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে তাকে নাজেহাল করছে, অথচ ভদ্রলোক গভীর মনোযোগে তার বায়োডাটা দেখছে, যেখানে খুব সামান্য কথাই লেখা আছে। কেননা, সে মাত্র লেখাপড়া শেষ করেছে, চাকরির কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ফলাফল। বোর্ডের অন্যান্য সদস্য মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেন, স্যার আপনি কোনও প্রশ্ন করলেন না। উনি বললেন, “না না, ঠিক আছে। আপনারা তো অনেক প্রশ্ন করেছেন, আমার কোনো প্রশ্ন নেই।” কে একজন বলল, “এখন আসুন, আপনি মনোনীত হলে আমরা যোগাযোগ করব।” সোহাগ ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বের হয়েই পাশের ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে কম্পিউটারে কাজ করতে দেখে। সে বুঝতে পেরেছে এখানে তার চাকরি হবে না, কেননা বোর্ডের মূল ব্যক্তি তাকে কোনো প্রশ্নই করেনি। আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে প্রৌঢ় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে বোর্ডের মূল ব্যক্তির নাম। তিনি বিস্ময়ভরা চোখে তাকান, জিজ্ঞেস করেন, “কেন?” সোহাগের কাছে যুৎসই কোনো উত্তর নেই। তিনি বললেন, “আপনি ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন না? এখানে কোনও তদবির চলে না, চলে যান। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে আর কখনো এ-ধরনের প্রশ্ন কোথাও করবেন না, ডিসকোয়ালিফাইড হিসেবে বিবেচিত হবেন। দ্রুত এখান থেকে চলে যান।”
ইন্টারভিউ বোর্ডের সভাপতি ইন্সুরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আরিফ আহমেদ আরিফ তখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও স্যুট-কোট পরে ভেতরে ঘেমে উঠেছেন, তাঁর চিনতে ভুল হয়নি পনের বছর আগের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সোহাগকে। ঘর থেকে বের হয়ে সোহাগ কেন যেন অফিসের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পরে কালো কাচ ঘেরা বড়ো একটা গাড়ি বের হয়ে গেল। গেটে দাঁড়ানো খাকি পোশাক পরা দু’জন গার্ড বুট ঠুকে স্যালুট দিল। সোহাগের বুঝতে অসুবিধা হলো না ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রধান বেরিয়ে গেলেন। গার্ড দু’জন তাকে খেয়াল করছিল। এবারে কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইল। সদুত্তর না পেয়ে দ্রুত চলে যেতে বলল।
৩.
সানরাইজ লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আরিফুল হক গাড়ির চালককে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি সর্বোচ্চ মাত্রায় দিতে বললেন। সে জানাল- স্যার, সর্বোচ্চ মাত্রাতেই আছে। গায়ের কোট খুলে সিটের পাশে রেখে দিলেন, ততক্ষণে ভেতরের গেঞ্জি ভিজে গিয়েছে। তার চিনতে ভুল হয়নি পনের বছর আগের সোহাগকে। টঙ্গি থেকে এক ঘণ্টাতেই খুব পরিচিত বনানীর ‘ডি-শ্যালে’ তিন-তারকা হোটেলে যান। বরফ কুচি দেয়া স্কস হুইস্কি ও কাবাবের অর্ডার দেন তিনি। অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি মাত্রায় তরল গলায় ঢালেন। বাসায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে হোটেলেই একটা কক্ষ ভাড়া নেন। সাথে কোনও কাপড়-চোপড় নাই। নির্ধারিত কক্ষে গিয়ে চালককে ঘুমের একটা ট্যাবলেট আনতে বলে। ট্যাবলেট খেয়ে প্যান্ট-শার্ট পরে নরোম বিছানায় গা এলিয়ে দেন। ঘুমে ঢলে পড়ার আগে একটা চিন্তাই উঁকি দেয়, সোহাগও নিশ্চয়ই তাকে চিনে ফেলেছে! চোখ ভারি হয়ে আসে, কিন্তু ঘুমে ঢলে পড়ে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন মনে পনের বছর আগের সেই রাতের ঘটনা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আবারও মাথার যন্ত্রণাটা সহ্যসীমা অতিক্রম করে। বিছানার অতিরিক্ত শ্বেতশুভ্র চাদরটা গায়ে জড়িয়ে টলতে টলতে উঠে হ্যান্ডব্যাগ থেকে ঢুলুঢুলু চোখে মাইগ্রেনের ব্যাথানাশক ট্যাবলেটটা বের করে খেয়ে নেন। এখন তার খুব প্রয়োজন ঘুম, কিন্তু ঘুমাতে পারছেন না; অথচ ঘুমে চোখের পাতা ভালো করে খুলতেও পারছেন না। ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপ থেকে আরও একটা ট্যাবলেট বের করে পানি দিয়ে খেয়ে নেন তিনি। বিছানার কাছে যেতেই বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে। বেডসাইড টেবিলে রাখা ইন্টারকম টেলিফোনের ডায়ালটা তুলতে যান রিসেপশানে ফোন করার জন্য, পারলেন না; শ্বেতশুভ্র চাদর গায়ে বিছানাতে ঢলে পড়েন- যেন কাফনের কাপড়ে মোড়ানো লাশ।