এখন আর বঙ্গবন্ধুর চর্চা হয় না

0

 

আব্দুল্লাহ আবু সাইদের কাছে একবার একজন জিজ্ঞাসা করল, “নেতা কাকে বলে?” তিনি খুবই সরল ভাষায় অত্যন্ত গভীর উত্তরটিই দিলেন। তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি ‘না’ বলতে পারে, সেই নেতা। সত্যের পক্ষে থেকে যে বিরোধীতা করতে পারে, সেই নেতা।” বঙ্গবন্ধু ১৮ বছর বয়সে সর্বপ্রথম জেলে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়েও বহুবার তিনি জেলে গিয়েছিলেন। আজকাল বঙ্গবন্ধুর গুণগ্রাহীদের ভাষ্যমতে, এই জেলে যাওয়াটা তাঁর ‘নেতা’ হওয়ার অন্যতম মূলমন্ত্র। তাঁরা দাবি করে বসে যে, প্রথম জেলে যাওয়াটাই তাঁর ‘নেতা’ হওয়ার পথে প্রথম কদম। প্রকৃতপক্ষে কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। কিন্তু এটিকেই একমাত্র কারণ বলে দাঁড় করানো একেবারে অনুচিত। জেলে গেলেই যদি নেতা হওয়ার হয়, তাহলে জেলে বসে বসে পকেটমারও নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখবে। জেলে যাওয়াটা নয় বরং জেলে যাওয়ার কারণটাই ছিল তাঁর ‘নেতা’ হওয়ার প্রথম ঝলক। তবে, সত্যিকারার্থে তিনি তো সেদিনই ‘নেতা’ হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন, যেদিন তিনি নিজ নেতার ভুল দেখে, নেতার মুখের সামনে প্রশস্ত বুকে বিরোধীতা করতে পেরেছিলেন।  বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, “শহীদ (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, “who are you? You are nobody.” আমি বললাম, “If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you Sir. I will never come to you again.” এ কথা চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম।” কথাগুলো বলার সময়কালে বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল স্রেফ ২৪। অর্থাৎ, এটা তখনকার কথোপকথন, যখন বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের একজন উঠতি নেতা আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিমলীগের প্রভাবশালী নেতা।

 

‘না’ বলার কাজটা যতটা সহজ মনে হয় আদতে ততটা সহজ নয়। তাও আবার নেতার সামনে রুদ্রস্বরে কথা বলার উদাহরণ তো একেবারেই বিরল। এমন নয় যে, শেখ মুজিব অন্য কোন নেতার অনুসারী ছিলেন বলেই শহীদ সাহেবকে এভাবে কথা শুনিয়েছিলেন। বরং, শেখ মুজিব তাঁর আত্মজীবনীতে পরিষ্কারভাবেই লিখেছেন, “আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত”। কিন্তু, ভক্তির মোহে তিনি কখনোই সত্যের পথকে ভুলে জাননি। ভক্ত হয়েও সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন নেতার ভুলকে অন্ধভাবে স্বীকার করেননি।

“শহীদ সাহেব সহজ-সরল এবং উদার মনের মানুষ”, উক্তিটি বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে বহুবার বলেছেন। এই সরলতার সুযোগ নিয়ে ১৯৪৪ সালের  ইলেকশনে শহীদ সাহেবকে বাদ দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীন ফজলুর রহমান সাহেবকে ইলেকশনের জন্য রেফার করে বসেন। আর এতেই ক্ষেপে উঠেন ছাত্র এবং লীগ কর্মীরা। নেতাদের মধ্যে বৈঠক হলেও, শেখ মুজিবসহ অনেকেই এর তীব্র বিরোধীতা করে বৈঠকে প্রবেশ করলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বললেন, “আপোস করার কোন অধিকার আপনার নাই। আমরা খাজাদের সাথে আপোস করবো না। কারণ, ১৯৪২ সালে নিজামুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজের ভাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। আবার তাঁর বংশের থেকে এগারজনকে ‘এমএলএ’ বানিয়েছিলেন। এদেশে তারা ছাড়া আর লোক ছিল না? মুসলিম লীগে কোটারি করতে আমরা দিব না। আমরাই হক সাহেবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, দরকার হয় আপনাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করবো।” সিদ্ধান্ত নেওয়া হল পরদিন সকালে জানানো হবে যে, খাজাদের সাথে আপোস হবে কি হবে না। পরদিনের ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গন্ধু বলছেন, “সকালে তিনি আমাদের নিয়ে বসলেন, আমি তাঁর কাছেই বসলাম। শহীদ সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছি না তোমরা পাঁচটা সিটই দখল করতে পারবে কি না?’ আমি বললাম, ‘স্যার, বিশ্বাস করেন আমরা নিশ্চয়ই জিতব, খোদার মর্জি থাকলে আমাদের পরাজিত হবার কোন কারণই নাই।’ আমি টেলিফোন তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘বলে দেন খাজা সাহেবকে ইলেকশন হবে।’ সেবারের পাঁচটি আসনেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীরা জয় লাভ করেন।

 

সত্যের উপর অটল থেকে বিরোধিতা করার জন্য যে গোর্দা প্রয়োজন সেটা মুজিবের প্রশস্থ বুকে বিদ্যমান ছিল।  তাই, নেতার সব কথায় ‘সহমত ভাই’ না বলে, দরাজ কণ্ঠে বিরোধিতাও করতে পেরেছিলেন। আর ঠিক এই কারণেই তিনি একজন সফল নেতা হতে পেরেছিলেন। যেভাবে নজরুল বলেছিলেন, “ধূমকেতু’র এমন গুরু বা এমন বিধাতা কেউ নেই, যার খাতিরে সে সত্যকে অস্বীকার ক’রে কারুর মিথ্যা বা ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে। ‘ধূমকেতু’ সে-দাসত্ব হ’তে সম্পূর্ণ মুক্ত।”৩ তরুণ মুজিব যেন, নজরুলের সেই ধূমকেতুর জ্বলন্ত উদাহরণ।

 

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে গান্ধী হতে জিন্নাহ, শেরে বাংলা হতে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী কারো সমালোচনাই বাদ রাখেননি। খুব প্রাঞ্জল ভাষায় পরিষ্কারভাবে তিনি সবারই সমালোচনা করেছেন। করেছেন কারণ সবাই মানুষ ছিলেন। একজন মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনে সমালোচনার কিছুই থাকবে না এমনটা হতে পারে না। সমালোচনার অর্থ যে, বিরোধীতা নয়, গালিগালাজ দেওয়া নয় বা কাউকে ভুল প্রমাণ করা নয়, তা বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবেই জানতেন। জনাতেন বলেই তিনি শহীদ সাহেবের সমালোচনা করলেও, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে কখনোই ভুলেননি। এখানে, ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পরের দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে সাক্ষাত করতে ছুটে যাওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ না করলেই নয়।  বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “ঢাকা থেকে করাচি রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমি মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। কারণ শহীদ সাহেব আইন মন্ত্রী হয়েছেন কেন? রাতে পৌঁছে আমি আর তাঁর সাথে দেখা করতে যাই নাই। দেখা হলে কি অবস্থা হয় বলা যায় না। আমি তাঁর সাথে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘গত রাতে এসেছ শুনলাম, রাতেই দেখা করা উচিত ছিল।’ আমি বললাম, ‘ক্লান্ত ছিলাম, আর এসেই বা কি করব, আপনি তো এখন মোহাম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী।’ তিনি বললেন, ‘রাগ করেছ, বোধহয়।’ বললাম, ‘রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুলই করেছি কি না?”

 

সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে শুদ্ধ চর্চার জন্য সমালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় আজকের দিনে সমালোচক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, নেই বলাটাও একেবারেই অত্যুক্তি হবে না। সমালোচকের অন্যতম প্রধান গুণাবলী সম্বন্ধে শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেন, “সহৃদয়তা, রসবোধ এবং উদারতা সমালোচকের প্রধান গুণ।” আজ এই গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ নেই বলেই সমালোচনা যে একটা আর্ট এটাই মানুষ ভুলতে বসেছে। সমালোচনা এখন এক প্রকার গালির নাম হয়েছে। তাই যারা প্রকৃত সমালোচক, এরা হয়ে যায় বিদ্বেষী। তাই এখন আর বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে সমালোচনা হয় না, পূজা হয়, পূজা।

 

বঙ্গবন্ধুর কর্মকে প্রকৃতার্থে মানুষের জন্য উপাকারী হিশেবে দেখতে চাইলে, তিনি যেভাবে নেতাদের সমালোচনা করেছেন, তাঁর জীবনী নিয়েও সেভাবে (যৌক্তিক) সমালোচনায় নামতে হবে। আবার সমালোচনা অর্থ কিন্তু কেবলই ভুলগুলো তুলে আনা নয়। বরং ভালো-মন্দ উভয়টা থেকেই শিক্ষণীয় বিষয় বের করতে পারা। তবে গিয়েই বর্তমান ছাত্রদের বুকে পাতি নেতাদের ভুলকে ভুল বলার একটা বিরাট গোর্দা তৈরি করা যাবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন-কর্ম নিয়ে চর্চা করতে হবে। মানব শেখ মুজিবকে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। দেবতা বানিয়ে ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে রেখে পূজা করে লাভ কী? দেবতা শেখ মুজিব থেকে মানবরা শিখবেই বা কী? অবাক করার বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে দেবতাদের সমালোচনা করার সুযোগ মানুষের থাকলেও, আজকের সময়ে মুজিব-সমালোচনা করা মানেই রাতারাতি রাজাকার কিংবা দেশদ্রোহী বনে যাওয়া। এটাও সত্য যে, আজকাল মুজিবের সমালোচনা হয় না, বিরোধীতা হয়। কিন্তু শিক্ষিত এবং প্রগতিশীলদের এটা ভুললে চলবে না যে, সমালোচনাও এক প্রকার আর্ট। শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেন, “যথার্থ সমালোচনা পূজা নহে, পূজাতে শ্রদ্ধা থাকিতে পারে, অন্ধ বিশ্বাসও থাকিতে পারে, কিন্তু পূজায় বিচারবোধ থাকে না। যে সমালোচক ‘পুজার আবেগমিশ্রিত ব্যাখ্যাকেই’ সমালোচনা মনে করেন, তাঁহার কাছে সমালোচনা স্তুতি মাত্র — দোষগুণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা সর্বাঙ্গীণ মূল্য পরিমাপ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে— তাঁহার সমালোচনা ‘ব্যক্তিগত সমালোচনা’রই নামান্তর। এইখানে আরও মনে রাখিতে হইবে, ‘পূজাও’ যেমন সমালোচনা নহে, ‘ঘৃণা’ও তেমন সমালোচনা নহে।”

 

রবীন্দ্রনাথ বলেন:

জীবনে জীবন যোগ করা

না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।

পরিশেষে বলতে চাই, মানব মুজিবকে মুক্ত করে উন্মুক্ত করতে হবে। তবেই বঙ্গের সবচেয়ে বড় বন্ধুকে বঙ্গের প্রতিটি সন্তান জানা এবং চেনার পাশাপাশি অনুভবও করতে পারবে। আমাদের প্রজন্মকে মুজিবীয় অনুভূতিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। যেই অনুভূতি আমাদেরকে নেতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জ্ঞাতিত্ব শিক্ষা দিবে। আর, মানব মুজিবকে উন্মুক্ত করতে না পারলে,  সমাজের সাধারণ মানবের সাথে মানবীয় মুজিবকে যুক্ত করতে না পারলে,  বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়ন কখনোই সম্ভব হবে না।

 

তথ্যসূত্র:

১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৯

২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩

৩. নজরুল রচনাবলী, রুদ্র-মঙ্গল, আমার পথ, পৃষ্ঠা ৪২০

৪.  অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৮৫-২৮৬

৫. সাহিত্য-সন্দর্শন, শ্রীশচন্দ্র দাশ, পৃষ্ঠা-১০৬

৬. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-১০৮

আপনার মন্তব্য

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না