বাঙালি মুসলমানের সঙ্কীর্ণতা দূর করার জন্য, প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ থেকে কমসে কম শত বৎসর পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানের সর্বক্ষেত্রে ‘বুদ্ধির মুক্তি’র জন্য অধ্যাপক আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আবদুল কাদির প্রমুখ কয়েকজনের নেতৃত্বে ১৯২৬ সালে গঠিত হয় “মুসলিম সাহিত্য সমাজ”। এই সাহিত্য সমাজের বিচরণক্ষেত্র কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা— সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়— নানা সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন— অবশ্যই প্রগতিশীল দৃষ্টিতে। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’র বার্ষিক মুখপাত্র হিসেবে ১৯২৭ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় শিখা। ১৯২৭ থেকে ১৯৩১— এ পাঁচ বছরে পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে কেবল, সংখ্যা হিসেবে একেবারে গোনায় ধরার মতো মনে না হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অবশ্য-স্বীকার্য, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের পক্ষে শিখা মুসলমানদেরকে গতানুগতিক পথ থেকে ফিরাবার সাধনা করেছে’ বিধায় অন্তত বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে ‘শিখা’র গুরুত্ব অনস্বীকার্য— প্রগতিশীলতার বিচারে তো ‘উন্নত সাহিত্য পত্রিকাসমূহেরও শ্রেষ্ঠ আদর্শের এক তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা’। “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”— এই স্লোগানকে শিরে ধরে যাঁরা চলবেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই উন্নত চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধির অধিকারী হবেন। এবং ১৯২৬ সালে বাঙলার মুসলমান সমাজে এমন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন করা রীতিমতো বিপ্লব, বিদ্রোহ বলা যায়— প্রত্যেকজনকে বলা যায় একেকজন বিপ্লবী, বিদ্রোহী।
মুসলিম সমাজে সঙ্গীত, ছবি এবং মঞ্চে অভিনীত নাটক সর্বোপরি শিল্পকলা সম্বন্ধে সবসময় একটা নেতিবাচক ধারণা থাকে, যারা এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকেন কিংবা এসবের প্রতি আকৃষ্ট হন তাদের মধ্যে ভয়াবহ রকমের ‘ফতোয়াভীতি’ থাকে। আর মৌলবাদী গোষ্ঠীও ওঁত পেতে থাকে ফতোয়া প্রদানের জন্য। অসুস্থ শিল্পকলার তো প্রশ্নই ওঠে না, সুস্থ শিল্পকলার বিরুদ্ধেও আজকের মুসলিম সমাজে মৌলবাদীদের দাপট নজর এড়ায় না। এই প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয়েছে, ‘শিখা’র সেই বিপ্লবীগণ কিভাবে প্রতিহত করেছিলেন এসব মৌলবাদীদের? তাঁরা কোন্ যুক্তিতে ‘শিখা’য় শিল্পকলার পক্ষে দৃঢ় কণ্ঠে আওয়াজ তোলেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে রচিত এই প্রবন্ধ।
লোক-সঙ্গীত
আধুনিক সঙ্গীতে প্রচুর অশ্লীলতা সদম্ভে ঢুকে পড়লেও সেই প্রাচীনকাল থেকেই লোক-সঙ্গীতের একচেটিয়া বিষয়বস্তু ছিল ইতিহাস, সমাজ ও মানুষ। লোক-সঙ্গীতে অশ্লীলতার অভিযোগ রীতিমতো দুর্লভ ব্যাপার— তবুও মৌলবাদীদের ফতোয়া থামেনি। তারা একচেটিয়াভাবে মুসলমানদের জন্য সঙ্গীত হারাম ঘোষণা করে মুসলিম সমাজকে সঙ্গীত থেকে দূরে রেখেছে যুগের পর যুগ। এ ব্যাপারে ‘শিখা’র প্রথম সংখ্যায় কবি আবদুল কাদির লিখেছেন: “আজকাল অন্নচিন্তায় পল্লীর কৃষক সঙ্গীত চর্চ্চার অবকাশ করিতে পারিতেছে না। তাহার উপর সংরক্ষণশীলদের দৌরাত্ম্যে তাহাদের জীবন যেভাবে সঙ্গীত-রস হইতে বঞ্চিত হইতে চলিয়াছে, তাহাতে অতি অল্পকালের মধ্যেই বাঙ্গালী মুসলমানের সমস্ত প্রকার লোক-সঙ্গীত যে লুপ্ত হইয়া যাইবে, সে বিষয়ে অনুমাত্র সন্দেহ নাই। বাংলার লোক সঙ্গীতে বাঙ্গালী মুসলমানের কি পর্য্যন্ত দান ও সৃষ্টি রহিয়াছে তাহার সীমা নির্দ্দেশ সুসাধ্য নহে। কারণ উক্ত বিষয়ের উপকরণ চাষীদের মুখে মুখে—তদ্ব্যতীত সম্মুখে সংগৃহীত উপাদান কিছুমাত্র নাই। অত্যল্পকাল পরই এই raw materialsও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। অতীতের এই গৌরবের উপকরণসমূহ সংগ্রহ করার পক্ষে আজ পর্যন্ত মুসলমান সমাজে যথেষ্ট উদ্যম দৃষ্ট হয় নাই। ইহা একটা জাতির পক্ষে গূঢ় পরিতাপ ও দুর্নিবার লজ্জার বিষয়, বলিতে হইবে।” (বাঙ্লার লোক-সঙ্গীত : আবদুল কাদের, শিখা সমগ্র : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ২০০৩, ৫৪ পৃষ্ঠা)
এ সংখ্যাতেই কাজী মোতাহার হোসেন “সঙ্গীত-চর্চ্চায় মুসলমান” প্রবন্ধে লিখেছেন: “রসানুভূতি মানবজাতির প্রকৃতিদিও অমূল্য সম্পদ। এজন্য সৃষ্টির আদিকাল হইতে সঙ্গীত সকল দেশে, সকল জাতির মধ্যেই কোন না কোনভাবে বিদ্যমান আছে। সভ্য সমাজ হইতে অতিদূর দূরান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে একতারা বা দোতারা এবং দুই বা ততোধিক ছিদ্রবিশিষ্ট বংশীর ব্যবহার দেখা যায়। মানুষের এই স্বাভাবিক বৃত্তি যতই চাপিয়া রাখা হউক না কেন, কোন না কোন রূপে তাহার প্রকাশ অবশ্যই হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, ধার্ম্মিক মুসলমানগণ প্রায় কোন সময়েই সঙ্গীতকে প্রীতির চক্ষে দেখেন না। তথাপি দেখিতে পাই, উচ্চকণ্ঠে সুললিত স্বরে আজান দেওয়া হয়, কেরাত করিয়া সুমিষ্ট স্বরে কোরাণ শরিফ পাঠ করা হয়। ইহা ছাড়া পরমার্থ সম্বন্ধীয় গজল, কাওয়ালী প্রভৃতির অন্ত নাই। মিলাদ শরিফে যে প্রকারে দরূদ পড়া হয়, এবং হজরতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য যে ওজন সমস্বরে ‘সালাম আলাইকা’ পড়া হয়, তাহাকে নিশ্চয়ই সঙ্গীত আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। শাস্ত্রকারেরাও আমোদে নিয়ম-নাস্তি হিসাবে বিবাহের সময় যে বাজাইয়া গান করা জায়েজ রাখিয়াছেন। ইহা হইতে অন্ততঃ এটুকু প্রমাণ হয় যে, নানারূপ সামাজিক ও ধর্ম্মনৈতিক বিধি নিষেধের ভিতরেও অনুষ্ঠানপ্রিয় মুসলমানগণের স্বাভাবিক সঙ্গীত স্পৃহা চরিতার্থ করিবার যৎসামান্য পন্থা আছে।” (সঙ্গীত-চর্চ্চায় মুসলমান : অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, প্রাগুক্ত, ৭৮ পৃষ্ঠা)
এইরকম আধুনিক চিন্তার পর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অধ্যাপক সাহেব অন্য এক প্রবন্ধে রীতিমতো যুক্তি উল্লেখ করে বলেন: “ধর্ম্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, নিষ্ঠাবান মুসলমান সমাজে যে সাধারণত সঙ্গীত নিষিদ্ধ পরিগণিত, তার আর সন্দেহ কি? কিন্তু অনেক বাড়ীতে দেখতে পাই, হারমোনিয়ামের রেওয়াজ না থাকলে হয়ত গ্রামোফোনের চল আছে। আবার বাড়ীর হারমোনিয়াম টিপলে বা বাংলা গানের টান দিলে যাঁরা ধর্ম্মনষ্টের ভয়ে চণ্ডমূর্ত্তি ধারণ করেন তাঁরাই কাওয়ালী গান ও মিলাদ শরিফে উর্দ্দু ফারসী বা আরবী গজল গান শুনে আনন্দে ভাবাবিষ্ট হন। এস্থলে সঙ্গীত হালাল কি হারাম এ তর্ক মোটেই উঠে না। যদি সঙ্গীত লোকের প্রাণ স্পর্শ করে, যদি সঙ্গীতের দ্বারা জীবন ছন্দ মধুময় হয়, যদি সঙ্গীত আনন্দ, বিষাদ, ভক্তি, প্রেম প্রভৃতি ভাবের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হয়, তবে তাকে ধর্ম্মের দোহাই রূপ কৃত্রিমতার আবরণ দিয়ে চেপে রাখা কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। সঙ্গীত সম্বন্ধে যা বলা হ’ল চিত্র, নাট্য, কারুকার্য্য, ভাস্কর্য্য প্রভৃতি ললিত কলা সম্বন্ধেও অল্প বিস্তর ঐ কথাই খাটে।” (ধর্ম্ম ও শিক্ষা : অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, প্রাগুক্ত, ৫০১ পৃষ্ঠা)
চিত্র – ছবি
সঙ্গীতের চেয়ে চিত্রের প্রতি বেশি শত্রুতা মৌলবাদীদের— চিত্রের ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব, উদ্দেশ্যকে ন্যূনতম পাত্তা না দিয়ে সোজাসাপ্টা হারাম ফতোয়া দেওয়া তাদের মজ্জাগত স্বভাব। এ-ব্যাপারেও শিখার চিন্তা রীতিমতো অবাক করার মতো! ‘মোগল যুগে চিত্র-চর্চ্চা’ নামক প্রবন্ধে আবদুস সালাম মুসলমানদের সাথে চিত্রকলার আদি সম্পর্কের বিষয়ে লিখেছেন: “মুসলমান শাস্ত্রে চিত্র ও ভাস্কর শিল্প-চর্চ্চা নিষিদ্ধ হইয়াছে কারণ উভয়ই পৌত্তলিকতা ও ঈশ্বরত্ব দাবী করার পক্ষে সহায়—‘divinity presumption’—এ এর পরিপুষ্টি সাধন করে। শাস্ত্রের বিধানানুসারে শিল্পী ও শিল্পানুরাগী ব্যক্তিমাত্রই নরকে যাইবার পথ প্রশস্ত করিয়া লয়। ইসলাম ধর্ম্ম প্রথম প্রচারের দিনে ঘোর পৌত্তলিকতাপূর্ণ আরব দেশে এই নিষেধ বাণী ঘোষণা করা হইয়াছিল। জগতে শান্তি স্থাপনের পর মানুষের স্বাভাবিক মনোবৃত্তির ক্রমবিকাশের সঙ্গে তখনকার এই বিধির সংঘর্ষ উপস্থিত হইল। কালে কালে যুগে যুগে মানব চিত্তের অদম্য উৎসাহ ও মানবাত্মার আকুল আবেদন শাস্ত্রের বাধা অতিক্রম করিয়া চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পে পূর্ণ প্রকাশ পাইল। খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীতে বাগদাদ শহরে যখন ইসলাম ধর্ম্মের পূর্ণ প্রতিভা বিরাজমান ছিল তখনও আব্বাস বংশীয় খলিফাগণ ইসলামের রক্ষক ও পরিপোষক হইয়াও চিত্র-চর্চ্চা করিয়াছিলেন। তাহাদের আদেশে রাজ দরবারে এ্যালবাম তৈয়ার করা হইয়াছিল। … সব সময় সব জাতির মুসলমান অতি প্রাচীনকাল হইতেই ভাস্কর শিল্প হইতে দূরে রহিয়াছিল, কিন্তু চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পে মুসলমান উন্নতির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া জগতে বরণীয় হইয়া রহিয়াছে। জ্ঞানে মহিয়ান শক্তিমান মুসলমান সম্রাটগণই প্রথম শাস্ত্রের বিধি লঙ্ঘন করিলেন, শাস্ত্রের প্রকৃত অর্থ, নিগূঢ় উদ্দেশ্য বুঝিয়া লইলেন। ধর্ম্ম আর মানুষের স্বাভাবিক মনোবৃত্তি উভয়কেই একত্র যুক্ত করিলেন। কলা ও শাস্ত্র যে পরস্পর বিরোধ নহে, ধর্ম্ম ও আর্ট যে বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয় না, ইহাই তাঁহারা বুঝাইয়া দিলেন।” (মোগল যুগে চিত্র-চর্চ্চা : আবদুস সালাম, প্রাগুক্ত, ১৮৭ পৃষ্ঠা)
প্রবন্ধের শেষাংশে তিনি রীতিমতো বৈপ্লবিক কণ্ঠে বললেন: “মোগলেরা নিজেদের জীবন যেভাবে সুন্দর ও শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছিলেন, তাঁহাদের পরবর্ত্তী যুগের মুসলমানগণ সভ্য জগতে বাস করিয়া, নিজেদিগকে সভ্য বলিয়া দাবী করিয়াও তাঁহাদের মত জীবনকে সুন্দর ও শক্তিশালী করিয়া গঠন করিতে পারেন নাই। যে বিদ্যা ও শিল্পে একদিন মুসলমান জগতের দীক্ষা গুরু ছিল, আজ অজ্ঞ ও মূর্খ তথাকথিত ধর্ম্মনেতাদের স্বার্থ বিজড়িত উপদেশ অনুসারে চলিয়া সেই মুসলমান নিজেদের জীবনটাকে ব্যর্থ করিয়া তুলিয়াছে। ধর্ম্মের আদেশগুলি সময়োপযোগী ছিল। ঘোর পৌত্তলিকতার যুগে চিত্র ও ভাস্কর্য্য নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়ার সার্থকতা ছিল। ভাস্কর্য্য পৌত্তলিকতার যতটুকু সহায়, চিত্রশিল্প ততটুকু সহায় হইতে পারে না। তাই মুসলমানগণ ভাস্কর্য্য শিল্পের চর্চ্চা করিতে পারে নাই। তাহাদের মানসিক বৃত্তিগুলি চিত্রশিল্প ও স্থাপত্যে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। বর্ত্তমান মুসলমান ধর্ম্মের দোহাই দিয়া প্রাণের জিনিস চিত্রকে গ্রহণ করিতেছে না। বর্ত্তমান যুগে চিত্র শিল্প যে কেবল একটা ভোগের জিনিস তাহা নয়, জীবিকা নির্ব্বাহেরও যথেষ্ট উপায় বটে, একথা মুসলমান চক্ষে অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করিয়া দেখাইলেও তাহাদের চক্ষে দোজখের চিত্র ভাসিয়া উঠিবে।” (প্রাগুক্ত, ১৯৯ পৃষ্ঠা)
নাটক
যে-সময় বাঙলায় মুকুন্দ দাসের যাত্রা, নাটক হিন্দু সমাজে রীতিমতো বিপ্লব নিয়ে এসেছিল সে-সময় যাত্রা, নাটক দেখাও মুসলমানদের জন্য ছিল হারাম। এমতাবস্থায় শিখাগোষ্ঠীর অন্যতম লেখক আবদুস সালাম ‘নাট্যাভিনয় ও মুসলমান সমাজ’ প্রবন্ধে এমন বক্তব্য রেখেছেন যাকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। তিনি লিখেছেন: “অভিনয়ে যে কেবল ধর্ম্মের জয় ও অধর্ম্মের পতনই দেখিবে তাহা নহে, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের ফল, একতা, শিক্ষা ও ব্যবসায় উন্নতির মনোহর চিত্র, মানব জীবনের গূঢ় রহস্য, সৃষ্টির বৈচিত্র্য ইত্যাদি দেখিয়া সাধারণের ধারণার যে গতি হইবে, তাহাতে উহা সমাজের পক্ষে কোন অবস্থায় না জায়েজ ত নয়ই, বরং অত্যন্ত জায়েজ বলিলেও বোধ হয় অপরাধ হয় না। বরিশালের মুকুন্দ দাসের যাত্রা বাংলার বোধ হয় এমন কোন পল্লী নাই যেখানে না হইয়াছে। হিন্দু সমাজ ও সংসারের যে উপকার ও সামান্য যাত্রায় হইয়াছে তাহা বোধহয় হিন্দু সমাজের বড় বড় মনীষীদের পক্ষেও এত অল্প সময়ে করা সম্ভব হইত না। মুসলমান সমাজেও এই রকম বহু মুকুন্দের আজ বিশেষ দরকার পড়িয়াছে। অভিনয়ের ভিতর দিয়া সমাজকে তার দুর্ব্বলতা চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিলে যে প্রভূত উপকার হইবে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। সমাজ সেবার পক্ষে অভিনয় বাস্তবিকই জরুরী। শিক্ষার অভাবে প্রথমথঃ সমাজে ও দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক ব্যক্তির কি হীন অবস্থা হয়, অপরপক্ষে শিক্ষার সম্মান, যশঃ সুখ ইত্যাদি অংকন করিয়া যদি অভিনয়ের ভিতর দিয়া লোক চক্ষুর সম্মুখে ধরা হয়, তাহা হইলে ফল তাহার নিশ্চয়ই সমাজের পক্ষে শুভ হয়। গ্ৰামের মাতব্বরের অত্যাচার, জমিদারের গোমস্তার অন্যায় উৎপীড়ন, ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা, উকিল, মোক্তার মুহুরীর বে-আইনী আবদার অনাচারের ভয়াবহ ছবি যদি অশিক্ষিত চিন্তাহীন লোকের সম্মুখে দৃশ্যের পর দৃশ্য ঘটিত হয়, তাহা হইলেই একবারও তাহারা চোখ বুঝিয়া চিন্তা করিবার অবসর করিয়া লয় ও বোঝে। আমার মনে হয়, স্ত্রী শিক্ষার আবশ্যকতা অভিনয়ের ভিতর দিয়া বেশ হৃদয়গ্রাহী ও সুন্দর করিয়া ফুটাইয়া তোলা যায়। সমাজ নূতন করিয়া গড়িয়া তোলার পক্ষে, অভিনয়ের সাহায্য একেবারে উপেক্ষার বস্তু নহে। ইসলামের কড়া অনুশাসন সত্ত্বেও কবি ও জারির দল মুসলমান সম্প্রদায়ে এখনও বর্ত্তমান আছে। অল্প কিছু উচ্চাঙ্গের নাটক যদি এদের দিয়া গ্রামে গ্রামে অভিনীত হয়, তাহা হইলে ঐ তুচ্ছ কবি ও জারির দলও সমাজের প্রভূত উপকারে আসিবে। ধর্ম্মের অনুশাসন অভিনয়ের বিরুদ্ধে থাকিতে পারে, কিন্তু সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য অভিনয় করা দরকার।” (নাট্যাভিনয় ও মুসলমান সমাজ : আবদুস সালাম খাঁ, প্রাগুক্ত, ১০৪-১০৮ পৃষ্ঠা)
সুস্থ শিল্পকলার বিরুদ্ধে বাঙলার মুসলমান সমাজে মৌলবাদীদের দাপট আজও অক্ষয় বিধায় শিল্পকলা এবং মুসলিম সমাজের সমন্বয়ে ‘শিখা’র প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারীতা স্বীকার না করে উপায় নেই। শিখাগোষ্ঠীর মতো বৈপ্লবিক দল গড়ে উঠে মৌলবাদীদের রুখে দেওয়ার জন্য তাঁদের ধ্যান-ধারণাকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চূড়ান্ত কথাটা বলেছেন আবদুর রশিদ বি.এ.— ‘আমাদের নবজাগরণ ও শরিয়ত’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন: “চিত্রাংকন, সঙ্গীত সর্ব্বত্রই যদি আমরা নিয়ম ও নীতির কেবল বাহ্যিক অনুসরণের দিকে দৃষ্টি না দিয়া তাহার প্রকৃত মর্ম্মানুযায়ী কার্য্যকরি, তাহা হইলে ধর্ম্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান হইবেই না, বরং তাহাই প্রকৃত ধার্ম্মিকতা বলিয়া গণ্য হইবে।” (আমাদের নবজাগরণ ও শরিয়ত : আবদুর রশীদ বি.এ., প্রাগুক্ত, ১০২ পৃষ্ঠা)
তথ্যসূত্র:
১. শিখা সমগ্র : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ২০০৩
২. মুসলিম সম্পাদিত ও প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা : ইসরাইল খান, বাংলা একাডেমি, ২০০৫